Our Sherpur

শেরপুর সোহাগপুরে নির্যাতিতা কার্ড পাবে না এইসময়ে তা হবে না

লেখকঃ মোঃ রাবিউল ইসলাম


“এহনো বেমাহের কাড অয় নাই”- কথাটা একাত্তরে সর্বস্ব হারানো বিধবা মায়ের এক অসহায় সন্তানের কণ্ঠে শুনে শিউরে উঠলাম। একটু একটু অবিশ্বাসও করলাম।
এখনো তাঁদের জন্য বিভিন্ন সুযোগ সুবিধার কার্ড পাশ হয়নি ! তবে কখন আর হবে? কেন এবং কীসের জন্য হচ্ছে না ! জানি না, তবে যাদের মহান ত্যাগের বিনিময়ে স্বাধীন দেশে সবাই স্বাধীনভাবে কাজ করে যাচ্ছি, তাঁরা সকল সুবিধা থেকে কেন এখনো বঞ্চিত থাকবে? তাও আবার জননেত্রী শেখ হাসিনা পর পর কয়েকবার ক্ষমতায় থাকার পরও। এর চেয়ে আর অবিশ্বাস্য কী হতে পারে? যে এলাকার ঘটনা সারাবিশ্ব জেনেছে সেখানে এমন হতে পারে এ প্রশ্নের জবাব কারোও জানা নেই।

প্রায় পঞ্চাশোর্ধ্ব নূর মোহাম্মদ নামের একজনের নিকট কথা বলে বিষয়টা নিশ্চিত জানতে পারলাম। উনার মা একাত্তর সালে শেরপুরের সোহাগপুর নামক স্থানে হানাদারদের নির্মম নির্যাতনের শিকার হন এবং গ্রামকে পুরুষ শূন্য করার জন্য দেড়শতাধিক পুরুষকে হত্যা করা হলে তাঁর বাবাও সেদিন শহীদ হন। তাঁর মা ফরিদা বেওয়া হারান তাঁর স্বামীকে। তিনিও হয়ে যান বিধবাপল্লির একজন। যদিও তাঁর বাবা শেরপুরের স্থানীয় লোক নন। কিশোরগঞ্জ থেকে যুদ্ধের সময় ভারতের সীমান্তবর্তী এলাকা সোহাগপুরে নিরাপদ আশ্রয়ের উদ্দেশ্যে এসেছিলেন। কিন্তু বিধাতা এখানেও তাঁদের জন্য শান্তি বরাদ্দ রাখেন নি। তাইতো স্বামী ও সর্বস্ব সম্পদ হারিয়ে এখানকার অনেকের মতো তাঁকেও ছোট্ট সন্তানদের বুকে নিয়ে নিদারুণ কষ্টে জীবনযাপন করতে হত। অনেক বছর পর জীবনের শেষপ্রান্তে এসে যখন অনেকেই সুযোগ পাচ্ছিল তখন তাঁর মনেও আশার সঞ্চার ঘটেছিলো। সন্তানরাও চেয়েছিলো মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট তাঁরা সবধরনের সাহায্য পাবে। দেড়শতাধিক বিধবার মধ্যে বেঁচে আছেন ২৬ জন। আজ প্রায় প্রত্যেকেই বয়সের সঙ্গে যুদ্ধ করে হেরে গিয়ে অচল হয়ে পড়েছেন। কেউ বিছানায় শুয়ে,কেউ হুইল চেয়ারে আবার কেউবা কোনোরকম হেঁটে চলাচল করতে করতে মৃত্যুর জন্য অপেক্ষায় রয়েছেন। তাঁদের নিজের কণ্ঠে যুদ্ধের ভয়াবহতম মুহূর্তের কথা জানতে শেরপুর জেলার পুলিশ প্রশাসন গত ৭ এপ্রিল ২০১৯ বিভিন্ন স্কুলের ছাত্রীদেরকে সোহাগপুর বিধবাপল্লীতে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করেন। এতে জেলার ৫টি স্কুলের ২১ জন শিক্ষার্থী অংশগ্রহণ করে। প্রত্যেকের নিকট নির্মম নির্যাতনের ঘটনা শুনতে গিয়ে অনেক ছাত্রী তাদের অশ্রু সংবরণ করতে পারেনি। এসময় কথোপকথনের সুবিধার্থে সকল পুরুষকে তাদের নিকট থেকে দূরে সরিয়ে দেওয়া হয়। শেষ বয়সে এসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নিকট থেকে একটা চমৎকার ঘর উপহার পেয়ে তারা কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন। বর্তমানে তাদের পল্লির সার্বিক সমস্যা নিয়ে তারা সরাসরি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলে জীবনের শেষ ইচ্ছে পুরণ করতে চান। তাঁদের মতে, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী একটু সদয় হলেই তাঁদের আশা পূর্ণ হতে পারে।

বিধবা নারীরা
সোহাগপুরের বিধবা নারীরা

আমারও বহুদিনের ইচ্ছে ছিলো অনেক আলোচিত এই বিধবা পল্লীতে একদিন অবশ্যই যাব। হঠাৎ করেই সেদিন সেই সুযোগটা পেয়ে গেলাম। আমাদের স্কুলের অধ্যক্ষ মাহবুবুর রহমান স্যার আমাকেও উপাধ্যক্ষ ম্যাডাম এবং ছাত্রীদের সঙ্গে যেতে বললেন। আমি সানন্দে যেতে রাজি হলাম। শেরপুর থেকে নকলা এবং নালিতাবাড়ি হয়ে গেলে প্রায় চল্লিশ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করতে হয়। সামনে এবং পেছনে পুলিশের গাড়ির সাথে ছাত্রীদের নিয়ে এক নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করতে সাহায্য করায় আয়োজকদের আন্তরিক ধন্যবাদ না দিলে অবশ্যই কার্পণ্য করা হবে। আমাদের সাথে সহকারী পুলিশ সুপার আমিনুল ইসলাম এবং জাহাঙ্গীর আলম সহ আরো অনেক কর্মকর্তা ছিলেন। অনুষ্ঠানে এলাকার চেয়ারম্যান , সরকারি বালিকা বিদ্যালয়ের একজন ছাত্রী এবং জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নাসরিন রহমান বক্তব্য রাখেন। বক্তব্যে তিনি গণহত্যায় বিধবাগণকেও মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মূল্যায়ন করেন এবং যেকোনো সমস্যায় তাঁর শরণাপন্ন হওয়ার আহ্বান জানান। জেলা মহিলা আওয়ামী লীগের সম্পাদিকা হিসেবে জনাব নাসরিন রহমানের নিকট ১৩ জন বিধবার সুযোগ বঞ্চিত থাকার কারণ জানতে চাইলে তিনি তিনি জানান, প্রশাসনের সঙ্গে আলোচনা করে জানা গিয়েছে খুব দ্রুতই সবার হাতে সরকারি সুযোগ সুবিধার কার্ড পৌঁছে যাবে। যদিও তাঁরা বিভিন্ন বেসরকারি এনজিও কর্তৃক সুবিধা পাচ্ছে তথাপি বাংলাদেশের সর্বস্ব সম্পদ হারানো এসব মানুষ সরকারি সুবিধা পাবে এটাই সবার চাওয়া।

গণকবরে উনসত্তর জনের নাম এবং অসহায় বিধবাদের হৃদয়বিদারক বর্ণনা গ্রহণের স্মৃতিময় ক্ষণ সকল শিক্ষার্থী এবং উপস্থিত সকলের মনেই গেঁথে থাকবে ।

কোনো দেশে কোনো অবস্থাতেই এমন গণকবর না হোক , না হোক কেউ সর্বস্ব সম্পদ হারিয়ে বিধবা এবং পিতা-মাতা হারিয়ে অসহায়।

মহান আল্লাহ্ বাংলাদেশের তথা বিশ্বের সকল শহীদ ও বীরাঙ্গনাদের জন্য সর্বোত্তম ব্যবস্থা রাখুন, এটাই হোক আমাদের প্রত্যাশা।

Leave a Reply

Scroll to Top