Our Sherpur

ভোগাই: এক অনার্য নদীর গান

এক অনার্য নদীর গান
রিয়াদ আল ফেরদৌস
রিয়াদ আল ফেরদৌস

ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পশ্চিম গারো পাহাড়ের ঢাল নকরেক গিরিশিখর থেকে ছয়টি বৃহৎ ঝর্ণা থেকে প্রবাহিত হয়েছে ক্ষ্যাপাটে এক জলধারা। কমরেড প্রমথ গুপ্ত তাঁর ‘মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী’ গ্রন্থে লিখেছেন – “নকরেক শিখর হইতে বাহির হইয়া দুধবান্দা গিরি, সান্দং, লোগা, চান্দাপাড়া, বান্দাপানী ও ভগী গিরির অসংখ্য ঝরনাধারা বুকে লইয়া ভোগাই নদী প্রবাহিত হইয়াছে নালিতাবাড়ীর মধ্য দিয়া দক্ষিণের কংস নদী পর্যন্ত।”

প্রাণ, প্রকৃতি ও আবহমান জীবনের সঞ্জিবনী ধারা এই ভোগাই নদী মেঘালয় কোল ঘেঁষে সীমান্তের জনপদ নালিতাবাড়ী ভূখন্ডকে দুই তৃতীয়াংশে বিভক্ত করেছে এবং ভাটিতে কংশ নাম ধারণ করে বয়ে গেছে মগড়া, ঘোড়াউত্রা ও মেঘনার মোহনার দিকে। ভোগাই স্রোতকে সীমান্ত শূন্যরেখা হিসেবে উজিয়ে দিয়েছে কোথাও।

ভোগাই সুদূর অতীতের ভোগবতী খ্যাত আজকের ভোগাই তীরবর্তী উপপর্বতীয় সকল জঙ্গলাকীর্ণ স্থান আর বাংলাদেশ ভারত সীমান্তকে সজ্ঞায়িত করে পানিহাটা, তারানি হয়ে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে প্রবেশ করেছে। ভোগাই তটস্থ কালাকুমা, নাকুগাঁও, কল্যাণকুড়া, হাতিপাগাড়, তন্তর, দুধকুড়া , নয়াবিল, মন্ডলিয়াপাড়া, ঘাকপাড়া, ফুলপুর , গেলাদুপাড়া, আন্ধারুপাড়া, কেরেঙ্গাপাড়া, চিনামারা, শিমুলতলা উত্তর পাড়া, মধ্যমকুড়া, কেন্দুয়াপাড়া, নালিতাবাড়ী বাজার, ছিটপাড়া, গোবিন্দনগর, কাপাশিয়া, গুজাকুড়া, কুননগর ইত্যাদি। এর করনদী তোতাপানি, সোপানু, বড়ঝোড়া, মেলেং, সঙ্গতিঝোড়া ইত্যাদি।

শাখা গাঙ্গিনা ভোগাই নদী কেরেঙ্গাপাড়া থেকে পূর্বমুখী ধারা হুইতাগাঙ অধুনা সুতিয়াখাল সোহাগপুর (গণহত্যার স্মৃতিবিধৌত) গ্রামের কাছে গাঙ্গিনা নামে জিগাকান্দা অবধি প্রবাহিত হয়েছে। আদি দৈর্ঘ ১৭.২৫ মাইল। গাঙ্গিনার তীরবর্তী গ্রাম পলাশিয়া, চান্দেরনন্নি, কাঁকরকান্দি, খুজিউড়া, সোহাগপুর, ভালকাকুড়া, যুগলি, রূপনারায়নকুড়া, পলাশতলা, খেলকুড়া, রুহি পাগারিয়া, সোনামোহা, কুতিউড়া, কৈচাপুর, মকিমপুর নগুয়া, নরাইল গাঙ্গিনারপার ও জিগাকান্দা। ভোগাই এর করনদী বুড়ি ভোগাই ও দর্শা।

ভোগাই নদী তাঁকে জড়িয়ে থাকা মাটি ও মানুষের প্রণিজ আমিষের এক অফুরন্ত ভান্ডার। এককালে দর্শায় বিপুল মৎস্য সম্পদের প্রাচুর্য ছিলো। এখন নাব্যতা ও জল সংকটে দর্শা, বুড়ি ভোগাই মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছে নিয়ত। মেলেং খাল ভরাট হয়ে গেছে আগেই। বোয়াল, কাতল, আইর, বাইম, চাপিলা, কাল বাউস এবং ভোগাই নদীর ভাগনা মাছের সুখ্যাতি পাহাড় অঞ্চলের সম্পদ। এছাড়াও টেংরা, টাকি, চিকরা, পুটি, বৌ মাছ, বইট্টা, কাচকি, কতৃ, ফৈলা, বাইল্লা, শিং, মাগুর, গতা, চাটা মাছ ভোগাই ও তাঁর করনদী গুলোকে সম্পদশালী করেছে।

বর্ষার পাহাড়ি ঢলে গারো পাহাড়ের প্রকাণ্ড গাছ ও গুড়ি ভেসে আসত। ভাটির মানুষের জ্বালানি কাঠের অন্যতম যোগান ছিলো এসব ঢলে ভেসে আসা পাহাড়ি খড়ি। আজকাল এসব খুব সামান্যই চোখে পড়ে।

ভোগাই নদী এলাকা
ভোগাই: এক অনার্য নদীর গান

মোটাদাগে ভোগাই পালিত গারো পাহাড়ের সমতলে নালিতাবাড়ী সহ তৎসংলগ্ন আজকের মানবায়িত কৃষি ও অর্থনৈতিক যোগাযোগ। সামন্ত যুগে এই ভোগাই নদীতে বাণিজ্যতরী ও হরেক বণিকের বিচরণে সরব ছিলো শক্ত জনশ্রুতি আছে। পাহাড়ি জনপদে নারিকেল গাছ ছিলোনা, ইলিশের আমদানি ছিলো না।

বিশেষত ধান, পাট, তামাক, চ্যাপা শুটকি, তুলা, লবণ, সরিষা এসবের বড় মোকাম গড়ে ওঠেছিলো এই নদীর অববাহিকায়। দেশভাগের আগে ভারতের তুরা শহরের সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিল বেশ জোরদার। শাল গজারি, শিরিষ, সেগুন কাঠ ও সুপারি বিপুল পরিমান ভোগাইয়ের স্রোত বেয়ে ভাটির বাজারে আসতো, আর ওদিকে বেশি চাহিদা ছিল তামাক, পাট, তুলা, ধান, শুটকি, মরিচ, ইত্যাদির। মোটাদাগে আমদানি রফতানির একটা বৃহৎ মাধ্যম ছিলো ভোগাইয়ের স্রোতধারা।

শেরপুর টাউনের জমিদারের বাটোয়ারা পরবর্তী মহালের সীমানা এই ভোগাই নদী। পূর্বপাড় আড়াইআনী বাজার এবং পশ্চিমপাড় তারাগঞ্জ বাজার। ঔপনিবেশিক কালপর্বে থেকেই এই বাজার গুলো অত্র নদীবিধৌত অঞ্চলের শস্যের প্রধান মোকাম হিসেবে গড়ে ওঠে।

ভোগাই পালিত গারো পাহাড়ের সমতলে নালিতাবাড়ী
ভোগাই: এক অনার্য নদীর গান

আটের দশক পর্যন্ত ভোগাই নদীর এপার এবং ওপারের জনমানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক যোগাযোগের একমাত্র মাধ্যম ছিলো জলপথ ও জলযান। ভরা পাহাড়ি ঢলের মরশুমে প্রায়শই নৌকাডুবি ও প্রাণহানি ছিলো নিত্য বছরের শোকাবহ ঘটনা। নয়া বৎসর উৎসব পার্বণের ও সূচি আচারে, বিসর্জনের সঙ্গী কৌলিন্য বর্জিত এই ভোগাই।

বুড়ি ভোগাই কালাকুমার পাহাড় হতে বেড়ে দিয়েছে প্রায় ১১ মাইল দৈর্ঘ্যের দক্ষিণমুখী অস্বচ্ছ  জলধারা যার নাম বুড়ি ভোগাই। ভালকাকুড়ার উত্তরে গিয়ে আবার গাঙ্গিনায় পতিত হয়েছে এই ধারা। তীরবর্তী গ্রাম কালাকুমা, কল্যাণকুড়া, তন্তর, বেলতৈল, পিঠাপুনি, শালমারা, মানিক কুড়া, বরুয়াজানি, কাঁকরকান্দি , ঝলঝলিয়া, জয়মঙ্গল, জুগলি ইত্যাদি। কাঁকরকান্দি এক জমানায় প্রচুর কাঁকর বা পাথর সমৃদ্ধ ছিলো বলে জনশ্রুতি আছে। সুতরাং ধরে নেয়া যায় বিধৌত বুড়ি ভোগাই এককালের প্রমত্তা নদী ও বন্দর অঞ্চল। এই গ্রামগুলোর কৃষিকাজ, পাড়াপাড় ও গৃহস্থালি বুড়ি ভোগাইকে আশ্রয় প্রশ্রয়ে গড়ে উঠেছিল।

বিখ্যাত দর্শা খাল বিশগিরিপাড়ায় বুড়ি ভোগাই থেকে উৎপন্ন হয়ে দক্ষিণ-পূর্ব মুখে কৈচাপুর ও শমনেরপাড়া, জিগাকান্দা গ্রামে গাঙ্গিনায় পতিত হয়েছে। অতীতের আনুমানিক দৈর্ঘ ১৩.৫ মাইল। তীরবর্তী গ্রাম বিশগিরিপাড়া, কাঁকরকান্দি, বাঘাইতলা, আমির খাঁকুড়া, পলাশতলা, ঘিলাভুঁঞ, সংরা, রান্ধুনিকুড়া, নৈয়ারিকুড়া, নলুয়া, ঘোঁষবেড়, মণিকুড়া, হালুয়াঘাট, খয়রাকুড়ি, গাঙ্গপাড়িয়াকান্দা, রঘুনাথপুর, খয়রাকুড়ি, মরাগাঙ্গকান্দা, জিগাকান্দা, কৈচাপুর ইত্যাদি।

শেরপুরের ভোগাই নদী
ভোগাই: এক অনার্য নদীর গান

ভোগবতী নদীর যৌবন আর নদী বাণিজ্য দুটোই আজ ধূসর ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতি। অন্ত্যজ শ্রেণীর সঞ্জিবনী ভোগাই ক্রমেই স্তিমিত হচ্ছে দখলে দূষণে এবং হায়েনাদের খনিজ সম্পদ বালু উত্তোলনের খননের ফলে। ভোগাই তীরবর্তী স্থলবন্দর ও তটস্থ ঝলমলে নগরের চাকচিক্যে নদীর ক্রন্দন মৃয়মাণ। প্রাচীন ভোগবতীর ভরা যৌবন, বর্ষার প্রমত্তা উজান ঢল, প্রাচুর্য ও সম্পদের উদ্ভাসিত বিভা একালের রূপকথার মতো।

তথ্যপুঞ্জি:
১। হরচন্দ্র চৌধুরী, সেরপুরের বিবরণ। দেজ পাবলিশিং , কলকাতা।
২। মজুমদার, কেদারনাথ, ময়মনসিংহের ইতিহাস, (দেজ পাবলিশিং, কলকাতা)
৩। প্রয়াত অধ্যাপক মোস্তফা কামাল (তারাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় সুবর্ণ জয়ন্তী স্মরণিকা -১৯৯৪)
৪।  সরেজমিন পরিদর্শন।

রিয়াদ আল ফেরদৌস, প্রাবন্ধিক, সম্পাদক, বালুচর সাহিত্য কাগজ।

Leave a Reply

Scroll to Top