Our Sherpur

নয়আনী জমিদার বাড়ি – শেরপুর ও কিছু স্মৃতি

নয়আনী জমিদার বাড়ি

নয়আনী জমিদার বাড়ি

ক‍্যাপ্টন (অবঃ) মোঃ রফিকুল ইসলাম
ক্যাপ্টেন (অবঃ) মোঃ রফিকুল ইসলাম, সেনা শিক্ষা কোর।

খাদ্য উদ্বৃত্তের জেলা শেরপুর। কৃষ্টি, সংস্কৃতি ও শিক্ষাদীক্ষায় শেরপুর অনেক জেলা থেকে এগিয়ে। এজেলার নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক দৃশ্য সকলের মন কাড়ে। শেরপুর পরগণার মুসলিম জমিদার শের আলী গাজীর নামানুসারে শেরপুর নামকরণ করা হয়। এই খ্যাতিমান জমিদার দীর্ঘ ২৪ বছর তাঁর শাসনকাল পরিচালনা করেন। অতঃপর নবাব মুর্শিদ কুলি খাঁর বিচারে শের আলীর জমিদারি বাতিল করে রামনাথ চৌধুরীকে শেরপুর পরগণার জমিদারি দেয়া হয়। তিনিই শেরপুরের প্রথম হিন্দু জমিদার। তাঁরা ১৭৯০ সালে ময়মনসিংহের জেলা মাজিস্ট্রেট ও কালেক্টরেট ডব্লিউ বাটন সাহেবের নিকট হতে ১০ সনা বন্দোবস্ত নেন। পরবর্তীতে স্টিফেন বায়ার্ডের নিকট হতে চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে নেয়া হয়।

Products list of Our Sherpur
শেরপুর জেলার যেসব পণ্য আওয়ার শেরপুর এ পাওয়া যায়।

১৮২০ সালে শেরপুর চৌধুরীদের জমিদারি প্রথম নয়আনী জমিদার বাড়ি ও সাতআনি জমিদার বাড়িতে ভাগ হয়। পরবর্তীতে সাতআনি জমিদারি তিনআনি, পৌঁনে তিনআনি, আড়াইআনি বড়বাড়ি, আড়াইআনি ছোটবাড়ি ও দেড়আনিতে ভাগ হয়।

শেরপুরে জমিদারদের মধ্যে নয়আনি জমিদার বাড়ি ছিল বৃহৎ। বিরাট জায়গা জুড়ে চারদিকে খালকেটে সুরক্ষিত করে বাড়িটি নির্মাণ করা হয়। নয়আনি জমিদাররা ছিল শিক্ষিত ও সাংস্কৃতিক মনা। তাঁরা ছিলেন শিক্ষানুরাগী। অনেকেই অনারারি মাজিস্ট্রেট ছিলেন। বিচার কার্ষ পরিচালনা করতেন। জমিদার কিরণ রায় চৌধুরী ছিলেন নয়আনির সর্বশেষ জমিদার।

সাংস্কৃতিকমনা নয়আনী জমিদার বাড়ি গান বাজনা, নাটক পুজাপার্বণ ও নানা উৎসব পালনের জন্য প্রকান্ড এক রঙমহল তৈরি করেন। দ্বিতল কাঠের এ বিশাল বাড়িটি শাল কাঠের খুটি ও গর্জন কাঠের পাটাতনে তৈরি ছিল। টিনের ছাওনির এ বাড়ির নীচ তলায় নাচগান ও নানা অনুষ্ঠান হতো। আর জমিদার ও তাঁদের পরিবারবর্গ দোতলা থেকে অবলোকন ও উপভোগ করতেন।

জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হবার পর বাড়িটি পরিত্যক্ত অবস্থায় থাকে। ১৯৬৪ সালে শেরপুর কলেজ প্রতিষ্ঠিত হবার পর কলেজের শিক্ষকদের পারিবারিক বাসস্থান হিসেবে ব্যবহৃত হয়। আর রঙমহলটি ব্যাচেলর অথবা যাঁরা পরিবার নিয়ে থাকেন না, তাঁদের জন্য বরাদ্দ থাকতো।

শেরপুর সরকারি কলেজ

১৯৭৫ সাল। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর আমি এর প্রতিবাদে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়ে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করি বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার না হওয়া পর্যন্ত আর কলেজে আসবো না। কিন্তু পরে বুঝতে পারি লেখাপড়া না করলে এ নৃশংস হত্যার বিচার পাওয়া সম্ভব নয়। তাই ৭৬ সালে আবার কলেজে ফিরে আসি। মাধবপুরে একটি বাড়িতে থেকে কলেজ করি। সেখানে পড়াশোনার সুবিধা করতে না পেরে প্রিন্সিপাল হান্নান স্যারকে ধরি একটা ব্যবস্থা করতে।

তিনি অনেক ভেবে রঙ মহলের একটি রুম আমার নামে বরাদ্দ দেন। আমি ও জৈমদ্দিন মামা থাকা শুরু করি। সেখানে ইংরেজির ফণি স্যার ও ইসলামের ইতিহাসের একজন স্যার থাকতেন। রঙ মহলে উঠেছি একথা শুনে আমার বাবা কি যে খুশি হয়েছিলেন তা ভাষায় প্রকাশ করার মত না। ছাত্রাবস্থায় তাঁরা সেখানে ভয়ে ভয়ে যেতেন। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে সেখানে যেতে হলে নিয়ম মেনে প্রণাম করে যেতে হতো। আর আমি দিব্যি রঙমহলের একটি কক্ষে থাকি, যেখানে সাধারণের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল।

যাক, রান্না করে খেয়েদেয়ে পড়াশোনা ভালোই চলছিল, হঠাৎ একদিন বিকেলবেলা চন্দন পাল ও মন্তুস নাগ সেখানে হাজির। তারাও সেখানে থাকবে, যদিও তাদের বাসা শহরেই। তারা অবশ্য অন্য কারণে থাকছিল। সেটা না-হয় অন্যদিন বলবো।

রঙ মহলে থেকে ১৯৭৭ সালে বিএ পাস করে একটি হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক হয়ে চলে যাই। পরে ১৯৮২ সালে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ ময়মনসিংহ থেকে বিএড করে আর্মি এডুকেশন কোরে কমিশন পাই। ১৯৮৪ সালে শেরপুর জেলা হবার পর সেখানে ডিসি অফিস ও জেলা জজের কার্যালয় স্থাপিত হয়। তৈরি হয় জেলা প্রশাসক ও জজ আদালতের কার্যালয়।

শেরপুর এলেই আমি সেখানে যেতাম। ঘুরে ঘুরে দেখতাম আর স্মৃতি হাতড়িয়ে বেড়াতাম। যে পুকুরে গোসল করতাম সেখানেও খানিকক্ষণ বসে থাকতাম। গাঙিনা পাড়ের চারদিকে ঘুরে আসতাম। তখনও বাড়িটি অক্ষতই ছিল। রঙমহলের দোতলায় উঠে আমার কক্ষটি দেখে আসতাম।

পরে নানা কারণে দীর্ঘদিন আর যাওয়া হয় নাই সেখানে। ২০১৮ সালে শেরপুরে স্থায়ী হবার পর সকালবেলা ঘুরে ঘুরে শহর দেখি। একদিন সকালে প্রিয় রঙমহল দেখার জন্য ডিসি অফিসের মেইন ফটক পারি দিয়ে ভিতরে ঢুকতেই আমার চক্ষু চড়কগাছ। আমি ভুল দেখছি না তো। নয়আনী জমিদার বাড়ির কোন স্মৃতি চিহ্নই নেই। পরে শুনলাম ২০০৩ সালে সেটা নিলামে বিক্রি করে দেয়া হয়েছে। মনটা ভীষণ খারাপ হলো। অনেকক্ষণ এদিকওদিক ঘুরলাম। কী আর করা যাবে, সরকারি সিদ্ধান্ত।

কালের বিবর্তনে অনেককিছুই পরিবর্তন হয়েছে। ঘাট অঘাট হয়েছে। ধনী গরীব হয়েছে। গরীব কোটিপতি হয়েছে। যে জমিদারের দাপটে শেরপুর পরগণার প্রজারা তটস্থ ছিল, আজ তাঁরা নেই, তাদের স্মৃতি নিশ্চিহ্ন। এটাই প্রকৃতির অমোঘ নিয়ম। আমরাও একদিন থাকবো না। আমাদের কর্ম হয়তো থেকে যাবে। আসুন, আমরা আমাদের পূর্বসূরিদের অবদান স্বীকার করে তাঁদের শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করি এবং তাঁদের স্মৃতি চিহ্নগুলো সংরক্ষণ করি, তবেই অসম্ভব সুন্দর এ পৃথিবী আরো সুন্দর হবে।

নয়আনী জমিদার বাড়ি

Leave a Reply

Scroll to Top