নালিতাবাড়ী: পাহাড়ি জনপদের বর্ণিল ক্রিড়াতীর্থ
রিয়াদ আল ফেরদৌস
পশ্চিম গারো পাহাড়ের উপপর্বতীয় অঞ্চলের নিম্ন সমভূমি নালিতাবাড়ী সুদূর অতীতে নৃগোষ্ঠী সংখ্যাগরিষ্ঠ জনপদ ছিলো। ফুটবল খেলার শত বছরের ঐতিহ্য এই তল্লাটে সুবিদিত। সন্ন্যাস বিদ্রোহ দমনে ১৮২৬ সালের শেষ ভাগে জামালপুরে সেনা ছাউনিতে ফুটবল খেলার কথা জানা যায়। জামালপুরের আওতায় শেরপুর মহকুমা তথা নালিতাবাড়ী অন্তর্ভুক্ত ছিলো। নালিতাবাড়ীর প্রাগ্রসর গ্রাম কাঁকরকান্দি ও বরুয়াজানিতে এই সময়ে খ্রিস্টান মিশনারীদের প্রভাবে নৃগোষ্ঠীদের মাঝে ফুটবল খেলার প্রচলন হয়। আজকের কাঁকরকান্দি বাজার মাঠ ষাটের দশক অবধি, শুধু নৃগোষ্ঠীদের খেলার মাঠ ছিলো। এখানকার ফুটবল দলের খ্যাতি ও বিস্তার সুদূর ভারতের তুরা, গৌহাটি, শিলং পর্যন্ত বিস্তৃত ছিলো।
ফারাং নামের একজন নৃগোষ্ঠী ফুটবলারের নাম এখনো মানুষ মনে রেখেছেন যিনি প্রায় পঞ্চাশ বছর পূর্বে প্রয়াত হয়েছেন। উল্লেখ করা যায় প্রত্যেশ রাকসাম (কারক) এই নামটিও। নালিতাবাড়ীর ক্রীড়া ইতিহাসে যে সংগঠনটির নাম অম্লান হয়ে আছে তা হলো “হান্টার্স ইলেভেন”। ১৯২৭ সালে প্রতিষ্ঠা করেন অত্র অঞ্চলের কিংবদন্তি ফুটবলার হারান বসু। ১৯৩৫ সালে ঢাকার ওয়ারি মাঠে জুবিলি উৎসবে যে ফুটবল টুর্নামেন্ট হয়েছিলো সেখানে হারান বসু সর্বোচ্চ গোলদাতা এবং স্বর্ণপদক জয় করেছিলেন ম্যান অফ দ্য ম্যাচ হয়ে। নয় আনীর তৎকালীন জমিদার মাঝেমধ্যেই ফুটবল খেলার জন্য হারান বোস এবং বন্ধুদের নিয়ে যেতেন।
নালিতাবাড়ীতে একটি উৎকৃষ্ট খেলার মাঠ জমিদার বাবু হারান বোসের অনুরোধে স্থায়ীভাবে পত্তন দেবার ব্যবস্থা করেন যা হান্টার্স ইলেভেনের মাঠ নামে সুবিদিত ছিলো। দেশভাগের পূর্বে এই ক্লাবের জৌলুশ ছিলো ঈর্ষনীয়। কিংবদন্তি ফুটবলার হারান বসু, রাখাল বসু, প্রভাত নাগ, বরকুনাথ, সুকুমার চৌধুরী, অবনী কর, মাখন সোম, হর সাহা মিশ্র প্রমুখ এই ক্লাবের মূখ্য খেলুড়ে ছিলেন।
দেশভাগের পর আজকের আড়াইআনী বাজার অঞ্চলের নওজোয়ান ক্লাব, তারাগঞ্জ স্কুল একাদশ ক্লাব স্থানিক ক্রিড়া পরিসরে স্মরণীয় হয়ে আছে। হরিপদ, গণেশ সরকার, লক্ষ্মীদাস প্রমুখ নওজোয়ান মাঠের ঐ সময় বিখ্যাত খেলোয়াড় ছিলেন। তারাগঞ্জ একাদশে লালবিহারী নাথ, সুরেন চ্যাটার্জি, নিখিল রায়, বীরেশ্বর রায়, আতর আলী, ওসমান উনি, অমর মজুমদার, ঠাণ্ডু সরকার, মন্টু রায়, মতিলাল সাহা প্রমুখ উল্লেখযোগ্য ভূমিকায় ছিলেন।
১৯৫৭ সালে পশ্চিম পাকিস্তানের আগা খান গোল্ডকাপ জয়ী কিয়ামারী স্পোর্টিং ক্লাব জামালপুর মহকুমাতে খেলতে আসে একটি আসরে। নালিতাবাড়ী থেকে একটা আদিবাসী ফুটবলা দল কোনরূপ প্রশিক্ষণ ছাড়াই খালি পায়ে খেলে সেই ক্লাবের বিরুদ্ধে রানার্সআপ হয়ে কৃতিত্বের স্বাক্ষর রেখেছিল। ষাটের দশকের অর্ধাংশ থেকে নৃগোষ্ঠীদের প্রভাব ও সংখ্যা নালিতাবাড়ীতে কল্পনাতীতভাবে হ্রাস পেতে থাকে। ৬৪’র রায়ট ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা এই জনপদের ভূ রাজনৈতিক কাঠামোর বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দেয়।
স্বাধীনতা পরবর্তী নালিতাবাড়ী ক্রীড়াঙ্গনে আমবাগান মহল্লার দত্ত বাড়ীর নাম স্মরণীয়। এই পরিবারের এমন কেউ নেই যিনি ফুটবলের সাথে জড়িত ছিলেন না। কিরণ দত্ত এবং অসীম দত্ত হাবলু, জয়জিৎ দত্ত এই নালিতাবাড়ীর স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ের কিংবদন্তি ফুটবলার। অসীম দত্ত হাবলু সত্তর দশক থেকে নব্বই পর্যন্ত নালিতাবাড়ীকে সারা দেশে ক্রীড়াঙ্গনের প্রতিনিধি হয়ে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন। হাবুল দত্ত নালিতাবাড়ীর কীর্তীমান ভূমিপুত্র।
এছাড়াও রত্ন সংঘ, নবরূপী, অগ্রদূত ক্লাব, যুব মুসলিম সংঘ নালিতাবাড়ীর গুরুত্বপূর্ণ ক্রিড়া সংগঠন । নালিতাবাড়ীর উল্লেখযোগ্য ক্রিড়াতীর্থ ভূমি হচ্ছে তারাগঞ্জ উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, শতবর্ষী হিরন্ময়ী উচ্চ বিদ্যালয় মাঠ, কাঁকরকান্দি বাজার মাঠ, পাইখাতলা মাঠ ইত্যাদি। সোনালী অতীত আজ ক্ষয়িষ্ণু স্মৃতি। ইতিহাস অজান্তেই তার স্বাক্ষর রেখে যায়। নালিতাবাড়ীর হৃদয় ভোগাই নদীর কোলে এই ক্রিড়াতীর্থ সমূহ এক জমানার আনন্দসিন্ধু।
তথ্যসূত্রঃ
- অধ্যাপক আব্দুস সালাম, নালিতাবাড়ীর মাটি ও মানুষ এবং আমি (২০০৬)
- সুবর্ণ সম্ভার, তারাগঞ্জ পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় স্মরণিকা ১৯৯৪ ইং।
- বিমল বসু স্বপন, বসু পরিবার। (২০১৯)
- তথ্য কৃতজ্ঞতা: প্রয়াত মোস্তফা কামাল, অসীম দত্ত হাবলু এবং এম.এ. হাকাম হীরা।