মুক্তিযুদ্ধে নালিতাবাড়ি | সাগর আহমেদ
ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কলকাতার ইডেন পার্কে সেদিন ছিল ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর বিশাল জনসভা। তার কিছু দিন আগে তিনি বিশ্ব সফর করে বিশ্ব জনমত সংগ্রহ করেছেন। কারণ পাকিস্তান ও ভারত সরকার তাদের উভয় দেশের সিমান্তে প্রচুর সৈন্য মোতায়েন করে রেখেছেন। রয়েছে প্রায় ১ কোটি শরণার্থী। এদিকে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রটি শুধু বিশ্ব স্বীকৃতির অপেক্ষায়। পাকিস্তান-ভারত যুদ্ধ য কোন মুহুর্তে ঘোষিত হতে পারে। তাই এক দিকে রাষ্ট্রীয় জনমত সৃষ্টি অন্যদিকে শরনার্থীদের শুভেচ্ছা জানাতে ছিল তার সেই সফর এবং জনসভা।
৪ ডিসেম্বর জনসভা শুরু হওয়ার পর প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী যখন মঞ্চে ভাষণ দিচ্ছেন মাত্র চার পাঁচ মিনিটের মধ্যেই ভারতীয় পশ্চিম রণাঙ্গন থেকে তাঁর কাছে সংবাদ এলো যে পাকিস্তান সরকার ভারত আক্রমণ করছে। ভাষণ শেষ না করেই সংগে সংগে মঞ্চ থেকে নেমে বিমান বন্দর, অতঃপর দিল্লী। রাতে ইমারজেন্সিতে মন্ত্রী পরিষদের বৈঠক করে সাথে সাথে আনুষ্ঠনিকভাবে যুদ্ধ ঘোষণা করেন। সারা ভারতে পশ্চিম রণাঙ্গনে শুরু হলো উভয় দেশের তুমুল যুদ্ধ।
৫ ডিসেম্বর ভোর ৭ টায় দেখা গেল বাংলাদেশের আকাশে ভারতীয় বিমান শো শো শব্দে আকাশ কাঁপিয়ে ঢাকা রাজধানীসহ বিভিন্ন জেলা শহরগুলোর উপর যেখানে খাঁন সেনাদের ঘাটি সেখানে ঠা-ঠা করে বোমা ফেলছে আবার বিমানগুলো ভারতের উদ্দেশ্যে চলে যাচ্ছে। সারাদিন এমনি ভাবে বিমান থেকে বোমা বর্ষণ। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র বিবিসি কলকাতা দিল্লীসহ সারা বিশ্বের রেডিও সেন্টার থেকে পাক ভারত ও বাংলাদেশের রণাঙ্গন থেকে সংবাদ আসতে থাকে যাকে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর মনোবল আরও বেড়ে যায়।
এদিকে ৫ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে ভারতীয় মিত্রবাহিনী তাদের সাজোয়া বাহিনী নিয়ে উত্তর ময়মনসিংহের শেরপুর, ঝিনাইগাতী হয়ে জামালপুরের উদ্দেশ্যে এবং হালুয়াঘাট হয়ে ময়মনসিংহের উদ্দেশ্যে মার্চ করে। ডালু সীমান্তে থাকা মুক্তিবাহিনী গণ ৬ ডিসেম্বর মার্চ করে নালিতাবাড়ির পথে শিমুলতলায় রাজাকার আল-বদরদের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হয়।
৬ তারিখ দিনে ও রাতে উভয় পক্ষে প্রচন্ড গোলাগুলি হলে রাজাকাররা তারাগঞ্জ মধ্যবাজারের ব্যাংকাগুলোতে অবস্থান নেয়। উভয় পক্ষের প্রচন্ড গোলাগুলির মধ্যে হোসেন আলী নামে একজন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন এবং সেই দিনই সন্ধ্যায় শহীদ মুক্তিযোদ্ধার লাশ নিয়ে টেনে হিঁচড়ে রাজাকাররা উল্লাস করে।
পরদিন ৭ ডিসেম্বর ভোরে মুক্তিযোদ্ধাগণ শিমুলতলা হতে একযোগে জয়বাংলা শ্লোগানে মুখরিত করে নালিতাবাড়ি বাজারে প্রবেশ করে। সেই সাথে স্থানীয় মুক্তিযোদ্ধের স্বপক্ষ শক্তি বুঝতে পারে যে দেশ স্বাধীন হয়ে গেছে। তাই তারাও মুক্তিযোদ্ধাদের স্বাদরে বরণ করে নিয়ে নালিতাবাড়ি সিও অফিসে জাতীয় পতাকা উত্তোলন করে।
প্রতিদিনই সূর্য উঠে, প্রতিদিনই আসে ভোর। সেদিন মসজিদে আযান হলো কিনা, মন্দিরে ঘন্টাধ্বনি বাজলো কিনা, ভোরের পাখিদের কলকাকলিতে মুখরিত হলো কি-না কে জানে? তবুও ভোর হলো, পুবাকাশে রক্তিম সুর্যের আভা ছড়িয়ে পড়ল দেশ হতে দেশান্তরে। দু’দিন তুমুল যুদ্ধের পর নালিতাবাড়ির আকাশেও উদিত হলো স্বাধীনতার নতুন লাল টকটকে সূর্য। মুক্ত হলো আমাদের প্রিয় দেশ- আমাদের প্রিয় নালিতাবাড়ি। দীর্ঘ নয় মাস নরক যন্ত্রণা শেষে ছোট বড় সবাই মিছিলে প্রাণ খুলে চিৎবার করে শ্লোগানে মুখরিত করতে থাকলো জয় বাংলা ধ্বনিতে।
তথ্যসূত্রঃ মুক্তিযুদ্ধে শেরপুর।
লেখকঃ আবদুর রহমান তালুকাদার।