একজন শিক্ষানুরাগী, গুণীজন ও ভাষা সৈনিকের চির বিদায়!
আমি প্রিন্সিপাল সৈয়দ আব্দুল হান্নান স্যারের কথা বলছি। তিনি আজ ০৮ জানুয়ারি ২০১৯ তারিখ ভোরে ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহ ওয়া ইন্না ইলাহি রাজিউন। তাঁর শোক সন্তপ্ত পরিবারের প্রতি সমবেদনা জানাচ্ছি। আমি তাঁর আত্মার মাগফেরাত কামনা করেই কিছু স্মৃতি চারণ করবো।
সালটা ১৯৬৫। আমি তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ের নিচের ক্লাসের ছাত্র। গ্রামের থাকি। পড়াশোনার চেয়ে খোলাধুলায় বেশি মনোযোগী। হঠাৎ একদিন শোনলাম শেরপুরএ “কলেজ” অর্থাৎ মহাবিদ্যালয় হয়েছে। আমরা বিদ্যালয়ে পড়ি, তারপর উচ্চ বিদ্যালয়, তারপর ম হা বিদ্যালয়। বড়দের কাছে গল্প শুনি আর মনে মনে কল্পনা করি মহাবিদ্যালয়টি কেমন। দেখার বড় সাধ জাগে। ভয়ে ভয়ে আব্বাকে বলি ‘ আমি মহাবিদ্যালয়’ দেখবো। আব্বা রাজী হয় না। কারণ বাড়ি থেকে শেরপুর পাঁচ মাইল দূরে। পুরো রাস্তাই হেটে যেতে হবে। আমিও নাছোর বান্দা। কান্নাকাটি শুরু করি। অবশেষে আব্বা রাজী হন।
রবিবার শেরপুরে হাট বসে সেদিন নিয়ে যাবে। আমার আনন্দ আর ধরে না। কবে আসবে রবিবার। কাঙ্খিত তারিখের আগের রাত আর আমার ঘুম হচ্ছিল না। যাক সকাল সকাল প্রস্তুত হয়ে আব্বার সাথে হেটে চলছি। কয়েকটি গ্রাম ছাড়িয়ে কানাশাখলা পেরিয়ে শেরপুরের পথে এগুচ্ছি। আব্বা মাঝে মাঝে জিজ্ঞেস করেন আমার কষ্ট হচ্ছে কীনা। আমি কষ্ট চেপে যাই।অবশেষে থানামোড় ঘুরে “জিকে স্কুল“এ পৌছাই। উল্লেখ্য ১৯৬৫ সালে ‘জিকে’স্কুলের ব্যায়ামাগারেই শেরপুর মহাবিদ্যালয় এর জন্ম।
ঘরটি টিনশেড আধাপাকা। লম্বা কক্ষ। ছাত্ররা বেঞ্চে বসে আছে, সামনে একজন শুভ্র সুন্দর লোক দাঁড়িয়ে বই না দেখেই গড়গড় করে পড়িয়ে যাচ্ছেন। আমি দেখে হতবাক। বই না দেখে পড়ানো আমার মত গ্রামের একজন ছোট ছাত্র দেখে হতবাক হওয়ারই কথা। আমি বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখতে দেখতে অজান্তেই একেবারে দরজার ভিতরে চলে গেছি। তখন শিক্ষকমহোদয় আমাকে দেখে মুচকি হেসে বললেন “বড় হয়ে যখন কলেজে আসবে তখন তোমাকেও পড়াবো।” পরে শুনলাম তিনিই হান্নান স্যার, প্রিন্সিপাল সৈয়দ আব্দুল হান্নান। প্রথম এভাবেই তাঁকে দেখেছি।
তারপর অনেকদিন আর দেখা হয়নি। কলেজের ছাত্রদের কাছে উনার নাম, গুণাগুণ শুনি। একেবারে কাছথেকে দেখার সুযোগ হয় ১৯৭০ এর নির্বাচনের সময়। আমি তখন স্কুলের উপরের ক্লাসের ছাত্র। বঙ্গবন্ধুর ডাকে আমরা নৌকা মার্কা তথা আনিস মুক্তার সাহেবের নির্বাচন করছি। তিনি বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হলেন। তার কয়েকদিন পর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন। আমরা নিজাম সাহেবের নির্বাচন করছি।
উল্লেখ্য সে বছর শেরপুর থেকে প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচন করছেন মরহুম নিজাম সাহেব, প্রফেসর ছাত্তার সাহেব, সুরুজ চৌধুরী, খন্দকার মজিবর ও আরএকজন সালফেট মজিবর। একদিন শুনলাম পাশের গ্রামে খন্দকার মজিবর সাহেবের নির্বাচনী সভা হবে, তাতে উপস্থিত থাকবেন হান্নান স্যার। আমরা নৌকা মার্কার লোক, তারপরও শুধু হান্নান স্যারকে দেখার জন্য যাওয়া হলো। সেদিন খুব কাছ থেকে তাঁকে দেখলাম, বক্তব্য শুনলাম। তিনি খন্দকার মজিবর সাহেবকে ভোট দেয়ার জন্য আহ্বান জানালেন। তখন তিনি শেরপুর কলেজের ইসলামের ইতিহাসের শিক্ষক।
তারপর শুরু হয় আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধ। আমরা তখন মুক্তাঙ্গনে। যেভাবে পারছি মুক্তিযুদ্ধাদের সহায়তা করছি। পাকসেনারা যাকে যেভাবে পারছে মেরে ফেলছে, নয় নিগৃহীত করছে। একদিন শুনলাম হান্নান স্যারকেও পাকসেনারা ধরে নিয়ে অপমান ও নিগৃহীত করেছে। সৌভাগ্য তাঁকে মেরে ফেলে নাই। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তিনি শেরপুর কলেজের প্রিন্সিপাল নিযুক্ত হন।
স্বাধীনতার পর আমি শেরপুর কলেজে ভর্তি হই। তখন কলেজে অনেক ছেলেমেয়ে। তিল ধারণের ঠাঁই নেই। তিনি খুব নিষ্ঠার সাথে দায়িত্ব পালন করছেন। স্বাধীনতার পর পর তাই সকলেই সংগ্রামী মনোভাব নিয়ে চলাফেরা করছে। কেউ যেন কারও কথা শুনতে চায় না। তারপরও তিনি ঠান্ডা মাথায় সবকিছু সামাল দিচ্ছেন। ঐসময় ছাত্র সাংসদ নির্বাচন হয়। ছাত্র ইউনিয়নের প্যানেল জয়লাভ করে। ছাত্রলীগের ছেলেরা যেন মেনে নিয়ে কোন গোলযোগ না করে তিনি তার ব্যবস্থা নেন। তারপর ৭৪ এর ভয়াবহ দুর্ভিক্ষের সময় সকলের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ। আমাদের তখন ফর্মফিলাপ চলছে কারও কাছে টাকা পয়সা নেই। ভাবছিলাম পরীক্ষা আর দেয়া হবে না। শেষ তারিখে তিনি টাকা বাকি রেখেই আমাদের ফর্মফিলাপের সুযোগ দেন। পরবর্তীতে পরীক্ষার আগে প্রবেশ পত্র গ্রহনের সময় টাকা দেবো বলে আমরা ফর্মফিলাপ করি। তার তিন মাস পর চূড়ান্ত পরীক্ষা। প্রায় সবার টাকা বাকি। কলেজের শিক্ষকদেরও আর্থিক অবস্থা বেশ খারাপ। অনেকেই বলছেন টাকা পরিশোধ না করলে প্রবেশপত্র দেয়া হবে না। আমরা অপেক্ষা করছি। পরদিন পরীক্ষা। সন্ধ্যে হয়ে রাত। আমরা কয়েকজন হান্নান স্যারের কাছে গেলাম। তিনি আদেশ দিলেন সকলের প্রবেশপত্র দিয়ে দিতে। কী দয়ালু লোক ছিলেন তিনি!
তারপর ৭৫/৭৬ সালে পাসের হার খুব কমে গেলে ছাত্র সংখ্যা খুব কমে যায়। শেরপুর এ মহিলা কলেজ হওয়াও মেয়েদের সংখাও আরও কম। কলেজে আর্থিক সংকট। স্যারেরা কেহ ঔষধের দোকান দিচ্ছেন, কেহ পুরাতন কাপড় বিক্রি করছেন। এমতাবস্থায় তিনি তা সাহসের সাথে মোকাবেলা করছেন। আমি তখন মাধবপুরে একটি বাসায় থাকি। সেখানে পড়াশোনা ভাল হচ্ছিল না। সে রাস্তা দিয়েই তিনি হেটে কলেজে আসতেন। সাথে তার বড় মেয়ে ও কলেজের পিয়ন টিপু সিং। স্যারকে দেখেই আমি সরে যেতাম। একদিন তিনি আমাকে ডেকে বললেন যে সমস্যা হলে আমি যেন নয়আানী বাড়ির রংমহলে উঠি। সেখানে স্যারেরা থাকেন। ইংরেজি শিক্ষক ও ইতিহাসের শিক্ষকের পাশের রুম আমাকে বরাদ্দ দেন। স্যারেরা আপত্তি করলেও তিনি কর্ণপাত করেন নি। শুধু বলেছেন আমাদের ঐ বছর রেজাল্ট ভাল হলে কলেজ সরকারি হবে। আমরা কথা রেখেছিলাম। সর্বোচ্চ সংখ্যক ছাত্র সে বছর গ্রেজুয়েট হই। তারপর কলেজ সরকারি হয়।
আমি শেরপুর থেকে চলে গেলে স্যারের সাথে আর একবার দেখা হয়েছিল। আমি তখন ডেপুটেশনে “দুদক” এ। ২০০৪ সালে ডিসি অফিসে একটা ইনকুয়ারির জন্য গিয়েছিলাম। তিনি প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডের সদস্য, তখন কথা হয়েছিল। তিনি দীর্ঘজীবী ছিলেন। একজন প্রকৃত ভদ্রলোক ছিলেন। ভাষাসৈনিক এ লোকটি চলে গেলেন প্রাকৃতিক নিয়মে। তাঁকে বিনম্র শ্রদ্ধা। আল্লাহ আপনাকে বেহেস্ত নছিব করুন। আমীন!
লেখকঃ মোঃ রফিকুল ইসলাম, সেনা শিক্ষা কোরের অবসর প্রাপ্ত সম্মানিত ক্যাপ্টেন।