Our Sherpur

অধ্যাপক আবদুস সালাম: একজন মাটি ও মানুষের রাজনীতিক

রিয়াদ আল ফেরদৌস
রিয়াদ আল ফেরদৌস

ভোগাই নদী বিধৌত প্রান্তিক জনপদ নালিতাবাড়ী উপজেলা বহু শতাব্দীর সংগ্রামী ঐতিহ্য বহন করে চলে। স্বাধীনতা উত্তর নালিতাবাড়ীতে জাতীয় রাজনীতির আলাপে অধ্যাপক আবদুস সালাম একটি অবিচ্ছেদ্য নাম। সীমান্ত লাগোয়া নালিতাবাড়ীর প্রত্যন্ত নয়াবিল গ্রামে বিগত শতাব্দীর তিনের দশকে জন্মগ্রহণ করেছিলেন আবদুস সালাম। তাঁর পিতা নালিতাবাড়ীর তৎকালীন ধনাঢ্য বনিক শের মামুদ সরকার।

প্রাথমিক শিক্ষা নয়াবিল গ্রামে তারপর যথাক্রমে তারাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয়, ঢাকা কলেজ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সবুজ আঙিনায় উচ্চশিক্ষ অর্জন করেন। তাঁর অগ্রজ ভাই আবদুর রাজ্জাক ছিলেন তৎকালীন স্থানীয় ইউনিয়ন চেয়ারম্যান।

ষাটের দশকে (১৯৫৯)সলিমুল্লাহ হলের ছাত্র সংসদ থেকে রাজনীতির হাতেখড়ি হয়েছিল তাঁর, তবে কর্মজীবন শুরু করেন শিক্ষকতার মতো মহান পেশায়। সুনামগঞ্জ কলেজ, জামালপুর ও গৌরিপুর কলেজে অধ্যাপনা করেছিলেন বিভিন্ন সময়ে। সালাম সাহেব স্কুল জীবন থেকেই সংস্কৃতিমনা ছিলেন এবং নাট্যমঞ্চে অভিনয় করেছেন। ব্যক্তি জীবনে সদালাপী ও মিষ্টভাষীতা তাঁর অন্যতম চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য। মুহুর্তের মাঝেই সাধারণকে আপন করে নেবার সম্মোহনী শক্তি ছিলো তাঁর মাঝে।

একজন মাটি ও মানুষের রাজনীতিক

১৯৭১ সালের শুরুতে অসহযোগ আন্দোলনের সময় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারা দেশে সর্বদলীয় সংগ্রাম পরিষদ গঠিত হলে নালিতাবাড়ীতে সালাম সাহেব সংগ্রাম পরিষদের সদস্য সচিব হয়েছিলেন। রাজনীতি সেবী আবদুস সালাম রাজনীতি চর্চায় আত্মপ্রচার বিমুখ তবে তিনি বিশ্বাস করতেন একজনের কর্মফলই রাজনৈতিক ভাগ্যোন্নয়নের সুযোগ এনে দেয়। সত্তরের দশকে তিনি জাতীয় রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে জড়িয়ে পড়েন। স্বাধীনতার প্রথম দশক ছিলো রক্তাক্ত রাজনৈতিক পালাবদলের খেলা, ভাগ্য তাঁকে নিরাশ করেনি। দ্বিতীয়, তৃতীয়, ও চতুর্থ জাতীয় সংসদে শেরপুর-২ সংসদীয় আসনে প্রতিনিধিত্ব করেছেন এবং বিভিন্ন মেয়াদে মন্ত্রিসভায় স্থান করে নিয়েছেন স্বপ্রতিভায় এবং প্রান্তিক জনপদ নালিতাবাড়ীকে পরিচিত করিয়ে দিয়েছেন জাতীয় ক্ষেত্রগুলোতে।

শিক্ষা বিস্তার, গণমুখী যোগাযোগ উন্নয়ন, তৃণমূল পর্যায়ে জনগণের আকাঙ্ক্ষার প্রতি সম্মান দেখিয়ে তাঁদের স্বপ্ন বাস্তবে রূপায়নের জন্য রাস্তা, ভোগাই নদীতে প্রথম সেতু, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান নির্মাণ করে নন্দিত হয়েছেন মানুষের কাছে। আলোকিত সমাজ বিনির্মাণে স্বপ্ন দেখতেন অধ্যাপক আবদুস সালাম। ক্রিড়া ও সংস্কৃতির নি:স্বার্থ পৃষ্ঠপোষক হিসেবে তিনি সুখ্যাতিপ্রাপ্ত।

শিক্ষাগুরু প্রয়াত নগেন্দ্র চন্দ্র পাল স্যারের স্নেহাস্পদ ছাত্র ছিলেন আবদুস সালাম সাহেব। শিক্ষাগুরুর প্রতি দেবতুল্য ভক্তি তিনি আজীবন প্রদর্শন করেছেন এবং যেদিন স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় দেশত্যাগ করে ভারতের মেঘালয়ে চলে যান অধ্যাপক আবদুস সালাম দু’নালা বন্ধুক সমেত নিরাপত্তা ব্যাবস্থা করে শিক্ষাগুরুকে সীমান্ত পাড় করে দেন। এমনই কথা শ্রী নগেন্দ্র চন্দ্র পাল তাঁর স্মৃতিকথায় লিখে গেছেন তারাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় সুবর্ণ জয়ন্তী স্মরণিকাতে।

অধ্যাপক আবদুস সালাম একজন মাটি ও মানুষের রাজনীতিক

আজীবন আওয়ামী রাজনীতির বিপরিতগামী স্রোতে রাজনীতি করা আবদুস সালাম সাহেব সারা জীবন বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপর ছিলেন বিনম্র শ্রদ্ধাশীল। ১৯৯৬ সালে সর্বশেষ তিনি জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেরপুর-২ আসন থেকে জাতীয় পার্টির প্রার্থী হয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। জাতীয় নির্বাচনে এটাই তাঁর শেষ অংশগ্রহণ ছিলো। এর মাঝে তিনি আটের দশকে স্থানীয় সরকার ব্যাবস্থা সংস্কার হলে উপজেলা পরিষদের নালিতাবাড়ীর প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন।

এরপর ভোগাই এর জল অনেক গড়িয়ে যায়, জাতীয় রাজনৈতিক মেরুকরণে তিনি বিভিন্ন সময়ে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে উঠেন। ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে জোট রাজনীতির মেরুকরণে দেশ বিভক্ত হয়ে পড়ে। ময়মনসিংহ উত্তর অঞ্চলে আওয়ামিলীগের বিরুদ্ধে জোটবদ্ধ নির্বাচনে বিএনপি নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোটের পক্ষে তিনি একাত্ম হয়ে কাজ করেন এবং রাজনৈতিক কৌশলে জয়লাভ করেন। এরপর আবার সময় বয়ে চলে, দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা , জরুরি অবস্থা, সামরিক শাসক সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার পেরিয়ে ২০০৯ সালে আওয়ামিলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতার মাধ্যমে সরকার গঠন করে।

স্থানীয় সরকার ব্যাবস্থা পুনঃ সংস্কার হলে বিলুপ্ত উপজেলা পরিষদ আবার চালু হয় এবং সারা দেশে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। নালিতাবাড়ী উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অধ্যাপক আবদুস সালাম সাহেব প্রার্থী হয়েছিলেন। তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন কৃষিবিদ বদিউজ্জামান বাদশা। নির্বাচনে অধ্যাপক আবদুস সালাম হেরে গিয়েছিলেন। এটাই তাঁর জীবনের শেষ নির্বাচন।

অধ্যাপক আবদুস সালামের বই:

আবদুস সালাম একজন মাটি ও মানুষের রাজনীতিক

জীবদ্দশায় তিনি নিজেকে জন্ম ঋন স্খলনের কজে ব্যায় করেছিলেন। তিনি প্রায়শই একটি বাক্য জনসভায় আবৃত্তি করতেন – ‘জননী জন্মভূমিষ্ঠ স্বর্গাজতি গরিয়সী’। জন্মভূমি নালিতাবাড়ীকে উপজীব্য করে দীর্ঘ তিন বছর বা বেশি সময় ধরে তথ্য উপাত্ত নিয়ে একটি গবেষণা গ্রান্থ সংকলন করেন “নালিতাবাড়ীর মাটি মানুষ এবং আমি।”

আদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে যারা নালিতাবাড়ীকে জানতে চাইবে তাদের জন্য একটি আকড় গ্রন্থ হিসেবে কাজ করবে। শেষ নির্বাচনের শেষ জনসভায় তিনি একটা শেষ ইচ্ছা ব্যক্ত করেছিলেন স্থানীয় শহীদ মিনার মাঠ মুক্তিযোদ্ধা মঞ্চে। জীবনের শেষ প্রান্তে তিনি জনগণকে সেবা করার সুযোগ দেবার আহবান জানিয়েছিলেন। তিনি নালিতাবাড়ীর মাটি ও মানুষের মাঝে শেষ নি:শ্বাস ত্যাগ করতে চান এবং এই মাটি ও মানুষ যেন তাঁর অন্তিমক্রিয়া সম্পাদন করেন সেই অনুরোধ জানান।

২০১১ সালের, ১৭ মার্চ পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করেন রাজনীতি অন্তপ্রাণ বৈচিত্র্যময় জীবনের অধিকারী অধ্যাপক আবদুস সালাম। তাঁর অনুরোধ নালিতাবাড়ীর মাটি ও মানুষ সম্মানের সাথে রেখেছিলো। আজ অধ্যাপক আবদুস সালাম প্রয়াত হয়েছেন এক যুগ পেরিয়ে গেল। তিনি নালিতাবাড়ীর ভূমিপুত্র স্মরণীয় ও বরণীয় একজন মানুষ। আঞ্চলিক উন্নয়ন, শিক্ষা, ক্রিড়া ও সংস্কৃতির তিনি সক্রিয় পৃষ্ঠপোষক ছিলেন। সময়ের প্রবাহে ধুলোমলিন হয়ে যায় স্মৃতি বিস্মৃতির ইতিহাসের ভাঙা টুকরোগুলো। অধ্যাপক আবদুস সালামের প্রয়ান দিবসে শ্রদ্ধায় স্মরণ করি তাঁর অম্লান স্মৃতি।

লেখক: রিয়াদ আল ফেরদৌস, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক

Leave a Reply

Scroll to Top