Our Sherpur

ঝাউগড়া গণহত্যা দিবস

ঝাউগড়া গণহত্যা দিবস

ঝাউগড়া গণহত্যা দিবস:

১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামিলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা পেলে আমাদের মনে আশা জাগে, হয়তো ২৪ বছরের গোলামীর অবসান হতে চলেছে। ছয় দফার ভিত্তিতে দেশ চলবে, আমরা স্বায়ত্তশাসন পাবো। চারদিকে জয় জয়কার। “জয়বাংলা” ধ্বনিতে মুখরিত সারা বাংলা। কিন্তু আশাহত হতে খুব বেশি সময় নেই নি।

বছরের শুরুতে অর্থাৎ ১৯৭১ সালে জানুয়ারিতেই আমরা বুঝতে পারি পাক সরকার সহজে আমাদের নিকট ক্ষমতা হস্তন্তর করবে না। স্বৈরাচার জেনারেল ইয়াহিয়া নানা টালবাহানা শুরু করে। এদিকে পুরো জাতি ক্রমে ফুঁসে উঠে। অবশেষে ইয়াহিয়া ০৩ মার্চ অধিবেশন ডাকে। আমরা ক্ষীণ আশায় আলো দেখতে পাই। কিন্তু বঙ্গবন্ধু ঠিকই বুঝতে পেরেছিলেন ইয়াহিয়া কখনো ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তাই তিনি আওয়ামিলীগের সিনিয়র নেতাদের যুদ্ধের জন্য তৈরি থাকতে বলেন।

ইতোমধ্যে কোন কারণ ছাড়াই ইয়াহিয়া ০৩ মার্চের অধিবেশন স্থগিত করেন। তখন বাংলার জনগণই বঙ্গবন্ধুকে দ্রুত স্বাধীনতা ঘোষণা করার অনুরোধ করে। বঙ্গবন্ধু ০৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে জনসভার ঘোষণা দেন। আমি তখন স্কুলের ছাত্র। আমরা ধরেই নিয়েছি বঙ্গবন্ধু সেদিনই স্বাধীনতার ঘোষণা দিবেন। এদিকে ০৩ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতারা স্বাধীন বাংলার পতাকা উত্তোলন করে। ০৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে সবাইকে যার যা আছে তাই নিয়ে প্রস্তুত থাকতে বললেন। তিনি ঘোষণা দিলেন, “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”

Products list of Our Sherpur
শেরপুর জেলার যেসব পণ্য আওয়ার শেরপুর এ পাওয়া যায়।

আমরা রেডিওর সামনে বসে আছি বঙ্গবন্ধুর ভাষণ শোনার জন্য। কিন্তু পাকিস্তান সরকার সেদিন ভাষণ প্রচার করতে দেয় নাই। পরদিন ঢাকা কেন্দ্র থেকে ভাষণটি প্রচার করা হয়। আমরা ০৭ তারিখ কলকাতা কেন্দ্র ও সন্ধ্যায় বিবিসি থেকে ঐতিহাসিক ভাষণটি শুনি। তারপরও বঙ্গবন্ধু ইয়াহিয়ার সাথে আলোচনা চালিয়ে যান। ২৫ তারিখ আলোচনা ভেঙে গেলে রাতে পাকিস্তান সরকার বঙ্গবন্ধুকে গ্রেফতার করে অপারেশন সার্চ লাইট শুরু করে ঢাকায় শতশত মানুষ হত্যা করে। গ্রেফতারের আগে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়ে যান। শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধ। পাক হানাদার বাহিনী বাঙালী নিধন শুরু করে।

২৬ এপ্রিল ১৯৭১ সালে ব্রহ্মপুত্র নদ পারি হানাদার বাহিনী শেরপুর প্রবেশ করে মোস্তফা, বুলবুল, রুটির দোকানী আহমদ আলী ও শনি বিগ্রহের পুরোহিত সুব্রত ভট্টাচার্যকে হত্যা করে। সেদিনই স্থানীয় রাজাকারদের সহায়তায় ঝাউগড়া গ্রামে আক্রমণ চালায়। শহর থেকে প্রাণ বাঁচানোর জন্য ব্যবসায়ী চৌথমল কারুয়া, নিপু সাহা সহ বেশ কয়জন ঝাউগড়ায় আশ্রয় নিয়েছিল। হানাদার বাহিনী সর্বজন শ্রদ্ধেয় মহেন্দ্র দেব সহ ০৮ জনকে বেঁধে মৃগী নদীর ধারে নিয়ে এক লাইন দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে লাশগুলো নদীতে ফেলে চলে যায়।

চৌথমল কারুয়া, নিপু সাহা ও মহেন্দ্র দেব সহ ০৮ জনের লাশ ভেসে আমাদের পাড়ার উত্তর দিকের ঘাটে গিয়ে আটকে থাকে। উল্লেখ্য মৃগী নদী খুনুয়া বাজারের নিকট দশানী নদের সাথে মিলিত হয়েছে। আমাদের পাড়াটা দুই নদীর মাঝখানে। প্রথমে মৃতদেহগুলো পাড়ার উত্তর দিকে মৃগী নদীর ঘাটে আটকে থাকে। দুইদিন পরই গন্ধ ছড়াতে থাকলে আমরা ক’জন মিলে বাঁশ দিয়ে মৃতদেহ গুলো ছাড়িয়ে দেই। ভাসতে ভাসতে দেহগুলো খুনুয়া বাজারের কাছে দুই নদীর মোহনায় গিয়ে আটকে। উল্লেখ্য ঐ সময় দশানী নদীতে স্রোত না থাকায় পূর্ব দিক থেকে বাতাসে কচুরিপানার সাথে দেহগুলো পশ্চিম দিকে গিয়ে আমাদের পাড়ার সামনের দশানী নদের ঘাটের কাছ গিয়ে আটকায়। তখন আর সরানো সম্ভব হয়নি। পরে শিয়াল কুকুরে দেহগুলো খেয়ে ফেলে। কঙ্কালগুলো অনেকদিন সেখানেই ছিল। পরবর্তীতে বর্ষাকালে বন্যার পানিতে ভেসে যায়।

প্রতি বছর মার্চ – এপ্রিল মাস এলে যখনই পাক হানাদার বাহিনীর নির্মমতার কথা মনে পড়ে, তখন ঝাউগড়া গণহত্যার স্মৃতি চোখের সামনে ভেসে উঠে। অনেকদিন পর আবার শেরপুরে বসবাস করছি, মুন্সি বাজার পেরিয়ে নয়ানী বাজারের দিকে গেলে দেখা যায় চৌথমল কারুয়ার নামে একটি মার্কেট হয়েছে। সেখানেই শহীদ কারুয়ার বাসভবন ছিল।

আবার ২৬ এপ্রিল ফিরে এসেছে। শেরপুরে পাক হানাদার বাহিনীর আগমন ও গণহত্যার কথা মনে পরে। হানাদার বাহিনী দীর্ঘ নয়মাস সারাদেশে নৃশংস হত্যা, অগ্নিসংযোগ ও লাখো মা বোনের ইজ্জত হরণ করে। অবশেষে আমরা ঐ বর্বর বাহিনীকে শোচনীয় ভাবে পরাজিত করে লাল-সবুজের পতাকা ছিনিয়ে এনেছি। পেয়েছি মহান স্বাধীনতা। বাঙালির ইতিহাসে মুক্তিযুদ্ধই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ ঘটনা। আমি সে ঘটনার অংশীদার হতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করি।

আসুন আমরা আবারও শপথ নেই, বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ি। এদেশের মানুষ স্বাধীনতার সত্যিকার স্বাদ গ্রহণ করুক। সকলেই সমভাবে স্বাধীনতার সুফল ভোগ করুক। আজকের দিনে এই হওক অঙ্গিকার। জয়বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

লেখক: ক্যাপ্টেন (অবঃ) মোঃ রফিকুল ইসলাম, সেনা শিক্ষা কোর।

Leave a Reply

Scroll to Top