Our Sherpur

টাউন শেরপুরে রবীন্দ্রজয়ন্তী

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

টাউন শেরপুরে রবীন্দ্রজয়ন্তী

”গত শতকের দু’য়ের দশকের শেষের দিকেই মূলত এই শেরপুর পরগণায় নতুন রাজনীতি মাথা চাড়া দিয়ে ওঠে। এই রাজনীতি সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবাপন্ন তৎপরতার ভেতর গড়ে ওঠা প্রগতিশীল রাজনৈতিক চর্চা ও তার নানামুখী তৎপরতা।

একদিকে ক্ষয়িষ্ণু সামন্ততন্ত্রের ভেতর কলকাতাকেন্দ্রিক শিক্ষার আলো বাতাসে বেড়ে ওঠা জমিদার তনয়দের কংগ্রেস গঠন ও সর্বভারতীয় কংগ্রেসের রাজনৈতিক কর্মসূসি বাস্তাবায়নের জন্য আন্দোলন সংগ্রাম, অন্যদিকে সাম্যবাদে দীক্ষিত তরুণ শিক্ষিত প্রজন্ম ও তালুকদার পিতার বিদ্রোহী সন্তান শোষণ-মুক্ত সমাজ গড়ার জন্য কম্যুনিস্ট পার্টি গঠন ও নানামুখী আন্দোলন সংগ্রাম চালাবার জন্য লড়াকু শক্তির আত্মপ্রকাশ ঘটে।

Products list of Our Sherpur
শেরপুর জেলার যেসব পণ্য আওয়ার শেরপুর এ পাওয়া যায়।

টাউন শেরপুর তিনের দশক থেকেই এই দুই ভাবার্দশে বিভক্ত হয়ে পড়ে—ব্যক্তি থেকে পরিবারে। আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ে নালিতাবাড়ি, নকলা, শ্রীবর্দী ও ঝিনাইগাতি অঞ্চলের গারো, কোচ, হদি সম্প্রদায়ের ভেতর। টংক তেভাগা আন্দোলনের ভিত প্রান্তিক অঞ্চলে এই সময়ে আস্তে আস্তে শক্ত মাটির উপর দাঁড়াচ্ছে।

জেল জুলুম মামলা হামলা কারণে রাজনৈতিক কর্মসূচি যখন পালন করা সম্ভব হচ্ছিল না, তখন সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে জনসংযুক্তার পরিসর বাড়াবার জন্য তরুণ কমিউনিস্ট নেতৃবৃন্দ রবীন্দ্রজয়ন্তী কথা ভাবতে শুরু করে। রবীন্দ্রনাথের নোবেল পাবার পর ও দু’য়ের দশকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ময়মনসিংহে ভ্রমণের পর ধীরে ধীরে এই উত্তর জনপদে রবীন্দ্রচর্চার মাঠ প্রস্তুত হতে থাকে। প্রাগ্রসর ময়মনসিংহ, নেত্রকোণা ও কিশোরগঞ্জ এগিয়ে থাকলেও, জামালপুর, শেরপুরে তখনো রবীন্দ্রচর্চা শুরু হয়নি। জমিদার ও উচ্চকোটির মানুষ শতরঞ্জি বিছিয়ে বৈঠকি গানের চল ছিল—ছিল নাটকচর্চা প্রশস্ত চাতাল।

গানের সুধা সকলের জন্য অবারিত ছিল না। প্রবেশাধিকার সংরক্ষিত ছিল। তবে বৈষ্ণব লোকাচারের প্রভাব বলয়ের কারণে রাধাকৃষ্ণের পালাগান ও পদাবলী দোল পূর্ণিমায় তিন বাড়ির প্যারীমোহন মন্দিরে অনুষ্ঠিত হতো বছর বছর। ভক্তের জন্য দ্বার উন্মোচিত। জমিদার রায় বাহাদুর রাধাবল্লভ চৌধুরী ছিলেন গৌরীয়ধারার বৈষ্ণব। লিখেছেন, ‘হরিনাম’ ‘নিকুঞ্জ রহস্য গীতিকা’ ও ‘রাগানুরাগদীপিকা’।

এমনিতেই শেরপুরে সাংস্কৃতিক চর্চার জমিন কর্ষিতই ছিল। নয় আনি বাড়ির আঙিনা থেকে শুরু করে পৌন তিন বাড়ির প্রশস্ত লাইব্রেরি উদ্যান পর্যন্ত নাট্য মঞ্চায়নের দাপট, অন্যদিকে জমিদারি আঙিনা বাদ দিয়ে টাউন শেরপুরে দলবদ্ধভাবে একে একে গড়ে ওঠেছে—‘সুহৃদ নাট্য সমাজ’ ‘বীনাপানি নাট্য সমাজ’, সাত আনি পাড়ায় ‘হিরোজ’, নালিতাবাড়ির ‘আর্য্য নাট্য গোষ্টি’র সাংবাৎসরিক কার্যক্রম ক্রমেই বেড়ে চলেছে। কেননা সে সময় নাটকই ছিল এই তল্লাটের বিনোদনের একমাত্র ভরসা।

অন্যদিকে, সাহিত্যচর্চার চাতাল তখন আরেকটু বিস্তার ঘটে গেছে দুই দুইটি প্রেসের কল্যাণে। আবার নাটক ও পত্রিকা প্রকাশ ছাড়াও, দেড় আনি বাড়ির জমিদার তনয় দেবেন্দ্রনাথ চৌধুরীর চিত্রাঙ্কন ও সেতার বাদনে এই অঞ্চলে উজ্জ্বল মুখ ছিলেন। ছিলেন পাঁচু রায়, যিনি ‘ক্যানভাসে ফুটিয়ে তুলতেন অপরূপ আলেখ্য।’

রবীন্দ্রজয়ন্তী
২৫শে বৈশাখ রবীন্দ্রজয়ন্তী

এই সময়ে টাউন শেরপুরে নাট্য আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব মোহিনী মোহন বল ছাড়াও ছিলেন—গনেশ বর্ন্ধন, মনি দাস, ঠাকুর দাস, দীনেশ ভট্টাচার্য-সহ আরো অনেকেই। এই ‘সুহৃদ নাট্য সমাজে’ অভিনয় করেই পৌন তিন বাড়ির জমিদার তনয় শ্রীপতি চৌধুরী৩ কলকাতা সিনেমা জগতে জড়িয়ে পড়ে পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে কয়েকটি সিনেমায় গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকায় অভিনয় করে সুনাম অর্জন করেন।

কাজে কাজেই এমন একটা সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে ‘১৯৩৭ সালে রাজবন্দিরা মুক্তি পেয়ে শেরপুরে একে একে ফিরে আসেন। ১৯৩৮ সালে রাজনৈতিক আন্দোলনের অংশ হিসেবে সাংস্কৃতিক কার্যক্রম হিসেবে ভাবতে গিয়েই রবীন্দ্রজয়ন্তীর কথা ভাবতে থাকেন জিতেন সেন।’

জিতেন সেন দু’য়ের দশকের শেষের দিকে বেড়ে ওঠা একজন রাজনৈতিক কর্মী। তিনি জি কে পি এম স্কুল থেকে বাংলায় সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে ম্যাট্রিকুলেশন পরীক্ষায় পাস করে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে পেলেন সোনার পদক ও স্কুলের পক্ষ থেকে একটি রৌপ্য পদক।

ঠিক এই সময়ে শেরপুরে আসেন নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু। তখন শেরপুর টাউন কংগ্রেসের সভাপতি ছিলেন দেড় আনি জমিদার শৈলেন্দ্রকুমার চৌধুরী। ১৯৩৮ সালে সুভাষ চন্দ্র বসু জানুয়ারির মাসে হরিপুর সন্মেলনে কংগ্রসের সভাপতি নির্বাচিত হবার কিছুদিন পরই শেরপুর সফরে এলে তাকে যে সংবর্ধনা দেয়া হয়, সে সংবর্ধনা কমিটির কনিষ্ট সদস্য ছিলেন জিতেন সেন।

জিতেন ১৯৩৮ সাল জেল থেকে ফিরে আসেন নতুন মতাদর্শ নিয়ে—মুক্তি পেয়ে কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন। সে সময়ে অনেকেই কংগ্রসের রাজনৈতিক ব্যানারে থেকে মূলত বিপ্লবী রাজনীতির তৎপরতার সাথে যুক্ত ছিলেন—রাজনৈতিক রণকৌশল হিসেবে। জিতেন সেনেরা সেই কৌশলই নিয়েছিলেন। ‘একদিকে স্বাধীনতা জন্য কাজ করা, অন্যদিকে সর্বহারা জনগণের মুক্তির জন্য শ্রমিক কৃষকদের শ্রেণি সংগঠন ও বিপ্লবী রাজনীতি করার জন্য পরিসর গ্রামে গ্রামে গড়ে তোলা।’২

জিতেন তাঁর রাজনৈতিক জীবন কংগ্রেস দিয়ে শুরু করলেও, জেল থেকে ফিরে সুভাষ বসুর সংবর্ধনার পর সামন্ততন্ত্রের সংশ্রব ছেড়ে কংগ্রেস ছেড়ে প্রকাশ্যে যুক্ত হন কম্যুনিস্ট পার্টিতে। এবার তিনি সাথে পেলেন এই অঞ্চলের বাঘা বাঘা কম্যুনিস্ট নেতা কর্মীদের। অগ্রজ রবি নিয়োগী, জলধর পাল, মন্মথ দে-সহ তার সমসাময়িক নেতাকর্মী পরেশ গুপ্ত, সন্তোষ দাশগুপ্ত, ছবি রায়, প্রমথ গুপ্ত , হেমন্তকু্মার ভট্টাচার্য, মণি চক্রবর্তী, বিমল ভট্টাচার্য-সহ প্রমুখ।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর
বিশ্ব কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

এমন একটা প্রেক্ষাপটে জিতেন সেনেরা সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মোড়কে জনসংযুক্তির জন্য রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজনে উদ্যোগী হলেন। গঠিত হলো উৎসব কমিটি। গান আবৃত্তি নির্বাচন ও শিল্পীদের মাঝে চলছে রিহার্সাল। গান আবৃত্তি রিহার্সালে ছিলেন অরুণা দাস, উমা নাগ, মাধুরী নাগ ও রমা বসু। রবীন্দ্রচর্চা সম্পর্কে জিতেন সেন লিখেছেন, ‘মোহিনীমোহন বল শুধু সুঅভিনেতাই ছিলেন না, গানও গাইতেন এবং ক্লারিও নেট বাজাতেন। খুব ভালো গায়ক না-হলেও, তিনিই বোধ হয় প্রথম শেরপুরের আসরে রবীন্দ্রসঙ্গীত গাওয়া শুরু করেন। রবীন্দ্র সাহিত্যানুরাগী ব্যক্তির সংখ্যা খুবই কম। রবীন্দ্র সঙ্গীতেরও প্রচলন ছিল অতি সামন্য।২

এর আগে টাউন শেরপুরে রবীন্দ্রজয়ন্তী হয়নি। জামালপুরেও হয়নি। ময়মনসিংহ-সহ অন্যান্য বধিষ্ণু অঞ্চলে রবীন্দ্রজয়ন্তী পালনের সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। যদিও এমন অনুষ্ঠান হবার পরিসর দীর্ঘদিন ধরেই শেরপুরে হাজির ছিল।

রবীরশ্মির প্রভাব ১৯১৩ নোবেল পুরস্কার পাবার পর পরই বঙ্গদেশের সর্বত্র দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। শেরপুরের মতো একটি সামন্ততান্ত্রিক পরগনার ভেতর যেখানে সাহিত্যচর্চা ও পত্রিকা প্রকাশের মতো নানা কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল, সেখানে রবীন্দ্রসৌরভ এসে পৌঁছায়নি ভাবতে কষ্ট হয়। এখানে তখন সাহিত্যানুরাগী নেহাতই কম নয়। প্রকাশিত হয়ে গেছে অনেকের কাব্যগ্রন্থ উপন্যাস-সহ ইতিহাসচর্চার বইপত্র—এমন কী আরবি ফারসির বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করে ফেলেছেন মৌলবী বসিরুদ্দিন ও মৌলবী ওয়েজ উদ্দীন।

এখানকার বিভক্ত জমিদার পরিবারগুলো যে শুধু শরীকী হিস্যা নিয়ে মামলা মোকাদ্দমা নিয়েই লিপ্ত ছিল, তা তো নয়। মামলা ছিল জমিদারবর্গদের প্রাত্যহিক প্রশাসনিক ঘটনা। ছিল খাজনা আদায়, ছিল বিদ্রোহী দমনের দাপটের সাথে সাথে নিজেদের আভিজাত্যের বজায় রাখবার জন্য পারিবারিক ঐতিহ্য ও অহংকার।

সর্বেপরি কী নয় আনী তিন আনি বা পৌনে তিন বা আড়াই কিংবা দেড় আনি জমিদারদের পারিবারিক শিক্ষা-দীক্ষা সাংস্কৃতিক রুচি কোনো অংশেই কমতি ছিল না—সামন্ত এই পরিবারেগুলোতে। জমিদার পরিবারগুলোর কোনো-না-কোনো সন্তান দেশ কিংবা দেশের বাইরে নিজস্ব মেধার স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। তিন আনি জমিদার তনয় বনোয়ারী লাল চৌধুরী উনিশ শতকের শেষের দিকে এডিনবারা বিশ্ববিদ্যালয় ডিএসসিও এডিনবারা রয়েল সোসাইটির ফেলো ছিলেন। ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের সহ-সভাপতি।

তবু কেন রবী আলো এই পরগনায় এসে পৌঁছায়নি? রবীন্দ্রনাথচর্চা ও তাঁর জয়ন্তীর জন্য অপেক্ষা করতে হলো ১৯৩৮ পর্যন্ত? জিতেন সেন তাঁর স্মতি কথায় লিখেছেন, ‘১৯৩৫ এল শেষের দিকে রবীন্দ্রনাথের আর্শীবাণী নিয়ে ‘কল্পনা’ নামে হাতে লেখা একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করেন।’২ দীর্ঘস্থায়ী হয়নি তরুণদের এই হাতের লেখা পত্রিকা প্রকাশ। হাতে লেখা এটিই টাউন শেরপুরে প্রথম সাহিত্য পত্রিকা। সেখানে লিখেছেন—পরেশ গুপ্ত, জীবনবল্লভ চৌধুরী, ছবি রায়, সন্তোষ দাশগুপ্ত প্রমুখ। ১২/১৪টি সংখ্যা প্রকাশিত হবার পর বন্ধ হয়ে যায়।

জ্যোতি পোদ্দার
লেখক: জ্যোতি পোদ্দার

যখন জিতেন সেন পার্ষদ রবীন্দ্ররজয়ন্তী উৎসব করার জন্য নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছেন, চলছে রিহার্সাল ও চাঁদা সংগ্রহ, ঠিক তখনই তারা জানতে পারলেন, ‘তিন আনি বাড়ির জমিদার তনয় জীবনবল্লভ চৌধুরী ও তাঁর কতিপয় বন্ধুর উদ্যোগে আরো একটি রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠানের আয়োজন চলছে।’

সংকটে পড়ে গেলেন জিতেন সেনেরা। ‘একই শহরে একই সময়ে দু’টি অনুষ্ঠান হবে জেনে আমাদের কেমন অস্বস্তি বোধ হলো। আমরা চেষ্টা করলাম দুই পক্ষ মিলে-মিশে একটি অনুষ্ঠান করার। কিন্তু সফল হলো না।’

রবীন্দ্রজয়ন্তীকে আর্বত করে একদিকে ক্ষমতাসীন শাসকবর্গের উদ্যোগ, অন্যদিকে দলবদ্ধ তরুণদের কর্মতৎপরতা। নিশ্চয় সে সময় টাউন শেরপুরে আলোচনার বিষয় হয়ে থাকবে। এই অঞ্চলে যা কিছু প্রথম তা কোনো-না-কোনো জমিদারদের প্রযত্নেই হয়েছে। কাজে কাজেই নোবেল লোরিয়েট বিশ্বকবির খেতাবপ্রাপ্ত কবির জন্মদিন পালনকে কেনই-বা সামন্ততান্ত্রিক জমিদার হাতছাড়া করবেন? কেননা জমিদার তনয় জীবনবল্লভ ও জীতেন সেনরা যৌথভাবেই সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করেছিল। ছিলেন ইয়ার দোস্ত।

দ্বিতীয় উদ্যোগটি নেয়া হয়েছে—তিন আনি অংশের জমিদার বর্গের পক্ষ থেকে জীবন বল্লভ চৌধুরীর প্রযত্নে। জীবন চৌধুরী শেরপুর গরগনায় জমিদার পরম্পরায় একজন গুণি মানুষ। এমএ পাশ, পিএইচডি করেছেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে, পেয়েছেন সাহিত্যরত্ন উপাধী। পিতামহ রাধাবল্লভ চৌধুরী রায় বাহাদুর খেতাবে ভূষিত।

জীতেনদের প্রযত্নে রবীন্দ্রজয়ন্তী হবে শুনে নিশ্চয় জমিদার তনয়ের ইগো আক্রান্ত হয়েছিল। নইলে কেনই-বা ভাঙন? যদিও শ্রেণিস্বার্থ দুই তরুণের বিপরীতমুখী।

কাজে কাজেই দাপটের প্রভাব কম নয়। একদিকে সামন্তশ্রেণি, অন্যদিকে গণতান্ত্রিক ভাব-ভাবনায় বেড়ে ওঠা একঝাঁক তরুণ। তাও আবার বৈপ্লবিক রাজনৈতিকচর্চা করে কেউ কেউ তখন কালাপানির উপারে আন্দামানে। সাম্যবাদের ভাবাদর্শ জারি তখন তরুণদের মাঝে। কেউ সদ্য ছাড়া পাওয়া পাড় কম্যুনিষ্ট। এদের তাপ ও চাপ নিশ্চয় কম ছিল না। নানা আলাপচারিতার ভেতর ঠিক হলো, ‘উভয় অনুষ্ঠানই হবে, তবে একই দিনে নয়। আলাদা দিনে।’

দুই পক্ষই জোড়কদমে চালাচ্ছে রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব পালনকে সফল করে তোলার জন্য নানা কার্যক্রম। জীবনবল্লভ চৌধুরীর প্রযত্নে আয়োজিত জয়ন্তী উৎসবের সভাপতিত্ব করেন ইতিহাসবিদ সাহিত্য সমালোচক ও শিল্পকলা গবেষক নীহার রঞ্জন রায় (১৯০৩-১৯৮১)। আর দু’দিন পর জিতেন সেনদের রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসবে এলেন আচার্য ক্ষিতিমোহন সেন (১৮৮০-১৯৬০), সভাপতি হিসেবে নয়, বরং প্রধান অতিথি হিসেবে।

নাগ পাড়ার যোগেশ চন্দ্র নাগের আমন্ত্রণেই এসেছিলেন ক্ষিতিমোহন সেন। ক্ষিতিমোহনের বন্ধুজন যোগেশ চন্দ্র নাগ। তিনি ভারতীয় মধ্যযুগের সাধনার ধারা (১৯৩০) বইয়ের লেখক। বন্ধুর বাড়িতে বেড়াতে আসার সুযোগটা জিতেন সেনেরা গ্রহণ করেন। পৌনে তিন আনি বাড়ির জয়কিশোর লাইব্রেরি চাতালেই অনুষ্ঠিত হয়—এই দলের রবীন্দ্রজয়ন্তী। সম্ভবত এই বাড়ির জমিদার সাহিত্যিক সত্যেন্দ্র মোহন চৌধুরী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন।

আর জীবনবল্লভ চৌধুরীর অনুষ্ঠানটি হয় আড়াই আনী বাড়ীর বিশাল মণ্ডপে। এই অনুষ্ঠানে সভাপতি নীহার রঞ্জন রায়ের ‘ওজস্বিনী ভাষায় বক্তৃতা সুধী সমাজের প্রশংসা লাভ করেন।’ অন্যদিকে, ক্ষিতিমোহন সেন প্রধান অতিথি হিসেবে ‘আলাপের ভঙ্গিতে কথকতার ঢঙে সুললিত ভাষায় রবীন্দ্র জীবন ও সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোকপাত করেন।’

টাউন শেরপুরে ১৯৩৮ সালে এটি একটি অনন্য ঘটনা। একই বছরে দুই মূল্যবোধ দ্বারা তাড়িত দুইটি গোষ্ঠি দুই দুইটি রবীন্দ্রজয়ন্তী দিয়ে শেরপুরে রবীন্দ্রনাথকে বরণ করে নিলো। জীবন চৌধুরীর আমন্ত্রিত ছিল ‘সমাজের বিত্তবান প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তি ও শিক্ষিত সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ।’ অন্যদিকে, জিতেন গংদের আয়োজিত অনুষ্ঠানে ‘আমন্ত্রিত ছিল সকলেই—ধনী দরিদ্র শিক্ষিত আধা-শিক্ষিত সবাই।’ দেশভাগের আগ পর্যন্ত, জিতেন লিখেছেন, ‘প্রতি বছরই রবীন্দ্রজয়ন্তী উৎসব হতো।’

ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তরে শেরপুর দক্ষিণে জামালপুর। কাছাকাছি সময়ে জামালপুরও রবীন্দ্রজয়ন্তী শুরু হয়। জিতেন সেনদের উদ্যোগে। সেখানেও পৌরহিত্য করেন ক্ষিতিমোহন সেন। বাল্যবন্ধু যোগেশ নাগের বাড়িতে ক্ষিতিমোহন ফি বছরই আসতেন। সেই বেড়াবার সুযোগটিই তরুণগোষ্ঠি কাজে লাগায়।

যদিও ঘটনাটি জামালপুরের। এখানে উল্লেখ করা অপ্রাসঙ্গিক হবে না। সময় ১৯৪১ সাল। সিংজানি স্কুলের রবীন্দ্রজয়ন্তী অনুষ্ঠান। জীতেন লিখেছেন, ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলছে। আমাদের অধিকাংশ বন্ধুবান্ধবের উপরই তখন ভারত রক্ষা আইন অনুযায়ী নিষেধাজ্ঞা ও স্বগৃহে অভ্যন্তরীনাদেশ জারী করা হয়েছে। সভা মিছিলে যোগদান ও বক্তৃতা করা নিষেধ। …আমরা ভাবলাম রবীন্দ্রজয়ন্তী তো সভা নয়, একটা উৎসবমাত্র।… তাই আমি আশু দত্ত ও অধীর বাবু—এই তিনজন নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে সঙ্গীত ও প্রবন্ধপাঠে অংশ গ্রহণ করলাম। …দিন দশেক পর আমাদের তিনজকে গ্রেফতার করে জামালপুর জেলে আটক রেখে পুলিশ ভারতরক্ষা আইন লঙ্ঘনের দায়ে আমাদের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করল।’

জিতেন সেন আর লিখেছন, ‘বিচারে প্রত্যেককে আটমাস সশ্রম কারাদণ্ডে দণ্ডিত হয়।’ ঘটনাটি ছিল নজীরবিহীন। পরবর্তী সময়ে জেলাজজ কোর্টে তাদের কারাদণ্ড মওকুফ হয়ে এক টাকা করে অর্থদণ্ডের আদেশ দেয়া হয় এবং জনৈক অ্যাডভোকেটই জরিমানার সে টাকা কোর্টে জমা দিয়ে দেন এবং আমরা মুক্তি পাই।’

রবীন্দ্রনাথ বাঙালির মনোভূমি নির্মার্ণের আধুনিক কারিগর। বাঙালির জীবন ও যাপনের এক অবিচ্ছেদ্য সত্তা। মানুষ তাঁর মুক্তির ভাষ্য ভাষা দিয়ে ভাষার ভেতরই গড়ে তোলে। যে ভাষার গতিশীলতা যত প্রবল সে ভাষা তত ধনী।

বাংলা ক্ষমতার দাপটের মুখে বেড়ে ওঠা ভাষা। বাংলার দেহে-মনে যে চেতনা উন্মুখ হয়ে আছে। রবীন্দ্রনাথে সেই মুখে এনেছে স্রোতের ধ্বনিগুচ্ছ।

ভাষীক জীব হিসেবে বাংলা ভাষাভাষি বাঙালির অগ্রগতি ভাষার চাতালে রয়েছে প্রশস্ততার পরিসর। ভাষা ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক প্রবহমান নদীধারা। নদীর নাব্যতা যেমন শারীরিক শ্রীবৃদ্ধি করে, তেমন ভাষার নাব্যতা মানবিক অর্জনে জীবনের শ্রীবৃদ্ধি।

রবীন্দ্রনাথ আমাদের সেই পরিসর নির্মাণ করে দিয়ে গেছে, তাঁর কবিতা গান উপন্যাস—এমনকি তাঁর যে বিশাল দার্শনিক প্রবন্ধাবলী রয়েছে—তার পরতে পরতে রয়েছে মানুষ হিসেবে শক্ত পায়ে দাঁড়াবার ভিত্তি।

দেশভাগ-পূর্ব এই জনপদের তরুণেরা যে উদ্যোগ নিয়ে রবীন্দ্রচর্চার বীজ বপন করে গেছেন, তার ধারাবাহিকতা রক্ষা করাই অগ্রজের প্রতি যথাযথ সন্মানপ্রদর্শনের একমাত্র পথ। কেননা রবীন্দ্রসমুদ্রে আমাদের অবগাহন করেই আগামীর পথ নির্মাণ করতে হবে। বাংলা ভাষা ও রবীন্দ্রনাথ এক সূত্রে গাঁথা।”

প্রথম প্রকাশ- শুভ বাংলাদেশ।

তথ্যসূত্র
১. দিবা-স্বপ্ন : জীবনবল্লভ চৌধুরী।/ সেরপুর মিলনমেলা, সম্পাদক : কল্পনা ধর, ১৯৮৯
২. সেরপুরে রবীন্দ্রজয়ন্তী : জিতেন সেন।/ সেরপুর মিলনমেলা, সম্পাদক : কল্পনা ধর, ১৯৯০
৩. আমার স্বপ্নের সেরপুর : শ্রীপতি চৌধুরী।/ সেরপুর মিলনমেলা, সম্পাদক : কল্পনা ধর, ১৯৮৯

Leave a Reply

Scroll to Top