মুক্তিযুদ্ধে নালিতাবাড়ি
”অনুপম প্রকাশনীর বই। প্রকাশ কাল ২০১১। লিখছেন আবদুর রহমান তালুকদার (১৯৪৮)। ১১ নং সেক্টরের মুক্তিযোদ্ধ। বাঙালীর স্বাধীকার আন্দোলনের অগ্নিযুগ ১৯৭১। পশ্চিম পাকিস্তানের উপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে লড়াই সংগ্রামের ফসল বাংলাদেশ। নিজস্ব মানচিত্র। সবুজের বুকে রক্তিম সূর্য খচিত পতাকা। এই পতাকা অর্জনের সেনানী আবদুর রহমান। যিনি এই প্রান্তিক সীমান্তবর্তী অঞ্চলের যুদ্ধ পূর্বর্তী ও যুদ্ধ কালীন কালখন্ডের নানা তথ্য ও উপাত্ত আশ্রিত বায়ান তুলে এনছেন। প্রত্যক্ষ যুদ্ধের অভিজ্ঞতা একমাত্র রনাঙ্গণে স্থিত কোন যোদ্ধাই যথাযথ ভাবে তুলে আনতে পারে। রহমান তা তুলে এনেছেন ভাবীকাল ও প্রজন্মের জন্য যেমন; ঠিক তেমনি একটি বস্তনিষ্ঠ ইতিহাসের পঠন পাঠনের আত্মিক অনুসন্ধানের জন্য।
একটি জাতির সামষ্টিক ইতিহাস মূলত খন্ড খন্ড ইতিহসের যোগফল। আবার সেই স্থানিক ইতিহাসের গভীরে থাকে সামষ্ঠিক ইতিহাস চেতনার বীজ। কাজে কাজেই আঞ্জলিক ইতিহাস-ইতিহাস চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন
করে থাকে। ইতিহাস চর্চার পঠন পাঠনের মধ্যে দিয়েই একটি জাতি চিন্তায়; চেতনায় পরিপুষ্ঠ হয় বিকশিত হয়।
রহমান এই প্রবাহমান যাপিত জীবনের ইতিহাস সৃষ্টির যেমন একজন সৈনিক; তেমনি তাঁর যুদ্ধকালীন সময় বাস্তবতার যোদ্ধা হয়ে উঠার প্রক্রিয়ায় যুক্ত থাকার সুবাদে ইতিহাসের কথকও বটে।
’মুক্তিযুদ্ধে নালিতাবাড়ি’ | আবদুর রহমান তালুকদার | অনুপম প্রকাশনী | প্রকাশ কাল ২০১১
স্বাধীনতা উত্তর প্রজন্মের প্রত্যাশা অধিক। সময়ের ব্যাস্তিতে প্রযুক্তিক উন্নয়নের একাকার এই কালখন্ডে একদিকে ইতিহাস ঐতিহ্যের ভিত্তি ভূমিতে দাঁড়িয়ে ব্যক্তির নিজস্বতা যেমন জরুরী-তেমনি দিগন্ত প্রসারিত বিশ্বব্যবস্থার কাঠামোতে নিজের অবস্থান ও ভূমিকা পালনও সম গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে সন্ধান ছাড়া কোন পথ নেই। আজকের
প্রজন্ম বহু দূরের যাত্রি। তাই তাঁর প্রয়োজন তথ্যানুসন্ধান। এই প্রত্যাশা কতটুকু পূরণ করতে পেরেছেন রহমান?
তথ্য উপাও যথাযথ বিন্যাস ও বস্ত নিষ্ঠতার প্রতি রহমানের দায়বদ্ধতা প্রশ্নাতীত। একথা স্বীকার্য যে, তথ্য ও উপাত্ত
ইতিহাসের প্রধান উপাদান। কিন্তু সেই উপাত্তের অন্তঃস্থলে যে চেতনার স্ফুরণ রয়েছে এবং স্থানিক আর্থ সামাজিক সাংস্কৃতির বহুবাচনিক স্বর রয়েছে তার বিচার বিশ্লেষণের কর্ম প্রবাহ রহমান করেন নি। যা একটি জাতির মুক্তিযুদ্ধের বহুকৌনিকতার সন্ধানের জন্য জরুরী।
একথা ঠিক যে, অঞ্চল ভিত্তিক মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংকলনের ক্ষেত্রে অন্য অঞ্চলের চেয়ে নালিতাবাড়িতে এই ধরণের কাজ খুবই কম হয়েছে। সেই দিক বিচারে নালিতাবাড়িতে ইতিহাস চর্চায় একটি নতুন মাত্রা যুক্ত হল।
নালিতাবাড়ির উর্বর ভূমি গঠনে এ অঞ্চলের ভূমিজ সন্তানদের রয়েছে গুরুত্বপূর্ণ ভুমিকা। গারো-হাজং-কোচ-বানাই-ডালু-হাদি ভূমিপুত্রদের কর্মতৎপরতার সংবাদ কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। অথচ এই আদীবাসীদেরও রয়েছে এক সংগ্রামী জীবনের ইতিকথা। জলধর পাল কিংবা প্রমথ দে সহ গেীতম ভদ্র ও আরো অনেকেই এই অঞ্চলের কৃষক আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে তুলে এনেছেন এই ভূমিপুত্রদের শোষন নির্যাতনের তাবৎ ইতিহাস।
আড়াই আনী বাজারে বটবৃক্ষের পাদদেশে অনুষ্ঠিত বঙ্গীয় কৃষক সমিতির প্রাদেশিক সম্মেলন ছিল তৎকালীন পূর্বভারতের কৃষক আন্দোলনের সূতিকাগার। এই আন্দোলনও আদীবাসীদের তৎপরতা অনন্য। এই আদীবাসীরাই পাকিস্তানের ভেদবদ্ধির যাঁতদাকলে পিষ্ঠ হয়ে গত শতাব্দীর ষাটের দশকে সমূলে উৎখাত হয়েছে।
রহমান এই উৎখাতের একটি চিত্র এই ভাবে এঁকেছেন, “১৯৬৪ সালের ২ ফেব্রুয়ারি… শতশত নারী, পুরুষ, শিশু, কিশোর- যুবকের হাত, মাথায়, কাঁধে ব্যাগ ও পুটলি। … দেশত্যাগ খুবই করুন, খুবই মর্মান্তিক। … একই গ্রামে, একই আলো বাতাসে বেড়ে উঠা মানুষ আমরা। … দেখলাম মুরব্বিদরে সাতে অনেকেই বকে বুক মিলিয়ে কান্নকাটি করে বিদায়ের দৃশ্য। বাড়ি থেকে বের হয়ে যাচ্ছে শূন্যহাতে। পেছনে বারবার তাকিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠছে। সাজানো বাগান, ঘর-বাড়ি, গৃহপালিত পশুপাখি সব ফেলে চলে যাচ্ছে।” রহমানদের প্রজন্মের তরুনরা এই ধরনের দেশত্যাগ চাইনি বলেই অস্ত্র হাতে নিয়েছিল। যুদ্ধকরেছেন। বাগানে শত ফুল ফুটবে এই প্রত্যাশায়।
বছর দুই পরে আবদুর রহমান লিখলেন ‘মুক্তিযুদ্ধে শেরপুর’। শেরপুর অঞ্চলের বিভিন্ন থানায় সংঘটিত লড়াই সংগ্রামের গৌরবগাথা উপজীব্য করে লিখলেন এই বইটি। প্রচ্ছদ এঁকেছেন ধ্রুব এষ। প্রকাশ কাল ফেব্রুয়ারি ২০১৩।
”যুদ্ধ দিনের ফেলে আসা কথা।”
সাপ্তাহিক কালের ডাকে প্রকাশিত ধারাবাহিক যুদ্ধকালীন কথাকতা। সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী মুক্তিযোদ্ধাদের অভিজ্ঞতা এবং সেই যোদ্ধাদের বর্তমান যাপিত জীবনের বয়ান স্মৃতির গহীনগুহা থেকে তুলে এনছেন এম.এ হাকাম হীরার প্রযত্নে আব্দুল মান্নান সোহেল, সাইফুল ইশলাম প্রমুখ। প্রশংসার দাবীদার। কেননা প্রতিটি মুক্তিযোদ্ধার অভিজ্ঞতাই আমাদের সামষ্ঠিক ইতিহাসের অভিচ্ছেদ্য অংশ। সেই অংশ ব্যতীত ইতিহাস চর্চা হয়না।
হতে পারে না।
মা-মাটির মুক্তির প্রশ্নে সেই অগ্নিঝরা আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়ছিল বিভিন্ন শ্রেণি-পেশা-ধর্ম-বর্মের মানুষ। স্বাধীকার আন্দোলন জাতীয় চেতনায় মূর্ত প্রতীক। রাজনৈতিক স্বাধীকার যেমন, তেমনি আর্থ সামাজিক সাংস্কৃতির বিকাশের প্রশ্নে সেদিনের এই আত্মত্যাগ। মুক্তি সোপানে আত্মহুতি। এক রক্তে লেখা ইতিহাস। সৃষ্টির লক্ষ্যে আত্মবলীদানে
প্রত্যায়ী। সেই ইতিহাসের বয়ানেই ফুটে উঠেছে। “যুদ্ধ দিনের ফেলে আসা কথা” সিরিজে। শ্রেণি বিভক্ত সমাজের শ্রেণি চেতনা আশ্রিত সেই যোদ্ধাদের লক্ষ্য ছিল এক। স্বাধীনতা। সার্বভৌমত্ব। বৈষমের বিলয় ঘটিয়ে খেটে খাওয়া মানুষের স্বাপ্নিক রাষ্ট্রকাঠামো নির্মাণ।
হাকাম হীরার সংকলিত বয়ানে যুদ্ধ-যুদ্ধকালীন যুদ্ধে যাবার উম্মুখ মন-সীমান্তপাড়ী-ট্রেনিং-সম্মুখ যুদ্ধ-রক্ত-বুলেট-রনহুংকার স্বপ্ন-নির্যাতন-শহীদ-লাল পতাকা ইত্যকার নান বিষয় একাকার। তাই সে অভিজ্ঞতার পাঠ হয়ে উঠে একান্তভাবে বহুস্তরীয়।”