Our Sherpur

শহীদ কমরেড শচী রায়

শহীদ কমরেড শচী রায়

জ্যোতি পোদ্দার
লেখক: জ্যোতি পোদ্দার

দেশভাগের তাপ ও চাপে বাঙলা তল্লাট তখন অস্থির। ব্রিটিশ উপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে নানা শ্রেণি ও পেশাজীবির আন্দোলন সংগ্রম জেল জুলুম ছড়িয়ে পড়েছিল সবখানে। নালিতাবাড়ীও সেই সংগ্রামে সামিল হয়েছিল। কেউ মুসলিম লীগের পক্ষে সামিল হয়ে; কেউ কংগ্রেসের পতাকা তলে আবার কেউ কমিউনিস্টের লাল ঝাণ্ডা উড়িয়ে চরমপন্থার পথ ও মত নিয়ে। এই তিন মতের প্রভাব এই তল্লাটে জারি ছিল।

Products list of Our Sherpur
শেরপুর জেলার যেসব পণ্য আওয়ার শেরপুর এ পাওয়া যায়।

যদিও এই তল্লাটের মাটি নানা কৃষক আন্দোলন ও বিদ্রোহে উত্তপ্ত ছিল আগে থেকেই। কমিউনিস্ট নেতা ও কর্মীরা মাটি ও মানুষের ভেতর থেকে বিদ্রোহী চেতনাকে উস্কে দিয়েছে বারবার। সংগঠিত করেছে। বিদ্রোহ করেছে। জেল জুলুম হত্যা নির্যাতনের শিকার এই নেতা ও কর্মীরাই বেশি ভোগ করেছেন। প্রান্তিক কৃষক ও জনজাতিদের ভেতর প্রভাব ও দাপটও ছিল অন্য যে-কোন রাজনৈতিক সংগঠনের চেয়ে বেশী।

সম্পন্ন কৃষকের ঘরে জন্ম নিয়েও শচী রায় পিতার পক্ষে ছিলেন না। ছিলেন কৃষকের পক্ষে। জমির বাতরে পড়ে থাকা লাঙলের ফালের পাশে পড়ে থাকা সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিম ও গারো, ডালু, বানাই, হদি, হাজং, বর্মণ কৃষকদের পক্ষে লড়েছেন শচী রায়।

এই কৃষক প্রান্তিক কৃষক। উৎপাদনে ঘাম ঝরে– গতর পুড়িয়ে ফলায় শস্য। ফসল ওঠে বিঘার পর বিঘার জমির মালিক বর্ণবাদী হিন্দু জমিদার তালুকদার ও পত্তনি নেয়া ভুস্বামীর গোলায়। জমির সাথে সম্পর্কহীন শ্রেণির গদিঘরে। ফি বছর বাড়ে মালিকের লাভ। আর কৃষক কেবলই গতর খাটে; গতরের কোন দাম নাই। সুখ বিলাস নাই। শচী রায় গত শতকের তিনের দশক থেকেই এই কৃষকের পক্ষাবলম্বন করেছিলন মানষের পাশে দাঁড়াবার ব্রত নিয়ে।

১৯৩১ সালে সালদা যড়যন্ত্র মামলার আসামী কারা হলে শচী রায় আত্মগোপন করেন ও এই গোপন অবস্থাতেই হাজং কৃষকদের সংগঠিত করার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। ঝিনাইগাতির সালদার জমিদার ছিলেন স্থানীয় ভূস্বামী ও জোতদার। জমির ফসল বন্টন নিয়ে মল্লিক পরিবারের সাথে গারো, হাজং, হদি কৃষকদের স্বতঃস্ফূর্ত ও আকস্মিক দ্রোহ ও মারামারির কারণে তৎকালীন সকল নেতাদের বিরুদ্ধেই জোতদার রাধা মোহন মল্লিক মামলা করেন। সেই ষড়যন্ত্র মামলার অন্যদের সাথে আসামী করা হয় প্রমথ গুপ্ত ও শচী রায়কেও।

নালিতাবাড়ীর প্রতাপশালী সতীশ চন্দ্র রায়ের জৈষ্ঠ্য সন্তান শচী রায় বাংলা ১৩২২ সাল ইংরেজী ১৯১৫ সালে জন্ম গ্রহণ করেন। শেরপুরের চক বাজারের বিবেকানন্দ সেবা সমিতির নানা কায়কারবারের ভেতর দিয়ে শচী রায়ের রাজনৈতিক ‘হাতেখড়ি’ শুরু হয়। “শচী রায় তখন ভিক্টোরিয়া স্কুলের সপ্তম শ্রেণির শিক্ষার্থী।”1 মূলত এই সেবা সমিতি ছিল যুগান্তর দলের একটি প্রকাশ্য কার্যক্রমের পরিসর। যুগান্তর দলে কর্মী রিক্রুট করার শাখা সংগঠন।

বিপ্লবী শচী রায়
ছবি: বিপ্লবী শচী রায়

“নালিতাবাড়ীর উচ্চ প্রাইমারী স্কুলের শেষ পরীক্ষায় পাশ করিয়া ভিক্টোরিয়া একাডেমিতে সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন।”1 প্রমথ গুপ্ত এক চিঠিতে শচী রায়ের সন্তান সুশীল রায়কে আরো লিখেছেন, “আমি তখন ৯ম শ্রেণির ছাত্র।”1 কমরেড প্রথম গুপ্তের জন্ম পাইকুড়ায়। তাত্ত্বিক ও বিপ্লবী নেতা। এই তল্লাটের নানা কৃষক আন্দোলনের শক্তিশালী সংগঠক। প্রমথ গুপ্তের প্রযত্নেই শচী রায় ১৯৩০-৩২ সালে ছাত্র ও যুব আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হন। জড়িয়ে পড়েন কৃষক আন্দোলনে।

এই তল্লাটে চাষের ভাগ, বেগার প্রথা, ভাওয়ালী, খামার প্রথার বিরুদ্ধে নানা নির্যাতন সত্বেও কৃষক রুখে দাঁড়িয়েছে। নিজের পরিণামের কথা ভাবেন নি। পরাজয় নিয়েও কৃষক ভাবেন নি। নিদির্ষ্ট পরিমাণ জমি ভোগদখলের বিনিময়ে রায়তকে প্রতি মাসে নির্দিষ্ট কয়েকদিন জমিদার বাড়িতে দৈহিক শ্রম দেবার প্রথাকে চাকরান বা বেগার প্রথা হিসেবে প্রচলিত ছিল। এই প্রথার বিরুদ্ধে লড়াই সহজ ছিল না। রুখে দাঁড়ালেই জমির ভোগ দখল স্বত্ব হারাতে হতো। হদি ডালু কৃষক এভাবে জোতদারদের ঘরে বাঁধা থাকত গৃহ-দাস হিসেবে।

জয়ের চেয়ে পরাজয়ের পাল্লাই বেশি। যখনই নিপীড়নের মুখে পড়েছে তখনই সে বিদ্রোহ করেছে। সব সময় যে সংগঠিত ছিল তা নয়। কখনো কখনো ব্যক্তির প্রতিবাদ মুখরতায় যুক্ত হয়েছে আরো অনেকে। এক হাটে এমন ঘটলে পরবর্তী হাটের দিনে তার ফলাফলও ভালো হয়নি। হয়েছে রক্তাক্ত মারামারি । মামলা হামলা হয়েছে। বাজার ছাড়া করেছে। বিদ্রোহী কৃষকের বাস্তভিটায় ঘু ঘু চড়িয়ে উচ্ছেদ করেছে মাটি থেকে।

“১৯২৮-২৯ সালের কথা। ব্রিটিশ ভারতের সর্বত্র চলছে ভয়ানক মন্দা প্রথম বিশ্ব যুদ্ধের অভিঘাতে। শিল্পজাত ও কৃষিজাত পণ্যের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাৎ। ৪/৫ মন ধান দিয়েও একটি ধুতি পাওয়া যেত না।”2 সেই চিঠিতে প্রমথ গুপ্ত আরো লিখেছেন, “এমন কি একটা কোদালও না। জামা কাপড় গামছা তখন কৃষকের কাছে বিলাস সামগ্রীর মতো। ঠিক এই সময়ে বৃহত্তর ময়মনসিংহ জেলার নালিতাবাড়ী থানার বাঘাইতলা হাটে কৃষকদের এক স্বতঃস্ফূর্ত বিদ্রোহ হয়। কৃষকরা নিজের উৎপাদিত ধান, চাল, পাট, সরিষা সব কিছু হাটের মধ্যে ফেলে রেখে শিল্পজাত পণ্য দখল করে নেয়।”2

শচী রায়ের ছেলে সুশীল রায়কে লেখা বিপ্লবী প্রথম গুপ্তের চিঠি
ছবি: শচী রায়ের ছেলে সুশীল রায়কে লেখা বিপ্লবী প্রমথ গুপ্তের চিঠি

এই ঘটনার পরিণামও ভালো ছিল না। নালিতাবাড়ীর কৃষক বিদ্রোহ ও তার উত্থান পতন জয় পরাজয় নিয়ে কোন কাজ হয়নি। অথচ নালিতাবাড়ী বড় বড় কৃষক আন্দোলনের আঁতুড়ঘর।

১৯৪৩ সালে ১০-১২ মে তারিখে নালিতাবাড়ীতে আড়াই আনী বাজারের নওজোয়ান মাঠে যে বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সন্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সে সন্মেলন সম্বন্ধে মহম্মদ আবদুল্লাহ রসুল লিখেছেন, “সে পর্যন্ত যতগুলো প্রাদেশিক সন্মেলন হয়েছিল তার মধ্যে নালিতাবাড়ী সন্মেলন ছিল সবচেয়ে সংগঠিত ও বিভিন্ন দিক থেকে কর্মিদের জন্য সবচেয়ে উৎসাহজনক। জায়গাটা ছিল বাইরের জগৎ থেকে বেশ দূরে। কাছাকাছি পাহাড়ি এলাকা ও আদিবাসী কৃষকদের বসতি।” এই সন্মেলনে তরুণ শচী রায় ছিলেন মধ্যম সারির নেতা। আরো ছিলেন জলধর পাল প্রমথ গুপ্ত জীতেন সেন রবি নিয়োগী মনি সিংহ আলাতাব আলীসহ সর্বভারতীয় নেতৃবৃন্দ।

“শচী রায় রাজেন্দ্র নাথ শিবাজহী মুখার্জি বৃন্দাবন কর্মকার জিতেন মৈত্রর উদ্যোগে নালিতাবাড়ীর যুবকেরা স্বল্পমূল্যে চা, জলখাবার স্টল ও কয়েকটি ছাত্র বিশ্রামাগার এবং প্রাথমিক চিকিৎসাকেন্দ্র খুলিয়া সাধারণকে সাহায্য করিয়াছেন।”2 এই সাক্ষ্য প্রমথ গুপ্তের। ১৯৪২ সালে নালিতাবাড়ীতে যে ’ফ্যাসিস্ট বিরোধী সন্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়ে সেখানেও শচী রায় তার সাংগঠনিক কার্যক্রম জারি রাখেন নিয়মত। ঢাকায় লেখক সোমেন চন্দ হত্যার পর সারা দেশে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়েছিল। নালিতাবাড়ীর তরুণেরা এই আন্দোলনে সারা দিয়েছিলেন। প্রমথ গুপ্ত লিখেছেন নালিতাবাড়ীতেই ‘সর্বপ্রথম’ এই ফ্যাসিস্ট বিরোধী সন্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।3

১৯৪৬ সাল। তেভাগা আন্দোলন শুরুর বছর। উৎপন্ন ফসলের তিন ভাগ চাষি আর এক ভাগ মালিকের–দাবীতে কৃষক আন্দোলন। এই চাষের ভাগ নিয়েই এই তল্লাটের আন্দোলন। কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বে অন্যান্য অঞ্চলের মতো নালিতাবাড়ী শ্রীবর্দী আর শেরপুরের ঢাকলহাটি, ভাতশালা ও বয়রায় এই আন্দোলন গড়ে ওঠে। এর আগের দশকে ছিল টংক আন্দোলন।” টংক মানে ধান কড়ারি খাজনা। হোক বা না হোক কড়ার মতো ধান দিতে হবে। টংক জমির উপর কৃষকের কোন স্বত্ব ছিল না।”4 ময়মনসিংহ জেলার উত্তর জনপদে প্রতিটি থানায় এই প্রথা প্রচলন ছিল।

টংক আন্দোলন কৃষকদের জমিদারের নাগপাশ থেকে মুক্তির আন্দোলন। শচী রায় টংক আন্দোলনের ভেতরই বড় হয়েছেন। সুসঙ্গে মনি সিংহের নেতৃত্বে এই আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। নিজে রাজ পরিবারের সদস্য হয়েও নিজের জমির উপর টংক প্রথা প্রথমে তুলে নিয়ে নিজের রাজ পরিবারের বিরুদ্ধে কৃষকের মাঝে থেকে কৃষকদের নিয়ে লড়াইয়ে নামেন। সফলও হন। যার ফলশ্রুতিতে ১৯৪০ সালে ভাগচাষের নয়া পদ্ধতি প্রবর্তিত হলো।

“সুসং জমিদারি এলাকায় যে টংক- ব্যবস্থা ছিল, তা ছিল খুবই কঠোর। সোয়া একক জমির জন্য বছরে ধান দিতে হতো সাত থেকে আট মণ। অথচ ওই সময়ে জোত- জমির খাজনা ছিল সোয়া একরে পাঁচ থেকে সাত টাকা মাত্র। ওই সময়ে ধানের দর ছিল প্রতি মণ সোয়া দুই টাকা। ফলে প্রতি সোয়া একরে বাড়তি খাজনা দিতে হতো এগারো টাকা থেকে প্রায় সতের টাকা। এই প্রথা শুধু মাত্র জমিদারদের ছিল, তা নয়; মধ্যবিত্ত ও মহাজনরাও টংক প্রথায় লাভবান হতেন। একমাত্র সুসং জমিদাররাই টংক প্রথায় দুই লক্ষ মণ ধান আদায় করতেন। এটা ছিল এক জঘন্যতম সামন্ততান্ত্রিক শোষণ।”4

টংক উচ্ছেদর পর কৃষকদের তেভাগা আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন শচী রায়। রবি নিয়োগী তখন আত্মগোপনে। তবুও তিনি গোপনে সংগঠিত করছেন কৃষকদের। শেরপুরে তেভাগা আন্দোলনে পুলিশের সাথে প্রত্যক্ষ সংঘর্ষে তিনজন নিহত হন। সে সময় নারীদের মধ্যে ছিলেন জ্যোৎস্না নিয়োগী, কণা বক্সী, পূর্ণিমা বক্সী প্রমুখ কমরেড। সারা বাংলা অঞ্চলে তেভাগা আন্দোলন তখন ছড়িয়ে পড়েছিল। শচী রায়দের স্থানিক আন্দোলনে জোতদার–পুলিশের সাথে লড়তে হয়েছে কখনো জমিতে ফসল কাটার সময়; কখনো এসডিও অফিস ঘেরাও করার সময়। কখনো থানার দারোগা বাবুর সাথে লড়তে হয়েছে। নালিতাবাড়ীর জলধর পাল প্রমথ গুপ্ত জিতেন মৈত্র কণা পাল জামেশ্বর হাজং রাজেন্দ্র শিবাজী শচী রায় প্রমুখ আন্দোলনকে চূড়ান্ত পর্যায় নিয়ে যায়। তবে ব্যর্থতাও কম নয়।

১৯৪৮ সাল থেকে কৃষক সভার সার্বক্ষণিক কর্মী হিসেবে আত্মনিয়োগ করেন শচী রায় এবং তার সাংগঠনিকতার কারণে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য পদ লাভ ও নালিতাবাড়ির লোকাল কমিটিটর বিশিষ্ট সভ্য নির্বাচিত হন।

বিপ্লবী শচী রায়ের স্ত্রী
ছবি: বিপ্লবী শচী রায়ের স্ত্রী

পাকিস্তান সৃষ্টির পরেও প্রান্তিক কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তন হয়নি। বাংলা অঞ্চলের জমি জিরাতিই কৃষকের প্রাণ ভোমরা। কৃষকের বেঁচেবর্তে থাকা। জমি স্বত্ব তার নাই। রয়েছে নানা আইনের ফন্দি ফিকির। মহাজনের ঋণের জাল। আর বাজার ব্যবস্থপনায় মধ্যস্বত্ত্ব ভোগিদের ও ভাগিদারীদের দৌরাত্ম্য। জমির নানা ওজনে ম্যারপ্যাচ। ফসলের ওজন, দাম ও পরিশোধ পদ্ধতি নির্ধারণ ছিল সাংবাৎসরিক রোগ। আন্দোলন ও বিদ্রোহ এই অঞ্চলে কম হয়নি। শচী রায়ের এই আন্দোলন বিদ্রোহের রাজনৈতিক পাঠ নিশ্চয়ই ছিল।

এই তল্লাটের পাগলপন্থী বিদ্রোহের (১৮২৫–১৮২৭) ইতিহাস তার অজানা ছিল না। পাগলপন্থীদের রাজনৈতিক ঘোষণা “সকল মানুষই ঈশ্বরের সৃষ্ট,কেহ কাহারও অধীন নহে,সুতরাং কেহ উচ্চ, কেহ নীচ এইরুপ প্রভেদ করা সঙ্গত নহে। ঈশ্বরের জমির উপর খাজনা ধার্য ঈশ্বরের আইনের পরিপন্থী।” শুধু কি জমি নিয়ে ফ্যাকরা? নারীর উপরও আছে নানা বিধি নিষেধ ও আইনের ফ্যাকরা। জমি ও নারী– দুই-ই উৎপাদন ক্ষেত্র। এই দুইকে ভোগী পুরুষ নিজের করায়ত্ত রাখার জন্য কালে কালে নানা আইন ও বিধি নিষেধের বেড়াজালে আটকে রাখার ফন্দি ফিকির লক্ষ করা যায়। বাংলার নারী ও জমি পুরুষতন্ত্রের নির্মম শিকার।

এই তল্লাটের কৃষক আন্দোলনের প্রেরণা ছিল পাগলপন্থীর এই নসিহত। একদিকে জমিদারের নানা খরচা আদায় যেমন ‘আবোয়াব’ ‘মাথট’ ‘অন্নপ্রাশন’ ‘পুন্যাহ’ আদায় অন্যদিকে আন্দোলন সংগ্রাম পাশাপাশিই চলছিল। কখনো থেমে থেমে। কখনো ধারাবাহিক। ১৮২০ সনে শেরপুরের জমিদারি নয় আনা সাত আনায় আবার তস্য সাত আনা আড়াই আনা দেড় আনা তিন আনা বিভক্তির জের স্থানিকে জোতদার তালুকদারেও নতুন বিভক্তি ঘটে ও তার মাশুল প্রান্তিক কৃষকের ঘাড়ে এসে পড়ে নানা ভাবে।

একদিকে জমির উৎপাদন কম অন্যদিকে নানা নামে নানা ভাবে খর্চা ও খাজনা আদায়। খাজনা আদায়ের আবার নানা পদ্ধতি। জেরবার কৃষককুল। কাজে কাজেই বিদ্রোহের আগুন আরো ছড়িয়ে পড়ে। ১৮৩৭–১৮৮২ সাল পর্যন্ত গারো অঞ্চলে বারবার বিদ্রোহের আগুন জ্বলে উঠেছে। কৃষিজাত তুলা ধান সর্ষে হলুদ মরিচ বাজারে নিয়ে এলেও বাজার মুন্সিদের প্রতাপে গারো হদি ডালু বানাই কৃষক ফসলের ন্যায্য মূল্য না পাবার কারণে বারবার সংগ্রাম লেগেই থাকত।

এই প্রান্তিক জনজাতিকে সব সময় তিন শত্রু — জমিদার, ব্যবসায় মহাজন সুদখোর ও ইংরেজ শাসক– বিরুদ্ধে লড়াই করেই টিকে থাকতে হয়েছে। পাহাড়ের পাদদেশ বলেই এই তল্লাটে বন্যার প্রকোপ কম হবার কারণে শষ্যদেবী উজাড় করে ভরে দিয়েছেন কৃষকের ক্ষেত। উৎপাদনে অধিকার তোমার ফসল ভোগে নয় এই অলিখিত নীতির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে এই তল্লাটের মানুষ। প্রান্তিক কৃষককুল।

শচী রায় সম্পন্ন ঘরের সন্তান ভোগে নয় ত্যাগে আর “লাঙল যার জমি তার” “জাল যার জলা তার” দাবী আদায়ে নেমে পড়েছিলেন। শচী রায় যে প্রজন্মে ও সময়ে বেড়ে ওঠা সে সময়ে যে কোন সহানুভূতিশীল মানুষমাত্রই মানুষের মাঝে নেমে আসে মানুষে মানুষ সমান এই দায় ও অধিকার বোধে।

তবে সেই সময় ও কাজ নিশ্চয়ই সহজ ছিল না। আজো নেই। আজো কৃষক জমিরে বাতরেই পড়ে আছেন। বাজার তার হাতে নেই। বাজার অর্থনীতিতে বাজার হলো পুঁজিপতির মন্দির। অদৃশ্য ঈশ্বরের মতো তার অবস্থান। তিনি নেই। তিনি নেই হয়ে তার বিধিবিধান নিয়ে তিনি আছেন সর্বত্র। বাজার এখন কর্পোরেটদের দখলে। উৎপাদিত ফসল বাজারের এলেই দাম নির্ধারিত হয়। বাজারের কারসাজিতে উৎপাদিত ফসলের দাম কেবলই পড়তির দিকে। উৎপদান খরচাও ওঠে না। গতরের শ্রম মূল্য নাই। কেবলই উদয় অস্ত জমির সাথে তার বসত।নিরন্ন বসত।

শচী রায়ের সময়ে যেমন ছিল এখনো তেমন। মাঝখানে শুধু সময় গড়িয়ে গেছে বহুদিন। শচী রায়ের সময়ের চেয়ে এখন কৃষক আরো নাজেহাল। বাজার তার দখলে নাই। বাজার দখল যার, ক্ষমতা তার। কৃষকের বীজ এখন বাজার মুখী। দেশি ধানে উৎপাদন কমে গেছে। রাসায়নিক সার ব্যবহারে জমির উৎপাদন শক্তি হ্রাস পেয়েছে কয়েক গুণ। নানা কিসিমের হাইব্রিড বীজ ফি বছর কিনে কৃষকের কর্ষিত জমিনে রূপন করতে হয়।

দেশি ধানের বীজ সংগ্রহ ও সংরক্ষণের যে বংশ পরম্পরায় জ্ঞান ছিল কৃষকের মজ্জাগত সেই জ্ঞান দিয়ে আর হাইব্রিড ধানের বীজ সংরক্ষিত হয় না। হাইব্রিড বীজ একবার ফল দিয়েই সে নপুংসক। কৃষককে বাজারমুখাপেক্ষী হতে হয়। শচী রায়ের প্রজন্ম এই ক্যারিক্যার দেখেননি। তার সময়ে ছিল বীজ সংরক্ষণের বিদ্যা।

কর্ষণ সার সেচ মলন এখন সবই বাজারমুখী। ঠিক মতো রাসায়নিক সার দিতে না পারলে এক্কেরার ফসল চিটা। মরা কার্তিক অভাবের কার্তিক সারা বছর।

কৃষকের এই দৈন্যদশার নাগপাশ থেকে শচী রায় ও তার প্রজন্ম লড়েছেন মাঠে ময়দানে। সফলও হয়েছেন। আন্দোলনের সুফল ক্যাশ করে ঘরে তুলেছেন ভোগী রাজনৈতিক গোষ্ঠি। কাজে কাজই পাকিস্তান হবার পরও নতুন দেশে কৃষকের অবস্থা খুব একটা যে পাল্টাচ্ছে না সেটা শচী রায়েরা ১৯৪৭ সালেই টের পেয়েছিলেন।

ধর্মভিত্তিক দেশ ভাগ মানুষের কোন কল্যাণ আনতে পারে না। তাই দেশ ভাগের পর পরই যখন বাংলা অঞ্চলে চলছে রেওয়াজ বদল করে দেশান্তরি হবার হিড়িক। একে একে নিজের দেশ ত্যাগ করে চলে যাচ্ছেন পর দেশে এক উন্মূল জীবন নিয়ে। শচী রায় সেই মিছিলে সামিল হয়নি। তিনি বেছে নিয়ে ছিলেন কঠিন ব্রত। মানুষে মানুষে সাম্য প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার।

“মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান হয়েও তিনি সব রকম রক্ষণশীলতা, গোঁড়ামি, বৈষম্য ও অসাম্যের বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন।”6 বিপ্লবী শচী রায় স্মরণে কমরেড সুশীল রায় আরো লিখেছেন, “সমাজতন্ত্রের প্রতি ছিল তার অকুণ্ঠ আস্থা। স্বপ্ন দেখতেন দেশের গরিব-দুখী মেহনতি শ্রমিক শ্রেণির মুক্তি। তৎকালিন পাকিস্তান সরকার অক্টোপাসের মতো বেড়ে ধরেছেন ব্রিটিশ শাসকের মতো বাংলার কৃষকদের। দেশ ও জাতিকে গ্রাস করে থাকা অপশক্তিকে ধ্বংস করতে মরিয়া হয়ে ওঠেছিলেন তিনি।”6

তিনি বুঝেছিলেন কৃষকের মুক্তির পথ চরমপন্থার পথ। সশস্ত্র লড়াইয়ের পথ। সেই পথই তিনি সাহসের সাথে যুঝে নিয়েছিলেন। সংগঠিত করেছিলেন তার সহযোদ্ধাদের। কিন্তু তার আগে চাই মুষ্টিবদ্ধ হাতের সাথে হাতিয়ার। আর সেই হারিয়ার বানানোর সময়েই বোমার স্প্রিন্টার বিস্ফোরণের সময় তার মৃত্যু ঘটে এই সাহসিক যোদ্ধার।

“যুদ্ধোত্তর যুগে কৃষকদের গণঅভ্যুত্থানে জীবন উৎসর্গ করেন মধ্যবিত্তের সন্তান শচী রায়। এই অঞ্চলে গেরিলাদের তিনি ছিলেন অন্যতম অস্ত্র শিক্ষক। শচী নিজের বন্দুক জঙ্গীদের হাতে তুলিয়া দিয়া লক্ষ্যভেদ করা গুলী ছো্ঁড়া শিক্ষা দিয়াছিলেন। তিনি নিজে কামার শালায় গাদা বন্দুক, কারখানায় হাতবোমা প্রস্তুত করিতেন। হাতবোমা তৈয়ার করার সময় বিস্ফোরণে তিনি শহীদের মৃত্যুবরণ করেন। তাহার সহকর্মী পূর্ণ হাজং বিকলাঙ্গ হইয়া সেই বৈপ্লবিক প্রচেষ্টার সাক্ষ্য বহন করিতেছেন।”7

প্রমথ গুপ্ত সুশীল রায়কে লিখেছেন, “১৯৫০ সালের ১৬ মে (২রা জৈষ্ঠ্যের ১৩৫৭ সাল) তারিখ বিকাল পাঁচটার দিকে শচী শত্রুহত্যার জন্য নিজেই জেলিমেন্ট বোমা বানাতে যান। কিন্তু বোমা প্রস্তুতকালীন সময়েই প্রচণ্ড বিস্ফোরণে মারাত্মক আহত হন শচী রায় সহ লক্ষ্মীকুড়ার পূর্ণ হাজং ও পরেশ হাজং।”2

সেদিন রাতেই অধিক রক্তক্ষরণের কারণে শচী রায় মৃত্যুের কোলে ঢলে পড়েন। ভীত সন্ত্রস হয়ে পড়েন অন্যান্য সহযোদ্ধারা। এমনিতেই পাকিস্তান সৃষ্টির পর প্রকাশ্যে রাজনৈতিকতা চালানো কষ্টকর হয়ে পড়েছিল কমিউনিস্টদের জন্য। তাই নানা সাংগঠনিকতা সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হয় কাকরকান্দী রামচন্দ্রকুড়া রুপনারায়নকুড়া পোঁড়াগাও নয়াবিলের মতো আরো প্রান্তিক অঞ্চলে। লোকচক্ষুর আড়ালে প্রশাসনের নাগালের বাইরে।

বোমা বিস্ফোরণ ও কমরেডের মৃত্যুর অভিঘাত আসে চারদিক থেকে। স্থানিক জনজাতি সমাজেও আতঙ্ক বিরাজ করছিল। সবে মাত্র পাকিস্তান সৃষ্টি হয়েছে। মুসলিম লীগ ও বিহারিদের নিয়ে গঠিত ই-পি-আর সবকিছু চোখে চোখে রাখছিলেন। ভারত সীমান্তরেখা খুবই নিকটে। কাজেই এই ঘটনার পর সাংগঠিক শক্তি ভেঙে পড়ে। ছড়িয়ে পড়ে কর্মী বাহিনী।

এমনিতেই দেশভাগের পর থেকেই চলছে হিন্দুদের কাতারে কাতারে লুকিয়ে জমি জমা বিক্রি করে ইন্ডিয়ার চলে যাবার তাড়ণা। অন্যদিকে নানা জায়গা ৎেকে আসা মানুষের ভেতর যাদের মাতুয়া বুদ্ধির ঘট একটু বড় তারা জলের দলে কিনে নিচ্ছে সনাতনীদের জমি জিরাত। বাড়ি ভিটা মাটি। এক চাপা অস্থিরতা বিরাজ করছিল সেই সময়।

বোমা বিস্ফোরণ ও মৃত্যুেকে কাজে লাগিয়ে কমিউনিস্টদের নামে নানা কথাবার্তা তখন বাজার দরে বেশ বিক্রি হচ্ছে। এমন সময়ে শচী রায়ের মৃত্যু কমরেডদের ভাবিয়ে তুলে। তারাগঞ্জ বাজার বাসীদের জন্য দাহ করার নির্ধারিত শ্মশানে শচী রায়কে দাহ না করে, প্রমথ গুপ্ত লিখেছেন, ” নালিতাবাড়ী — হালুয়াঘাট সীমান্তবর্তী সংযোগস্থলে উত্তরে মেলেং নদীর তীরে শচী রায়ের দাহ সম্পন্ন হয়।”2

মেলেং ভোগাইয়ের থেকে সৃষ্ট একটি প্রসারিত খাল। ভোগাই নদীর নাব্যতা কমে গেলে মেলেং খাল ভরাট হয়ে সময়ের পালাচক্রে উচিয়ে দিয়েছে জমিন বুক। নানা কারণেই পরিবারের কাছে মরদেহ স্থাস্তান্তর করা যাচ্ছিল না। শচী রায়ের মুখাগ্নি করলেন বিপ্লবী নেতা কমরেড প্রমথ গুপ্ত। তার হাত ধরেই শচী রায়ের রাজনৈতিক জীবন শুরু। নানা আন্দোলনে ছিলেন পাশাপাশি।

YouTube: Our Sherpur

১৭ মে ভোরেই মুখাগ্নী করেন কমরেড গুপ্ত। ছিলেন কমরেড জামেশ্বর হাজং সহ আরো পঞ্চাশ জন নেতা কর্মী। প্রমথ গুপ্ত লিখেছেন “কমরেড শচী রায়ের মৃতদেহে বনফুল চন্দন ও ধূপধুনা দিয়ে শেষ শ্রদ্ধা জ্ঞাপন করেন। এছাড়াও তার শিয়রে অর্ধনমিত কাস্তে হাতুড়ি লাল পতাকা উড়তে থাকে। রক্তবর্ণ বস্ত্রের আচ্ছদনে আচ্ছাদিত করে মৃতের মুখাগ্নি করেন বিপ্লবী প্রমথ গুপ্ত পরে তার সমবেত সাথীরা তাকে অনুসরণ করেন।”2

শচী রায়ের মৃত্যুর পর সংগঠন আর আগের মতো থাকেনি। পুলিশি ভয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পরে। কেউ কেউ আত্মগোপনে চলে যায়। কেউ কেউ দেশান্তরি হন। এই তল্লাটের কৃষক সংগঠক ও সাংগঠনিকতা যেহেতু জনজাতির মাঝেই ছিল বিস্তার। তাই প্রশাসনের নজরদারি ও চাপ দিন দিন বাড়তে থাকার কারণে প্রত্যক্ষ নেতারা সীমান্তের উপারে পাড়ি দেন। সাথে সাথে তার পরিবারবর্গ আত্মীয় স্বজন –এমন কি পড়শিও।

শেরপুরের কমরেড জীতেন সেন কমরেড প্রমথ গুপ্ত কমরেড বল্লভী বকসী কমরেড ভুপেন নাগ কমরেড হীরু ভট্টাচার্য নকলার কমরেড দ্বীজেন সরকার চন্দ্রকোণা কমরেড নগেন মোদক নালিতাবাড়ী নীচপাড়ার কমরেড এই তল্লাটের শক্তিশালী সংগঠক জলধর পাল ও তার স্ত্রী কণা পাল কমরেড জিতেন মৈত্রী সহ প্রমুখ নেতারা নানা সময়ে দেশত্যাগ করেন।

নেতৃত্ব শূন্য কৃষক আন্দোলন ঝিমিয়ে পড়ে। অন্যদিকে দফায় দফায় চলে সপরিবারে দেশত্যাগ। নানা উছিলায় থানার দরাগাবাবু নেতাকে দোষী সাবস্ত হবার কারণে তার অনুপস্থিততে তাপ চাপ ও রোষ পড়ে নেতার পরিববার বর্গ ও তার সমাজের উপর।জনজাতিসহ হিন্দুরা মানসিক আশ্রয়হীন হয়ে পড়ে। যেহেতু এই তল্লাট কৃষক আন্দোলনের আঁতুড়ঘর মিছিল মিটিঙ আর বিদ্রোহের গোলাঘর কাজে কাজেই ক্ষমতাসীনেরা শচী রায়ের মৃত্যুর পর এক ধরণের ত্রাস লিখিত ও অলিখিত ভাবে জারি রাখেন। দেশভাগ উত্তর বিশ বছরের মধ্যেই হাজং বানাই ডালু গারো ও সনাতনী হিন্দুদের বাস্তুভিটা ও জমিজিরাতের হাত বদল হতে থাকে। মরে যায় আন্দোলনের সকল শাখা প্রশাখা। কেউ গোপনে কেউ একজন দুজন করে দেশান্তরি হতে হতে পাল্টে যায় সমগ্রচিত্র।

সুশীল রায়কে ১৯৮১ সালে ২ মে তারিখে লিখিত চিঠিতে প্রমথ গুপ্ত লিখেছেন, “১৯৪৮-৫০ সনে আমরা যে আন্দোলন করি তা বামপন্থায় সংকীর্ণ বিচ্যুতি হটকারী বলা হয়।”2 তখনকার পার্টির দলিল ও লাইন অনুসারে শচী রায়দের আন্দোলন পূর্ব পাকিস্তানের কমিউনিস্ট পার্টির লাইনের বাইরে গিয়ে স্থানিকতার প্রেক্ষিতেই এই চরমপন্থার লাইন গ্রহণ করা হয় বলে মনে হচ্ছে। স্থানীয় রাজনীতির উদ্ভূত পরিস্থিতিই হয়তো শচী রায়দের নিয়ে গেছে এই পথে আন্দোলনকে সশস্ত্র রূপ দেবার জন্য। স্থানীয় রাজনৈতিকতা নিয়ে যারা অনুসন্ধান করবেন তারা হয়তো এমন চরমপন্থার কার্যকারণ খুঁজে বের করবেন।

তবে স্থানীয়ভাবে তার অভিঘাত পড়েছিল মারাত্মক। সবচেয়ে বড় দলটি দেশত্যাগ করে ১৯৬৪ সালের ২ ফেব্রুআরি সকালে। মুক্তিযোদ্ধা আবদুর রহমান তালুকদার লিখেছেন, “সময় ১০/১১ টা হবে হয়তো। নিজ গ্রাম বরুয়াজানি, পাশ্ববর্তী কাঁকর কান্দি, সোহাগপুর তথা ঐ অঞ্চলের সব উপজাতি নিদিষ্ট সময়ে এসে হাজির হলো বরুয়াজানি গ্রামের গারো পাড়ার মাঠে। দূর থেকে দেখে মনে হলো যেন খন্ড খণ্ড মিছিল আসছে। শত শত নারী পুরুষ শিশু কিশোর যুবক বৃদ্ধ তথা আবালবৃদ্ধবনিতা জড়ো হতে থাকল। হাত মাথায় কাঁধে ব্যাগ ও পুটলি। যেন মনে হলো এটি এক মিলন মেলা। না, ওটা ছিল হতভাগ্য দেশের হতভাগ্য মানুষের সাম্প্রদায়িক প্রতিহিংসার আগুন। দীর্ঘ সময়ের চাপা আগুন সেদিন দাও দাও করে জ্বলে উঠেছিল।”8 দল বেঁধে দেশত্যাগ এটিই ছিল সর্বশেষ ঘটনা।

মৃত্যুর দুইদিন পর ৪ জৈষ্ঠ্য ১৩৫৭ সালের ‘কমরেড শচী রায় অমর রহে’ শিরোনামে প্রকাশিত হয় “রশ্মি বুলেপটিন” প্রমথ গুপ্তের সম্পাদনায়।1 ‘রশ্মি’ স্থানীয় কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক মুখপাত্র। দেশভাগের পর প্রথম ও শেষ পত্রিকা। রশ্মি’র আলো আর বিকিরিত হয়নি। বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে নেতা ও বিশাল কর্মিবাহিনী। তৎকালীন মুসলিম লীগ ও কেন্দ্রীয় পাকিস্তান সরকারের নিপিড়নের কারণে অনেক নেতাই আত্ম গোপনে চলে গেছেন। পাশাপাশি বুর্জোয়া দল একটা নিপুন কৌশলে কমিউনিস্ট নেতা ও তাদের কায়কারবার নিয়ে ছড়িয়ে দেয়া নানা কুতর্ক।

ক্ষমতাসিনেরা প্রকৃত পক্ষেই কমিউনিস্টদের সাংগঠনিকতাকে ভয় ও সমীহ করত। যেভাবে কমিউনিস্ট পার্টি মানুষের মাঝে থেকে মানুষের সাম্যের কথা বলে জনগণকে সোচ্চার করছিল তা অন্য সংগঠন করতে পারেনি। গত শতকের চারের দশক থেকেই কংগ্রেস ও মুসলীম লীগ আ ‘ কমিউনিষ্টরা নাস্তিক ধর্মে বিশ্বাস করে না–এমন কুতর্কের গুজব ছড়িয়ে দেয়। সাংগঠনিকভাবে ভাবে মোকাবেলা না করতে পারলেও এটা করে তারা সফলও হয়েছে কার্যত। এতে করে জলধর পাল রবি নিয়োগীদের তৈরি করা মাঠের ফসল ঘরে তুলেছে বুর্জোয়া দলের লোকেরা। তারাই ক্ষমতায় থেকে যথা পূর্ং তথা পরং থেকে গেছে। মানুষের আর মুক্তি মেলেনি।

পাকিস্তানের সময়কালে কৃষক নেতা শহীদ শচী রায়কে নিয়ে প্রকাশ্য কোন স্মরন সভা হয়েছে কিনা আমি জানি না। তবে দেশ স্বাধীনের পর আটের দশকের শুরুতে একটি স্মরণ সভা হয়েছিল। সেটা জেনে প্রমথ গুপ্ত লিখেছেন, “শহীদ শচী রায় ভুপেন ভট্টাচার্য সর্বেশ্বর ডালু যোগেন্দ্র হাজংসহ প্রমুখ শহীদ কৃষকদের নামে কোনো শহী স্তম্ভ বা স্মৃতি স্মারক নির্মিত হয়নি আজো বলে ক্ষোভ ও উষ্মা প্রকাশ করেছেন।”2

এ ছাড়াও ১৬ মে ১৯৮৪ সালে নালিতাবাড়ী কমিউনিস্ট পার্টির পক্ষে কমরেড ফরিদ উদ্দিন আহমেদ ‘র আহ্বানে একটি লিফলেট প্রকাশিত হয় এবং স্থানীয় শহীদ মিনারে একটি আলোলোচনা সভা আয়োজন করে। এছাড়া আর কোন তৎপরতা চোখে পড়েনি। তবে এক কথা ঠিক ফি বছর শচী রায়ের মৃত্যু দিনে তার ছেলে সুশীল রায় সাপ্তাহিক একতা কিংবা দৈনিক সংবাদে ব্যাক পেইজে “লাল সালাম বিপ্লবী শচী রায়” শিরোনামে থাকত একটি স্মৃতি তর্পন। এ ছাড়া নালিতাবাড়ী’র সুধি সমাজের অন্য কোন ভুমিকা চোখে পড়েনি।

এই প্রজন্মে তরুণ তরুণী শচী রায়ের কথা জানে না। জানে না তার ও তাদের আত্মত্যাগ ও ত্যাগের মহিমার কথা। আজকের যে বাংলাদেশ সেই প্রাতস্মরনীয় মানুষদের অবদান। ইতিহাস নির্মাণের যে বা য়ারা কারিগর তাঁদের প্রত্যকের রয়েছে কোন না কোন ভুমিকা। একেক জন একেকভাবে দেশ ও মাটি বিনির্মানে ভুমিকা রাখে এবং রাখতে হয় –রেখে গেছেন আমাদের প্রাগ্রসর অগ্রজেরা। সেই ইতিহাসের কারিগরদের স্মরণ বরণ করা ভাবি কালের সন্তানদেরই কর্তব্য। দিতে হবে প্রাপ্য মর্যদাও । শচী রায় সেই ইতিহাস নির্মাণের সক্রিয় জীবন উৎর্গিত একটি মানুষের নাম। একটি সময়ের নাম। একটি আলোকিত প্রাণের নাম।

টুকিটাকি

  1. কমরেড সুশীল রায়কে লেখা কমরেড প্রমথ গুপ্তের চিঠি
  2. ফ্যাসি বিরোধী আন্দোলন — প্রমথ গুপ্ত
  3. জীবন সংগ্রাম– মণি সিংহ
  4. সেরপুর বিররণ– হবচন্দ্র চৌধুরী
  5. লাল সালাম বিপ্লবী শচী রায়–সুশীল রায় / সাপ্তাহিক একতা/১৯৮২
  6. সশস্ত্র প্রতিরোধ–প্রমথ গুপ্ত
  7. মুক্তিযুদ্ধে নালিতাবাড়ী — আবদুর রহমান তালুকদার

Leave a Reply

Scroll to Top