শেরপুরের জমিদারি: সুফি জরিপ শাহ প্রতিষ্ঠিত রাজ্যের পরবর্তীতে নামকরণ করা হয় গড়জরিপা। নানা ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে সম্রাট আকবরের আমলে এটি কামরূপ রাজ্যের অন্তর্গত দশকাহনিয়া বাজু বা বাজুহা বা অঙ্গরাজ্যের রাজধানী হিসেবে পরিচালিত হয়। বাজুহা বা অঙ্গরাজ্যের অধিপতিদের বলা হয় “জমিদার”। মোঘল সাম্রাজ্যের অন্তর্গত এই দশকাহনিয়া বাজু বা অঙ্গরাজ্যের এক সময় অধিপতি বা জমিদার হন ভাওয়ালের গাজী বংশ। এই গাজী বংশের শেষ অধিপতি বা জমিদার হলেন শের আলী গাজী। তিনি দীর্ঘ একুশ বছর মতান্তরে চব্বিশ বছর রাজত্ব করেন। শেরপুরের স্বাধীনতা ঘোষণা করে জমিদারি হারান।
শের আলী গাজী ছিলেন অত্যন্ত স্বাধীনচেতা, প্রজাহিতৈষী ও ন্যায়বিচারক। তার সুশাসনের ফলে প্রজারা যেমন সুখে শান্তিতে বসবাস করতো। তেমনই রাজা ও রাজ্যের প্রতি অনুগত ছিলো। বাজুহা বা অঙ্গরাজ্য হিসেবে বছর বছর রাজ্যের নবাবের এবং কেন্দ্রীয় সম্রাটের সমীপে নিয়মিত খাজনা পরিশোধ করতে হয়। বিনিময়ে প্রজাদের দমন ও শাসন করার জন্য প্রয়োজনে বহিরাগত ফৌজ বা সৈন্য এবং আশ্রয় প্রশ্রয় পাওয়া যায়। অবশ্য কেন্দ্রীয় সরকারের চাহিদার প্রেক্ষিতে প্রয়োজনীয় সৈন্য এবং রসদ সামগ্রী পাঠাতেও হয়।
দশকাহনিয়ার প্রজারা সুখে শান্তিতে বসবাস করে। বহিরাগত ফৌজ বা সৈন্যদের প্রয়োজনীয়তা নেই। জনগণ জমিদার শের আলী গাজীর প্রতি আস্থাশীল। এসব বিবেচনায় নবাব ও সম্রাটের সমীপে খাজনা দেয়া বন্ধ করে দেন এবং রাজ্যের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। পাশাপাশি এলাকার নতুন নামকরণ করেন শেরপুর। স্বভাবতই কেন্দ্রীয় সরকার চরম নাখোশ। কোনো ভাবেই স্বাধীনতার স্বীকৃতি দেননি। কিন্তু আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তার জন্য অপসারণ করতে পারছে না শের আলী গাজীকে। এমন সময় জনৈক বাণীবল্লভের তৎপরতায় কেন্দ্রীয় সরকার শের আলী গাজীকে উৎখাতের সুবর্ণ সুযোগ পায়।
ইতোপূর্বে (প্রায় এক দশক আগে) দশকাহনিয়া বাজুতে শের আলী গাজীর জনৈক খাজনা আদায়কারী হিসেবে নিয়োজিত ছিলেন রামবল্লভ মজুমদার। রামবল্লভের রূপবতী স্ত্রীর নাম পদ্মগন্ধা বা পদ্মাবতী বা পদ্মা। অনেকেই পদ্মগন্ধার প্রতি শের আলী গাজীর প্রেমের বিষয় বলেন। অনেকেই বলেন, দর্শা গ্রামের জনৈক বৈদ্যের রূপবতী কন্যা পদ্মগন্ধা। গাজী তার রূপ লাবণ্যে মুগ্ধ হয়ে পড়েন। কিন্তু গাজীর কানুন গো রামবল্লভ বিয়ে করে ফেলেন পদ্মগন্ধাকে। গাজী ক্রোধান্বিত হয়ে কৌশলে নৌবিহারে নিয়ে রামবল্লভকে হত্যা করেন। উল্লেখ্য, একজন জমিদার যখন নৌবিহারে যান, স্বভাবতই তখন নৌকায় মাঝি-মাল্লা, দেহরক্ষী, ফৌজ, পেয়াদারা থাকে। জমিদারের পক্ষে অতি নিম্নস্তরের কর্মচারী নিয়ে নির্জন স্থানে তা-ও আবার নৌবিহারে যাওয়ার বিষয়টি অনেকটাই হাস্যকর মনে হয়।
অনেকেই বলেন, রামবল্লভের সাথে পদ্মগন্ধার বিচ্ছেদ ঘটে এবং পদ্মগন্ধা জমিদার মহলে খাদ্য সরবরাহ করতো। কোনো কারণে গাজী তাকে শাস্তি দেবার জন্য বন্দি করার পরিকল্পনা করেন। গোপনে সংবাদ পেয়ে পদ্মগন্ধা পালিয়ে যায়।
আবার অনেকেই বলেন, জমিদার মহলে যাতায়াতের সুযোগে গাজীর পুত্রের সাথে পদ্মগন্ধার অবৈধ প্রণয় ঘটে। কথিত প্রণয়ের ফলে পদ্মা গর্ভবতী হয়ে পড়ে। এই অবৈধ প্রণয়ের বিষয় প্রকাশিত হলে শের আলী গাজী পদ্মাকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করতে পারেন, এই ভয়ে পদ্মা রাজধানী গড়জরিপা থেকে পালিয়ে যায়। পদ্মার পিতার বাড়ি শেরপুরের পূর্ব দিকে দর্শা নামক গ্রামে (বর্তমানে নেত্রকোণার অন্তর্গত )। পদ্মা পিতার বাড়ি না গিয়ে চলে যায় “হিলড়া” নামক দুর্গম স্থানে। এই “হিলড়া” গ্রামে পদ্মার জ্ঞাতি বংশ বসবাস করতো। এদিকে রাজধানী গড়জরিপায় এক নির্জন স্থানে নিহত হয় পদ্মার স্বামী রামবল্লভ মজুমদার। অনেকে আবার বলেন, রামবল্লভ মজুমদার নিহত হবার পর প্রাণের ভয়ে পালিয়ে যায় অন্তঃসত্ত্বা পদ্মগন্ধা।
যা হোক, সব বর্ণনা থেকে দুটি বিষয়ে মিল পাওয়া যায়।
১) রামবল্লভ মজুমদার নিহত হয়।
২) অন্তঃসত্ত্বা অবস্থায় পদ্মগন্ধা পালিয়ে যায়।
শের আলী গাজী যখন শেরপুরের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন তখন পলাতকা পদ্মগন্ধার শিশুপুত্রের বয়স নয় বছর। নাম “রামনাথ নন্দী”। পদ্মগন্ধা তখন পুত্র রামনাথ সহ জনৈক বাণীবল্লভের আশ্রয়ে থাকে “রাঙ্গামাটিয়া” নামক স্থানে।
স্বাধীনতা ঘোষণা করার জন্য কেন্দ্রীয় সরকার শের আলী গাজীর প্রতি চরম নাখোশ। এই সুযোগে বাণীবল্লভের পরামর্শ ও ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় পদ্মগন্ধা তার শিশুপুত্র রামনাথকে নিয়ে হাজির হয় নবাবের দরবারে। গাজীর প্রতি নবাব নোটিশ পাঠান। নবাবের নোটিশের জবাব দিলে, তার বশ্যতা বা অধীনতা স্বীকার করা হয়। সদ্যঘোষিত স্বাধীনতা মূল্যহীন হয়ে পড়বে। এই বিবেচনায় শের আলী গাজী নবাবের নোটিশের জবাব দিতে বিরত থাকেন। ওদিকে নোটিশের জবাব না দেয়ার প্রেক্ষিতে নবাবের আদেশে আদালতে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়।
শের আলী গাজী বুঝতে পারেন, বিচারের নামে প্রাণদণ্ডের সমূহ সম্ভাবনা! অন্যথায় ভয়াবহ যুদ্ধ! অনন্যোপায় হয়ে নবাবের দ্বারস্থ হলেন। নবাব তখন ইসলামী মিরাস অনুসরণের সুযোগ দেন। ধূর্ত বাণীবল্লভের পরামর্শে বাদিপক্ষ অর্থাৎ পদ্মগন্ধা শর্ত দিলো, জমিদারি ছেড়ে দিলে তবেই সমঝোতায় রাজি। শের আলী গাজী তখন শর্ত দিলেন, বাজুহা বা অঙ্গরাজ্যের নতুন নামকরণ “শেরপুর” বহাল থাকতে হবে এবং পদ্মগন্ধা জমিদারি পাবে না। রাজ্যসরকার তথা নবাব বাহাদুর এসব শর্ত মেনে নিলেন। বাদি, বিবাদি ও নবাবের সব পক্ষের সম্মতিতে শেরপুর বাজুর নতুন অধিপতি বা জমিদার হন পদ্মার শিশুপুত্র “রামনাথ নন্দী”। শিশুপুত্রের পক্ষে দেখাশোনা করবেন মাতা পদ্মগন্ধা ওরফে পদ্মাবতী।
জমিদারি হারিয়ে শের আলী গাজী তার খামারবাড়িতে অবস্থান করেন। সুফি সাধনায় জীবন যাপন করেন। সেই এলাকাটিই বর্তমানে “গাজির খামার” গ্রাম। গিদ্দাপাড়ায় তার মাজার বা সমাধি। কথিত আছে, শের আলী গাজীর বংশের কেউ অথবা কিছু অনুসারী পাকুরিয়া গ্রামে বসবাস করতেন। সেই এলাকাটিই বর্তমানে “পাকুরিয়া ফকির পাড়া”। উক্ত গাজীর খামার এবং পাকুরিয়া ফকির পাড়ায় বেশ কিছু জায়গা-জমি লাখেরাজ, অর্থাৎ সরকারকে এসব সম্পত্তির কর দিতে হয় না। লৌকিক ভাষায় অনেকেই বলেন, “নাহারাজি সম্পত্তি”।
এদিকে বাণীবল্লভের প্রতি কৃতজ্ঞতা স্বরূপ রামনাথ তাকে শেরপুরে প্রচুর পরিমাণে সম্পত্তি দান করেন। জমি পেয়ে বাণীবল্লভ তার পিতা ভুবানন্দ এবং পুত্র রাজবল্লভসহ পুরো পরিবার নিয়ে বসবাস শুরু করেন। এই এলাকাটির বর্তমান নাম “রাজবল্লভপুর”।
তথ্যসূত্র:
- ময়মনসিংহের বিবরণ, শ্রী কেদারনাথ মজুমদার
- শেরপুর জেলার অতীত ও বর্তমান, পণ্ডিত ফছিহুর রহমান
- শেরপুরের ইতিকথা, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন
- ইতিহাস ঐতিহ্য গড়জরিপা, প্রকৌশলী এম আহসান আলী ও মো. আকরাম আলী।
- শ্যামল বাংলা, আব্দুস সামাদ ফারুক।
- বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন।
- ভ্রমণ গাইড।
- উইকিপিডিয়া, শেরপুর জেলা।
লেখক: হারুনুর রশীদ, কবি ও গবেষক