তুলশীমালার জমিদারি
বহুবছর আগের কথা। গারো পাহাড়ের পাদদেশে গড়ে উঠেছিলো এক রাজ্য। দশকাহনীয়া নামের সেই রাজ্যের রাজধানী ছিল গড়জরিপা। সেই রাজ্যের জমিদার হলেন শের আলী গাজী। তিনি রাজ্যের নতুন নাম রাখলেন শেরপুর।
অনেকবেশি প্রজাদরদি ছিলেন এই জমিদার। তাঁর প্রজারা আবাদ করতো সুগন্ধি তুলশীমালা ধান। সাধারণ বর্গাচাষিরাও তুলশীমালা চালের ভাত খেতো। শের আলী তাঁর চাষীদের নিয়ে খুব অহংকার করতেন। কিন্তু সমাজের উঁচুজাতের মানুষের চোখে বিষয়টা ভালো লাগলো না। সাধারণ প্রজারা কেন সুগন্ধি চালের ভাত খাবে?
প্রান্তিক চাষিরা সেরাটা উৎপাদন করলেও তাদের সেটা ভোগের অধিকার নেই। শের আলীর পরগণায় যে এর ব্যতিক্রম চলছে! এটা কীভাবে মানা যায়? তুলশীমালার একর প্রতি উৎপাদনও কম। এদিকে একর প্রতি পাঁচমণ ধান খাজনা দিতে হয়। কিন্তু শের আলী যে কৃষক প্রদত্ত কম খাজনাতেই সন্তুষ্ট! তাই অনেকেই বেশি রাজস্ব দিয়ে জমিদারি পেতে কানাঘুষা করতে লাগলো। কীভাবে কী করা যায়, তা নিয়ে এরা নানারকম ফন্দিফিকির আঁটতে লাগলো।
বংশানুক্রমে প্রাপ্ত জমিদারিতে শের আলী গাজীর ততোটা মনোযোগ নেই। তাঁর ছিল মাছ শিকার আর ঘুরে ঘুরে প্রকৃতির দেখার শখ। তিনি মন চাইলেই দলবল নিয়ে নৌকায় করে দর্শা নদে মাছ শিকারে বেরিয়ে পড়তেন।
এসময় তিনি দুপুরের আহারটা নিকটবর্তী কোনোএক প্রজার বাড়িতে সেরে নিতেন। তাঁর এই দুর্বলতাকে চক্রান্তকারীরা মোক্ষম হাতিয়ার হিসেবে বেছে নিলো। এদিকে মুর্শিদাবাদ সরকারের অধীনতাকে ছিন্ন করে স্বাধীনভাবে জমিদারি শুরু করার মানসে তিনি তাঁর মতো করে জমিদারি চালাতে লাগলেন। গড়জরিপা থেকে শাসন কেন্দ্র মৃগী নদীর তীরে স্থানান্তরিত হল, পরগণার নামও পরিবর্তন হয়ে শেরপুর হল। মুর্শিদাবাদের নবাব পরিবারও এতে গাজীর ওপর ভীষণ ক্ষুব্ধ হলেন।
শের আলী গাজী মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে একদিন নৌকা নিয়ে বের হলেন। যেতে যেতে নদী তীরবর্তী দর্শাঘাটে তাঁর নৌকা থামালেন। ঘাটে এক অপরূপা সুন্দরী তার সইদের নিয়ে জলকেলি করছিল। সুন্দরী যুবতীকে দেখে বিমুগ্ধ হলেন নৌকারোহী শের আলী গাজী। সে সময় মেয়েদের বাল্যবিয়ের প্রচলন ছিল।
পদ্মাবতীরও অল্পবয়সে বিয়ে হয়েছিল। তাঁর স্বামী অসম বয়সের রামবল্লভ নন্দী। পদ্মাবতীও সুপুরুষ শের আলীকে দেখে দিওয়ানা হলেন। মাছ শিকার শেষে শের আলী তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে অবস্থা সম্পন্ন এক গেরস্ত পরিবারে প্রবেশ করলেন। সেই বাড়িতেই দুপুরের আহারের ব্যবস্থা হল। খাবার বসে শের আলী গাজী বিস্মিত হলেন।
এ যে তাঁর আরাধ্য মানসী পদ্মাবতীর বাপের বাড়ি! লজ্জার অবগুণ্ঠন টেনে স্মিত হাসির রেখা টেনে পদ্মলোচনের গভীরে প্রেমের আলো ছড়িয়ে মানসপ্রিয়া যে তাঁর থালে খাবার তুলে দিচ্ছে! সেদিনই তাঁদের অন্তরে প্রেমের প্রবল তুফান শুরু হল। এরপর প্রায়শই মাছ শিকারের উদ্দেশ্যে পদ্মাবতীর বাপের বাড়িতে ছুটে যান শের আলী গাজী। পদ্মাবতীর স্বামী ব্যবসা-বাণিজ্যের কাজে প্রায়ই বাইরে অবস্থান করেন। ফলে উঠতি বয়সে সুপুরুষ শের আলী গাজী পদ্মাবতীর হৃদয় মন্দিরে দেবতার আসন পেলেন।
এরই মধ্যে পদ্মাবতীর স্বামী বাণিজ্যে গিয়ে নৌ-ডাকাতের কবলে পড়ে নিহত হলেন। পদ্মাবতীর জীবনে নেমে এলো চরম একাকিত্ব। অবশেষে বেশ কিছুদিন পর পদ্মাবতী পালিয়ে এসে জমিদার শের আলী গাজীর পাণি গ্রহণ করলেন। তাঁদের প্রেমের মিলন ঘটলো বটে, সেই সুখ বেশিদিন স্থায়িত্ব পেলো না। গাজীর বিরুদ্ধে নতুন করে ষড়যন্ত্র শুরু হল। সুযোগ সন্ধানীরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে ষড়যন্ত্রের ডানা মেলতে থাকলো।
পদ্মাবতী হিন্দু ললনা। তাঁর সাথে মুসলমানের বিয়ে হতে পারে না। তাছাড়া তাঁরা তাঁদের স্ব স্ব ধর্মানুরাগী যে! তাই গাজীর বিরুদ্ধে অন্যের স্ত্রী হরণ, যৌন নিপীড়ন, ধর্ম অবমাননা ও রামভল্লব হত্যার অভিযোগ আনা হল। এরই মধ্যে পদ্মাবতীর কোলজুড়ে এক রাজপুত্রের আবির্ভাব হয়েছিল।
বেশ কিছুদিন পর পদ্মাবতী বাপের বাড়িতে গেলেন। বাড়িতে গিয়ে তিনি আটকে গেলেন। তাঁর বাবা ও আত্মীয়-স্বজন মুর্শিদাবাদ নেজামতে পদ্মাবতীর জামাতা হত্যা ও সতীত্ব হরণের অভিযোগ দাখিল করলো। পদ্মাবতী তাঁর নিজের ও শিশুপুত্রের প্রাণ রক্ষায় বিচলিত হয়ে পড়লেন। জমিদারের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণ হলে যে, তাঁর বাবা ও গোত্রের উপর শাস্তির খড়্গ শাণিত হবে। এরকম পরিস্থিতিতে তিনি শের আলী গাজীর বিরুদ্ধে নবাবের কাছে সাক্ষ্য দিতে বাধ্য হলেন।
এদিকে এই পরিস্থিতিতে জমিদার পলাতক হতে বাধ্য হলেন। নবাবের বিচারে পলাতক গাজীর প্রাণদণ্ডের রায় হল। তবে শর্ত দেওয়া হল যে, তুলশীমালা চাল সাধারণ প্রজারা ভাত রান্নার কাজে ব্যবহার করতে পারবে না। বার্ষিক রাজস্ব হিসেবে তাঁর প্রজাদের জমিদার পরিবার ও নবাব পরিবারের ভোগের জন্য একটা নির্দিষ্ট পরিমাণ তুলশীমালা ধান জমা দিতে হবে। শেষ শর্তটা হল, তাঁকে জমিদারি ত্যাগ করতে হবে।
অবশেষে শের আলী গাজী পদ্মাবতীর পুত্র রামনাথকে জমিদারি লিখে দিতে রাজি হলেন। এরপর তিনি সুফী সাধকের জীবন বেছে নিয়ে আত্মগোপনে চলে গেলেন। পদ্মাবতীর মনের দুঃখ তাঁর মনেই রয়ে গেলো। তিনি তাঁর পুত্রকে পরগণায় সুশাসন প্রতিষ্ঠার মন্ত্রণা দিলেন। বংশ পরম্পরায় শাসকরা স্কুল, আদালত চিকিৎসা কেন্দ্র স্থাপন করলেন। মা ছেলেকে গোপনে কী মন্ত্রণা দিয়েছিলেন তা হয়তো বলা যাবে না, তবে পরগণার নাম শেরপুর যে অক্ষত রইলো! কালক্রমে এই জনপদ সমৃদ্ধ নগরে পরিণত হল। নিজ নামে জনপদের পরিচয়ে আজও বেঁচে আছেন শের আলী গাজী।
বিদ্র.: তুলশীমালার জমিদারি :গল্পের আদলে বর্ণিত ঐতিহাসিক প্রবন্ধে কিছু কাল্পনিক তথ্য সন্নিবেশিত হয়েছে। বাকি তথ্যগুলো বিভিন্ন প্রিন্ট মিডিয়া থেকে গৃহীত হয়েছে।