Our Sherpur

সুফি জরিপ শাহ (রহ.) এর মাজার

সুফি জরিপ শাহ (রহ.) | হারুনুর রশীদ

নামটি মূলত জরিপ (রহ.)। বাদশাহ শব্দের সংক্ষিপ্ত রূপ শাহ। হ্যাঁ, বাদশাহ ছিলেন বলেই জরিপ শাহ নামেই সর্বাধিক পরিচিত। তবে, রাজ্য শাসনের তুলনায় ধর্মপ্রচারক হিসেবেই সবচেয়ে সম্মানিত তিনি। ১৩০১ খ্রিস্টাব্দে হযরত শাহজালাল (রহ.) সহ ৩৬০ জন আওলিয়া ভারতবর্ষে আগমণ করেন। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে তৎকালীন শ্রীহট্ট (সিলেট) রাজ্যের রাজা গৌর গোবিন্দকে পরাজিত করে। এই ৩৬০ জন আউলিয়ার একজন এই জরিপ শাহ (রহ.)। শ্রীহট্ট জয়ের পর মূলত ধর্ম প্রচারের জন্য সারা ভারতবর্ষে বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়েন। সেই ধারাবাহিকতায় জরিপ শাহ ৩৬০ একর জমির উপর তৈরি করেন তার আস্তানা। তিনি যে স্থানটিতে তার আস্তানা গাড়েন, সেটিই হলো বর্তমান গড়জরিপা।

মূলত হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় মুসলমানের আস্তানা। এলাকাবাসী মেনে নিতে পারছিলো না। নানাভাবে অন্যায়, অত্যাচার, আক্রমণ শুরু করলো। বহিশত্রুর হাত থেকে রক্ষার জন্য তার আস্তানার তিন পাশে একটি পরিখা বা খাল খনন করেন। এই পরিখা বা খালটির পরবর্তীতে নামকরণ করা হয় “কালিদহ সাগর“। কিংবদন্তী আছে, সুফি জরিপ শাহের (রহ.) জিন মুরিদেরা মাত্র একটি রাতে এই খাল খনন করে। উল্লেখ্য, তারা ৩৬০ জন সফরসঙ্গী সুরমা নদী পার হয়েছিলেন একটি জায়নামাজে চড়ে। হযরত শাহজালাল (রহ.) আজান দিয়ে রাজা গৌর গোবিন্দের সাত তলা বিশিষ্ট সুঠাম প্রাসাদ ভেঙ্গে চুরমার করেছেন। এক রাতে এত বিশাল পরিখা বা খাল তৈরি আল্লাহর ওলিদের পক্ষে জটিল কোনো বিষয় নয়।

পরিখা বা খালের মাটি দিয়ে দুই পাড়ে সাতটি উঁচু জাঙ্গাল তৈরি হয়। জরিপ শাহের এই কারামতি দেখে শত্রুপক্ষ আতঙ্কিত হয়ে পড়ে। সাধারণ লোকজন দলে দলে মুসলমান হতে থাকে। চির নির্লোভ, সদাচরণ, ন্যায় বিচার, দানশীলতার জন্য অমুসলিমরাও তাকে অনুসরণ করতে থাকে। অল্পদিনের মধ্যেই তার রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়। এই রাজ্যের সীমানা ছিলো পূর্বে নেত্রকোনা, পশ্চিমে দেওয়ানগঞ্জ, উত্তরে আসামের দক্ষিণ অঞ্চল এবং দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত। ৩৬০ একর জুড়ে তার রাজপ্রাসাদ, সৈনিকদের ব্যারাক, হাতি-ঘোড়া লালন পালনের জন্য বহু পুকুর, পর্যাপ্ত রাস্তাঘাট ছিলো। এবাদতের জন্য তৈরি করেন একটি রাজকীয় মসজিদ। কালক্রমে সেটির নামকরণ করা হয়, শাহী বারো দুয়ারী মসজিদ

শাহী বারো দুয়ারী জামে মসজিদ গুম্বজ
শাহী বারো দুয়ারী জামে মসজিদ গুম্বজ

সুফি জরিপ সাহেব মৃত্যুর বেশ কিছু দিন পর এই রাজ্যটি আবার হিন্দুদের দখলে যায়। দলিপ নামক সামন্ত রাজা পরিখা বেষ্টিত এই ৩৬০ একর জমির এই এলাকাটিকে তার নিজের নামে গড়দলিপা দুর্গ বলে ঘোষণা দেয়। সুফি জরিপ শাহের স্থাপনাগুলো ভেঙ্গেচুরে নিজের মত করে তৈরি করে।

এই রাজ্যের পার্শ্ববর্তী রাজ্যের নাম ছিল বাংলা। এই বাংলার অধিপতি হন ফিরোজ শাহ। ফিরোজ শাহের সেনাপতি ছিলেন মজলিস খান হুমায়ুন। ফিরোজ শাহের নির্দেশ পেয়ে সেনাপতি মজলিস খান হুমায়ুন এই রাজ্য আক্রমণ করেন। এই যুদ্ধে দলিপ রাজা পরাজিত ও নিহত হয়।

মজলিস খান হুমায়ুন এই রাজ্যের রাজা হিসেবে তার নাম ঘোষণা করেন, শাহ মজলিস খান হুমায়ুন। তিনি তখন এই দুর্গের নামকরণ করেন গড়জরিপা। পুরাতন মসজিদটি নতুনভাবে তৈরি করেন। কোচ দলিপ রাজা জরিপ শাহের কবরের কোনো চিহ্ন রাখেনি। মজলিস শাহ অনুসন্ধান করতে থাকেন জরিপ শাহের কবর। হঠাৎ তার নজরে পড়ে, এক দরবেশ অর্ধেক দেহ মাটিতে পুঁতে থাকা অবস্থায় জিকির করছে। মজলিস শাহ বুঝতে পারেন, তিনিই সুফি জরিপ শাহ (রহ.)। সেই জায়গাটিই জরিপ শাহের মাজার হিসেবে সংরক্ষণ করেন। ১৯০ ফিট দৈর্ঘ্য ও ৬৫ ফিট প্রস্থ অংশে এখন আছে মাজার, একটি মসজিদ, একটি ঈদগাহ। মাজারের পাশে প্রাচীন নিদর্শন হিসেবে কয়েকটি পাথর আছে।

উল্লেখ্য, পীর, মাশায়েখ, গাউস, কুতুব, ওলি, মাজার, খানকাহ, দরগাহ ইত্যাদি পবিত্র শব্দ ব্যবহার করে অনেকেই ভণ্ডামি করছেন। তাদেরকে শক্ত হাতে দমন করতে হবে। পক্ষান্তরে প্রকৃত পীর-মাশায়েখদের সম্মান দিতে হবে। তাদের জীবনি, সৎকর্ম, অবদান ও বিশেষ কীর্তিগুলো জানতে হবে, জানাতে হবে। মাজার-দরগাহগুলো সংরক্ষণ করতে হবে।

Leave a Reply

Scroll to Top