Our Sherpur

একজন শহীদ দারোগ আলীর গল্প

ক‍্যাপ্টন (অবঃ) মোঃ রফিকুল ইসলাম

সালটা ১৯৬৯। মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলায় বঙ্গবন্ধুুকে ফাঁসির দন্ড দেয়া হয়েছে। তাই ফেব্রুয়ারি থেকেই বাংলা সাত কোটি মানুষ ফুসে উঠতে শুরু করে। মাসের শেষের দিকে গণ অভ্যুত্থানে রূপ নেয়। আমরা ছয় দফা ও এগার দফা আদায়ের জন্য মিছিল করছি। শেরপুর তখন থানা শহর। প্রতিদিনই মিছিল হচ্ছে। একদিন স্মরণ কালের সবচেয়ে বড় মিছিলের অগ্রভাগে ছিলাম। আমি তখন ৭ম শ্রেণির ছাত্র। শ্লোগানে প্রকম্পিত শেরপুর শহর।’ জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো’ ‘তোমার আমার ঠিকানা পদ্মা মেঘনা যমুনা’ ‘ পিন্ড না ঢাকা, ঢাকা ঢাকা’ উল্লেখ্য বঙ্গবন্ধু তখনো “বঙ্গবন্ধু ” হয় নাই।
মার্চের ১ম সপ্তাহে কেন্দ্র থেকে নির্দেশ আসে আইয়ুব শাহীর তথাকথিত মৌলক গণতন্ত্রের সকল মেম্বার চেয়ারম্যানদের পদত্যাগ করাতে হবে। আমরা প্রথমে শেরপুর এর অন্তর্গত ১১নং বলাইর চর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন পেরিকে পদত্যাগ করাবো সে উদ্দেশ্যে ০৫ মার্চ বুধবার আমরা মিছিল সহকারে চেয়ারম্যান বাড়িতে যাই। বিভিন্ন গ্রাম থেকে মিছিলের নেতৃত্ব দেয় প্রয়াত রিলিফ চেয়ারম্যান আনিস, প্রয়াত চেয়ারম্যান আঃ সালাম, প্রয়াত চেয়ারম্যান লেবু ভাই। তারা তখন সিনিয়র ছাত্র ছিলেন। সেদিন চেয়ারম্যান জসিম উদ্দিন সাহেব আমাদের সাথে কাঙ্ক্ষিত আচরণ করে ০৩ দিন সময় চেয়ে আমাদের ০৮ মার্চ শনিবার আসতে বলেন। সে দিন তিনি পদত্যাগ করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন।

০৮ মার্চ শবিবার সকাল থেকেই আমরা কুমরার চর পেরিবাড়ি জড় হতে থাকি। সকাল ১০টা নাগাদ পেরি বাড়ি কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়। উল্লেখ্য পাকিস্তান আমলে পেরি বাড়ির মত এত বড় বাড়ি আশেপাশের থানায় ছিল না। জমিদার বাড়ির মত মনে হতো। ঐ সময় তাদের গাড়ি ছিল। গাড়ি “পের পের” শব্দ করতো বলে নাম করণ হয় পেরি বাড়ি।

আমরা এগারো টা পর্যন্ত পদত্যাগ পত্রের জন্য অপেক্ষা করি। হঠাৎ শুনতে পাই চেয়ারম্যান সাহেব পেছন দিয়ে পালিয়ে গেছে। এ খবর শোনা মাত্র ছাত্র জনতা ক্ষেপে যায় এবং শ্লোগান দিতে থাকে। হঠাৎ কে যেন বলে উঠে ‘চল আমরা পরিষদের কাগজ পত্র, সীল ছাপ্পর নিয়ে যাই।’ সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র জনতা বৈঠকখানার আলমারি ভেঙে কাগজ পত্র নিতে শুরু করে। আমরা ছোটরা পেছনে দাঁড়িয়ে শ্লোগান দিতে থাকি।
আসলে আগে থেকেই পেরিরা পরিকল্পনা করে রাখে যে আমরা কিছু করা মাত্র তারা আমাদের আক্রমণ করবে। বাড়ির ভেতরে তারা শতাধিক লোক বল্লম, টেটা রামদা সহ অপেক্ষা করতে থাকে। ছাত্র জনতা পরিষদে ঢুকে আলমারি ভেঙে কাগজ পত্র নিতে থাকে তখন চেয়ারম্যান সাহেবের কলেজ পড়ুয়া ছেলে আঙুর ঘরের দুতলা থেকে ৪/৫ রাউন্ড গুলি করে। ছড়রা গুলির কারণে সামনে থাকা চার জন গুলি বিদ্ধ হয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে। তখন বাড়ির ভেতর থেকে শতাধিক লোক লাঠি,বল্লম, টেটা নিয়ে আমাদেরকে আক্রমণ করে।নিরস্ত্র আমরা দৌড়ে পালাই। কিছুক্ষণ পরে জানতে পারি আহতদের মধ‍্যে আমাদের দারোগ আলী ভাইও আছে। এমতাবস্থায় পেরিরাও ভয় পেয়ে যায়। একজন খবর পাঠায় যেন আমরা আহতদের নিয়ে যাই। তখন খালেক মাস্টার, জব্বার মাস্টার এবং আরও কয়েক জন পাশের বাড়ি থেকে জল চৌকি নিয়ে দারোগ ভাইকে নিয়ে শেরপুর রওনা দেই।পথিমধ্যে দারগ ভাই মারা যায়।

দারোগ আলী ভাই জিকে স্কুলের ১০ম শ্রেণির ছাত্র ছিলেন। আমরা লাশ নিয়ে পৌছার আগেই খবর পেয়ে হাজার হাজার ছাত্র জনতা পৌর পার্কে সমবেত হয়। দারোগ আলী ভাই অত্যন্ত নিরিহ, সাধারণ পরিবারের ছেলে ছিলেন। সেদিন তিনি স্কুলে রওনা দিয়েছিলেন।কয়েকজন তাকে অনুরোধ করে মিছিলে নিয়ে যায়। বিকেলের মধ‍্যে শত শত জনতা পেরি বাড়ি ঘেরাও করে আগুন ধরিয়ে দেয়। একটানা তিন দিন আগুন জ্বলতে থাকে।

কৃতজ্ঞ জাতি শেরপুর পৌর পার্ক দারোগ আলীর নামে নামকরণ করে। ১৯৭২ সালে জঙ্গলদীতে তার নামে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় স্হাপন করে। ১৯৭০ থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত প্রতি বছর ০৮ মার্চ আমরা দারোগ ভাই এর কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানিয়ে দোয়া মাহফিল করেছি। প্রতিবছর শেরপুর থেকে আনিস মুক্তার সাহেব, নিজাম ভাই, সামাদ উকিল, মোহসিন মাস্টার, রশিদ ভাই, ওদু ভাই, মন্জু ভাই ও আরো অনেকে আসতেন। আমরা ভেরু মন্ডলের ঘাট থেকে এগিয়ে নিতাম।

আমি দীর্ঘদিন শেরপুরের বইরে। জানিনা এখন তার মৃত্যু বার্ষিকী পালিত হয় কি না। শীঘ্রই আমি শেরপুরে স্হায়ী হবো ইনশাআল্লাহ। তখন শেরপুর বাসীকে আরো অনেক কিছু জানাতে পারবো।
আজ ০৮ মার্চ ২০১৮। দারোগ আলী ভাই এর ৫০ তম মৃত্যু বার্ষিকীতে তার বিদেহী আত্মার মাগফেরাত কামনা করছি। আল্লাহ তাকে বেহেস্ত নছিব করুণ। আমিন!

লেখকঃ ক‍্যাপ্টন মোঃ রফিকুল ইসলাম, সেনা শিক্ষা কোর।

Leave a Reply

Scroll to Top