Our Sherpur

শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা

শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা

জ্যোতি পোদ্দার

জ্যোতি পোদ্দার
লেখক: জ্যোতি পোদ্দার

এই উত্তর জনপদের টাউন শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চার ইতিহাস খুব বেশী দিনের না। দেশভাগের পূর্বে এখানকার সামন্ত জমিদারদের নিজস্ব পত্রিকা ছিল—ছিল প্রেসও। যত না বাণিজ্যের কারণে মুদ্রণযন্ত্র স্থাপন তার চেয়ে অধিকতর দৃষ্টি ছিল শিল্প সাহিত্য চর্চার পরিসর নির্মাণ করা।

যে সময়ে শেরপুরে মুদ্রণ যন্ত্র স্থাপিত হয় তখন টাউন শেরপুর নিতান্তই প্রান্তিকের প্রান্তিক– এক পাণ্ডববর্জিত অঞ্চল। তবু এখানে ’বিদ্যোন্নতি সাহিত্য চক্র’ গঠিত হয়ে গেছে। বেরুচ্ছে মাসিক ‘বিদ্যোন্নতি সাধিনী’ (১৮৬৫) সামন্ত জমিদার হরচন্দ্র চৌধুরীর প্রযত্নে বিখ্যাত পণ্ডিত চন্দ্রমোহন তর্কালঙ্কারের সম্পাদনায় অন্যদিকে জগন্নাথ অগ্নিহোত্রির সম্পাদনায় ’বিজ্ঞাপনী’ (১৮৬৬)।

প্রান্তিকের প্রান্তিক টাউন শেরপুর হতে দুই দুটি পত্রিকা বের হচ্ছে। চাট্টিখানি কথা নয়। পত্রিকা থাকবে আর গ্রাহক পাঠক থাকবে না — তেমন তো হতে পারে না। কাজে কাজে মুদ্রণ যন্ত্র স্থাপন করে পাঠকের সাথে সম্পর্কায়ন দ্রুততর করা। প্রথম দিকে ঢাকা থেকে ছাপিয়ে আনতে হতো। এতে সময় ও অর্থ– দুটিই বাঁচে। শিল্প, সাহিত্য, দর্শন চর্চার পরিসর বাড়িয়ে দেবার যে আকুলতা সামন্ত হরচন্দ্র চৌধুরী ভেতর ছিল তাকেই অধ্যাপক মোস্তফা কামাল বলেছেন, “এখানেই শিল্পী হরচন্দ্র চৌধুরী সামন্ত হরচন্দ্রকে পরাজিত করে স্বাধীন শৈল্পিক সত্তায় জাগ্রত ও স্পষ্টবাক।”

Products list of Our Sherpur
শেরপুর জেলার যেসব পণ্য আওয়ার শেরপুর এ পাওয়া যায়।

সামন্ততন্ত্রের গভীরে তখন নয়ানী জমিদার ও পৌনে তিন আনি জমিদারদের ভেতর যেমন শরিকি হিস্যা ঈর্ষা বিদ্বেষ বাড়ছিল একই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছিল কল্যাণমুখী নানা কায়কারবার। একপক্ষ স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন তো আরেক পক্ষ বছর না ঘুরতেই আরেকটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। তেমন পাল্লা দিয়ে পারিবারিক পাঠাগার প্রতিষ্ঠা বা পত্রিকা প্রতিষ্ঠা। এই পাল্টা পাল্টির ভেতরই জন্মেছেন হিরন্ময়ী দেবী।

হিরন্ময়ী দেবী চৌধুরীই এই উত্তর জনপদের প্রথম মহিলা কবি। ১৯২১ সালে ’পুস্পাধার’ কাব্য গ্রন্থটি প্রকাশিত হয়। যদিও….পুষ্পাধার সাধারণের মধ্যে প্রকাশিত হইল না।২৫ বইটির ভুমিকা লেখেন আড়াইআনী জমিদার শ্রী গোপাল দাস চৌধুরী।

পত্রিকা প্রকাশের চার বছর পর ১৮৬৯ সালে টাউন শেরপুর পৌরসভা ঘোষিত হয়। এখানে একটু তথ্য দিয়ে রাখি ময়মনসিংহ ও শেরপুর একই সনে পৌরসভা ঘোষিত হয়। এপ্রিল আটে ময়মনসিংহ, জুন ষোলই শেরপুর। হাতে গুনা কয়েক মাসের ছোট শেরপুর পৌরসভা। নিশ্চয় এই প্রান্তিকের প্রান্তিক বৃটিশের অর্থনৈতিক সূচকে শেরপুর তখন রাইজিং জোন–রাজনৈতিক প্রশাসনিক ও অন্যান্য ক্ষেত্রে যথেষ্ট অগ্রগতির স্পেস বিদ্যমান ছিল।

এই আর্থসামাজিক বুনিয়াদের উপর ভিত্তি করে আরো যতটুকু শেরপুরের বিকাশ ও বিস্তরনের দরকার ছিল ততটুকু বলতে গেলে হয়নি। কেন হয়নি তার কার্যকারন ও পর্যালোচনা যোগ্য কোন সমাজতত্ত্ববিদ করবেন– সেই ক্ষেত্র আমার না।

দেশভাগ পূর্বের দালিলিক প্রমাণপত্র পেতে আমাদের হাত পাততে হচ্ছে হরচন্দ্র চৌধুরী প্রণীত ‘সেরপুর বিবরণ’ (১৮৭২) অথবা বিজয় চন্দ্র নাগের ’নাগ বংশের ইতিহাস’ (১৯২৭) অথবা হাল আমলে প্রকাশিত নয় আনী জমিদার বাড়ির উত্তরধিকার গোপা হেমাঙ্গী রায়ের ‘সোনার খাঁচার দিনগুলো’ (২০০৪) উপর।

দেশের ১৪শ জিআেই পণ্য শেরপুরের তুলশীমালা ধান

স্থানিক কোন আর্কাইভ বা পুরাতন পাঠাগার না থাকার (ইতিহাস চেতনা না থাকার কারণে কালের প্রকোপে অথবা কর্তা ব্যক্তিদের অবহেলায় ধ্বংস হয়ে গেছে) দরুণ তৎকালীন সময়ে প্রকাশিত কোন পত্রিকা বা স্মরণিকা আমাদের হাতে নেই। থাকলে হয়তো টাউন শেরপুরের যাত্রা পথটুকু বেশ ভালো ভাবেই জানা যেতে।

পরবর্তীতে যারা টাউন শেরপুরে নিয়ে কাজ করেছেন যেমন অধ্যাপক দেলওয়ার হোসেন, পণ্ডিত ফসিহুর রহমান বা হাল আমলে মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ– তারা কেউই ১৮৮০ সাল থেকে ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত টাউন শেরপুরে সামাজিক রাজনৈতিক অর্থনৈতিক বা সাংস্কৃতিক ইতিহাসের কোন দালিলিক তথ্যাদি হাজির করেন নি– কোথাও কোথাও ঘটনার তারিখ লিখেই ইতিহাস চর্চার কর্তব্য সম্পন্ন করেছেন।

তবে যতটুকু তাদের সামর্থ (একক ব্যক্তি কতটুকুই আর করতে পারে!) ততটুকু দিয়ে তারা তাদের কাজ সম্পন্ন করে গেছেন। অত্যন্ত তারা তো শুরু করে গেছেন–এখন বাকি মিসিংলিংক সন্ধান ও পর্যালোচনার করে যোগসূত্র স্থাপন। তবে না তৈয়ার হবে অতীতের সাথে বর্তমানের সংযোগ সড়ক। তার দায় ভাগ এই প্রজন্মের।

স্থানিকে সমাজ কারিগরিদের সন্মান জানানো এবং তাদের প্রাপ্য মর্যাদা দেবার এই একমাত্র পথ তাদের নানামুখী কাজের ভাবের নানাদিক নিয়ে আলোচনা করে পর্যালোচনা করা– তাদের সময় ও কাজের সম্ভবনা ও সীমাবদ্ধতা নিয়ে আলোচনা সমালোচনার পরিসর সৃষ্টি করা। স্থানিক ইতিহাসের উপাত্ত সংগ্রহ বিশ্লেষণ করে যথাযথ ভিত্তি রচনা ছাড়া জাতীয় ইতিহাস বিকাশ লাভ করতে পারে না। ইতিহাস শুধুমাত্র কতিপয় তারিখ আর গুচ্ছ গুচ্ছ মানুষের নাম নয়। নয় জলাবদ্ধ পুকুরের ভাগাড়— ইতিহাস একটি জীবন্ত ব্যাপার।

শেরপুরের মন্ডা আর মুক্তাগাছার মন্ডা কী একই?

যা আমরা হারিয়েছি তা তো গেছেই, কালের গর্ভে যতটুকু এখনো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে– হোক না ধর্ম কিংবা শিল্প সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনীতি বা পরিবার সমাজ ক্ষেত্র– কার  তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ রাখা– ভাবী কালের সমাজভাবুকদের জন্য। সেই জায়গায় দাড়িয়েই যতটুকু সম্ভব টাউন শেরপুরের ছোটকাগজ চর্চার হদিস আনা বা উপাত্ত হিসেবে হাজির রাখা। সব যে পেয়েছি সেইদাবী করব না– যতটুকু পেয়েছি হোক সে স্মরণিকা ভাঁজপত্র স্কুল কলেজের বার্ষিকী বা সাহিত্য পত্রিকা কিংবা নানা সংগঠনের সংকলন — সকলকে ‘ছোটকাগজ’ ডাক নামে একত্রে হাজির করা। একে অপরের যোগসূত্রতা বা বিচ্ছিন্নতা তুলে ধরা— কিংবা বলা যেতে পারে প্রকাশিত নতুন পুরাতন ছোটকাগজ একজন পাঠকের এক ধরনের পাঠ ও পাঠোত্তরে টুকিটাকি মন্তব্য এবং লিখিয়েদের নানা কথাবার্তার সময়ের লেখচিত্র মাত্র।

দেশ ভাগ উত্তর তরুণ সুশীল মালাকার হাতে লেখা পাক্ষিক পত্রিকা ‘কিশোর’ (১৯৫৭) দিয়েই টাউন শেরপুরে ছোটকাগজের যাত্রা শুরু। সহ-সম্পাদক অধির দাসকে নিয়ে ‘বছর খানিক ধরে’ প্রকাশিত হয়েছিল। ষাটের দশকের শেষদিকে সুশীল মালাকার ও মোজ্জামেল হকের যৌথতায় সাহিত্য পত্রিকা মাসিক ‘দখিন‘ (১৯৬৭) বের হয় নিউ প্রেস থেকে। এটিই টাউন শেরপুরে ছাপা পত্রিকার যাত্রা বিন্দু– এইটুকুই তথ্য হিসেবে হাজির। ১৯৪৭ থেকে ১৯৬৭ এর মাঝে ‘কিশোর’ ছাড়া অন্য কোন সাহিত্য পত্রিকা বা স্মরণিকা প্রকাশিত হয়েছে কিনা তার কোন দালিলিক তথ্যাদি পেলাম না। হয় তো হয়েছে, হয়তো না। এতটুকু মেনেই ১৯৭০ সন থেকেই তথ্যাদি সূত্রাবদ্ধ করতে থাকি।

ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়ন তাদের আদর্শিক লড়াই শুধু মিছিল বা মিটিঙের ভেতর সীমাবদ্ধ না রেখে বিভিন্ন দিবসভিত্তিক স্মরণিকা প্রকাশের ভেতর দিয়েও চর্চা করে গেছে। এখনকার ছাত্র রাজনীতির রূপ যাই হোক না কেন স্বাধীনতার আগে পরে ছাত্র সংগঠনগুলো স্মরণিকাকে হাতিয়ার করেছে। শিল্প সাহিত্য দর্শন চর্চার ভেতর দিয়ে রাজনৈতিকতার চর্চা করেছে। টাউন শেরপুরে এই দুটি সংগঠনের স্মরণিকা গুলো ছিল- আবাহন (১৯৭০), লাল পলাশ (১৯৭০), সূর্য্য অন্বেষা (১৯৭০), রক্তের স্বাক্ষর (১৯৭১), ওরা মরণজয়ী (১৯৭২), স্পন্দিত শোনিত (১৯৭৩), অগ্রণী (১৯৭৩), অঙ্গন (১৯৭০), ঘোষনায় আমরা (১৯৭২), নন্দিত নবীন (১৯৭৪)।

শেরপুরে শ্রমিক সংগঠনও সাহিত্য পত্রিকা করেছে। সাতের দশকের শেষের দিকে মূলত জাসদের প্রভাব বলয়ে এই শ্রমিক সংগঠনগুলো গড়ে ওঠেছে। সমর্পন (১৯৭৯), প্রলেতারিয়েত (১৯৮০), শ্রমিকদের মে দিবসের পত্রিক। এছাড়া জাসদ ছাত্রলীগ তাহেরের ফাঁসির পর আরো দুটি স্মরণিকা প্রকাশ করে–বিস্ফোরণ (১৯৮০) ও লাল সালাম (১৯৮০)।

গোষ্ঠিভিত্তিক সাংস্কৃতিক কর্মতৎপরতা শুরু করেন কৃষ্টি প্রবাহ। সাহিত্য চর্চা তাদের লক্ষ ছিল না। ছিল গান নাটক নৃত্য ইত্যাদি চর্চা ভিত্তিক কার্যক্রম। বিভিন্ন সময়ে তারা বুলেটিন বা বিশেষ সংখ্যা প্রকাশ করলে কবিতা বা গল্প নিবন্ধ নিয়েই প্রকাশ পেতো। স্থানিকের বৈশিষ্ট্যই এমন। প্রবাহ (১৯৭৪) তাদের নিজস্ব কাগজ।

শহীদ মোস্তফা থিয়েটার নানা তৎপরতার ভেতরও নাট্য বিষয়ক কাগজ ’নাট্যপত্র’ (২০১০) প্রকাশ করে। অন্যদিকে উদীচী আর্দশভিত্তিক সাংস্কৃতিক সংগঠন। আটের দশকেই শেরপুরে তাদের কার্যক্রম বিস্তার লাভ করে। উদীচী নিদির্ষ্ট লক্ষ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে আজো শেরপুরসহ সারা দেশে সমাজ রূপান্তরের জন্য সাংস্কৃতিক লড়াই সংগ্রাম করে যাচ্ছে। তাদের মুখপত্র বিভিন্ন সময় বিভিন্ন নামে বের হয়েছে। যে ক’টি হাতে পেয়েছি—ব্রজে বাজে বাঁশী (১৯৮৬), অঙ্হিকার (১৯৮৫), মৃৎ (২০০৮), ইস্ক্রা (১৯৮৫), প্রস্তুতি (১৯৮৬), ছিঁড়ে আনো ফুটন্ত সকাল (১৯৮৮), রক্তপদ্ম (১৯৮৩) ইত্যাদি।

পাতাবাহার দুলাল দে বিপ্লবের প্রতিষ্টিত শিশু কিশোর সংগঠন। ১৯৭২ সালে যুদ্ধ থেকে ফিরেই দুলাল এই খেলাঘরটি প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭৫ বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকী যে প্রতিরোধ যুদ্ধে ডাক দেন– এই শেরপুর অঞ্চলে অনেকের মতো তিনিও সেই যুদ্ধে অংশ নেন এবং জামালপুরে আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সন্মুখ যুদ্ধে শহীদ হন। স্থানিকে কর্মতৎপরমুখী এই খেলাঘরের সাময়িকী গুলো হলো—প্রতিধ্বনি (১৯৮৯), অঙ্গিকার (!), চেতনা (১৯৭৭)। এছাড়া বৈতালিক কচিকাঁচার বার্ষিক মুখপত্র — কচিকাঁচা (১৯৮৫) আর শিশুদের জন্য শিশুদের পত্রিকা ’দুরন্ত (১৯৮৮)-ই একমাত্র টাউন শেরপুরে শিশুতোষ পত্রিকা যেখানে সম্পাদকদ্বয় যথেষ্ট মাঠ প্রস্তুতি করেই শুরু করেছিলেন কিন্তু গোটা তিনেকের পর হাল ছাড়তে হলো।

শেরপুর সাহিত্য পরিষদ গঠনে কবি আবদুর রেজ্জাক অনুঘটকের ভূমিকা পালন করেছেন। অগ্রজ এই কবি দীর্ঘদিন সাংগঠনিক তৎপরতার ভেতর দিয়ে পত্রিকা প্রকাশ করে গেছেন। বিভিন্ন নামে কাগজ করলেও ’কালিক’ ছিল তাঁর সম্পাদিত সবচেয়ে ভালো একটি সাময়িকী। এছাড়াও –উচ্চারণ (১৯৮২), কালিক (১৯৯৩), অন্বেষা (১৯৮১), স্মরণিকা (১৪১০) ও স্পন্দন (১৪০২)।

শেরপুরের ছানার পায়েস…

এছাড়াও কলতান গোষ্টীসহ আরো কতিপয় সংগঠনের নিয়মিত অনিয়মিত ছোটকাগজগুলো হলো- আমরা তোমারই সন্তান (১৯৯১), সমর্পন (১৯৭৯), বিজয় কেতন (১৯৮৩), ক্ষোভ (১৯৮১), অংকুর (১৯৯০), কংস (১৯৯০), অনুশীলনী (১৯৯২), ধী (১৯৯২), বালার্ক (১৯৯৯), রক্ত ঝরা একাত্তর (১৯৯৫) ও বিহান (২০১৮)।

গত শতকের আটের দশক টাউন শেরপুরে যেমন একের পর এক সাহিত্য গোষ্ঠির জন্ম নিয়েছে তেমনি মৃত্যু ও অপুষ্টির হারও উর্ধ্বমুখী। চিন্তার জাড্যতা ও অধিকতর সাংগঠনিক কার্যক্রম এবং শুধু কমিটি সর্বস্ব সাহিত্য গোষ্ঠি হবার কারণে টিকে থাকতে পারেনি। তবে একমাত্র বিহঙ্গ সাহিত্য গোষ্ঠির প্রযত্নে প্রকাশিত ’মানুষ থেকে মানুষে’ (১৯৮০) কাগজটি ধারাবাহিক প্রকাশের ভেতর দিয়ে তারা তাদের নানা মমুখী কার্যক্রম চালিয়ে গেছেন।

টাউন শেরপুরে লাইব্রেরির চলার পথ ১৯২৬ থেকে। রিডিং ক্লাব নামে প্রতিষ্টিত সেই সময়ে “টাকা ডিপোজিট” রেখে গ্রাহক বাড়িতে বই নিয়ে যাবার প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যে যাত্রা শুরু সেটিই আজকের খান বাহাদুর ফজলুল রহমান জেলা সরকারি গ্রন্থাগার। আটের দশকে কয়েকজন উদ্যোগী সংস্কৃতজন গ্রন্থাগারের পক্ষে উচ্চারণ (১৯৮৬) নামে একটি চমৎকার সাময়িকী প্রকাশ করে। নির্দিষ্ট প্রান্তিকে বের হবার প্রতিশ্রুত হলেও  ’উচ্চারণ’ আর উচ্চারিত হলো না। দীর্ঘদিন বোবা কালা হয়ে পড়ে থেকে অবশেষে সাংবাদিক হাকিম বাবুলের তৎপরতায় জেলা প্রশাসক মো: নাসিরুজ্জামানের প্রযত্নে আবারো গ্রন্থগার  ’ধ্বনি-১’ (২০১০) ধ্বনিত হলেও পুষ্টির অভাবে এখন আর কোন স্বর ও সুর নাই।

অনুশীলন
অনুশীলন

তবে আশার কথা বর্তমান গ্রন্থাগারিক সাজ্জাদুল করিম নানামুখী তৎপরতা চালিয়ে গ্রন্থগারটি পাঠকবান্ধব করে গড়ে তুলছেন; তিনিও মনে করে “পাঠাগারকে আরো উচ্চকিত করতে হলে পাঠাগারের নিদিষ্ট সাময়িকী থাকা দরকার- হোক সে মুদ্রিত কিংবা ওয়েব ম্যাগ- অথবা দুটোই।”

সাহিত্য পত্রিকার লড়াই কেউ কেউ ভাবেন নিতান্তই ব্যক্তি উদ্যোগ কেন্দ্রিক। এতে সামষ্টিকের ঝামেলা নাই। স্বাধীনতার স্পেস বাড়ে। ব্যক্তিদিশাই পত্রিকার চরিত্র ঠিক করে। সম্পাদকের ভাব ভাবনার রূপায়নের জন্য এখানে রয়েছে প্রশস্ত পথ। আবার এখানে দায়ও ষোল আনা। ঝুঁকি বন্টনের সুযোগ নেই।

হয় রাগী যুবকের ত্যাড়ামী নিয়ে এগিয়ে যাও তোমার হাতিয়ার নিয়ে নানা ঘটনাকে প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করে জারি রাখো রাজনৈতিকতা অথবা এক সংখ্যার পর আর্থিক বোঝা ঘাড়ে নিয়ে রণে ভঙ্গ দাও। আর সম্পাদকের তকমা গায়ে মেখে গেয়ে বেড়াও, “হ্যাঁ আমি একটি কাগজ করি। শীঘ্রই বের করব। লেখা সংগ্রহ করছি।” লেখা সংগৃহিত হতেই থাকে হতেই থাকে কাগজ আর বের হয় না।

দ্বিতীয় দলেই পড়ে স্থানিকের অধিকাংশ সম্পাদকেরা। যে উৎসাহ উদ্দিপনা নিয়ে প্রথমার জন্য জীবনপাত করে প্রকাশের পর দ্বিতীয়ার দিকে টান আস্তে আস্তে ফিকে হয়ে আসে। এই প্রবণতাই স্থানিক ছোটকাগজ চর্চার প্রবণতা। তাই বলে সবাই না। ঘাড় ত্যাড়া কেউ কেউ একা একা হাঁটে বহুদূর।

যারা স্থানিকে এক সংখ্যা করেই কুড়িতে বুড়িয়ে গেছেন বা ঝরে গেছেন পথের বাঁকে সেই কাগজ সম্পাদকের কথা কী আমরা তুলব না? তাঁর শ্রম প্রেম ঘাম চোখের ভেতরে জন্মে নেওয়া স্বপ্নের কোনই মূল্য থাকবে না? তা কী হয়?

মানুষ থেকে মানুষে
মানুষ থেকে মানুষে

তা হতে পারে না। আমি কোন নিক্তি নিয়ে স্থানিকের ছোট কাগজ আলোচনায় বসি নি। বরং যে কোন ধরনের নিক্তিকেই সন্দেহের চোখে দেখি। এক বাটখারা দিয়ে সবকিছু যাচাই হয় না। হতে পারে না। একেক স্থানিকে একেক রঙে রঙিন। তার উচ্চরিত ভাষা থেকে শুরু করে যাপনের সকল ক্ষেত্র আলাদা লালাদা। দেখবার চোখের অভাবে সকলের গায়ে ছড়িয়ে দেই একরূপতার চাঁদর।

আলাদাই সুন্দর। এক বাটখাড়ার চাপে ভাপে তাপে স্থানিকের আঞ্চলিক জন্মদাগ কেবলই ফ্যাকাশে ফ্যাকাশে মনে হয়। তাতে গুরুত্ব ধরে না মমত্বও ধরে না। স্থানিকের কবি কেন্দ্রে মুখগুজে স্থানিকের কাজকে মনে করে ”হাত মকশো করার স্মরণিকা”।

একরূপতাই যেন কালের ঈশ্বর। তিনিই কেন্দ্র তিনি পরিধি। এ্যাই শালা আমার আঁকা বৃত্ত ছাড়া অন্য কোন বৃত্ত নেই। একরূপতার কড়াল গ্রাসে হারিয়ে গেছে বৈচিত্র। স্থানিকের বৈচিত্র দিয়ে ভাষার বৈচিত্র। ভাষাজীবের বহুরৈখিকতা। যাপনে বহুকৌনিক না হলে কবিতা গল্প নাটকে নৃত্যতে বহুরৈখিকতা আসে না। আসতে পারে না। স্থারিকের সবিকাশ জরুরি। স্থানিকে আনুভুমিক বিকেন্দ্রিকরন জরুরি। খাড়াখাড়ি ক্ষমতার বিন্যাস জরুরি। তবেই স্থানিক তাঁরস্বরে কথা কইয়ে উঠবে- সেই স্থানিক হোক না শেরপুর, মুন্সিগঞ্জ, নওঁগা অথবা পাতরাইল কিংবা নাচোল।

টাউন শেরপুরে ব্যক্তির প্রযত্নে ছোটকাগজ–প্রয়াস (১৯৮৭), রবি রশ্মি (১৯৮৩), কবিতাপত্র (১৯৮৩), বিজ্ঞাপন পত্র (১৯৮৪), বৈশাখী (১৯৮৩), বিষন্ন সৈকতে ভোরের নোঙর (১৯৮৪), এই প্রান্তের সময় স্রোত ও অন্যান্য ১৯৯৯), রক্তের আল্পনা (১৯৮১), আড্ডা (১৯৯২), ময়ূখ (১৯৯৬), সঞ্চরণ (১৯৯১), বর্ষাতি (১৯৯৭), সাহিত্যলোক (১৯৯৩), কনকাঞ্জলি (১৯৭৯), মন্বন্তর (১৯৮০), দৃষ্টি কথা বলবে (১৯৭৯), চতুরঙ্গ (১৯৭৬), ক (১৯৮৪), রক্ত মাংসের স্বর (১৯৮৩), সূর্করোজ্জ্বল নিজ দেশ (১৯৮৬),  ক্ষয় (২০১০), সপ্তডিঙ্গা মধুকর (২০০২), রা (১৯৯৮)।

তুলশীমালা চালের প্রথম কাস্টমার রিভিউ

এই ছোটকাগজগুলো টাউন শেরপুরে সাহিত্য চর্চা চাতাল নির্মানে সবিশেষ ভুমিকা পালন করেছে। হয় তো কয়েকটি কাগজ একাধিক আলোর মুখ দেখেনি তবু সূচনা সংখ্যায় নিজের সরব উপস্থিতি জারি রেখেছে। স্থানিকে পাঠক বলয় যথেষ্ট প্রসারিত নয়। আর্থ সামাজিক কাঠোম এমন যে নিজে ও পরিবারের আহার সংস্থানের সকাল সন্ধ্যা গতরে পরিশ্রমের পর আর ফুসরত কই? পঠন পাঠনের যে সংস্কৃতি যে আলোড়ন যে ঝোঁক সমাজে দেখা দেবার কথা সেটি টাউন শেরপুর কেন বাংলাদেশের কোন মফস্বলের ভাগ্যে জুটে নাই। সব কিছু সর্বসুখ ঐ রাজধানী ঢাকাতে- এমন মনোভঙ্গির কারণেও স্থানিক ন্যাতিয়ে আছে ম্যাড় ম্যাড়া হয়ে আছে। সজীবতা নেই। সনদধারী বেড়েছে বটে। স্কুল কলেজে কিণ্ডার গার্ডেন কোচিংয়ের রমারমা; বাজার আছে ক্ষুদ্র ঋণের নামে নানা কিসীমের টাকার দোকান।

তাই বলছিল পঠন পাঠনের সংস্কৃতি গড়ে দেবার যে সামাজিক সাংস্কৃতিক আত্মিক আন্দোলন সেটি মফস্বলে বিস্তার ঘটেনি। রাজনৈতিক ট্যাণ্ডার বাজির সাথে পাল্লা দিয়ে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নের সুচক উর্ধ্বমুখী। জ্ঞান ও জ্ঞানীর সন্মান করতে হবে বলে বই মুখস্ত করলেও প্রয়োগে এসে চোরাবালিতে আটকে আছে।

কড় গুণে গুণে বলে দেবার মতো পাঠকের সংখ্যা। কাজে কাজেই ছোটকাগজের বাজার বলতে ঐ গুটি কয়েক জনের করিডোর। কাগজ বিক্রি করতে গেলে কবি ও সম্পাদকেরর ঘাম ঝরার সাথে সাথে আগ্রহও ঝরে পড়ে মাথা থেকে পায়ে।

তদুপরি আছে কবি ও কবিতা সম্পর্কে অবজ্ঞা অবহেলা। হোক সে পরিবার কিংবা নাগরিক সুশীলবর্গের। দ্বিমেরু রাজনীতির কারনে সুশীলেরা হালুয়ারুটি একটু ঘুরিয়ে খাবেন তবু তরুণ কবি ছোটকাগজ নিয়ে টু শব্দ করিবেন না। পাঠক সমালোচকের পর্যালোচনাই যে তরুণের নতুন দিশা খুলে দিতে পারে তেমন পাঠক কিংবা সমাজ আমরা “সৃজন করিতে পারি নাই।”

তিন রাস্তা মোড়ে গলা ফুলিয়ে ঘন্টার ঘন্টার পর বক্তৃতা দিতে পারি বটে কিন্তু কোন ভাবেই চিন্তা চর্চা করবার পাঠচক্র করবার পরিসর তৈরি করবার অবসর কারো হয়নি। কোথাও কোন কিছু তো এমনি এমনি জন্ম বিকাশ ঘটে না, তার একটা কার্যকারন থাকে- ফসল ঘরে তোলবার পূর্বে যেমন জমি চাষাবাদের দরকার পরে; তেমনি স্থানিকের বিকাশ সার্বিকতার উপর নির্ভর করে। সেই পরিসর আমাদের কই।

পঠন পাঠনের সংস্কৃতি গড়ে তুলবার কোন সামিজিক ফোর্স নাই। ছাত্র শিক্ষক অভিভাবকের এখন এ প্লাসকেই মেনেছে জীবনের সার। স্কুল কলেজ শ্রেণিকক্ষ এখন স্রেফ পরীক্ষা হলো কোচিংই হলো মৌল বিদ্যাপীঠ- ভেতর শিক্ষার্থী কোচিংয়ের বাইরে কী ভীষণ কাতরতা নিয়ে এখানে ওখানে হত্যে দিয়ে বসে আছে কালের বাবা মা।

স্কুল কলেজের পাঠাগার দেখেছেন? গাদাগাদা বইয়ে ঠাসা তার উপর ধুলার পরে ধুলার প্রেলেপ। শিক্ষক ব্যাচের পর ব্যাচ টিউশন করিয়ে করিয়ে ক্লান্ত, মুখে আর কোন রা বেরুই না। সব ক্যালরি শেষ। শিক্ষক রুমে বসে পান চিবাতে চিবাতে একটু ঘুমিয়ে ফুয়েল ভরে নিচ্ছে মাত্র।

এ চিত্র সর্বত্র। হোক সে শহর বন্দর জেলা কিংবা থানা শহর ইউনিয়ন পর্যন্ত এই চলচ্চিত্র কম বেশি দেখা দেবে। গ্রাম তো সেই গ্রাম নেই। পাকা রাস্তা। ম্যাইক্রো ক্রেডিট বাংলা। গ্রামীণ, আশা, ব্র্যাক আপারা এ বাড়ি ওবাড়ি উঠান বৈঠকে টাকা বেচাকেনায় ব্যস্ত। তাই বলে স্কুল কলেজে বার্ষিকী একবারেই হয়নি তা কিন্তু নয়। তবে তা হাতে গোনা। স্কুল কলেজের দেয়ালিকা, ম্যাগাজিন সাহিত্য চর্চার আঁতুর ঘর। সেই চর্চা স্বাধীন বাংলাদেশে বাড়েনি। দেখভাল করার লোক থাকলেও এই সহশিক্ষা কার্যক্রমের প্রতি একধরনের অবজ্ঞা প্রত্যক্ষ পরোক্ষভাবে মনের গভীরে জারি রয়েছে। তবু যেকটি এই স্থানিকে পেলাম- বার্ষিকী/৯০, প্রপর্ণ (১৯৯০), উৎস (২০০২), ধারা খরতর (২০১৫), কিশোলয় (১৯৯৮), শুভ্র ভোরের পুষ্পকথা (২০০৭), রজত (২০১৬), ভিক্টোরিয়া (২০১৭), প্রপর্ণ (১৯৯৯) ইত্যাদি।

শিশুদের জন্য কোন বিনোদনকেন্দ্র নেই। সজীব ফসল ঘরে ওঠছে। হোক সে হাইব্রীড। উঠছে পাকা দালান। টাইলস করা হাই কমোড লো কমোড বাথ রুম। সবই হাল ফ্যাশনের। হোন্ডা চালিয়ে তরুণ শহর যাচ্ছে আড্ডা মারতে নয়তো রাস্তার মোড়ে মাথা গুঁজে নেটে ঘুরছে জগৎ সংসার। এই আমাদের প্রান্তিক জনপদের সাধারন দৃশ্যবালি।

স্থানিকে ছোটকাগজ বের করবার প্রবণতা পড়তির দিকে। স্থানিক পাঠককে না পেয়ে কবি সম্পাদক এখন সিটিজেন ছেড়ে নেটিজেনে। লাইক কমেন্টসের সংখ্যায় গুনে নিচ্ছে কবিতা পড়ার রেটিং। নিউ ফিড আর টাইম লাইনেই স্থানিক কবির রমরমা বাজার।

এই উত্তর জনপদে বেড়ে ওঠা আমাদের ভূমিজরা প্রান্তিকের প্রান্তিক। গারো জনগোষ্ঠি নানা ধর্মীয় অনুষ্ঠান উপলক্ষ্যে স্মরণিকা বা ভাঁজপত্র প্রকাশ করছে।

সেখানেও কবিতা চর্চার পরিসর গড়ে ওঠছে। মিঠুন রাকসাম এ অঞ্চলে বেড়ে ওঠা তরুণ কবি। তাঁর কবিতায় উঠে আসছে গারো যাপনচিত্র। দ্বন্দ্ব ও সংঘাত। আপোস ও নির্মম বাস্তবতা। মিঠুনের কবিতায় গারো কথা বলছে। গারোর কথা গারোর কলমেই উঠে আসবে- যে জীবন আমার না সে জীবনের কথা কী করে আমি বয়ান করব? সেই জীবনের জন্য দরকার হয় প্রাঞ্জল সাংমা কিংবা একজন মিঠুন রাকসাম। মিঠুনের গারো কবিতা উচ্চকিত কবিতা।

বৃদ্ধ নানীর সাথে মন খুলে কথা বলতে পারি না।
নানী বাংলা জানে কম
আমি মান্দি জানি কম
মুখোমুখি বসে থাকি — বোবা হয়ে যাই।
শালার নিজের ভাষাটাও ভুলে গেলাম।
                      (গন্ধচোর: মিঠুন রাকসাম)

থকবিরিম– গারো সাহিত্যের কাগজ। প্রান্তিক জনগোষ্ঠী গারোদের আচিক ভাষা ও সংস্কৃতির বয়ানের কাগজ। মিঠুন রাকমামের প্রযত্নে প্রকাশিত। না, এই প্রকাশনার স্থানিক নয়— ঢাকা তে। হয়ত মিঠুনরা বুঝেছে বাঙালীর তাপ চাপ ভাপের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে বাঙালী রাজধানীতে দাঁড়িয়ে কেন্দ্রের বিবুদ্ধে প্রান্তিকের প্রান্তিক লড়াই চালিয়ে যেতে হবে। নিজের ভাষা সংস্কৃতিকে বাঁচার লড়াই চালিয়ে যেতে হবে।

থকবিরিম মানে বাংলা ভাষান্তরে ’বর্ণমালা’। থকবিরিম একটি প্রকাশনী সংস্থাও বটে। উদ্দেশ্য “গারো ভাষার সাহিত্য, গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, উপন্যাস, গারো লোককথা প্রকাশের মাধ্যমে নিজ ও অন্যান্য জনগোষ্ঠির সাথে পরিচিতকরণ।”

গারো আমাদের পড়শী। এ ভুখণ্ড নির্মাণের কারিগর। বহু রৈখিকতার মেলাবন্ধন অনাদিকালের। দেখাদেখি চাষ লাগালাগি বাসের পড়শী গারো হাজং কোচ বানাই ডালু হদি হিন্দু মুসলিমদের যৌথ যাপনের ভুমিখণ্ড এই উত্তরের জনপদ।

লাগালাগি পাশাপাশি হাত দুরত্বের পড়শী সম্পর্কে জানাশোনা কম। যতটুকু জানাজানি দাপটের জানাজানি। নিজেকে কেন্দ্রে রেখে পরিধিকে জানাজানির মতো। কখনো কালো নেটিভ, জংলি, জমিদারবাবুর এস্টেস্টের বেগার খাটা লোক। অচ্ছুত মান্দি। কখন নিজের সাধর্মের শ্রেষ্ঠতার নিরিখে, কখনো ভাষাভাষীর জাতীয়তাবাদের পাটিগনিতের সুদকষার হিসাব সূত্রে মন্দার্থে জানাজানি; নীচুতার নিক্তির মাপমাপি। বাঙালি হবার প্ররোচনায় – এক রৈখিক রেখার পাঠ। অথবা জাতিসত্ত্বার অস্তিত্ব অস্বীকার করার রাজনৈতিক পাঠ।

কিন্তু কখনো গারো জনগোষ্ঠির নিজস্বতার নিরিখে যাপনের রসায়ন দিয়ে বুঝতে চাই নি। খুব বেশি গারো কাগজ সংগ্রহ করতে পারিনি। পড়শীর সাথে আমারও কম দূরত্ব নয়। রবেতা ম্রং কিংবা সুদীন চিরান অথবা প্রাঞ্জল এম সাংমা আমার একমাত্র জানালা- ছোট্ট জানলা। সেখান থেকে সংগৃহিত- ব্রিংনি বিবাল (২০০৯), ওয়ানগালা (১৯৯৯), আসপান (২০১৫) ইত্যাদি প্রপাত্ত রেখেছি পঠকের জন্য।

ঋদ্ধহোক থকবিরিম। থকবিরিম নিজস্বতার বিকাশে গেয়ে উঠুক নিজের গান সে বলুক – সকলের সাথে আমার অবারিত যোগ আছে। বৈচিত্র্যই সুন্দর। ক্ষুদ্রই সুন্দর। সংখ্যাধিক্যের খাড়াখাড়ি দাপট নয়; গড়ে উঠুক মানুষের আড়াআড়ি বুনট। পারস্পরিক নির্ভরতার দ্যোতনা।

ব্যক্তি ধর্মনিরপেক্ষ হতে পারে। চর্চায় নিজে সকলকে ছাড়িয়ে যায়- যেতেও পারে- তাঁর মনোভুমি এক সার্কিকতার ছবি আঁকে। রিলিজিয়ন কে একান্ত ব্যক্তিকতার কোঠরে প্রাইভেসির করিডোরে ফেলে দিয়ে মানুষকে মানুষ হিসেবে খাড়া করবার লড়াই সংগ্রাম- রাষ্ট্র ও ধর্ম কে আলাদা করে– সেকুলারপন্থীকে সংগ্রাম করতে হয়। এ সংগ্রাম রাজনৈতিক সংগ্রাম। দীর্ঘদিনের সংগ্রাম। শুধু বাচনিকতা এর বাইরের খোলশমাত্র।

কিন্তু পাশ্চাতের সমাজকাঠমোর বুনন দিয়ে তো আমার সমাজ গঠিত নয়। তার আছে নিজস্ব ধরনধারন। ব্যক্তি ধর্মনিরপেক্ষতা চর্চা করলে বটে কিন্তু  আমাদের পরিবার সমাজ ধর্মনিরপেক্ষতার চর্চা করে নি। বার মাসে তের পার্বনের রিচুয়াল নিয়েই তার দিনগুজরান করতে হয়– দীর্ঘদিনের সংস্কার অভ্যাস রিলিজিয়ন ভিত্তিক অনুষ্ঠানে তাকে যুক্ত হতে হয়- সমাজের স্বভাব আর প্রভাব দুম করে উঠে যায় না; যেতে পারে না– তার জন্য যে রাজনৈতিক সংগ্রাম সেটি আমরা করে তুলতে পারিনি। এই সংগ্রাম হয়ে ওঠা সংগ্রাম। পুরানো খোলস থেকে বের হয়ে নতুনত্বের স্বাদ গ্রহণ-  সেটি খস করে কাগজে লিখলেই পরিবর্তন হবার নয়।

তার জন্য যে রাজনৈতিক কর্মতৎপরতা তার অভিমুখ এখন বীজাকারে বীজেস্থিত। আমরা প্রত্যাশা করতেই পারি কোন আগামী ভবিষ্যত। যাক যা বলছিলাম। ধর্মিক আয়োজিত অনুষ্ঠান স্যুভিনিয়র বা কোন স্মরণিকা বের করা নতুন নয়। এটি কখনো গুরুত্বের সাথে দেখা হয় নি। পত্রিকা প্রকাশ রিচুয়ালের কোন অবিচ্ছেদ্য অংশ নয় বরং তরুণ যে উৎসবে মেতে উঠে পুজা সংখ্যা বাহারি উৎসবের গায়ে একটি পালক যুক্ত করার ভেতর দিয়ে উৎসবকে আরেকটু রঙিন করে তোলে পাশাপাশি মহল্লার তরুণ লিখিয়ে হাত মকশো করার একটা পরিসর পায়। কে জানে হয়তো এই কাগজটিই হতে পারে তরুণের উস্কে দেয়া কাঠি- জ্বলে ওঠতে পারে মুহুর্তে অন্ধকার ভেদ করে।

টাউন শেরপুরে একটা সময় এই চর্চা ছিল। শারদীয়া (১৯৯২), আদ্যা (২০১৪), স্মরণিকা (১৩৯২), দশভুজা (১৯৮৬), অঞ্জলি (১৪১৯), শারদ অর্ঘ্য (১৯৮৭) অন্যত্র দেখিনি। উৎসব উদযাপন পরিষদ এমন উদ্যোগেকে স্বাগত জানানো উচিত। স্মরণিকার চাতালে যে শুধু সাহিত্য চর্চা হতে পারে তা কিন্তু নয়– ধর্ম সংক্রান্ত আলোচনাও হতে পারে; হতে পারে পড়শী সংখ্যা গরিষ্ঠ কোন মানুষ লেখাপত্র। এতে করে সমাজে মানুষে মানুষে আরো একটি ব্রিজিং সৃষ্টি হতে পারে।

জ্যোতি পোদ্দার

শুধু মুখে বকবক করলে “সম্প্রীতি” বজায় থাকে না নিজের উঠানে অপরকে স্পেস দেবার মনোভঙ্গিও থাকতে হয় আর তখনই ধর্ম যার যার উৎসব সবার — কথাটির কার্য়ক্ষমতা দ্যোতিত হয়। এটি শুধু সনাতনীদের একার চর্চার বিষয় না– দেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের চর্চার জমিনও বটে।

স্থানিকে উৎসব স্মরণিকা তেমন একটা চাতাল হতে পারে। পুজাসংখ্যা কালে ভদ্রে বের হলেও স্থানিকে ঈদ সংখ্যা কড়ে আঙুলে গুনার মতো অবস্থা। আটের দশকে দুরন্ত চৌধুরী কয়েকবার ঈদুল আজাহ সংখ্যা করেছিলেন। বিভিন্ন নামে করলেও ’আলোড়ন’ নামেই একাধিকবার করেছেন। নয়েক দশকে সুহৃদ জাহাঙ্গীর “ঈদ সংখ্যা” নামে তাঁর নিযমিত কাগজ “আড্ডা”র একবার শুধু নামাঙ্কন করেছিলেন।

“আলোড়নে” ধর্ম ধর্মাচারের নানা বিধিবিধান নিয়ে আলোচনা থাকলেও “আড্ডা” তে শুধু ঈদ সংখ্যা লেখা- এ ছাড়া টাউন শেরপুরে এখানকার সাপ্তহিক দশকাহনীয়, চলতি খবর বা সাপ্তাহিক শেরপুর ঈদ সংখ্যা করবার উদ্যোগ দেখলেও; ইসলামিক আন্দোলনের সাথে যারা জড়িত– হোক জড়িত শরিয়তী বা মারফতি– কাউকে ঈদকে কেন্দ্র করে ধর্ম- সাহিত্য চর্চার চাতাল নির্মানের চেষ্টা দেখিনি।

বড় বড় মিডিয়া হাউজের কথা আমি বলছি না– বলছি কোন স্থানিকতায় পঠন পাঠন কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়বার যে মামলা মোকদ্দমা– আমি তার কথা বলছি। স্থানিকের অনাবাদী জমিন আকর্ষণ না করলে কোন সোনাই ফলবে না। দৈর্ঘ্যপ্রস্থে আমিনের মাপা জমির কথাই শুধু বলছি না — বলছি স্থানিকে মনোভুমি কর্ষন করার কথাও। স্থানিকতার বিনির্মান ছাড়া একটি দেশের আর্থসামাজিক কাঠামো গড়ে উঠতে পারে না।

রাজনীতির কেন্দ্রীভূত নীতি স্থানিককে করে রেখেছে ভাগাড়। তার বিকাশের কোন পরিসর সে রাখেনি। সংবিধানের পাতা থেকে কথাগুলো বের হয়ে আর পরিধির দিকে আসার সম্ভবনাকে সে করে রেখেছে চুয়ে পড়ার উপনিবেশিক নীতি শৃঙ্খলায়।

প্রকাশ উন্মুখ তরুণের প্রথম চাতাল হচ্ছে ’ভাঁজপত্র’। কবি যশপ্রার্থীর তরুণের রাখ রাখ ঢাক ঢাক গুড়ের ব্যবস্থাপত্রের নাম ভাঁজপত্র। চারপাতা ভাঁজের ভেতর বন্ধুদের কাঁচালেখা অথবা নিজের ছদ্মনামে একাধিক লেখা প্রকাশের মাধ্যম ভাঁজপত্র। সহজে কম পয়সায় বের করা যেমন যাচ্ছে তেমনি সহজে স্মৃতি থেকে হারিয়েও যাচ্ছে– এমনকি প্রকাশিত কপিটিও পাবার জো নেই। টাউন শেরপুরে ভাঁজপত্র—ইস্ক্রা (১৯৮৫), কবিতার কাগজ (১৯৮৯), ছাপ (১৯৯২), চিত্রচেতনা (১৯৮৬), সুড়ঙ্গ (২০০৮), উপমা (২০০৮), উত্তরণ (২০০৫), আর্তনাদ (২০১৭), মুহিম নগরের ট্রেন (২০১৮), দিপ্তী (২০০৩), সিঁড়ি (২০১১), মুক্ত বিহঙ্গ (২০১১), শুভেচ্ছা (২০০৭), মুক্তি (২০১৬), পদাঙ্ক (২০০৬), মধুকর (২০১৯), আলোর মিনার (২০১৯), পদ্মপাণি (২০১৮) ইত্যাদি প্রকাশিত ভাঁজপত্র।

দেয়ালিকার চল একেবারেই উঠে গেছে। শ্রেণি শিক্ষকের উদ্দীপনায় মেতে ওঠা শিক্ষার্থীদের দিবস কেন্দ্রিক তৎপরতা। সুন্দর হাতের লেখা আর বাহারী রঙের কাজ করা দেয়ালিকা যখন স্কুলমাঠে কিংবা দেয়ালে ঝুঁলে – তা দেখার আনন্দ আজকাল শিক্ষার্থী পাচ্ছে কি? খুব কম স্কুলেই দেয়ালিকা হয়। কয়েক বছর আগে টাউন শেরপুরে “জাতীয় শিক্ষা সপ্তাহে” উপলক্ষ আয়োজিত অনুষ্ঠানে দু’টি স্কুলের দেয়ালিকা দেখেছিলাম।

২০১৯ সালে ডিসি উদ্যানে শিশু কিশোরেরা আবির্ভাব স্থাপন করে।

অন্যান্য ক্লাব অথবা পরিবেশবাদী সংগঠন কিংবা শিক্ষায়তন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকেও বিভিন্ন প্রান্তিকে সাহিত্য চর্চার পরিসর নির্মাণে তৎপরতা লক্ষনীয়। দিবসভিত্তিক যেমন তেমনি সমাজ সংস্কৃতির প্রতি দায়বদ্ধতা থেকেও গড়েছে সংগঠন। “অরুনোপল” তেমনি একটি সংগঠন। এক স্ববপ্নবাজ তরুণ- রমিজুল ইসলাম লিসানের ব্রেইণচাইল্ড- অরুনোপলে। এদের মুখপাত্র সাহিত্য সংস্কৃতিররসমাহার “উৎস্বর্গ।”

কিন্ত বেদনা এই যে লিসানকে আমরা হারিয়েছি- ব্রেইনস্ট্রোকে ২০২০ সালের ২০ জানুয়ারিতে লিসানের ভেতর বড় এক সংগঠককে আমি দেখেছিলাম। বিকশিত হবার আগেই লিসান চলে গেল। টাউন শেরপুর একজন ভাবী নেতা হারালো। বিভিন্ন সংগঠন ভিত্তিক ছোটকাগজ হলো- আমাদের পাখি (২০১৯), রঙধনু (২০০৫), ফোঁটা (২০১৮), দেশের কথা (২০০৪), বাতিঘর (২০১৫), বিন্দু (২০০৯), উৎস্বর্গ (২০১৬), কংস (১৯৯০) ইত্যাদি নানা সংগঠনের সাহিত্য চর্চার চাতাল।

আবির্ভাব
আবির্ভাব দেওয়ালিকা

স্থানিকের কাজ গুলো এক মলাটে আনার ধারণা থেকেই মূলত ১৯৭০ সাল খেকে ২০২০ পর্যন্ত প্রকাশিত ছোটকাগজের হদিশ দিয়েছি মাত্র। বাছাইয়ের কোন বাটখারা বা নিক্তি আমি রাখি নাই। প্রাপ্ত সকল ছোটকাগজের তথ্য উপাত্ত দেবার পাশাপাশি নিজের কিছুকথাবর্তা ভরে দিয়েছি– সংযোগের মশলা হিসেবে; এর চেয়ে বেশি কিছু করি নাই।

তবে হ্যা যে সকল কবিতা উদ্ধৃতি দিয়েছি সেগুলো আমার ব্যক্তিগত পছন্দের বাছাই; সমগ্রদেশের প্রেক্ষিতে কোন তুলনা আমার লক্ষ ছিল না — স্রেফ স্থানিকের মনভূমির কর্ষিত জমিনকে দেখা ও দেখানোর পায়তারা আর কী করে মনোভুমি দৈর্ঘ্যপ্রস্থ গভীরে বাড়ানো যেতে পারে ভেতরে ভেতরে গোপন এক টান সদা হাজির থেকেছে– সেটি হোক শেরপুর কিংবা নাচোল অথবা কাউখালী–টাউন শেরপুরের স্থানিকতা উপলক্ষ মাত্র।

১৯৭০ সাল। বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে আর্বিভাব হবার প্রসূতি সময়। সাহিত্য সংস্কৃতি রাজনৈতিকতার নানা তৎপরতার ভেতর দিয়ে চলছে আত্মপরিচয় সন্ধানের লড়াই সংগ্রাম। কী কবিতা কী গানে কী সাহিত্য পত্রিকা চর্চায় – জীবনের সকল ক্ষেত্রে বাংলার জল, বাংলার ফল, বাংলার মাটির সাথে নিজেকে মিলবার ও মেলাবার জাতীয়তাবাদী দশক। এমন সময়ে ‘পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন’ শেরপুর মহাবিদ্যালয় শাখা প্রকাশ করেন ‘আবাহন’। নববর্ষ সংখ্যা। নারায়ণ চন্দ্র ঘোষ ও আবদুছ ছাত্তারের যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত পত্রিকাটির মূল্য পঁচিশ পয়সা। ‘আমাদের প্রেস’ জামালপুর থেকে মূদ্রণ। নববর্ষের অহ্বান জানিয়ে ‘আবাহনে’ শাহেদা বেগম রুনু লিখেছেন–

“মাধবীলতার কানে কানে,
চুপি চুপি—
বাতাস বলে গেল,
— সে আসবে…
গাছের ডালে বসে
সুন্দর পাখিটা ভাবলো
— সে আসবে….”
         (চৈত্রের শেষে)

গোলাম রহমান রতন লিখেছেন, “কোন আঞ্চলিক ভাষাভাষী লোকের পারিপার্শ্বিকতার উপর নির্ভর করে, সেই অঞ্চলের সংস্কৃতি।…সংস্কৃতির নিজস্ব স্বকীয়তা যেমন বিদ্যমান প্রতিটি ভিন্ন ভিন্ন অঞ্চলে, তেমনি তার প্রকাশও বিভিন্ন একই কারণে। তাই মোমেনশাহী গ্রাম্য অঞ্চলের বিয়ের গানের সাথে পাঞ্জাবী, বিয়ের গানের সামঞ্জস্যতা বিরল।” সাহিত্য ও সংস্কৃতি প্রসঙ্গে গোলাম রহমান রতন আরো লিখেছেন, “লোকসমাজই সংস্কৃতির ধারক ও বাহক; সে কারণে লোক সমাজকে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। স্বভাবতই সংস্কৃতির সঙ্গে সমাজ জীবনের সম্পর্ক ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। আর সমাজ জীবনের ভিত্তিটাই দাঁড়িয়ে আছে সম্পদ সম্ভার ও তার ব্যবহার প্রনালীর উপর; জীবিকার নতুন উপাদান ও উপকরণের আবিষ্কারে অগ্রসর হচ্ছে জীবন যাত্রা।” “আবাহনে” আরো লিখেছেন বিজন কর্মকার, মতীশ চন্দ্র কর, তপন সেন, উদয় শংকর রতন, সাধন গুপ্ত প্রমুখ।

”স্নিগ্ধ সলিলে উত্তাল তরঙ্গ দমকা হাওয়ার আভাস
মহাবীর, নহ ক্ষান্ত অতি দূরন্ত নব যুগের রাঙা প্রভাত
অশান্ত খড়গে দাম্ভিকের খর্বে শিলাবারি হানি
তাণ্ডব শেষে সুর আসে ভেসে মুকুলের কান্নাবাণী”
                    (উন্মাদ বৈশাখ: সাধন গুপ্ত)

শহর শেরপুর ছাত্র ইউনিয়ন থেকে একই বছরে প্রকাশিত একুশে সংকলন ’লাল পলাশ’ (১৯৭০)-এর সম্পাদক বিপ্লব কুমার দে ওরফে দুলাল। দুলাল শেরপুরে কবিতা আন্দোলনের একনিষ্ঠ কর্মী। পচাত্তুরে বঙ্গবন্ধু হত্যকাণ্ডের পর কাদের সিদ্দিকীর ডাকে যে প্রতিরোধ যুদ্ধ সংগঠিত হয় সেখানে তিনি জড়িয়ে পড়েন। এই প্রতিরোধ যোদ্ধা জামালপুরে তৎকালীন আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর সাথে সংঘর্ষে নিহত হন। তিনি একাধারে কবিতা গল্প নাটক অন্যদিকে সংগঠন চর্চায় শেরপুরে ইতিবাচক ভূমিকা রেখেছেন। লাল পলাশ তার প্রথম সম্পাদিত কাগজ।

“অন্ধকারের বুকচিরে একটি হৃদয়
শ্বাশ্বত প্রেমের অভিসারে
এগিয়ে চলে…
এগিয়ে চলে নিষ্ঠুর সমাজের টুঁটি চেপে
আর মিথ্যা নিয়মের বাঁধ ভেঙে।”
      (অন্ধকারের বুক চিরে: বিপ্লব কুমার দে দুলাল)

স্বাধীনতাপূর্ব ছাত্র সংগঠনগুলো ছাত্র রাজনীতির চাতাল নির্মাণে সাহিত্য সংস্কৃতি চর্চাকে হাতিয়ার করেছেন। হোক সে ছাত্র ইউনিয়ন কিংবা ছাত্রলীগ। গত শতাব্দীর ছয়ের দশকেই শেরপুরে ছাত্র ইউনিয়নের বিস্তার ঘটে মূলত এই অঞ্চলে কমিউনিস্ট নেতাদের প্রযত্নে। বিপ্লবী রবী নিয়োগীর বৈপ্লবিকতা দাহিকা শক্তি হিসেবে তরুণদের মাঝে নতুন সমাজ বিনির্মাণে উদ্বুদ্ধ করেছে নিসন্দেহে।

একই ভাবে বাঙালী জাতীয়তাবাদী চেতনা ব্যক্তি ও সমাজ জীবনে প্রতিফলিত করার জন্য টাউন ছাত্রলীগ ভূমিকা পালন করেছে। এ ক্ষেত্রে এডভোকেট আব্দুস সামাদ, আনিছুর রহমান, নিজাম উদ্দিন আহম্মদের মতো নেতৃত্ব তরুণদের উৎসাহিত করেছে।

১৯৭০ সালে অন্য ছাত্র সংগঠনের মতো ছাত্রলীগও অমর একুশে স্মরণে প্রকাশ করেন ’সূর্য অন্বেষা’। নব কুমার সাহা ও সফিকুর রহমানের যৌথ সম্পাদনায় প্রকাশিত স্মরণিকার মূল্য পঞ্চাশ পয়সা। নিউ প্রেস শেরপুর টাউন থেকে মূদ্রণ “পূর্ব্ব-পাক ছাত্রলীগ শেরপুর ও শহর শাখার প্রচার সম্পাদক তালাপতুর হোসেন মঞ্জু ও এমাদুল হক নিলু কর্তৃক প্রকাশিত ও প্রচারিত।” লেটার প্রেসে ছাপা সূর্য অন্বেষা হচ্ছে ছাত্রলীগের দ্বিতীয় প্রকাশনা।

সুশীল মালাকারের নিবন্ধ ’বাংলা ভাষা ও উন্নাসিকতা’, কবিতা লিখেছেন রেজাউল করিম, সংগ্রাম চক্রবর্তী, বিকাশ দাশ, হাছান আলী আর নিত্যলাল বণিক লিখেছেন, “সংগ্রামী মিছিলে দীপ্ত পতাকা অমর একুশে” অনুপ্রেরণামূলক প্রবন্ধ।

পরের অংশ: শেরপুরে ছোটকাগজ চর্চা

রেফারেন্স: শেষ পর্বে।

Leave a Reply

Scroll to Top