Our Sherpur

সূর্যদ্দী গণ হত্যা শেরপুর।। ক্যাপ্টেন মোঃ রফিকুল ইসলাম

ক‍্যাপ্টন (অবঃ) মোঃ রফিকুল ইসলাম

২৪ নভেম্বর, ১৯৭১ সালে সূর্যদ্দী গ্রামের নিরীহ ৪৯ জন নারীপুরুষকে নির্মম ভাবে হত্যা ও প্রায় ২০০ বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয় পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসরা।
১৯৭১ সালের নভেম্বর মাস। দেশ স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে। পাকবাহিনীরা পথ খুঁজছে কীভাবে মুক্তিবাহিনীদের প্রতিহত করা যায়। তাই ঐ সময় তারা নির্যাতনের মাত্রাও বাড়িয়ে দেয়। লোক দেখলের ইট টানানোর জন্য বাংকার এলাকায় নিয়ে যায়। ভয়ে সাধারণ মানুষও শহর মুখী হয় না।
আমরা মুক্ত এলাকায় ছিলাম বলে আমাদের চর এলাকায় শত শত মুক্তিযোদ্ধা আশ্রয় নিয়েছিল। আমরা তাদের খাবেরের ব্যবস্থা করতাম। ঘরে ঘরে ভাগ করে খাওয়াতাম। আমাদের নদীতে জেলেরা প্রচুর মাছ ধরতো। তারাও প্রতিদান মুক্তিযোদ্ধাদের খাবারের মাছ সরবরাহ করতো।

২৪ নভেম্বর সকাল ০৮০০টার দিকে আমরা কজন জেলেদের কাছ থেকে মাছ আনার জন্য মৃগী নদীতে গেছি। এমন সময় হঠাৎ গুলির আওয়াজ। এলএমজির বার্স্ট ফায়ার। ভীমগন্জ থেকে এক কিলোমিটার দক্ষিনে মৃগী নদীর ওপারে আমাদের বাড়ি। প্রথমে ধারণা করলাম ভীমগন্জ ঠাকুরবাড়ি আক্রান্ত হয়েছে। তখন আমাদের চর এলাকায় বিশেষকরে চর জংগলদী, বেতমারী, ফটিয়ামারী, চরখারচর ও প্রত্যন্ত এলাকার সকল মুক্তিযোদ্ধা নদী পার হয়ে ভীমগন্জের দিকে অগ্রসর হতে থাকে।

পরে লোকমুখে শুনতে পারি পাক হানাদাররা সূর্যদ্দী গ্রাম আক্রমণ করেছে। ততক্ষণে আগুনের লেলিহান শিখা ও মানুষের আর্তচিৎকার চারিদিক ছড়িয়ে পড়েছে।শুনলাম সূর্যদ্দী বড়বাড়ি, দেওয়ানবাড়ি ও কিরসাবাড়ির প্রায় ২০০ বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। স্থানীয় কয়েকজন রাজাকারের সহায়তায় এই আক্রমণ হয়। সে সময় মুক্তিযোদ্ধা সেহরাব আলী, আঃ খালেক, ফজলুর রহমান, মমতাজ উদ্দিন ও আবুল হোসেন সহ অনেক মুক্তিযোদ্ধা সেখানে অবস্থান করছিল।
প্রথমে মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিহত করার চেষ্টা করলে খুনুয়া চরপাড়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা আফসার আলী শহীদ হন। আশেপাশের চর এলাকার গ্রাম থেকে জড় হওয়া মুক্তিযোদ্ধারা প্রতিআক্রমণ করতে চাইলে অনেকে নিষেধ করেন। কারণ এতে জানমালের ক্ষয়ক্ষতি অনেক বেড়ে যাবে। প্রায় দুইঘন্টা নির্মমতার পর হানাদার বাহিনী ট্রাকে করে শেরপুর ফিরে যায়।
তারপর শুরু হয় প্রিয়জনদের খোজাখুজি। বাড়ির আশপাশেরর জঙ্গলে, ধানখেতে খুজে মোট ৪৯ জনের লাশ পাওয়া যায়। প্রায় ২০০ বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। স্বাধীনতার মাত্র ২২ দিন পূর্বে এ নারকীয় হত্যাকান্ড ঘটে। মুহূর্তে ধ্বংশ হয়ে যায় সাজানো গোছানো সূর্যদ্দী গ্রাম।

স্বাধীনতার পর প্রতিবছর এদিনটি স্মরণ করা হতো ৭৫ এর আগ পর্যন্ত। এখন দিনটি পালিত হয়কিনা আমার জানা নেই। দীর্ঘ ৩৫ বছর আমি শেরপুরের বাইরে ছিলাম। আমার ধারণা নিশ্চয় শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করা হয়।

খুনুয়ার বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ আফসার আলীর কবরটি আমি অনেকবার দেখেছি।অযত্নে অবহেলায় পরে ছিল। সরকারী ভাবে তাঁকে স্মরণে রাখার জন্য কিছু করা হয় কিনা জানিনা। শুনেছি ময়মনসিংহ এর ডাঃ হেফজুল বারী সাহেব কবরটি পাকা করে দিয়েছেন এবং রাস্তার পাশে একটি সাইন বোর্ড টাঙিয়ে দিয়েছেন।

বছর ঘুরে আবার সেদিনটি ফিরে এসেছে, আসুন আমরা সেদিনের বীর শহীদ মুক্তিযোদ্ধা আফসার আলী সহ ৪৯ জন শহীদদের আত্মার মাগফেরাত কামনা ও শ্রদ্ধা নিবেদন করি। সে সাথে অসম্ভব সুন্দর বাংলাদেশেরর জন্য আত্মাহুতি দেয়া সকল বীরদের শ্রদ্ধা জানাই। আসুন আমরা নিরলস ভাবে কাজ করে দুর্নীতিমুক্ত সেনার বাংলা গড়ি। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখকঃ ক্যাপ্টেন মোঃ রফিকুল ইসলাম, (অবঃ) সেনা শিক্ষা কোর।

Leave a Reply

Scroll to Top