দেশভাগ উত্তর শেরপুরের সাহিত্য
শেরপুর পরগণায় ১৯৩৫ এর শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথের আর্শীবাণী নিয়ে ‘কল্পনা’ নামে হাতে লেখা একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ একটি অনন্য ঘটনা। ঠিকই এই সময়ে একদিকে ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্রের ভেতর কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষার আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা জমিদার তনয়দের কংগ্রেস গঠন ও সর্বভারতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক কর্মসূচি বাস্তাবায়নের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম, অন্যদিকে সাম্যবাদে দীক্ষিত তরুণ শিক্ষিত প্রজন্ম ও তালুকদার পিতার বিদ্রোহী সন্তান শোষণ-মুক্ত সমাজ গড়ার জন্য কম্যুনিস্ট পার্টি গঠন ও নানামুখী আন্দোলন সংগ্রাম চালাবার জন্য লড়াকু শক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটে। এই বিপরীতমুখী ভাব ভাবনার ভেতর ‘কল্পনা’ প্রকাশিত হয়।
যদিও দীর্ঘস্থায়ী হয়নি তরুণদের এই হাতের লেখা পত্রিকা। সেখানে লিখেছেন—পরেশ গুপ্ত, জীবনবল্লভ চৌধুরী, ছবি রায়, সন্তোষ দাশগুপ্ত প্রমুখ। ১২/১৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হবার পর বন্ধ হয়ে যায়।
এই কল্পনা পত্রিকা প্রকাশকালিন জিতেন সেন পার্ষদ রবীন্দ্ররজয়ন্তী উৎসব করার জন্য নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছেন, চলছে রিহার্সাল ও চাঁদা সংগ্রহ, ঠিক তখনই তারা জানতে পারলেন, ‘তিন আনি বাড়ির জমিদার তনয় জীবনবল্লভ চৌধুরী ও তাঁর কতিপয় বন্ধুর উদ্যোগে আরো একটি রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে।’
সংকটে পড়ে গেলেন জিতেন সেনেরা। জিতেন সেন লিখেছেন, ‘একই শহরে একই সময়ে দু’টি অনুষ্ঠান হবে জেনে আমাদের কেমন অস্বস্তি বোধ হলো। আমরা চেষ্টা করলাম দুই পক্ষ মিলে-মিশে একটি অনুষ্ঠান করার। কিন্তু সফল হলো না।’
রবীন্দ্রজয়ন্তীকে আর্বত করে একদিকে ক্ষমতাসীন শাসকবর্গের উদ্যোগ, অন্যদিকে দলবদ্ধ তরুণদের কর্মতৎপরতা। নিশ্চয় সে সময় টাউন শেরপুরে আলোচনার বিষয় হয়ে থাকবে। এই অঞ্চলে যা কিছু প্রথম তা কোনো-না-কোনো জমিদারদের প্রযত্নেই হয়েছে। কাজে কাজেই নোবেল লোরিয়েট বিশ্বকবির খেতাবপ্রাপ্ত কবির জন্মদিন পালনকে কেনই-বা সামন্ততান্ত্রিক জমিদার হাতছাড়া করবেন? অথচ জমিদার তনয় জীবনবল্লভ ও জীতেন সেনরা যৌথভাবেই সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করছিলেন। ছিলেন ইয়ার দোস্ত।
এই উদ্যোগটি নেয়া হয়েছে—তিন আনি অংশের জমিদার বর্গের পক্ষ থেকে জীবন বল্লভ চৌধুরীর প্রযত্নে। জীবন চৌধুরী শেরপুর গরগনায় জমিদার পরম্পরায় একজন গুণি মানুষ। এমএ পাশ, পিএইচডি করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, পেয়েছেন সাহিত্যরত্ন উপাধী। পিতামহ রাধাবল্লভ চৌধুরী রায় বাহাদুর খেতাবে ভূষিত।
জীতেনদের প্রযত্নে রবীন্দ্রজয়ন্তী হবে শুনে নিশ্চয় জমিদার তনয়ের ইগো আক্রান্ত হয়েছিল। নইলে কেনই-বা ভাঙন? যদিও শ্রেণিস্বার্থ দুই তরুণের বিপরীতমুখী। কাজে কাজেই দাপটের প্রভাব কম নয়। একদিকে সামন্তশ্রেণি, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক ভাব-ভাবনায় বেড়ে ওঠা একঝাঁক তরুণ। তাও আবার বৈপ্লবিক রাজনৈতিকচর্চা করে কেউ কেউ তখন কালাপানির উপারে আন্দামানে। সাম্যবাদের ভাবাদর্শ জারি তখন তরুণদের মাঝে। কেউ সদ্য ছাড়া পাওয়া পাড় কম্যুনিষ্ট। এদের তাপ ও চাপ নিশ্চয় কম ছিল না। নানা আলাপচারিতার ভেতর ঠিক হলো, ‘উভয় অনুষ্ঠানই হবে, তবে একই দিনে নয়। আলাদা দিনে।’
দুই পক্ষই জোড়কদমে চালাচ্ছে রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব পালনকে সফল করে তোলার জন্য নানা কার্যক্রম। জীবনবল্লভ চৌধুরীর প্রযত্নে আয়োজিত জয়ন্তী উৎসবের সভাপতিত্ব করেন ইতিহাসবিদ সাহিত্য সমালোচক ও শিল্পকলা গবেষক নীহার রঞ্জন রায় (১৯০৩-১৯৮১)। আর দু’দিন পর জিতেন সেনদের রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসবে এলেন আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন (১৮৮০-১৯৬০), সভাপতি হিসেবে নয়, বরং প্রধান অতিথি হিসেবে।
নাগ পাড়ার যোগেশ চন্দ্র নাগের আমন্ত্রণেই এসেছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন। ক্ষিতিমোহনের বন্ধুজন যোগেশ চন্দ্র নাগ। তিনি ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারা (১৯৩০) বইয়ের লেখক। বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে আসার সুযোগটা জিতেন সেনেরা গ্রহণ করেন। পৌনে তিন আনি বাড়ির জয়কিশোর লাইব্রেরি চাতালেই অনুষ্ঠিত হয়—এই দলের রবীন্দ্রজয়ন্তী। সম্ভবত এই বাড়ির জমিদার সাহিত্যিক সত্যেন্দ্র মোহন চৌধুরী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।৪
আর জীবনবল্লভ চৌধুরীর অনুষ্ঠানটি হয় আড়াই আনী বাড়ীর বিশাল মণ্ডপে। এই অনুষ্ঠানে সভাপতি নীহার রঞ্জন রায়ের ‘ওজস্বিনী ভাষায় বক্তৃতা সুধী সমাজের প্রশংসা লাভ করেন।’ অন্যদিকে, ক্ষিতিমোহন সেন প্রধান অতিথি হিসেবে ‘আলাপের ভঙ্গিতে কথকতার ঢঙে সুললিত ভাষায় রবীন্দ্র জীবন ও সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত করেন।’
এই রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনের ভেতর দিয়ে যে সাংগঠনিক তৎপরতা শুরু হয়েছিল তা বিকশিত হবার আগেই ঘটে যায় দেশভাগ। সম্পন্ন হিন্দু একে একে পাড়ি দেন সীমান্তের ওপারে। দারুণ এক সংকটে নিপতিত শেরপুরের সাংস্কৃতিক পরিসর। বছর ঘুরতে না ঘুরতেই ভাষার প্রশ্নেই উত্তাল সারাদেশের মতো শেরপুরও। মিছিল মিটিং হলেও দেশভাগ ও ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে কোন সাহিত্যের কাগজ এই সময়ে প্রকাশিত হয়েছে কি না আমরা জানি না।
তবে ১৯৫২ সালে রৌহা অধিবাসী সৈয়দ আবদুস সুলতান ‘পয়গাম’ নামে একটি সাপ্তাহিক প্রকাশ করেন। বছর খানেক প্রকাশকাল ছিল। সেখানে ভাষা আন্দোলন কিংবা দেশভাগ জনিত কোন কনটেন্ট ছিল কিনা আমি জানি না। সৈয়দ সুলতান বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বৃটিনের রাষ্ট্র দূত হয়েছিলেন। “মনিরাগ” ‘পথের দেখা’ পঞ্চনদীর পলিমাটি’ তার উল্লেখযোগ্য রচনা।
টংক প্রথা বিরোধী যে আন্দোলন ময়মনসিংহের উত্তরে শুরু হয়েছিল সেই আন্দোলনের শহীদ হন নালিতাবাড়ী’র শচী রায়। তিনিই দেশভাগ উত্তর প্রথম শহীদ। ১৯৫০ সালের ১৬ মে তার শহীদবরণের কয়েকদিন পর তার স্মরনে কমিউনিস্ট পার্টি নালিতাবাড়ীর উদ্যোগে ‘রশ্মি’ নামে একটি সাহিত্য বুলেটিন প্রকাশ করেন বলে প্রমথ গুপ্ত জানিয়েছেন শচী রায়ের ছেলেকে লেখা একটি চিঠিতে।
এছাড়াও মুহাম্মদ মুহসীন আলীর সম্পাদনায় ১৯৫৭ সালে কিছুদিন প্রকাশিত হয় “বাণী বিচিত্রা”। তবে নাটক চর্চা ও মঞ্চয়ান থেমে থাকেনি। নাটকই ছিল এই তল্লাটের সাংস্কৃতিক হাতিয়ার। মোহিনী মোহন বল এই তল্লাটে আধুনিক নাট্য মঞ্চায়নের সিংহপুরুষ। “বীনাপাণি” “সুহৃদ নাট্য সমাজ নালিতাবাড়ীর আর্য নাট্য সমাজ ইত্যাদি সংগঠন নাট্য চর্চার পরিসর নির্মাণ করেন।
এই সময়ে ধীরেন হোড় বিমল কর্মকার নালিতাবাড়ীর নগেন্দ্র চন্দ্র পাল ও আব্দুর রশীদ প্রমুখ নিজেদের লেখা নাটক মঞ্চায়নে এগিয়ে আসেন।
গত শতাব্দীর ছয়েক দশক বাঙালী জনগোষ্ঠীর আত্মপরিচয়ে পরিচিত হবার দশক। স্বাধীকার অর্জনে ব্যক্তি ও সমাজের আলোড়িত হবার দশক। ষাটের তরুণ জাতীয়তাবাদী বা মার্ক্সবাদী হওয়া ছাড়া তার অন্য কোন পথ ছিল না। সময়ের আহ্বান–সময়ের বাধ্যবাধকতা তরুণকে ঘরের বাইরে নিয়ে এসেছে। শেরপুরের যুব সমাজ তার ব্যতিক্রম নয়।
এমনিতেই দেশভাগ জনিত প্রতিক্রিয়ায় দেশ জুড়ে ছিল অস্থিরতা অন্যদিকে বাঙালী জনগোষ্ঠীর নিজস্বতা অর্জনের জন্য ছিল নানা রাজনৈতিক তৎপরতা।ষাটের তরুণ ইমদাদুল হক হীরা (১৯৩৪-২০০৭) বাঙালী সংস্কৃতির ধারাকে জনগনের মাঝে ছড়িয়ে দিতে গড়ে তোলেন ‘গণসংস্কৃতি সংসদ’। মূলত আর্ট কাউন্সিল থেকে বের হয়ে সংসদ গঠন করলেন প্রগতিশীল ও জাতীয়তাবাদী তরুণেরা ইমদাদুল হক হীরার নেতৃত্বে।
গণসংস্কৃতি সংসদের কোন মুখপত্র ছিল না। সংসদের হাতিয়ার ছিল নাটক। সঙ্গীত। নৃত্য। শেরপুরে সাংস্কৃতিক চর্চার জমিন বিনির্মাণে সংসদের তৎপরতা উল্লেখযোগ্য।সংসদের সভপতি ছিলেন সৈয়দ আবদুল হান্নান ও সাধারন সম্পাদক ছিলেন এমাদদুল হক হীরা। “সর্বতো ভাবে প্রগতিশীল ও গণমুখী সংস্কৃতির প্রতিষ্ঠাই ছিল গণসংস্কৃতি সংসদের উদ্দেশ ও লক্ষ্য” লিখেছেন শেখ আবদুল জলিল।” উনসত্তুর সালের উত্তাল বাংরাদেশ। “জলিল বলেন, “উত্তাল জনগণের মন ও জীবন। সে সময়ে যা কিছু পাকিস্তানী তার বিরুদ্ধেই প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের ডাক দিয়েছিল গণসংস্কৃতি সংসদ।”
শেরপুরে নাটক চর্চার ইতিহাস বহ পুরানো। নয়ানী জমিদারদের নাট্যপ্রীতি সকলেই জানেন। কেউ এক জন হয়তো সেই ইতিহাসের তত্ত্বতালাশ করবেন। তবে এখানে বলে রাখি এই সংসদ থেকেই প্রথম শেরপুরে ছেলে মেয়েরা একসাথে নাটকে অভিনয় করা শুরু করেন। সংসদ ছিল নাটক প্রধান সংগঠন। ছেলে মেয়েদের যৌথ অভিনয়নের মাধ্যমে ‘প্রবেশ নিষেধ’ নাটকটি মঞ্চস্থ হয়। এ ছাড়াও ধনঞ্জয় বৈরাগীর ‘রূপালী চাঁদ’ আব্দুল্লাহ আল মামুনের ‘সুবচন নির্বাসনে’ ‘সংবাদ কার্টুন’ আলাউদ্দিন আল আজদের ‘সংবাদ শেষাংশ’ নাটক মঞ্চস্থ হয়।
মূলত মার্ক্সবাদী তরুণেরাই গড়ে তুলে গণসংস্কৃতি সংসদ। সেই আলোকেই সংসদ পরিচালিত হচ্ছিল। প্রতিষ্ঠার কিছুদিন পর জাতীয়তাবাদী তরুণেরা সংসদ থেকে বের হয়ে গড়ে তুলে ‘কৃষ্টি প্রবাহ’ গোষ্ঠি। বঙ্গাব্দ ১৩৭৭ (১৯৭০ সালে) কৃষ্টি প্রবাহের যাত্রা শুরু।
যদিও ছিয়াত্তর সালে কিছু তরুণ ‘কৃষ্টি প্রবাহ’ থেকে বের হয় গঠন করলেন ‘ত্রিসপ্তক’। আরো যুক্ত হলেন অভিনেতা দেবদাস চন্দ, তবলাবাদক উদয় সাহা, নর্তক কমল পাল। গোলাম রহমান রতন লিখেছেন, “নতুন প্রতিশ্রুতি নিয়ে কতিপয় তরুণের প্রচেষ্টায় ‘ত্রিসপ্তক গোষ্টি’ গঠিত হয়েছে। পপ সঙ্গীতের নতুন জগতে এদের প্রবণতা লক্ষনীয়।” তবে ওস্তাদ কানুসেন গুপ্ত কৃষ্টি প্রবাহে প্রশিক্ষক হিসেবে থেকে গেলেন। পরবর্তী কালে এই তরুণেরা শেরপুরের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডকে বেগবাণ করার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করেছে এবং এখনো করে যাচ্ছেন বিপদগ্রস্ত।
১৯৭৪ সালে কৃষ্টি প্রবাহ প্রকাশ করে ‘শহীদ স্মরনিকা’ বুলেটিন। সম্পাদক সুশীল মালাকার। সম্পাদক সুশীল লিখেছেন, “একটা জাতির ঐশ্বর্য প্রতিভাত হয় ভাষার মাধ্যমে। বাঙালী জাতির প্রধান সম্পদ হচ্ছে তার মুখের ভাষা; প্রাণের ভাষা — বাংলা ভাষা। এই ভাষাতেই সে ঐশ্বর্যবান। কিন্তু সেই ঐশ্বর্যবানের সংখ্যা কত?” সম্পাদক সুশীলের একটি মৌলিক প্রশ্ন যা আজও সমান ভাবে প্রাসঙ্গিক।
কৃষ্টি প্রবাহের মুখপত্র ‘প্রবাহ’ অনিয়মিত দিবস ভিত্তিক পত্রিকা। ১৯৭৪ সালের শহীদ সংখ্যা বুলেটিনে সুনীল বরন দে‘ তার ‘শেরপুরের সাংস্কৃতিক উত্তরাধিকার’ নিবন্ধে লিখেছেন, “পাকিস্তানী অটোক্রেসির বিরুদ্ধে যুগের যন্ত্রণার সংগে সংগে ব্যক্তি স্বাতন্ত্র্য যখন আত্ম স্বাতন্ত্র্য চেতনায় রূপ নিলো তখনই বাংলা সংস্কৃকিতে বিপ্লবের সূচনা হলো।”
উদয় শংকর রতন তাঁর কবিতায় লিখেছেন—-
‘অনেক অন্ধকারকে বুকে তুলে নিয়ে
সূর্যের আলোকে
তোমাকে অনেক খুজেছি
ব্যর্থতার সিঁড়ি বেয়ে বেয়ে
জীবনে কি পাইনি— কি পেয়েছি?”
(মুক্তির আলোকে তোমাকে)
সম্পাদক সুশীল ‘প্রবাহ’ ছাড়াও স্বাধনীতার পূর্বে ‘দখিনা’ নামে আরেকটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন। সুশীল মালাকার লিখেছেন, “১৯৬৭ সালে আমি ও মোজামেল হকের যৌথতায় ‘দখিনা’ নামে নিউ প্রেস থেকে একটি মাসিক পত্রিকা বের হয়।”
ছয় ও সাতের দশকে সাহিত্য চর্চা ও চর্ষার পরিসরে এলেন মুহম্মদ মুহসীন গোলাম রহমান তালাত মাহমুদ উদয় শঙ্কর রতন গঙ্গেশ দে আব্দুর রেজ্জাক নালিতাবাড়ীর মোস্তফা কামাল, মুস্তাক হাবীব ও রনজিৎ নিয়োগী।
গত শতকের নয়ের দশকে আমরা যারা কবিতা নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছি সারা শহর এই ষাটের তরুণ আবদুর রেজ্জাক, আবু বকর ও জাকির হোসেন নয়ের কবিদের জন্য মেলে দিয়েছিলেন চাতাল– সে চাতালে রবিন পারভেজ, সুহৃদ জাহাঙ্গীর, ক্ষমা চক্রবর্তী, হাদিউল ইসলাম, মনিরুজ্জান মনি, বৃতেন্দ্র মালাকার রজব বকশি সহ আরো অনেকে মেতেছি কবি কবিতা আড্ডা নিয়ে। সেই তিন সম্পাদকের প্রতি আমার অশেষ ঋণ। স্থানিকের নিয়মিত কাগজ সাহিত্য চর্চার পরিসর বিনির্মান করে। সেই কাজটি তারা করেছেন।
সাতের দশকেই কবি তালাত মাহমুদের কাব্যগ্রন্থ ‘ স্বর্গের দ্বারে মর্ত্যের চিঠি’ (১৯৭৫) ও ‘গীতিলতিকা’ (১৯৭৯) প্রকাশিত হয়। সাহিত্য ও সাংবাদিকতা ক্ষেত্রে তিনি অর্জন করেন ঝিল বাংলা সাহিত্য পুরস্কার (১৯৮০)।
কবি রনজিত নিয়োগী’র কাব্যগ্রন্থ ’রৌদ্রভুক রাত্রি’। মার্ক্সবাদে আস্থা এই কবি লিখেছেন বেশি প্রকাশ করেছেন কম। তাঁর কবিতার স্বর তীক্ষ্ণ এবং গভীর। মন যোগানো নয়– মন জাগরণের কবি রনজিত নিয়োগী।
“চিত্রশিল্পী ও কবি এই যুগল সত্তা নিয়ে রণজিত নিয়োগী”র আত্মপ্রকাশ ষাটের দশকে। জন্ম ৭ নভেম্বর ১৯৪২সালে। বাবা উপমহাদেশের প্রখ্যাত বিপ্লবী, ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের সিংহপুরুষ কমরেড রবি নিয়োগী, মা কমরেড জ্যোৎস্না নিয়োগী।
রণজিত নিয়োগীর সত্তরতম জন্ম দিনে প্রকাশিত রবিন পারভেজের “রা” পত্রিকার বিশেষ সংখ্যায় রবিন লিখেন, “যে বিপ্লবী রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে কবি রণজিত নিয়োগীর জন্ম এবং বেড়ে ওঠা, তা থেকেই সৃষ্ট তাঁর কবিতার মন। বাবা’র কবিতায় যে আহ্বান ছিলো, ‘তোমাদের কবিতায় গানে আর ছবিতে সাধার মানুষের সংগ্রাম আনন্দ বেদনা ওঠে আসুক’।
নিয়োগীর কবিতা সম্পর্কে রবিন পারভেজ আরো বেশি লিখেছেন, “বিশ্বায়নের কারণে আজ আমাদের সংস্কৃতি যে অস্পষ্ট, জাতিসত্তা বিচ্ছিন্ন, ইতিহাস- ঐতিহ্যহীনতায় দাঁড়াচ্ছে– নিয়োগী তাতে সামিল হতে নারাজ। নিজস্ব রাজনীতি, সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের ভিত্তিমূল বিবেচনা করেই বৈশ্বিক হয়ে উঠতে হয়— তাঁর কবিতায় আমরা এমন চেতনারই সাক্ষাত পাই।”
ক
‘আকাশ মহল থেকে ভাসমান স্প্রিংয়ের দোলনায়
লাফাচ্ছে ঝাঁপাচ্ছে তারা
বারবার উড়ছে তারা ইন্দ্রধনু ডানায় আকাশ
আর সর্বশেষ পৌঁছে যায় মহাকাশ উচ্চতায়।
ক্লাউন কিন্নর কণ্ঠ
কনসার্টের ফেনায় ফেনায় উচ্ছ্বসিত আলোর বুদ্বুদ
আউরে যাচ্ছে
মানুষের উন্নতির উজ্জ্বল পরিসংখ্যান
মাটি থেকে আকাশ আর মহাকাশ উচ্চতার
জটিল যোগফল।
(সার্কাস: রণজিত নিয়োগী)
রণজিত নিয়োগী “মৃৎ” প্রকাশ করেন ২০০৮ সালে। গোটা চারেক সংখ্যা উদীচী জেলা সংসদের ব্যানারে প্রকাশ পায়। ‘মৃৎ’ শিল্প সাহিত্যের কাগজ। কবিতারই প্রাধান্য ছিল। প্রচ্ছদ নিজেই করেছেন। শেরপুরে যারা ব্লক বা প্রচ্ছদ করেন তিনি তাদের মধ্যে অন্যতম। তাঁর নিজের পত্রিকা বা রবিন পারভেজের ‘রা’ সবগুলো সংখ্যায় তিনি প্রচ্ছদ করেছেন। তাঁর রেখার গতি ও বিন্যাস একটি আলাদা মাত্রা আনে। পাঠকের নজর কাড়ে।
এখানে আরেকটু তথ্য দেয়া যেতে পারে। ১৯৭১ সালে কোলকাতায় সংগঠিত বাংলাদেশর মুক্তি সংগ্রামী শিল্পী সংস্থার কর্মকাণ্ডে চিত্রিশিল্পী হিসেবে নিয়োগী যুক্ত হন। কবি বিষ্ণু দে সম্পাদিত ‘বাংলদেশের কবিতাগুচ্ছ’ সংকলণের প্রচ্ছদ অংকন করেন রণজিত নিয়োগী।
নিয়োগী তাঁর কাগজে কবি ও কবিতা নির্বাচনে একদিকে যেমন লেখার শিল্পের দিকে নজর দিতেন তেমনি লেখকের রাজনৈতিক মতাদর্শের কী — সেই দিকেও তাঁর সজাগ দৃষ্টি রাখতেন। রনজিত নিয়োগী তুলি ও কলম নিয়ে চিন্তার ‘কার্তুজ’ হৃদয়ে প্রথিত করে ঠিক ঠিক নিশানায় তাক করে রেখেছেন আধিপত্যবাদ বিরোধী এক সমাজ বাস্তবতার অশ্রুত স্বাপ্নিক কার্যক্রম। জাত পাত শ্রেণি বিভেদ বিরোধীতার মনোভুমি নিয়োগীর এক অনিবার্য বৈপ্লবিক উত্তরাধীকার।
যে বৈপ্লবিক পরিসরে কবি রণজিত নিয়োগীর বেড়ে ওঠা; সেই প্রাতিবেশিক বলয়ে উত্তর উপনিবেশিক সময়ে আধিপত্যবাদ বিরোধী হওয়া ছাড়া অন্যকোন পথ নেই; বরং এক অনিবার্য অনুশীলন। এই কার্যক্রমে নিয়োগী সতত হাজির ছিলেন।
১৯৭৯ সালে পাবলিক লাইব্রেরির সম্পাদক লুৎফুর রহমানের প্রচেষ্টায় একটি স্মরনীয় সাহিত্য সন্মেলেন হয়। আবু তাহের তার স্মৃতি কথায় লিখেছেন, “সেই অনুষ্ঠানে এসেছিলেন যতীন সরকার ড. সনজিদা খাতুন রফিক আজাদ নির্মেলেন্দু গুণ ইমদাদুল হক প্রমুখ কবি সাহুত্যিক।
তার কয়েক বছর পরই মুহম্মদ মুহসীন আলীর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয় “উচ্চরাণ”। উচ্চারণ আটের দশকে একটি উল্লেখযোগ্য চাতাল। এখানেই প্রবীণদের সাথে যুক্ত হয় সৌমিত্র দে, শিব শংকর কারুয়া, রিয়াজুল হাসান সম্রাট মলয় মোহন বল প্রমুখ।
আর সবচেয়ে উল্লেখ যোগ্য বিদেশি ভাষার অনুবাদ “উচ্চারণে”প্রকাশ। অনুবাদক মুহাম্মদ আবু তাহেরের নিজেরও একটি ত্রৈমাসিক ছিল। নাম “সঞ্চারণ”। এখানেই তিনি প্রকাশ করেন Albert camus এর আউটসাইডার– “ভিনদেশী” শিরোনামে। এছাড়া তিনি J M Synge এর Rider to the Sea এর একাঙ্কিকাটি “সাগরের শিকার” নামে অনুবাদ প্রকাশ করেন।
এ সময় শেরপুর ছোট কাগজ প্রকাশের উর্বর সময়। কখনো ব্যক্তিগত ভাবে কখনো গোষ্ঠীবদ্ধতায় কখনো কোন না কোন সংগঠনের ব্যানারে। এমনকি শ্রমিক সংঠনের বিজয় দিবসের পত্রিকার নাম রাখেন “প্রলেতারিয়েত”।
এই সময়ে সাহিত্য চর্চায় ওঠে আসে একঝাঁক মুখ। মিছিল মিটিং হরতাল অবরোধের মধ্যে আটের দশকেই বের হয় “মানুষ থেকে মানুষে”। কবি রবিন পারভেজ, দেবাশীষ চত্রবর্তী, বৃতেন্দ্র মালাকার, সৌমিত্র শেখর, মামুন রাশেদ সুহৃদ জাহাঙ্গীর। মানুষের ভেতর থেকে মানুষের কথাই উচ্চারিত তাদের কবিতায়—
ক
বিপ্লব!
তুমি তো হবেই সুতো ছেঁড়া ঘুড়ির মতন
(আহ কমরেড/ সৌমিত্র শেখর)
খ
শ্রমিকের ঘামে ভিজে গেছে
কলকারখানা সব
ঘামের দামের সাথে নেবে
জান্তব রাজার শব।
(জান্তব রাজার শব/মামুন রাশেদ)
গ
মানুষ এখনো মরেনি বলেই
মানুষ প্রতিবাদ মুখর
জীবন প্রয়াসী
(বৃতেন্দ্র মালাকার)
ঘ
মেরেছো যারে সেও তাহের
আমিও তাহের
কর্ণেল তাহের
(রবিণ পারভেজ)
ঙ
একটি আলোর কণা থেকে লক্ষ প্রদীপ জ্বেলে
একটি মানুষ মানুষ হলে বিশ্ব ভুবন টানে।
(সুহৃদ জাহাঙ্গীর)
এই ছিল শেরপুরে আটের দশকে অন্য প্রবণতার ভেতর একটি প্রবণতা।
নয়ের দশক গত শতকের অন্য দশক থেকে নিজস্ব সময় গুণেই আলাদা। একদিকে দুই ভাববিশ্বের পারস্পরিক প্রতাপ ও প্রভাবে পূর্ব ইউরোপের সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রকাঠামো একে একে ভেঙে পড়ছে অন্যদিকে মুক্ত বাজার আর্থনৈতিক কাঠামোর ভাপে চাপে চারদিকে ক্রমেই ভাঙছে সীমানা। গড়ে ওঠছে বিশ্ব অর্থনীতির বাতাবরণে বিশ্বায়নের বিস্তার– ঠিক সেই সময়ে নয়ের কবি ও কবিতার উত্থান।
তাদের নিরীক্ষা প্রবণতা উত্তরাধুনিক ডিসকোর্সে ক্রমেই নতুন নতুন পরিসর গড়ে ওঠছে। সত্তরের কবিতায় মিছিল মিটিং বিপ্লবের বাতাবরনে কবিতায় ও কবিতে আর্দশের ছিল মাটিতে দাগ কাটার মতো এপাশ ও পাশ। কেউ সমাজতন্ত্রের ভাবাদর্শে দিক্ষিত কেউ বুর্জোয়া গণতন্ত্রে। নব্বই এই বিভক্ত ভেঙে পড়ল। চলল শেকড়ে সুলুকসন্ধান। ঐতিত্যের বিনির্মাণ। ইতিহাসের পুণপাঠ।
এই ভাব প্রবনতার বাইরে শেরপুর ছিল না। সময়ের টোন শেরপুরের কবিরা ঠিকই ধরতে পেরেছেন। প্রকাশ ভঙি ও মোকাবেলায় সকলে সমান ও সমান্তরাল ছিল সেটি বলা ঠিক হবে না। নব্বইয়ের কাকন রেজা হাদিউল ইসলাম, রফিকুল ইসলাম আজাদ, আরিফ হাসান, রোমান জাহান প্রমুখ কবি।
কবি হাদিউল ইসলামের প্রকাশিত বই ‘ধুলোকালস্রোত’ আর “আগুনের শিরদাঁড়া”
ক
“এক্ষুনি বৃষ্টি নামবে
তুমি বাতাস আর নক্ষত্রগুলো শীঘ্র ঘরে তললো।”
খ
বৃষ্টি হচ্ছে, মেঘদূত পাঠ হচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়
বৃষ্টি হচ্ছে, মেঘদূত ভিজে যাচ্ছে পাড়ায় পাড়ায়।
কাকন রেজার সুর স্বর আরেকটু মগ্ন। আরেকটু ব্যক্তিগত বোধ ও বোধনে জারিত রস।
“লাল টবে ফুটে রয় নিষিদ্ধ গোলাাপ
লাল ঠোঁটে কেঁপে ওঠে নিষিদ্ধ প্রলাপ।”
(টুকরো কবিতা/ কাকন রেজা)
কবি আবদুস সামাদ ফারুক–যদিও আমাদের অগ্রজ। তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ ‘ঘাস ফড়িংয়ের জ্যোৎস্নাস্নান’ (২০১০) ও ‘শিশিরে জীবন কল্লোল’ (২০১২) এ নয়ের যে প্রচল ভাব প্রবণতা তা প্রচণ্ডভাবে হাজির। ইতিহাস বোধে জারিত কবি সামাদের মনোভুমি। ইতিহাস শুধু হাড্ডি কংকালসার নয় বরং একটি জীবন্ত বিষয়। ইতিহাস-ঐতিহ্য পূর্ণপঠনের ভেতর দিয়েই বর্তমানের অবকাঠামো গঠন করতে হয়।
“কী যে দূর্বিনীত আনন্দ তোমাকে দেখতে পেয়ে
প্রতিবাদের যে বহ্নিশিখা তুমি
জ্বেলেছিলে গারো পাহাড়ের নিস্তব্ধতা দেখা
শান্ত মানুষের মনে,
তাই একদিন ছড়িয়ে গিয়েছিল সবখানে।”
কবি সামাদ জানেন ইতিহাসের কোন রৈখিক পথ নেই। কখনো উন্মত্ত নদীর প্লাবণের মতো ছড়িয়ে পড়ে। বাঁক নেয়। তৈরি হয় নয়া ভুমি, সামাদের ভাষায় “সেই আগুন কখনো নেভে কখনো জ্বলে বারবাট জ্বলে ঘরে ঘরে”।
গারো আমাদের পড়শী। কোচ, ডালু, হদি, বানাই আমাদের পড়শী। এ ভূখণ্ড নির্মাণের কারিগর। তাদের সাথে বহু রৈখিকতার মেলাবন্ধন অনাদিকালের। দেখাদেখি চাষ লাগালাগি বাসের পড়শী গারো, হাজং, কোচ, বানাই, ডালু, হদি হিন্দু মুসলিমদের যৌথ যাপনের ভুমিখণ্ড এই উত্তরের জনপদ।
লাগালাগি পাশাপাশি হাত দুরত্বের পড়শী সম্পর্কে জানাশোনা কম। যতটুকু জানাজানি দাপটের জানাজানি। নিজেকে কেন্দ্রে রেখে পরিধিকে জানাজানির মতো। কখনো কালো নেটিভ, জংলি, জমিদারবাবুর এস্টেস্টের বেগার খাটা লোক। অচ্ছুত মান্দি। কখনো নিজের সাধর্মের শ্রেষ্ঠতার নিরিখে, কখনো ভাষাভাষীর জাতীয়তাবাদের পাটিগণিতের সুদকষার হিসাব সূত্রে মন্দার্থে জানাজানি; নীচুতার নিক্তির মাপমাপি। বাঙালি হবার প্ররোচনায়—এক রৈখিক রেখার পাঠ অথবা জাতিসত্ত্বার অস্তিত্ব অস্বীকার করার রাজনৈতিকতা।
কিন্তু কখনো গারো জনগোষ্ঠীর নিজস্বতার নিরিখে যাপনের রসায়ন দিয়ে বুঝতে চাইনি। পড়শীর সাথে আমারও কম দূরত্ব নয়। রবেতা ম্রং কিংবা সুদীন চিরান, অথবা প্রাঞ্জল সাংমা আমার একমাত্র জানালা—ছোট্ট জানলা। সেখান থেকে সংগৃহীত—ব্রিংনি বিবাল (২০০৯), ওয়ানগালা (১৯৯৯), আসপান (২০১৫) ইত্যাদি উপাত্ত রেখেছি পাঠকের জন্য।
সেখানেও কবিতাচর্চার পরিসর গড়ে ওঠেছে। মিঠুন রাকসাম এ অঞ্চলে বেড়ে ওঠা তরুণ কবি। তাঁর কবিতায় উঠে আসছে গারো যাপনচিত্র। দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। আপোস ও নির্মম বাস্তবতা। মিঠুনের কবিতায় গারো কথা বলছে। গারোর কথা গারোর কলমেই উঠে আসবে—যে জীবন আমার না সে জীবনের কথা কী করে আমি বয়ান করব? সেই জীবনের জন্য দরকার হয় প্রাঞ্জল সাংমা কিংবা একজন মিঠুন রাকসাম। মিঠুনের গারো কবিতা উচ্চকিত কবিতা।
‘বৃদ্ধ নানীর সাথে মন খুলে কথা বলতে পারি না।
নানী বাংলা জানে কম
আমি মান্দি জানি কম
মুখোমুখি বসে থাকি—বোবা হয়ে যাই।
শালার নিজের ভাষাটাও ভুলে গেলাম।’
(গন্ধচোর : মিঠুন রাকসাম)
গারো আর্থ- সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক চিত্রের একটি অন্যবদ বার্ষিক সংকলন “ব্রিংনি বিবাল” বড়দিন ও নববর্ষ সংখ্যা হিসেবে প্রকাশিত হয় ২০০৯ সালে মরিয়মনগর থেকে। ব্রিংনি বিবালের অর্থ বনের ফুল। সম্পাদক টিটু রাকসাম। গত শতকের আটের দশক থেকে প্রকাশ।
নিষ্কৃত হাগিদক “অবকাশ নয়, চাই গাজনী গ্রাম”. নিবন্ধে লিখেছেন “এই তিনটি লেক বহু গারো পরিবারের ভূমি গ্রাস করেছে। তোমরা এর প্রবাহধারাকে বল প্রবাহিণী, আমি বলি তারে অশ্রুধারা; তোমরা একে শুধু বল জল, আমি বলি তারে চোখের জল। কারো আবাদী জমি, কারো জুম জমি, কারো আনারস, আম বা কাঁঠাল বাগান, কারো একমাত্র সম্বল দু’বিঘা ভিটেমাটি দখল করে গড়া এই গজনী অবকাশ।
তোমরা এর মাঝে খুঁজে পাও নয়নাভিরাম দৃশ্য, নাম দিয়েছ তারে ‘অবকাশ কেন্দ্র’। আমি এর মাঝে খুঁজে পাই শোষণ, বঞ্চনা আর শুনতে পাই পাহাড়ের কান্না, যারে আমি নাম দিয়েছি ‘মানবাধিকার লঙ্ঘন কেন্দ্র’।….. চাই না আমি উড-লট বাগান, সামাজিক বনায়ন; চাই শুধু প্রাকৃতিক বন জঙ্গল; চাই না আমি গজনী অবকাশ, চাই ফিরে পেতে গাজনী গ্রাম। দাও ফিরে আমার সেই বড় গাজনী গ্রাম।”
গারো স্বর এখন প্রতিস্বরে ধ্বনিত হচ্ছে। যে গ্রাম এই জনপদে বেড়ে ওঠা মানুষের জীবন জীবিকার চাতাল সেই গ্রাম এখন বাঙালী জনগোষ্ঠির বিনোদন কেন্দ্র। পিকনিক স্পট। সেই স্পটের গভীরে লুকিয়ে আছে ভূমিজ মানুষের প্রপিতামহ কিংবা তার প্রপিতামহের কবর হাজারো মানুষের বুকফাঁটা আর্তনাদ। আকাশমনি গাছে ছেয়ে গেছে গাজনী গ্রাম। পাখ পাখালি নেই। পশুপাখি নেই। শুধুই লিজের পর লিজের রবার বাগান। সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের লিজের বাগান। মিঠুন রাকসাম তার ‘দলিলে ভাটপাড়া গ্রাম’ কবিতায় লিখেছেন-
” তখনও মান্দি নারী কাঠগড়ায়
চেঁচিয়ে বলছে ‘ বাবু ও দলিল জাল’
মিঠুন প্রতিশ্রুতি তরুণ কবি। তার কবিতায় গারো সমাজ যাপনের কথা যেমন ওঠে এসেছে তেমনি শোষন বঞ্চনা কথা। তার কবিতায় নিজস্ব শৈলী ইতোমধ্যে পাঠক সমাজের দৃষ্টি কেড়েছে।
বারমারী ফাতেমা রানী তীর্থযাত্রা উপলক্ষে রয়েছে প্রতিবছর কোন না কোন স্মরনিকা। আমি যে সংখ্যাটি হাতে পেয়েছি সেটি ষষ্ঠ বর্ষের প্রথম সংখ্যা ২০০৩। এ বছরে অনুষ্ঠানের মূল প্রতিপাদ্য ছিল “জপমালার শক্তি আমাদের মুক্তি”. এই অনুষ্ঠানের তীর্থ সংগীত রচনা ও সুর দিয়েছেন জেমস জর্ণেশ চিরান।
ক
“আমরা মিলন মোহনাতে এসেছি
মাগো তোমারি কাজে
বুকেরই মাঝে
তব নাম লিখে নিয়েছি।”
খ
“সবুজ শ্যামল পাহাড় ঘেরা
মায়ের তীর্থভূমি
তোমার চরন রাখি মোরা
শত প্রণাম চুমি”
মায়ের চরণ: (লিপা চিসিম)
‘ওয়ানগালা’ মান্দিদের কৃষ্টি ও সংস্কৃতি উৎসব। কৃষিকেন্দ্রিক উৎসব। গারো জনগোষ্ঠি তাদের শস্যের দেবতা ‘মিসি সালজং’ কে নিবেদিত প্রথম কর্তিত ফসল অর্ঘ্যদানের উৎসব। ‘আমন ধান রোপণ শেষে বর্ষার ফসল আউস ধান ও অন্যান্য ফসল ঘরে তোলার পর পরই এই ‘ওয়ানগালা’ অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিবছর আশ্বিন মাসে এই উৎসবের শুভারাম্ভ। যেমনটি বাঙালী জনগোষ্ঠীর নবান্ন কার্তিকের শেষদিনে। নতুন ধান নতুন চালের পিঠা পায়েসের পারিবারিক সামাজিক উৎসব।
কৃষি আমাদের যাপনের ভিত্তি হলেও শিল্পের দিকে ঝুঁকেপড়বার কারনে কৃষিকেন্দ্রিক উৎসব থেকে আমরা দূরে সরে গেছি। নাগরিক নবান্ন উৎসব হচ্ছে বটে– তাঁর সাথে সংখ্যাগরিষ্ট মানুষের প্রাণের সংযোগ নেই। সৌখিন নাগরিকদের কর্পোরেট কৃষি উদযাপন।
”গারোদের আদিপিতা আ,নিআ,পিলফা শস্যের দেবতা মিসি সালজং এর দর্শন লাভ করেন। সেই সময়ে পিলফার সার্বিক অবস্থা শোচনীয় ছিল। শস্যদেবতা মিসি সালজং তাঁকে শস্যের বীজদান ও আর্শীবাদ করে যান। সেই থেকে ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতার চিহ্নস্বরূপ আদি গারো পিতা শস্যফলিয়ে এবং তা খাওয়ার আগে বিভিন্ন দেবতার উদ্দেশ্যে শস্য এবং শস্যজাত চু এবং নাচ গান তাদের সন্তুষ্টি বিধানের জন্য উৎসর্গ করেন।”
এই কৃষিকেন্দ্রিক যৌথসামাজিক উৎসবকে কেন্দ্র করে প্রকাশিত প্রথম কাগজ “ওয়ানগালা” স্মরনিকা। সম্পাদক রবেতা ম্রং। রবেতা শিক্ষকতার পাশাপাশি গারো সমাজের সাংস্কৃতিক সামাজিক নানা তৎপরতায় নিজেকে যুক্ত রেখেছেন দীর্ঘদিন। এ তল্লাটের একজন পরিচিত সাহসী নারীর নাম রবেতা ম্রং।
”যুগের বির্বতনে এবং বিদেশী খ্রিষ্টান মিশনারীদের প্রভাবে আজ গারোরা খ্রষ্ট ধর্মাবলম্বী” প্রকৃত অর্থে আমি জাতিতে মঙ্গোলীয় বংশোদ্ভূত বোডো সম্প্রদায়ের গারো, মাতৃসূত্রে বাঁধা এবং অন্যদিকে ধর্মবিশ্বাসে ধর্মান্তরিত খ্রিস্টান” বললেন সুদিন চিরান। ধর্মান্তরের দাপট এবং কালের প্রবাহে ওয়ানগালা, রংচুগালা সহ মান্দিদের বাদ্য বাজনা মান্দি দামা, রাংখ্রাম আদুরী বাজনা পর্যন্ত নিষদ্ধ হয়ে যাচ্ছিল।…… কারণই ছিল সরল প্রাণ মান্দিদের খৃস্টধর্ম গ্রহণ। খ্রিস্টধর্মই যে এসব মান্দি কৃষ্টির অন্তরায় বা বাঁধা ছিল তা কিন্তু ছিল না। তখনকার মিশনারীদের এইসব কৃষ্টি পালনে ভুল বোঝাবুঝিই ছিলো আসল কারণ।’
সেই ভুল বোঝাবুঝি সহজে কাটেনি। গত শতাব্দীর প্রথম দশকে রাণীখং এ মিশনারীদের কার্যক্রম শুরু হবার পর সোমেশ্বরীতে অনেক জল বয়ে গেছে। নতুন ধর্মাচরণে ওয়ানগালাকে অভিযোজিত করতে অপেক্ষা করতে হয়েছে ভাটিকানের সিদ্ধান্তের জন্য। “দ্বিতীয় ভাটিকান মহাসভায় (১৯৬০–৬৫)খ্রিস্টীয় উপাসানালয়ে বিভিন্ন ভাষাভাষীদের নিজস্ব ভাষায়,কৃষ্টিতে চালু করার সুপারিশক্রমে অনুমোদন দেওয়া হয়। ফলে বিভিন্ন জাতির মানুষ স্ব স্ব ভাষায়, কৃষ্টিতে খ্রিস্টীয় উপাসনা শুরু করেন। এভাবেই নিজস্ব ও স্থানীয় কৃষ্টির সঙ্গে ধর্মীয় ভাবধারায় খাপ খাইয়ে সংস্কৃতায়ন করা হয়। এই সংস্কৃতায়নের সুবাদেই আজ আমরা প্রাচীনকালের ঐতিহ্য হারিয়ে যাওয়া এই ওয়ানগালা উৎসবটির জাঁকজমকের সাথে পালন করে থাকি।”
রবেতার সম্পাদিত কাগজ প্রসঙ্গেই কথাগুলো উঠে এলো। রবেতার নিজস্ব প্রচ্ছদ পরিকল্পনায় অংকন করেছেন সাইফুল ইসলাম। রবেতা প্রচ্ছদের একটি ভাষ্য দিয়েছে। “উঁচু পাহাড়ের টিলায় নকপান্থের পাশ দিয়ে কল কল রবে ছোট ঝর্ণা বয়ে গেছে। ঝর্ণা এখানে শুদ্ধতার প্রতীক; আনন্দ উচ্ছ্বাসের প্রতীক রূপে নেওয়া হয়েছে। দোমি যুক্ত ক্রশ যা অতীত ও বর্তমানের সংস্কৃতায়নেরর প্রতীক। সূর্য সমগ্র খ্রিস্টমণ্ডলীর প্রতীক। আদুর — যা দিয়ে ওয়ানগালা উৎসবে আসার জন্য জনগণকে আমন্ত্রণ জানাচ্ছে। পিছনে দামা বাদকের সাথে দুই মহিলা আনন্দে নেচে নেচে মোড়ল বাড়ির দিকে যাচ্ছে,ওয়ানগালায় শরিক হতে।”
- নকপন্থ— যুবদের থাকার ঘর
** দোমিযুক্ত ক্রুশ— মুরগীর পালক লাগানো ক্রুশ - আদুর— মহিষের শিঙ্গা
রবেতা সম্পাদিত এটি প্রথম সংখ্যা হলেও এটি মরিয়মনগরের দ্বিতীয় ওয়ানগালা উৎসব। এর আগে ১৯৮৫ সালে মিশনে পালিত হয়। এবং ভাটিকান সিদ্ধান্তের পর ১৯৮৪ সালে বিড়ুইডাকুনী মিশনে প্রথম ওয়ানগালা উৎসব পালিত হয়।
এছাড়াও ২০১৫ সালে প্রকাশিত হয় ‘আপ্সান’। অর্থাৎ একতা। প্রধান সম্পাদক রবেতা ম্রং। নির্বাহী সম্পাদক নিলীপ ম্রং। ওয়ানগালাকে কেন্দ্র করে এটি সবচেয়ে সমৃদ্ধ একটি মুখপত্র। ছয় ফর্মার স্মরনিকা। এবারই প্রথম মরিয়মনগর ধর্মপল্লীতে উদযাপিত হলো রিচ্চাসা দামানি ওয়ানগালা ২০১৫। এই সংখ্যায় লিখেছেন,
সুভাষ জেংচাম/ ওয়ানগালা উৎসব: স্রষ্ট্রার উদ্দেশে গারোদের কৃতজ্ঞতা প্রকাশ।
সুদিন চিরান/ ওয়ানগালা আবাচেংআনি খাৎথা
সঞ্জীব দ্রং/ আদিবাসী অধিকার- উপলব্ধি
রবেতা ম্রং/আমাদের শিকড় কোথায়?
মতেন্দ্র মানখিন/ গারোদের লোক নৃত্যধারা
নিলীপ ম্রং/ গারো আদি সমাজ ও ধর্ম
কবিতা রিখেছেন
গন্ধচোর/ মিঠুন রাকসাম
তবুও এসেছি/ লিপা চিসিম
আহ্বায়ক লিখেছেন, “উৎসবের ভেতর দিয়ে লুপ্ত প্রায় গারো জনগোষ্ঠির আধ্যাত্মিক বিশ্বাস ও মূল্যবোধকে আরো সমৃদ্ধ করা, ঐতিহ্যবাহী গারো কৃ্ষ্টি ও সংস্কৃতি চর্চায় উৎসাহিত করা এবং ঐতিহ্যবাহী সংস্কৃতিকে নতুন প্রজন্ম এবং শিকড়ের টানে আত্মপরিচয় খোঁজার, জানা ও লালন করার একটি উপায়।”
আচিক মান্দির সাহিত্যের কাগজ নিজস্বতার বিকাশে গেয়ে উঠুক নিজের গান সে বলুক—সকলের সাথে আমার অবারিত যোগ আছে। বৈচিত্র্যই সুন্দর। ক্ষুদ্রই সুন্দর। সংখ্যাধিক্যের খাড়াখাড়ি দাপট নয়; গড়ে উঠুক মানুষের আড়াআড়ি বুনট। পারস্পরিক নির্ভরতার দ্যোতনা।
ব্যক্তি ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে। চর্চায় নিজে সকলকে ছাড়িয়ে যায়—যেতেও পারে—তাঁর মনোভূমি এক সার্বিকতার ছবি আঁকে। রিলিজিয়নকে একান্ত ব্যক্তিকতার কোঠরে প্রাইভেসির করিডোরে ফেলে দিয়ে মানুষকে মানুষ হিসেবে খাড়া করবার লড়াই সংগ্রাম—রাষ্ট্র ও ধর্ম কে আলাদা করে—সেকুলারপন্থীকে সংগ্রাম করতে হয়। এ সংগ্রাম রাজনৈতিক সংগ্রাম। দীর্ঘদিনের সংগ্রাম। শুধু বাচনিকতা এর বাইরের খোলসমাত্র। কিন্তু পাশ্চাতের সমাজকাঠমোর বুনন দিয়ে তো আমার সমাজ গঠিত নয়। তার আছে নিজস্ব ধরনধারণ। ব্যক্তি ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চা করলে বটে, কিন্তু আমাদের পরিবার সমাজ ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা করেনি।
বারো মাসে তেরো পার্বনের রিচুয়াল নিয়েই তার দিনগুজরান করতে হয়—দীর্ঘদিনের সংস্কার অভ্যাস রিলিজিয়ন ভিত্তিক অনুষ্ঠানে তাকে যুক্ত হতে হয়—সমাজের স্বভাব আর প্রভাব দুম করে উঠে যায় না; যেতে পারে না—তার জন্য যে রাজনৈতিক সংগ্রাম সেটি আমরা করে তুলতে পারিনি। এই সংগ্রাম হয়ে ওঠা সংগ্রাম। পুরনো খোলস থেকে বের হয়ে নতুনত্বের স্বাদ গ্রহণ—সেটি খস করে কাগজে লিখলেই পরিবর্তন হবার নয়। তার জন্য যে রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা তার অভিমুখ এখন বীজাকারে বীজেস্থিত। আমরা প্রত্যাশা করতেই পারি কোনো আগামী ভবিষ্যৎ।
কবি প্রাঞ্জল সাংমা। প্রান্তিকের প্রান্তে থাকেন। বাংলাদেশের শেষ সীমায় প্রাঞ্জলের বেড়ে ওঠা। জল পাহাড় অরণ্যই প্রাঞ্জলের প্রশস্ত মাঠ। লিখছেন যতটুকু তারচেয়ে নিজের কমিউনিটি এগিয়ে নেবার জন্য নানা কায়কারবার করে যাচ্ছেন। “অরণ্য কুটির” প্রাঞ্জলের প্রকাশিত বই। প্রাঞ্জল নিজের লেখায় লেপ্টে দিয়েছেন এক মায়াবি আর দ্রোহের প্রাঞ্জলতা।
ক।
আমার একজন মা আছে
মায়ের একটা ভাষা আছে
উৎসের শেকড় আছে
আমিই থাকি শেকড়ের কাছে
খ।
সংখ্যালঘু দেহ
এভাবেই ক্ষয়ে পড়ে
জ্বলনে
অপমানে।
গ।
আমরাও মানুষ বলেই কষ্ট জানি
কষ্ট জানে পাহাড়, সবুজ অরন্য গহীন মায়াবন
ঘ।
এখানেও অন্ধকার নামে
এখানে অন্ধকা নামে নিয়ম ভেঙে
সকাল সন্ধ্যা দিনে দুপুরে
ঙ।
আহা প্রজাপতি
তার দ্বিধা,বসবে কোথায়
খোপায় না গোলাপে
‘গারো সাহিত্য ও নৃত্যকলা প্রসঙ্গে’ শিক্ষক সুনীল বরণ দে লিখেছেন, “পাহাড়ী ঝর্ণার উদ্দাম ও উচ্ছলতায় পূর্ণ গারো সাহুত্য-অবয়ব; ছন্দোবদ্ধ এর গতিধারা। মুখেমুখে প্রচলিত গলৃপ- কাহিনী ও অপ্রকাশিত গানগুলো গারোদের সবচেয়ে বড় প্রাণ সম্পদ। এসব গল্প কাহিনীতে এদের কল্পনা শক্তির প্রসারতা রচন রীতির উৎকর্ষতা এবং অনুসন্ধিৎসুমনের জিজ্ঞাসার স্পষ্ট অভিব্যক্তির প্রকাশ দেখা যায়। প্রচলিত গল্প কাহিনীতে ব্যক্তিজীবনের বিকাশের পাশাপাশি বিশ্বের সাথে আনুপূর্বিক ঐক্যস্থাপন এবং সামাজিক সহযোগিতা ও সহমর্মিতার অতলান্ত আকাঙ্খাও রয়েছে।”
এছড়াও শিক্ষক ও কবি যুগল কোচ হারিয়ে যাওয়া কোচ ভাষায় লিখে যাচ্ছেনে কবিতা।
ক
বেগান সুমলায় তো
গামছা লাখায় সিৎলাখানা
নানি মক্কন ডি
অর্থাৎ
চোখের জলে তুমি ভেসে যাচ্ছো
ঘাড়ের গামছা দিয়ে মুছে দেবো
তোমার চোখের জল।
পড়শী কবি যুগল আমার ভাষা জানেন। আমার সংস্কৃতি জানেন। আমি যুগলের ভাষা জানি না বুঝি না। জানি না যুগলের সাংস্কৃতিক বোধ ও মনন। যুগল নিজের ভাষা লিখেন আবার নিজেই অনুবাদ করে দেন আমার আাংলা ভাষা। যুগল নিজের ভাষা নিজের কমিউনিটির ছেলে মেয়েদের শিখাচ্ছেন। ভাষার বৈচিত্র্যই একটি তল্লাটের বহুরৈখিকতার উৎস মুখ।
হাজং, হদি, ডালু সাম্প্রতিক সময়ে সনাতন ধর্মে শরণ নিলেও যাপনে বিশ্বাসে হদির ভাব ভাবনা জড়িয়ে ছড়িয়ে আছে। এখনকার হদি বিয়ে পুরহিত দর্পন দ্বারা শাসিত হলেও হদি বিয়েতে বিয়েরগীত উল্লেখ যোগ্যভাবে হাজির।
ইছল মাটি পিছল খাইয়া
ভাঙল মাটির কলস
কত রঙের সাজল সখী
নাকের ডাসা লড়ে
হাইট্টা যাইতে মাঞ্জা চিকন
হালিয়া ঢুলিয়া পড়ে
কেহ লইল লোটা ঘটি
কপহ লইল জারি
শ্রীমডি রাধিকা নিলো
হীরার ললসী।
এই প্রান্তিকের প্রান্তিক জনজাতির যাপন ও তার মননভুমি নিয়ে সুনীল বরণ দে মহাশয়ের দু’টি নিবন্ধ ছাড়া এ তল্লাটে কেউ লিখিত কাজ করেন নি। আমাদেরই পড়শী তারা তাদের ভাব ভাবনা নিয়ে সৃষ্টিশীল কাজ করবার দায় আমরা এড়াতে পারি না। তাদের সৃজনী কর্ম ছাড়া শেরপুর পরগণার কাজ অসম্পূর্ণ থেকে যেতে বাধ্য।
গত শতকের নয়ের শেষ দিকে পাঁচ তরুণ বেশ আটঘাট বেঁধেই সাহিত্য চর্চার পরিসরে নিজেদের উপস্থিতি সজোরে ঘোষণা করেন। কবি সফিউল আজম একটি বিশ্ব বিদ্যালয়ে ইংরেজি পড়ান। তিনি তার ভাব বিশ্বকে প্রকাশ করবার মাধ্যম হিসেবে নিয়েছেন ইংরেজি ভাষা।
তাঁর কবিতা সম্পর্কে Linda Rogers বলেছেন, “Azam’s new poems remind us that every generation needs to recreate the songlines that map our progress from then to now. There are the lyrics that describe who we were and what we becoming.They are musical, sensual, and intelligent; and they take us forward, beyond grief for what was to hope for what might be.
সফিউলের সর্বশেষ বই persecution (2021) বইটি আইল্যাণ্ডের Salmon Poetry থেকে প্রকাশিত। এছাড়া লিখেছেন safe under water(2014) In Love with Gorgon (2010) আর Impass (2003)
শেরপুরের কবি সফিউল তাব মেধা মননের রশ্মি বিশ্বে ছড়িয়ে দিচ্ছেন সেটি নিশ্চয় আমাদের পুলকিত করে। আরো পুলকিত করে যখন ফ্রান্সের Sabastien Doubinsky লিখেন, “Sofiul Azam is truly one of the leading voices of modern Asian pietry.
কবি ও গদ্যকার সুমন সাজ্জাদ (১৯৮০) জাহাঙ্গীর নগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যপনা করছেন। নিয়মিত সম্পাদনা করছেন ‘সহজিয়া’ নামে জনপ্রিয় একটি ওয়েবম্যাগ।’ নীল কণ্ঠেরপালা’ (২০১৪) ‘পতনের শব্দগুলো’ (২০০৭) ‘ইশক’ (২০১৪) ও এইচএসবি- কালি কলম তরুণ কবি ও লেখক ২০১১ সালে পুরস্কৃত হন তাঁর ‘প্রকৃতি, প্রান্তিকতা ও জাতিসত্তার সাহিত্য’ প্রবন্ধ বইটির জন্য। কবি সুমন সাজ্জাদ গদ্যে পদ্যে তুলে এনেছেন এই সময়ের সুর ও স্বর। ‘রসে বসে বারমাসে’ নানা ইয়ার্কির ইশারা ইঙ্গিতে তুলে এনেছেন সময়ের নানা অনুষঙ্গ— কবুর ভাষায় ‘চিড়িয়াস ভঙ্গিতে জগতক’ দেখা।
কপিলেফ্ট আন্দোলন করে যাচ্ছেন কবি দুপুর মিত্র। লেখালেখি একটি সামাজিক কর্ম। ব্যক্তি একটি প্যাসেজ মাত্র। যে কারোর ভেতর দিয়েই সেই সৃজনী বের হয়ে আসতে পারে। তার জন্য সৃষ্টিকর্মের বিনিময় মূল্য হতে পারে না। কবি দুপুর মিত্র তাই সত্ত্ব ত্যাগের লড়াই নেমেছেন। সারা বিশ্বে এই আন্দোলন ক্রমেই শক্তভিত্তি পাচ্ছে। গদ্য পদ্যের দুই পরিসরেই তিনি লিখছেন। ইবুক ফর্মে প্রকাশ করেছেন, ‘বর্ণমালা কবিতা’ (২০২২) ত্রপদী ঢঙ্গে ‘মধ্যবিত্ত সংসারের কবিতা’ (২০২০) নানা মাত্রায় নানা ঢঙে কবিতা নিয়ে করছেন পরীক্ষা নিরীক্ষা।
কখন এক শব্দের কবিতা কখনো ভৌতিক কবিতা বা বৈজ্ঞানিক কবিতা। যেমন সন্ধ্যারোদ। ঘর্মরেখা। কাশশিউলি। সাধারণ আরোহী অবরোহী যুক্তি শৃঙ্খলা দিয়ে কবি দুপুরের এক শব্দের কবিতায় ঢুকতে যে কোন পাঠকের দারুণ শক লাগবে। সন্ধ্যার ধারণা দিয়ে রোদকে ধরা যাচ্ছে না আবার প্রচল রোদ দিয়ে সন্ধ্যাকে চিহিত করা যাচ্ছে না। দুপুরে এক শব্দের কবিতা ‘সন্ধ্যারো ‘ পাঠকের যুক্তি শৃঙ্খলা তছনছ করে দেয়।
নীহার লিখন (১৯৮৩) এই সময়ের উচ্চকিত শব্দের কবি। যাপনের প্রচল ঘেরাটোপ ভেঙে ভেঙে তার যাত্রা। ‘চে ও হিরামন পাখি (২০২২) গল্পের বই। চেনা জানার পরিসর থেকে ভাষার বুননে ভাষার ভেতর নীহার এক দূরবর্তী পরিসরে খুব সহজেই পাঠককে নিয়ে চলেন তার গদ্যে। ‘মনসিজ বাগানের শ্বেত’ (২০২০), ‘পিনাকী ধনুক’ (২০২০), ব্ল্যাকহোল ও পড়শীবাড়ি (২০১৮), ‘আমি আপেল নীরবতা বুঝ ‘ (২০১৮), ও ব্রহ্মপুত্র (২০১৭),
ব্রহ্মপুত্র নীহারের উল্লেখযোগ্য রচনা। মীথ আর সমকালীন যাপনের নানা অনুষঙ্গের আখ্যান।
চন্দনার ডাকে ঋষি হয়ে চলে যেতে পারি
ছুঁয়ে দিতে পারি অমন কান্নার শঙ্খটাকে;
……………………………
আমি অনার্য এক
তোমাকে এক লহমায় নগ্ন ছুঁড়ে ফেলে
চলে আসতে পারি অন্তঃপুর ছেড়ে।
সবচেয়ে ব্যথার এই যে এই পাঁচ তরুণের এক উজ্জ্বল প্রতিশ্রুতিশীল তরুণ অমিত ধর (১৯৭৮–২০১৫) কে আমরা ধরে রাখতে পারলাম না। অমিত উত্তর ময়মনসিংহের একমাত্র তরুণ যিনি Alliance FrancaiseFrancaise ফরাসী ভাষার শিক্ষক ছিলেন।
কবিতা চর্চার পাশপাশি দুই হাতে অনুবাদ করছিলেন সরাসরি ফরাসি থেকে বাংলায়। যদিও শেষদিকে কবিতার চেয়ে ফিকশনের দিকেই তিনি ঝুঁকে পড়েছিলেন। বলতেন, “সমকাসলিন বাংলাদেশ ফিকশন লেখার উন্মুখ প্রান্তর।” বিশ্ব সাহিত্যের তত্ত্বতালাশের জানসলা ছিলেন অমিত ধর আর সফিউল আজমকে। একজনের কাজ থেকে পেতাম ইংরেজি সাহিত্যের দুনিয়া অন্য জনের কাজ থেকে ফরাসি ভাষাভাষির ভাববিশ্ব।
অমিতের অকাল মৃত্যু আমার এবং আমাদের এক অপূরনীয় ক্ষতি। বাংলা ইংরেজি ফরাসি তিনটি পরিসরেই অমিতের চলাচল ছিল অবারিত। মাত্র খসাইত বছরে বয়সেই শ্বাসকষ্ট জনিত কারণে শেরপুর হাসপাতাসলে ২০১৫ জুলাই মাসের ১৯ তারিখে তিনি মারা যান। আরো কষ্টকর সংবাদ হচ্ছে সেই সময়ে আমরা হাসপাতাল তন্ন তন্ন করেও এক সিলিন্ডার অক্সিজেন সংগ্রহ করতে পারিনি।
নারী লেখকদের উপস্থিতি থাকলেও এখনো নিজস্ব স্বর ও সুর নিয়ে যে সরব উপস্থিতি সেটি যে নেই বলাই বাহুল্য। ১৯২১ সালে হিরণ্ময়ী চৌধুরী’র ‘পুষ্পাধার’ কাব্যগন্থ প্রকাশের ভেতর দিয়েই মূলত শেরপুর পরগণার নারী লেখকদের আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু। সাতের দশকে শাহজাদী আঞ্জুমান আরা মুক্তি, পারভীন হাসি, বিভা সরকার, ক্ষমা চকৰবর্তী, জাকিয়া পারভিন, রোজিনা তাসমিন, কোহিনূর রুমা, জান্নাতুল রিকসনা ও ব্রীজেট বেবী। কবি কোহিনূর রুমা নারীদের মাঝে নিজস্বতা সাক্ষর রেখে চলেছে।
“ঘরে একজন মানুষ পাথর দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে–
আর ওই দৃষ্টিতে চোখ রেখে
আমি মধুপুরের কথা ভাবছি”
(আপনি এবং একজন মানুষ: কোহিনূর রুমা)
লুল আব্দুর রহমান এই তল্লাটের ছড়ার অগ্র পথিক। “সূর্য আজ নিলাম হবে” (২০০৯), “ভুত পেত্নীর ছা” (২০০০) ইত্যাদি রচনা ছাড়াও বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত “বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি” গ্রন্থামালার একজন গুরুত্বপূর্ণ সংগ্রাহক ছিলেন। তিনিই মূলত স্বাধীনতা উত্তর এই তল্লাটের একমাত্র লোকজ সংস্কৃতির সংগ্রাহক। যদিও ছড়াকার হিসেবেই লোকমুখে পরিচিত।
নূরুল ইসলাম মনি, মোস্তাফিজুল হক ও আশরাফ আলী চারু মূলত এই তল্লাটের ছড়ার পরিসর ক্রমেই প্রসারিত করে চলছেন। নানা জাতীয় কাগজে প্রকাশিত হচ্ছে তাদের শিশু সাহিত্যের সম্ভার। আগের যে কোন সময়ের চেয়ে শেরপুরে শিশু কিশোরদের ছড়া কবিতা গল্পর চাষাবাদ বেশিই হচ্ছে। এটি আমাদের জন্য আশা জাগরণের সংবাদ বটে।
খুব কাছাকাছি সময়ে শেরপুরের সাহিত্য চর্চায় উন্মুখ আরো একঝাঁক তরুণ। হইসেল হোসেন, বিপ্লব সাহা, আজাদ সরকার, অশেষ সেনগুপ্ত, রাকিব হাসান, তন্ময় সাহা, তারেক আহসান, কবির মুকুল, সুমন দাস প্রমুখ। হুইসেল হোসেন পেশায় কাঠমিস্ত্রী। প্রাথমিকের গণ্ডি পেরুলেও আর পড়াশোনা করতে পারেন। তাতে বিশেষ ক্ষতি নেই। সময়বও সমাজকে দেখবার চোখ তিনি ঠিকঠিক রপ্ত করে ফেলেছেন। লিখছেন উপন্যাস।
অভিজিৎ চক্রবর্তী’র কবিতায় উচ্চারিত শব্দ উচ্চকিত ও ইশারায় ছুঁয়ে ফেলে পাঠকের মন।
“একমুঠো সাদা সাদা ভাত
কী করে পাল্টে ফেলে বোল
নির্ণয় করে জাতপাত”
কিংবা সুনম দাস তাঁর কবিতায় বলেন —
যা ভাবছ তা না, অহেতুক গুরু ভেবে
শিষ্য তুমি ক্ষয়ে যাও কেন?
অরণ্যে পাখিদের বাস
ফলজবৃক্ নেই– এখন কাকেরাই সন্ত্রাসী।
স্থানিক সাহিত্য চর্চা পরিসর যে খুব একটা বড় সেটি বলব না। প্রতিবন্ধকতাও জারি আছে। জারি আছে নানা সম্ভবনা। শেরপুর এখন সেই সম্ভবনার প্রসূতি। তবে এ কথা জোর দিয়েই বলতে হবে যে স্থানিকের অনাবাদী জমিন কর্ষণ না-করলে কোনো সোনাই ফলবে না। দৈর্ঘ্যপ্রস্থে আমিনের মাপা জমির কথাই শুধু বলছি না—বলছি স্থানিকের মনোভূমি কর্ষণ করার কথা। স্থানিকতার বিনির্মান ছাড়া যেমন একটি তল্লাট বিকশিত হয় না তেমনি একটি দেশের আর্থসামাজিক সাংস্কৃতিক কাঠামো।