Our Sherpur

গারো পাহাড়ের চিঠি-১৬ | জ্যোতি পোদ্দার

গারো পাহাড়ের চিঠি-১৬

জ্যোতি পোদ্দার

”এই উত্তর জনপদের অধিবাসী হদি জনগোষ্ঠী একদা কৃষি কাজে বাধ্য হলেও তাদের কায়কারবার ও চরিত্র ছিল ক্ষত্রিয়সুলভ। ক্ষত্রিয়দের সংঘবদ্ধ ক্ষাত্রশক্তির বলেই এই অঞ্চলের বর্ণহিন্দু ভূস্বামীগণ পুরুষানুক্রমে বিষয় সম্পত্তি ভোগ দখল করিতেন।

হদি ছিল রায়তের লাঠিয়াল বাহিনী। এছাড়াও জমিদার বাড়ির সমস্ত গৃহস্থালির কাজ যথা: থালা বাসন মাজা, কাপড় কাঁচা, ঘর পরিস্কার পরিচ্ছন্ন করা, পাখাটানা, বাগান বাড়ি ফলের বাগান, খেলার মাঠ, পুকুর, রাস্তাঘাট পরিস্কার করা, জ্বালানি কাঠ চেরা এবং পালা করিয়া সমস্ত রাত্রি জমিদার বাড়ি চৌকি দেওয়া প্রভৃতি ছিল তাহাদের প্রধান কাজ। আবার কোন দাঙ্গা হাঙ্গামায় জমি দখল, চর দখল, কোন বিদ্রোহী প্রজার জমি দখল, ভিটে মাটি উচ্ছেদ করার নিষ্ঠুর কাজে এই হদিদের লাগান হইত।

তোমার জন্য উদ্ধৃতি একটু বড় হলো বৈকি। এছাড়া কোন উপায় দেখছি না। ইতিহাসের ঘটনাক্রম তল থেকেই দেখতে হয়। একটা সময় জোতদারদের কিছু জমি জিরাত চাষ করে জীবন ধারণ করতে পারত এই শর্তে যে মাসে ৫/৭ দিন জোতদারদের গৃহে বেগার খাটতে হতো পরিবারের অন্য সদস্যসহ পালাক্রমে। যা ইতিহাসে নানকার প্রথা নামে পরিচিত। স্থানিকে যাকে বলত ‘বেগারী খাটা’।

অথচ তুমি জেনে অবাক হবে এই ভূস্বামীগণ হদিকে দেখতেন ঘৃণার চোখে; অস্পৃশ্যতা বাতাবরণে। ”অথচ নিয়তির এমনি পরিহাস যে হিন্দুধর্মালম্বী এই নানকার প্রজাদের উপর বর্ণহিন্দু জমিদারের সামাজিক ও আর্থিক নির্যাতন ছিল সীমাহীন ও বর্ণনাতীত… নাপিত ধোপার ব্যবহার, রান্নাঘর বা দেবালয়ে প্রবেশ ছিল নিষিদ্ধ।”১

কোচপাড়ার জীবন সংগ্রাম
Click : Mugniur Rahman Moni

যে হদি ক্ষত্রিয়রা ছিল জমিদারে জানমাল রক্ষা ও খাজনা অনাদয়ে প্রজার জমিতে উচ্ছেদ ও তার ভিটিতে ঘুঘু চড়াবার পাইক পেয়াদা বরকন্দাজ লাঠিয়াল তারাই একদিন দাস হদির ‘অস্ত্রের মুখ’ পরির্বতিত হয়ে গিয়ে প্রভুদের বিরুদ্ধে লড়েছেন এই তল্লাটের মানুষদের সাথে।

এ তল্লাটে হদিদের ইতিহাস শুধু গৃহদাস ও জোতদারদের লাঠিয়াল হবার ইতিহাস নয়। হদি ও রায়তদের মধ্যে আপোস ও সংগ্রাম কম হয়নি। শাসকের পক্ষালম্বন ও তাঁর বিরোধিতা সমান তালে চলছে। আবার দ্রোহের ফলাফল হয়েছে মারাত্মক। কখনো চাষাবাদে অংশ গ্রহণে নিষেজ্ঞা কখনো সমাজচূত্য আবার কখনো পরিবারে সুদ্ধ জমিদার বাড়িতে আরো বেগার খাটা।

শেরপুর পরগণার জমিদারের সামরিক শক্তি অথচ সামাজিক অধিকার থেকে বঞ্চিত এই ক্ষত্রিয় হদিরাই– ইতিহাসের খেলা এমনই যে তারাই একদিন জমিদারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়ে ছিল। আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন। উন্মেষ ঘটেছিল শ্রেনিচেতনা। সফলও হয়েছেন।

রবি নিয়োগী

১৯৩৭–৩৮ সালেই প্রবল আন্দোলনের ফলে শেরপুর পরগনায় নানকার প্রথা বা গৃহ দাস প্রথা বাতিল হয়। পায় নাগরিক মর্যাদা। হদিদের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন রবী নিয়োগী, জিতেন সেন ও হেমন্ত ভট্টাচার্য্যের মতো প্রাগ্রসর যুব নেতারা। তারাগড় গ্রামে যে সন্মেলন ও সমাবেশ হয় সেখানে উপস্থিত ছিলেন চান্দের নগর, নাকশি, পাঞ্জরভঙা, নকলা তারাকান্দি, বালিয়া, শালিয়া, মোবারকপুর, কালিনগর, কদমতলির হাজার হাজার নিপীড়িত হদি সম্প্রদায়ের লোকজন। যৌথতার আন্দোলনে উত্থাপিত হয়।
ক) নানকার প্রথা অবসান
খ) মন্দিরে প্রবেশ ও পুষ্পাঞ্জলি প্রদানের অধিকার
গ) অনুমোদিত দাখিলা দিয়া নানকারি জমির খাজনা আদায়ের ব্যবস্থা করা।

জমিদার রায়তের বিরুদ্ধে সংগঠিত হয়ে নানা দাবী উত্থাপন ১৯৩৮ সালে সহজ ছিল না। শোভাযাত্রা ও সমাবেশকে মোকাবেলা করার জন্য রায়তেরা, “নিজেরাই প্রচুর পরিমানে বন্দুক ও কার্তুজ মজুদ করিল এবং তাহাদের অতীত দিনের ঢাল, তরোয়াল বৱশা, বল্লম রামদা খড়্গ প্রভৃতি মারাত্মক অস্ত্রগুলি রঙিন কাপড়ে ঢাকিয়া ভাড়া করা লোকের সাহায্য শোভাযাত্রা যাত্রাও বাহির করিল।”

তবুও ১৯৩৮ সালে জমিদার বাড়িতে কেউ আর বেগার খাটতে গেল না। শেরপুরে তখন কংগ্রেস ও কমিনিস্টের প্রতাপ তুঙ্গে। আন্দোলনের তাপ ও চাপে কার্যত নানকার প্রথা উচ্ছেদ হয়ে গেল।

তবে তোমাকে আরেকটু নোটস দিয়ে রাখি ১৯২৮ সাল ছিল তাদের সংগঠিত হবার বছর। উঁচু নীচু জাত তথা অস্পৃশ্যতা নিয়ে এখানকার নেতা কর্মিদের মাঝে যে অস্বস্তি অবস্থা ছিল কেদার চক্রবর্তীর নেতৃত্বে পরস্পর পরস্পরকে জল দানের মধ্য দিয়ে ঐক্যের ভিত্তি গড়ে ওঠে। ইতিহাসে যা ‘জলচল’ আন্দোলন নামে খ্যাত হয়ে আছে। এই আন্দোলনের পুরভাগে ছিলেন হদি, কোচ, ডালু, বানাই, বর্মণ সম্প্রদায়ের লোকজন।

ক্ষাত্রতেজ থাকলেও জমিদারী প্রথা ও দেশভাগ পরবর্তীতে হদি জনগোষ্ঠী আর সংগঠিত হয়ে থাকতে পারেনি। তাদের সমাজ অভ্যন্তরে অতীত মুখীতার কারণে হদি বাস করত স্মৃতিতে শ্রুতিতে পুরান লোককাহিনীর নানা বীর্যবত্তার সংবাদে বুদ হয়ে। বর্তমান হয়েছে অস্থির। ভবিষ্যতের ইশারাও সমাজের ভেতর গড়ে না উঠার কারণে হদি সম্প্রদায় নেতৃত্বহীন হয়ে পড়ে। দেশান্তর ও স্থানান্তর যেমন হয়েছে তেমন ধর্মান্তরও হয়েছে। আবার একই স্থানে বসত করলেও আর সংঘবদ্ধতা সৃষ্টি হয়নি। বরং বিভেদের দেয়াল নির্মাণ করে করে যাপন করেছে প্রান্তিকের প্রান্তিক জীবন।

নির্জীব নিষ্ক্রিয় হদির জীবন কেটেছে বিচ্ছিন্নতায়। নিজেকে নিয়ে নিজের বেঁচে থাকার গল্পে। হদি তরুণদের ডাকে সেদিন গিয়ে ছিলাম ‘গাওবর্ত’ অনুষ্ঠান। গাওবর্ত মানে গ্রামের ব্রত। সকলকে নিয়ে সকলের ব্রত। প্রকৃতিলগ্না হবার ব্রত। বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে একা হয়ে গেলে নানা দুর্বিপাকে পড়ে গেলে মানুষ আরেক মানুষের পাশে দাঁড়ায়। গাওব্রত সেই ধরনের ব্রত।

গ্রীষ্মের খাড়া রোদের দাপটে এই সময়ে শরীরের নানা ঘা পাঁচড়া বা চর্ম রোগের প্রাদুর্ভাব ঘটে। এই কৌমের বিশ্বাস প্রকৃতির কাছ থেকে আসা মানুষ প্রকৃতি থেকে দূরে সরে গেলে মানব শরীরে যেমন নানা রোগের প্রকাশ ঘটে তেমনি প্রকাশ ঘটে সমাজ শরীরেও।

কাজেই রোগ দূর করার জন্যেই প্রকৃতির নিয়ম নিষ্ঠা ও প্রকৃতিলগ্না হবার যৌথ সাধনাই করে থাকত হদি সম্প্রদায়। গাওবর্ত সেই প্রকৃতিলগ্না হবার ব্রত বা লৌকিক উচ্চারণে বর্ত। নানা কারণেই এই পরব হারিয়ে গেছে। রয়ে গেছে স্মৃতি আর মৌখিক পুরাণে কথা ও গানে বিচ্ছিন্নতা যন্ত্রণা ও মেলাবার আকাঙ্খা।

হদি কল্যাণ পরিষদ সেই স্মৃতি ও শ্রুতি নিয়ে এলো আজকের অনুষ্ঠানে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখলাম পুরোহিত বিহীন একটি যৌথ লৌকিক ক্রিয়া ও ক্রীড়া। সাধ সাধনা মানত ও যৌথ গীতের অনুষ্ঠান গাওব্রত। উঠানে কলা গাছ গেড়ে আল্পনা এঁকে সাজিয়েছে মণ্ডপ। চাল কলা খই আমপাতা নিমপাতাসহ নানা উপাচার একের সাথে গেঁথে দিয়েছে অন্যজে। কোন কিছু ই ছিন্ন হবার সুযোগ নেই। চারধারে গোল হয়ে বসে গাইছে গীত হদি রমণীরা। কথার চেয়ে নাঁকি সুরেই সয়লাব অস্থায়ী মণ্ডপ। খুব করে কান পেতেও গানের কোন কথাই উদ্ধার করতে পারলাম না।

জীবন সংগ্রাম

বিচ্ছিন্ন মানুষের স্মৃতিও ছেঁড়াসূতা। একমুখ খুঁজে পেলেও অন্যমুখ স্মৃতি শ্রুতি যাপনের কোথাও খুঁজে পায় না সুরবালা বিশ্বাস। মাথা নাড়ে। মাটিতে আঁকে আঁকিবুঁকি। তবুও করোটি ও মনে ভাসে না। আশি পেরুনো সুরবালার চোখের মতো সব ঝাপসা দেখেন। পান খাওয়া মুখে হাসতে হাসতে বলেন.. “বাপ মনে করতে পারি না। আমার ঠাম্মার কাছে শুনছিলাম উতুম ঠাকুরের ব্রতের কথা।”

মূলত বৃষ্টি প্রার্থনার ব্রত উতুম পুজা। চৈত বৈশাখের খরার সময়ের ব্রত। উঠানে পিটু লি দিয়ে আঁকা লতা পাতার মাঝেই থাকে অশুভ নাশের ইঙ্গিত। শুভের আহ্বান। ব্রত মানে গেরস্থের বিপদ থেকে কিভাবে উদ্ধার পাওয়া যাবে তাঁর নানা আলাপ থাকে ব্রত কথায়। কথায় ও সুরে। সুরবালা সবটুকু মনে করতে পারল না।

সুরবালার মুখোমুখি বসে টুকে আনি নানা গান ও কথা। কিছু তার নিজের হলেও “…সব গান আমার না–তয় আমাগো সমাজের।” সুরবালা তার ঠাম্মার কাছে শুনে শুনে মুখস্ত করছিলেন। এই বয়সে বলতে পারেন না কোনটা তার আর কোন তার ঠাম্মার কাছ থেকে শেখা সমাজের গান।

ক. ঘরখানি লেপা পুছা দুয়ারখানি বাসি
আঙ্কি আঙ্কি চাইয়ারে দেখো
ঐ ঘরের বসতি রাম কানাইরে
বনে থাকে ধেনুরে
রাখো রাখালের মতো
কদম ডালে যাইয়া কৃষ্ণ খোঁজে মোহন বাঁশি।

খ. হাতে কইরা দিলে গো ভিক্ষা হাতে শঙ্খ লড়ে
কুলায় কইরা দিলে দিলে গো ভিক্ষা ঘরের লক্ষী ছাড়ে
ডালায় কইরা দিলে গো ভিক্ষা ধনে পুত্র বাড়ে
ভিক্ষা দেও গো ভিক্ষা দেও গো সাধের সাধ্বানি।

গ. ইছল মাটি পিছল খাইয়া
ভাঙল হীরার কলসি
কত রঙের সাজল সখী
নাকের ডাসা নড়ে
হাইট্টা যাইতে মাঞ্জা চিকন
হালিয়া ঢুলিয়া পড়ে

তবে জানো কি অসংগঠিত হদি আবার যৌথতায় খুঁজে পেতে চায় সেই বীর্য সেই ক্ষাত্রতেজ। চায় শেকড়ের সন্ধান। তাপস বিশ্বাস ও তার টিমের অক্লান্তের ফসল এই আয়োজন। এই তল্লাটের নানা স্থানে থেকে নানা বয়সী হদিরা এসেছেন নিজেদের পরিচয়ে নিজেরদের আলোতে নিজেদের দিকে তাকাবার জেদ ও আগ্রহ নিয়ে।

মণ্ডপ ঘিরে আয়োজিত গাওব্রত দেখতে দেখতে তাই মনে পড়ে গেলো হদিদের নিপীড়ন ও বঞ্চনার অনালোকিত ইতিহাস। ইতিহাস মৃত নয়। ইতিহাস জীবন্ত। হদি তার আত্মপরিচয় খুঁজতে চাইলে নিশ্চয়ই তাকে ইতিহাসে মাটি ও মনন ছাড়া তার এগুবার পথ নেই।”

Leave a Reply

Scroll to Top