১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নালিতাবাড়িতে সংঘটিত
“নাকুগাঁও ও ডালু হত্যাকান্ড”
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কাল রাতে পাকিস্তানি বাহিনীর “অপারেশন সার্চ লাইট” নামে বর্বরোচিত হত্যাকান্ডের সময়, পর্যায়ক্রমে এদেশের সর্বত্র শুরু হতে থাকে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি। অন্য দিকে, দেশের অধিকাংশ মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে ছুটতে থাকে বিভিন্ন দিক। দেশের মাটিতে, দেশের বিভিন্ন জায়গায় ঘটতে থাকে পাকবাহিনীর হত্যাকান্ড, এ হত্যাকান্ড থেকে নারী এবং শিশুরাও বাদ পরেনি। মানুষ জীবন বাঁচাতে ভারতের শরনার্থী ক্যাম্পে চলে যেতে থাকে। ময়মনসিংহ, মধুপুর, মুক্তাগাছা, পিয়ারপুর, নান্দিনাসহ এ অঞ্চলের মানুষ গুলো নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার জন্য শেরপুরের নালিতাবাড়ির নাকুগাঁও ভোগাই নদী হয়ে ভারতের ডালুতে প্রবেশ করতো। আর এটাই ছিল তখনকার ভারতে যাওয়ার অন্যতম প্রবেশ পথ। কারণ নালিতাবাড়ি সদরে শুরুর দিকে পাকবাহিনী প্রবেশ করেনি। তবে যে কোন মুহুর্তে পাক বাহিনীর আসার সম্ভাবনা ছিলো। আর তাদের দোসর- রাজাকার, আলবদর এবং আলশামসরা একত্রিত হতে থাকে নালিতাবাড়িতে। তারা দল গঠন করতে থাকে স্বাধীনতার বিরুদ্ধে এবং যারাই মুক্তির জন্য প্রতিবাদ করতে আসবে তাদের নিশ্চিহ্ন করতে। এদিকে সীমান্তে তখনো অনেকটা শান্ত পরিবেশ বিরাজ করছিলো।
২৫ মে ১৯৭১, ভোরবেলা। বিভিন্ন স্থান থেকে মানুষজন এসে নাকুগাঁও ভোগাই নদী সাতঁরিয়ে কেউবা গলা পানিতে হেঁটে হেঁটে নদী পার হতে লাগলো। ঠিক তখনই কিছু বুঝে উঠার আগেই পাক বাহিনী কাঁশবনের ঝোপঝাড় থেকে একসঙ্গে রাইফেল, স্টেনগানসহ অন্যান্য অস্ত্রের ব্রাশফায়ারে ঝাঁঝরা করে ফেলে নিরীহ নিরস্ত্র আশ্রয়কামী মানুষ গুলোর শরীর। আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে তাদের আর্তচিৎকারে। ভোগাই নদীর পানি আর রক্ত মিশে একাকার হয়ে গেলো, স্রোতের কারণে লাশগুলোর হদিস পাওয়া যায়নি, কোন মানুষ জীবিত অবস্থায় ডালু পৌঁছাতে পারছে কিনা তাও জানা নাই। কতজন লোক এ নির্মম হত্যাকান্ডের স্বীকার হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যানও নেই।
এই নিকৃষ্টতম হত্যাজ্ঞের পর, হানাদার বাহিনী অতি দ্রুত ভোগাই নদী পার হয়ে ডালু বাজারে বি. এস. এফ. ক্যাম্পে গুলি করতে করতে প্রবেশ করে। ৯ জন বি. এস. এফ. কে হত্যা ও ৫ জনকে বেঁধে নিয়ে তাদেরকে ময়মনসিংহ আটকে রাখে। এছাড়াও ডালু বাজারে অসংখ্য বেসামরিক লোককে হত্যা করে একই দিনে। পরবর্তিতে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ৫ জন বি. এস. এফ. কে মুক্ত করা হয় ময়মনসিংহ জেল থেকে।
নাকুগাঁও এ নির্মম হত্যাকান্ডটি সংঘটিত হয় বলে এটি ইতিহাসে “নাকুগাঁ হত্যাকান্ড” নামে পরিচিত পায়। ঐ দিন এ নির্মম হত্যার স্বীকারে কত জন লোক ছিলো তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে নালিতাবাড়ি ও শেরপুরের যে কয়জন ছিলো, তাদের কয়েকজনের নাম নিচে দেওয়া হলোঃ-
১. নীরেন দাস (নালিতাবাড়ি বাজার)।
২. নৃপেন দে (নালিতাবাড়ি বাজার)।
৩. নরেন শীল ( নালিতাবাড়ি বাজার)।
৪. ফণীন্দ্র দাস (নালিতাবাড়ি বাজার)।
৫. মোতালেব হোসেন (শেরপুর)।
৬. হরিয়া (শেরপুর)।
৭. আশ্রাফ আলী (বরুয়াজানি)।
৮. রিয়াজ উদ্দিন সরকার (হাতিপাগার)।
৯. আহাদ সরকার (কালাকুমা)।
১০. শাহাজাহান (ময়মনসিংহ)।
১১. আবেদ আলী (অজ্ঞাত)।
১২. নুর ইসলাম (ইপিআর) (অজ্ঞাত)।
১৩. আজাহার উদ্দিন (পুলিশ) (অজ্ঞাত)।
১৪. অশ্বিনী মিস্ত্রি (অজ্ঞাত)।
পরিশেষে, দুঃখের সাথে বলতে হয়, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরার জন্য নাকুগাঁও হত্যাকান্ডের স্থানটিকে যথাযথভাবে সংরক্ষণ এবং তেমন কোন স্মৃতিস্তম্ভ তৈরি করা হয়নি। এখন পর্যন্তও সেরকম ভাবে কোন অনুষ্ঠান বা পদক্ষেপ নিয়ে নালিতাবাড়ি, শেরপুর তথা জাতির কাছে, নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরা হয়ে উঠেনি। তবে আমরা আশাবাদী, শিঘ্রই কোন পদক্ষেপেরর মাধ্যমে এই স্থানটিকে তুলে ধরা হবে!
সূত্র- মুক্তিযুদ্ধের কিশোর ইতিহাস।
তথ্য সংগ্রহঃ সাগর আহমেদ।