শেরপুরের সাহিত্য চর্চা
”এই উত্তর জনপদের টাউন শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চার ইতিহাস খুব বেশি দিনের নয়। দেশভাগের আগে এখানকার সামন্ত জমিদারদের নিজস্ব পত্রিকা ছিল-ছিল প্রেসও। যত না বাণিজ্যের কারণে মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন তার চেয়ে অধিকতর দৃষ্টি ছিল শিল্প-সাহিত্যচর্চার পরিসর নির্মাণ করা।
যে সময়ে শেরপুরে মুদ্রণযন্ত্র স্থাপিত হয় তখন টাউন শেরপুর নিতান্তই প্রান্তিকের প্রান্তিক-এক পাণ্ডববর্জিত অঞ্চল। তবু এখানে ‘বিদ্যোন্নতি সাহিত্য চক্র’ গঠিত হয়ে গেছে; বেরোচ্ছে মাসিক ‘বিদ্যোন্নতি সাধিনী’ (১৮৬৫) সামন্ত জমিদার হরচন্দ্র চৌধুরীর প্রযত্নে বিখ্যাত পণ্ডিত চন্দ্রমোহন তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় অন্যদিকে জগন্নাথ অগ্নিহোত্রির সম্পাদনায় ‘বিজ্ঞাপনী’ (১৮৬৬)। প্রান্তিকের প্রান্তিক টাউন শেরপুর থেকে দুই দুটি পত্রিকা বের হচ্ছে চাট্টিখানি কথা নয়। পত্রিকা থাকবে আর গ্রাহক পাঠক থাকবে না-তেমন তো হতে পারে না। কাজে কাজে মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন করে পাঠকের সঙ্গে সম্পর্কায়ন দ্রুততর করা।
প্রথমদিকে ঢাকা থেকে ছাপিয়ে আনতে হতো। এতে সময় ও অর্থ-দুটিই বাঁচে। শিল্প-সাহিত্য দর্শনচর্চার পরিসর বাড়িয়ে দেওয়ার যে আকুলতা সামন্ত হরচন্দ্র চৌধুরীর ভেতর ছিল তাকেই অধ্যাপক মোস্তফা কামাল বলেছেন, ‘এখানেই শিল্পী হরচন্দ্র চৌধুরী সামন্ত হরচন্দ্রকে পরাজিত করে স্বাধীন শৈল্পিক সত্তায় জাগ্রত ও স্পষ্টবাক।’
হিরন্ময়ী দেবীই এই উত্তর জনপদের প্রথম মহিলা কবি। ১৯২১ সালে তার ‘পুস্পাধার’ কাব্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়।
দেশ ভাগ উত্তর তরুণ সুশীল মালাকার হাতে লেখা পাক্ষিক পত্রিকা ‘কিশোর’ (১৯৫৭) দিয়েই টাউন শেরপুরে ছোটকাগজের যাত্রা শুরু। সহ-সম্পাদক অধির দাসকে নিয়ে ‘বছর খানিক ধরে’ প্রকাশিত হয়েছিল। ষাটের দশকের শেষদিকে সুশীল মালাকার ও মোজ্জামেল হকের যৌথতায় সাহিত্য পত্রিকা মাসিক ‘দখিনা (১৯৬৭) বের হয়’ নিউ প্রেস থেকে। এটিই টাউন শেরপুরে ছাপা পত্রিকার যাত্রা বিন্দু-এইটুকুই তথ্য হিসাবে হাজির।
ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন তাদের আদর্শিক লড়াই শুধু মিছিল বা মিটিংয়ের ভেতর সীমাবদ্ধ না রেখে বিভিন্ন দিবসভিত্তিক স্মরণিকা প্রকাশের ভেতর দিয়েও চর্চা করে গেছে। এখনকার ছাত্র রাজনীতির রূপ যাই হোক না কেন স্বাধীনতার আগে পরে ছাত্র সংগঠনগুলো স্মরণিকাকে হাতিয়ার করেছে। শিল্প-সাহিত্য দর্শনচর্চার ভেতর দিয়ে রাজনৈতিকতার চর্চা করেছে। শেরপুরে শ্রমিক সংগঠনও সাহিত্য পত্রিকা করেছে। সাতের দশকের শেষের দিকে মূলত জাসদের প্রভাব বলয়ে এই শ্রমিক সংগঠনগুলো গড়ে উঠেছে।
সমর্পণ (১৯৭৯) প্রলেতারিয়েত (১৯৮০) শ্রমিকদের মে দিবসের পত্রিকা। এ ছাড়া জাসদ ছাত্রলীগ তাহেরের ফাঁসির পর আরও দুটি স্মরণিকা প্রকাশ করে-বিস্ফোরণ (১৯৮০) লাল সালাম (১৯৮০)। গোষ্ঠীভিত্তিক সাংস্কৃতিক কর্মতৎপরতা শুরু করেন কৃষ্টি প্রবাহ। সাহিত্যচর্চা তাদের লক্ষ্য ছিল না। ছিল গান নাটক নৃত্য ইত্যাদি চর্চাভিত্তিক কার্যক্রম। বিভিন্ন সময়ে তারা বুলেটিন বা বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করলে কবিতা বা গল্প নিবন্ধ নিয়েই প্রকাশ পেত। স্থানিকের বৈশিষ্ট্যই এমন। প্রবাহ (১৯৭৪) তাদের নিজস্ব কাগজ।
শহীদ মোস্তফা থিয়েটার নানা তৎপরতার ভেতরও নাট্যবিষয়ক কাগজ ‘নাট্যপত্র’ (২০১০) প্রকাশ করে। অন্যদিকে উদীচী আদর্শভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠন। আটের দশকেই শেরপুরে তাদের কার্যক্রম বিস্তার লাভ করে। উদীচী নির্দিষ্ট লক্ষ্য উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আজো শেরপুরসহ সারা দেশে সমাজ রূপান্তরের জন্য সাংস্কৃতিক লড়াই সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তাদের মুখপত্র বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে বের হয়েছে। যে কটি হাতে পেয়েছি-ব্রজে বাজে বাঁশী (১৯৮৬) অঙ্গিকার (১৯৮৫) মৃৎ (২০০৮) ইস্ক্রা (১৯৮৫) প্রস্তুতি (১৯৮৬) ছিঁড়ে আনো ফুটন্ত সকাল (১৯৮৮) রক্তপদ্ম (১৯৮৩) ইত্যাদি।
পাতাবাহার দুলাল দে বিপ্লবের প্রতিষ্ঠিত শিশু-কিশোর সংগঠন। ১৯৭২ সালে যুদ্ধ থেকে ফিরেই দুলাল এ খেলাঘরটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী যে প্রতিরোধ যুদ্ধে ডাক দেন-এই শেরপুর অঞ্চলে অনেকের মতো তিনিও সেই যুদ্ধে অংশ নেন এবং জামালপুরে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখযুদ্ধে শহিদ হন। স্থানিকে কর্মতৎপরমুখী এ খেলাঘরের সাময়িকীগুলো হলো- প্রতিধ্বনি (১৯৮৯) অঙ্গিকার, চেতনা (১৯৭৭)।
এ ছাড়া বৈতালিক কচিকাঁচার বার্ষিক মুখপত্র-কচিকাঁচা (১৯৮৫) আর শিশুদের জন্য শিশুদের পত্রিকা ‘দুরন্ত’ (১৯৮৮) একমাত্র টাউন শেরপুরে শিশুতোষ পত্রিকা যেখানে সম্পাদকদ্বয় যথেষ্ট মাঠ প্রস্তুতি করেই শুরু করেছিলেন কিন্তু গোটা তিনেকের পর হাল ছাড়তে হলো। শেরপুর সাহিত্য পরিষদ গঠনে কবি আবদুর রেজ্জাক অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছেন। অগ্রজ এই কবি দীর্ঘদিন সাংগঠনিক তৎপরতার ভেতর দিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করে গেছেন। বিভিন্ন নামে কাগজ করলেও ‘কালিক’ ছিল তার সম্পাদিত সবচেয়ে ভালো একটি সাময়িকী।
এ ছাড়া-উচ্চারণ (১৯৮২) কালিক (১৯৯৩) অন্বেষা (১৯৮১) স্বরণিকা (১৪১০) স্পন্দন (১৪০২)। এ ছাড়া কলতান গোষ্ঠীসহ আরও কতিপয় সংগঠনের নিয়মিত অনিয়মিত ছোটকাগজগুলো হলো-আমরা তোমারই সন্তান (১৯৯১) সমর্পণ (১৯৭৯) বিজয় কেতন (১৯৮৩) ক্ষোভ (১৯৮১) অংকুর (১৯৯০) কংস (১৯৯০) অনুশীলনী (১৯৯২) ধী (১৯৯২) বালার্ক (১৯৯৯) রক্ত ঝরা একাত্তর (১৯৯৫) বিহান (২০১৮)।
গত শতকের আটের দশক টাউন শেরপুরে যেমন একের পর এক সাহিত্য গোষ্ঠীর জন্ম নিয়েছে তেমনি মৃত্যু ও অপুষ্টির হারও ঊর্ধ্বমুখী। চিন্তার জাড্যতা ও অধিকতর সাংগঠনিক কার্যক্রম এবং শুধু কমিটিসর্বস্ব সাহিত্যগোষ্ঠী হওয়ার কারণে টিকে থাকতে পারেনি। তবে একমাত্র বিহঙ্গ সাহিত্যগোষ্ঠীর প্রযত্নে প্রকাশিত ‘মানুষ থেকে মানুষে’ (১৯৮০) কাগজটি ধারাবাহিক প্রকাশের ভেতর দিয়ে তারা তাদের নানামুখী কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন।
টাউন শেরপুরে লাইব্রেরির চলার পথ ১৯২৬ থেকে। রিডিং ক্লাব নামে প্রতিষ্ঠিত সে সময়ে ‘টাকা ডিপোজিট’ রেখে গ্রাহক বাড়িতে বই নিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যে যাত্রা শুরু সেটিই আজকের খান বাহাদুর ফজলুল রহমান জেলা সরকারি গ্রন্থাগার।
আটের দশকে কয়েকজন উদ্যোগী সংস্কৃতজন গ্রন্থাগারের পক্ষে উচ্চারণ (১৯৮৬) নামে একটি চমৎকার সাময়িকী প্রকাশ করে। নির্দিষ্ট প্রান্তিকে বের হওয়ার প্রতিশ্রুত হলেও ‘উচ্চারণ’ আর উচ্চারিত হলো না। সাহিত্য পত্রিকার লড়াই কেউ কেউ ভাবেন নিতান্তই ব্যক্তি উদ্যোগকেন্দ্রিক। এতে সামষ্টিকের ঝামেলা নেই। স্বাধীনতার স্পেস বাড়ে। ব্যক্তিদিশাই পত্রিকার চরিত্র ঠিক করে। সম্পাদকের ভাব ভাবনার রূপায়ণের জন্য এখানে রয়েছে প্রশস্ত পথ। আবার এখানে দায়ও ষোলোআনা। ঝুঁকি বণ্টনের সুযোগ নেই।
টাউন শেরপুরে ব্যক্তির প্রযত্নে ছোটকাগজ-প্রয়াস (১৯৮৭) রবি রশ্মি (১৯৮৩) কবিতাপত্র (১৯৮৩) বিজ্ঞাপনপত্র (১৯৮৪) বৈশাখী (১৯৮৩) বিষণ্ন সৈকতে ভোরের নোঙর (১৯৮৪) এই প্রান্তের সময় স্রোত ও অন্যান্য (১৯৯৯) রক্তের আল্পনা (১৯৮১) আড্ডা (১৯৯২) ময়ূখ (১৯৯৬) সঞ্চরণ (১৯৯১) বর্ষাতি (১৯৯৭) সাহিত্যলোক (১৯৯৩) কনকাঞ্জলি (১৯৭৯) মন্বন্তর (১৯৮০) দৃষ্টি কথা বলবে (১৯৭৯) চতুরঙ্গ (১৯৭৬) ক (১৯৮৪) রক্ত মাংসের স্বর (১৯৮৬) ক্ষয় (২০১০) সপ্তডিঙ্গা মধুকর (২০০২) রা (১৯৯৮)।
এ ছোটকাগজগুলো টাউন শেরপুরে সাহিত্যচর্চা চাতাল নির্মাণে সবিশেষ ভূমিকা পালন করেছে। হয়ত কয়েকটি কাগজ একাধিক আলোর মুখ দেখেনি তবু সূচনা সংখ্যায় নিজের সরব উপস্থিতি জারি রেখেছে। স্থানিকে পাঠক বলয় যথেষ্ট প্রসারিত নয়।
এই উত্তর জনপদে বেড়ে ওঠা আমাদের ভূমিজরা প্রান্তিকের প্রান্তিক। গারো জনগোষ্ঠী নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে স্মরণিকা বা ভাঁজপত্র প্রকাশ করছে। সেখানেও কবিতা চর্চার পরিসর গড়ে উঠছে।
গারো আমাদের পড়শী। এ ভূখণ্ড নির্মাণের কারিগর। বহু রৈখিকতার মেলবন্ধন অনাদিকালের। দেখাদেখি চাষ লাগালাগি বাসের পড়শী গারো, হাজং, কোচ, বানাই, ডালু, হদি, হিন্দু, মুসলিমদের যৌথ যাপনের ভূমিখণ্ড এই উত্তরের জনপদ। কিন্তু কখনো গারো জনগোষ্ঠীর নিজস্বতার নিরিখে যাপনের রসায়ন দিয়ে বুঝতে চাইনি। খুব বেশি গারো কাগজ সংগ্রহ করতে পারিনি। পড়শীর সঙ্গে আমারও কম দূরত্ব নয়।
রবেতা ম্রং কিংবা সুদীন চিরান অথবা প্রাঞ্জল এম সাংমা আমার একমাত্র জানালা-ছোট্ট জানলা। সেখান থেকে সংগৃহিত-ব্রিংনি বিবাল (২০০৯) ওয়ানগালা (১৯৯৯) আসপান (২০১৫) ইত্যাদি। প্রকাশ উন্মুখ তরুণের প্রথম চাতাল হচ্ছে ‘ভাঁজপত্র’। কবি যশপ্রার্থীর তরুণের রাখ রাখ ঢাক ঢাক গুড়ের ব্যবস্থাপত্রের নাম ভাঁজপত্র। চারপাতা ভাঁজের ভেতর বন্ধুদের কাঁচালেখা অথবা নিজের ছদ্মনামে একাধিক লেখা প্রকাশের মাধ্যম ভাঁজপত্র। সহজে কম পয়সায় বের করা যেমন যাচ্ছে তেমনি সহজে স্মৃতি থেকে হারিয়েও যাচ্ছে-এমনকি প্রকাশিত কপিটিও পাওয়ার জো নেই।
টাউন শেরপুরে ভাঁজপত্র-ইস্ক্রা (১৯৮৫) কবিতার কাগজ (১৯৮৯) ছাপ (১৯৯২) চিত্রচেতনা (১৯৮৬) সুড়ঙ্গ (২০০৮) উপমা (২০০৮) উত্তরণ (২০০৫) আর্তনাদ (২০১৭) মুহিম নগরের ট্রেন (২০১৮) দিপ্তী (২০০৩) সিঁড়ি (২০১১) শুভেচ্ছা (২০০৭) মুক্তি (২০১৬) পদাঙ্ক (২০০৬) মধুকর (২০১৯) আলোর মিনার (২০১৯) মুক্ত বিহঙ্গ (২০১১) পদ্মপাণি (২০১৮) ইত্যাদি প্রকাশিত ভাঁজপত্র।
থানা নালিতাবাড়িতে টাউন শেরপুরের দুই প্রভাবশালী জমিদারের ‘মহল’ হিসাবেই সাংস্কৃতিক চর্চার পাটাতন গড়ে ওঠে। এমনিতে গত শতকের বিশের দশক থেকেই কমিউনিস্ট পার্টির প্রভাবে নানা আন্দোলন সংগ্রাম দানা বেঁধে উঠছিল। বিশেষ করে ১৯৪৩ সালে নালিতাবাড়িতে যে, ‘বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলন’ অনুষ্ঠিত হয়েছিল তার প্রভাব এ এলাকার নাট্যচর্চার ক্ষেত্রে বিস্তার ঘটে। ‘তারাগঞ্জ আর্য নাট্য সমাজ’ নাট্য আন্দোলনের প্রতিভূ হিসাবে ভূমিকা পালন করে। ছিল স্থায়ী ঘূর্ণায়মান মঞ্চ। দর্শনীয় বিনিময়ে নাটক মঞ্চায়ন।
কিন্ত সাহিত্যচর্চার আনুষ্ঠানিকতা শুরু হয় নগেন্দ্র চন্দ্র পালের প্রযত্নে। তার রচিত গ্রন্থ ‘হস্তক্ষেপ’ ‘অভিমান’ ‘নালিতাবাড়ির ইতিবৃত্ত’ ইত্যাদি।
আবদুর রশিদের ‘মেয়ের বাবা’ ও ‘জোড়াতালি জীবন’ আবদুর রহমানের ‘রূপসী নদীর তীরে’ দিয়ে স্বাধীনতা পূর্ব সাহিত্যচর্চা চললেও স্বাধীনতার পর সাহিত্যচর্চা বেগবান হন। নাজমুল আহসান, মোস্তফা কামাল, মুশতাক হাবীব, রাধা বিনোদ দে, খালেদা রায়হান ও মঞ্জুরুল আহসান বুলবুল ও তপন চক্রবর্তী প্রমুখ গত শতকের আটের দশক দাপিয়ে বেড়ান এ প্রান্তিক থানায়।
নয়ের দশকে শুরু থেকে সাহিত্যের কাগজ ও চর্চায় আসে ভিন্নতা। প্রকাশিত হয় দেয়ালিকা ছোটকাগজ। এ সময়ে লিখতে আসেন মুনীরুজ্জামান তালুকদার, জয়নব বিবিসহ আরও কেউ কেউ। আবদুস সামাদ ফারুকের ‘ঘাস ফড়িঙের জ্যোৎস্না স্নান’ ও ‘জল জ্যোৎস্নায় নাজমূল’ জোবায়দা খাতুনের ‘ভোগাই-কন্যার আত্মকথন’ আবদুর রহমান তালুকদের ‘আর একটা যুদ্ধ চাই’ কোহিনূর রুমার ‘নীল উপাখ্যান’ বিপ্লব সাহার ‘অধরা মাধুরী’ ও মুহাম্মদ শহীদুল ইসলামের ‘বর্ণবাতি’ এ ছাড়া আরও লিখছেন বাংলাদেশ বেতারের তালিকাভুক্ত গীতিকার আজিজুর রহমান সরকার, প্রদীপ মুকুল ও রফিকুল ইসলাম।
শ্রীবরদী উপজেলার পশ্চিমের বধিষ্ণু থানা। এখানেও দেশভাগ পূর্ব ১৯৪৩ সালে খামারিয়া পাড়ায় গড়ে ওঠে যাত্রাদল ‘বীনাপানি অপেরা’। প্রান্তিক এই অঞ্চলে যাত্রাই ছিল জনসাধারণের বিনোদনের একমাত্র আশ্রয়স্থল। স্থানিক সম্পন্ন কৃষক পরিবারই ছিল প্রধান পৃষ্ঠপোষক। পুঁথি সাহিত্যনির্ভর যাত্রা কিংবা নিমাই সন্ন্যাস, দাতা কর্ণ, রাধার মান ভঞ্জন অথবা সামাজিক বিষয়বস্তুকে উপজীব্য নাট্যচর্চা এই তল্লাটে সাহিত্য সংস্কৃতিচর্চার পরিসর সৃষ্টি হয়।
উপন্যাসিক গোলাম মোহম্মদ সাহিত্যচর্চার পাশাপাশি লিখলেন ‘জামালপুরের গণ ইতিবৃত্ত’ (১৯৫৪) নামে ইতিহাস। স্থানিক খুঁটিনাটি তুলে ধরলেন তার ইতিবৃত্তে। লিখলেন, ‘ইসলাম সার সংগ্রহ’ ‘পবিত্র হাদিসের অমিয় কণা’ ‘বন্দিনী’, ‘আঁখির নেশা’ ইত্যাদি তার রচিত উপন্যাস। যদিও তিনি সম্পাদক হিসাবেই পরিচিত ছিলেন অধিক। জামালপুর থেকে প্রকাশিত ‘শান্তি বার্তা’ ও ‘পল্লী মঙ্গল’ দুটি সাপ্তাহিক তিনি দীর্ঘদিন সম্পাদনা করেন।
১৯২২ সালে তিনি গুরুসদয় দত্তের ব্রতচারী আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন। তৎকালীন মহাকুমা প্রশাসক হিসাবে গুরুসদয় দত্ত জামালপুরে এলে গোলাম মোহম্মদ ব্রতচারী আন্দোলনে উদ্বুদ্ধ হন। গুরু সদয় দত্তের প্রভাবে ‘পল্লী মঙ্গল’ সাপ্তাহিকটি বছর চারেক নিয়মিত প্রকাশিত হতো। নাট্যকার আবদুল্লাহ আল মামুনের (১৯৪৬) এই শ্রীবর্দীর কাকিলাকুড়া গ্রামে জন্ম স্থান হলেও তার প্রকাশ ও বিকাশ রাজধানী ঢাকাতে। এখন দুঃসময়, সুবচন নির্বাসনে ইত্যাদি তার বহুল অভিনীত ও প্রকাশিত নাটক।
গত শতকের সাতের আটের দশকে সুকুমার রায় (১৯৫২) আব্দুস সাত্তার, আশরাফ হোসেন প্রমুখের নেতৃত্বে মঞ্চস্থ হয়েছে ‘বাঈজী’ ‘সূর্যমহল’ ‘একটি পয়সা’ ‘অশ্রু দিয়ে লেখা’ নাটক দর্শকনন্দিত হয়েছিল। তরুণ নাট্যকার মুরাদ আলী সরকারের নেতৃত্বে গড়ে উঠল ‘সবুজ নাট্যগোষ্ঠী’(১৯৭৫) তার রচিত ‘রক্তাক্ত বাংলা’ মুক্তিযুদ্ধকে উপজীব্য করে লেখা নাটক দারুণ জনপ্রিয় হয়।
লুলু আব্দুর রহমান মূলত ছড়াকার। লুলুর সংগ্রহে আছে স্থানিক ছড়া বিয়ের গীত অশ্লীল গালি ধাঁধা গ্রাম্য চুটকি। শ্রীবর্দীর নানা প্রান্তে এখনো বিয়েতে আনন্দ উচ্ছ্বল ঠাট্টা ইয়ার্কি করুণ সুরের বিয়ের গীত কান পাতলেই শোনা যায়। যদিও আধুনিকতার দাপটে বিয়ের গীতের প্রভাব ও প্রতাপ কমে এসেছে অনেক। লুলু আব্দুর রহমানের কাঁধের ব্যাগ ভর্তি নানা কিসিমের বিয়ের গীতঃ
পান দিলাম আড়ে আড়ে
গুয়ে দিলাম চোখের ঠারে
চুন দিতে দেখলি
সাধের দেওরারে
নওবু কার ঘরে ছোকরি।
হাদিউল ইসলাম নব্বুইয়ের কবি। এক সময়ে ‘সাঁকো’ নামে সাহিত্যের কাগজ বের করতেন। তার প্রকাশিত বই ‘ধুলোস্রোত’ (২০০৪) ও ‘আগুনের শিরদাঁড়া’ (২০১৯) এ ছাড়া সুমন দাসের ‘অসীম তুমি কবিতা হও’ (২০১২) আরও লিখছেন নুরুজ্জামান খান, আজাদ সরকার, সুরুজ্জামান, প্রমুখ।
প্রান্তিক সীমান্তবর্তী ঝিনাইগাতিতেও নানাভাবে নিরবচ্ছিন্নভাবে সাহিত্য আন্দোলন করে যাচ্ছে। রয়েছে কবিতা সংগঠন। শরৎ ম্রং-এর ‘স্বপ্নগুলো ইচ্ছে হয়’ রোকন রাইয়ানের ‘সুখিয়া’ অন্যতম। এ ছাড়া নিয়মিত লিখছেন শামসুল হক শামীম, হাজেরা ইয়াসমিন ও ছড়াকার শাহিন শিমুল।
নকলা থেকে প্রকাশিত হচ্ছে তারেক আহসান সম্পাদিত ‘চিরহরিৎ’ এ এম ফিরোজের ‘ছিঁড়ে গেছে আশালতা’ ও মাজহারুল ইসলামের ‘অরুণোদয়’।
টাউন শেরপুরে সাহিত্যচর্চা উনিশ শতকেই উন্মুখ হয়ে ওঠে। রাধা বল্লভ চৌধুরীর ‘রাগানুগাদীপিকা’ রমাকান্তর ‘মনসার ভাসান’ রামনাথ বিদ্যাভূষণ মৌলিক রচনা নেই-আছে সাংখ্য মতে শ্রীমদ্ভাগবদ গীতার অনুবাদ। ‘তাহ্ইয়াতুচ্ছালাত’ নামে পুঁথিটি প্রায় দেড়শ বছর আগে রচনা করেন পাইকুড়ার মুন্সী রমজান আলী। আরেকটি পুঁথি লেখেন প্রায় একই সময় মুন্সী বছির উদ্দিন কারবালার কাহিনি অবলম্বন করে ‘শাহাদৎনামা’।
স্বাধীনতার পর শেরপুরে সাহিত্যচর্চা যে কোনো সময়ের চেয়ে বৃদ্ধি পায়। আবদুর রেজ্জাকের ‘আমাকে বলতে দাও’ তালাত মাহমুদের ‘স্বর্গের দ্বারে মর্ত্যরে চিঠি’ রনজিত নিয়োগীর ‘রৌদ্রভুক রাত্রি’ উদয় শংকর রতনের ‘নির্সগের নীল খামে’ সুহৃদ জাহাঙ্গিরের ‘জলের আগুন’ রবিন পারভেজের ‘দৃশ্যের ওপাশে চিহ্নের আড়ালে’ কাকন রেজা ‘স্থির করে দাও কম্পমান জল’ রোমান জাহানের ‘কেবলই ক্ষয়ে যাওয়ার কাহিনী’ রফিক মজিদের ‘অদৃশ্য অনুভূতি’ সুমন সাজ্জাদের ‘নীল কণ্ঠের পালা’ নীহার লিখনের ‘ব্রহ্মপুত্র’ হুইসেল হোসেনের ‘হয়তো নয়তো প্রেম’ মোস্তাফিজুল হকের ‘ইচ্ছে ডানার পাখি’ ও আশরাফ আলী চারুর ‘নির্বাক জননি’ ও জাহাঙ্গীর আলম ‘রূপসী ছড়ার দেশ’ অন্যতম।
এ ছাড়া লিখছেন রফিকুল ইসলাম আধার, আরিফ হাসান, আইরিন আহমেদ লিজা প্রমুখ।
স্থানিকে সাংস্কৃতিকচর্চার চাতালই তৈরি হয় নাটককে কেন্দ্র করে। ধনপ্রধান জেলা শেরপুরের নাট্য আন্দোলন চর্চার বয়ান বাদ দিয়ে সাহিত্যচর্চার পরিসর নির্মাণ করা সম্ভব নয়। নাটক চর্চার মতো দলীয় কায়কারবারের ভেতর দিয়ে ব্যক্তি তার সাহিত্যচর্চার মতো ও পথটি বাতলে নেয়। ধারাবাহিক চর্চা যেমন আছে তেমনই আছে চর্চার ছেদ। স্থানিক সাহিত্যচর্চার বৈশিষ্ঠ্যও বটে।”
প্রথম প্রকাশ: যুগান্তর।