যাপনকলা । জ্যোতি পোদ্দার
“প্রাণ ও অপ্রাণ সকলকে নিয়েই যাপন। সকলকে নিয়ে সকলের সাথে লতার মতো জড়িয়ে ছড়িয়ে আমাদের বেঁচে থাকা। নানা কর্তাগিরির ভেতর তৎপর হয়ে ওঠা। একার জীবন জীবের না। কথা-বলা-জীব কথা বলে বলে যে পরিসর সৃষ্টি করে তা বৃহৎ জীবনের সাথে সম্পর্কিত– যে জীবন স্থানিক ও কালিকের রঙে রাঙিয়ে ওঠে বটে — সে জীবন কিন্তু প্রবাহমান চির বর্তমান।
কথা-বলা-জীব যেমন যেমন কর্মমুখরতায় যুক্ত থাকে তেমন তেমন যাপনকলা হয়ে উঠে তার কালের সঙ্গি স্থানের সঙ্গি। কর্মমুখরতা কালে কালে পাল্টে যায়। পাল্টাতে হয় জীবনের নিয়মে। পাল্টে যায় যাপনকলা। যাপনকলা সোশাল বাই প্রোডাক্ট। নতুন কর্মমুখরতায় নতুন যাপনকলা যুক্ত হয়— বিগত যাপনকলা থেকে যায় স্মৃতিতে শ্রুতিতে।
যে জীবন একদা ছিল সহজ বর্তমান তা এখন শুধুই অভ্যাসের দোষে দুষ্ট। প্রাক্তণ নিয়মের নিগড়ে বন্দি। পালন আছে আচার আছে–আচারেই বিচারের হুকুমত আছে পরম্পরা কিন্তু সপ্রাণতা নেই। প্রশ্ন নেই।
যে কর্মমুখরতার সাথে এই যাপনকলা যুক্ত থাকে সেই কর্মমুখরতা সরে সরে গেলে যাপনকলা তার মুখরতা হারায়।নতুন করে ঘটে সৃষ্টিশীল রূপান্তর; সৃষ্টি হয় নতুন গাঠনিকতা। পুরাতনের দাসত্বে প্রায়ই সেই নতুনের আবাহণ টের পাই না। নতুনকে দেখি সন্দেহের মনোভঙ্গি নিয়ে।
অভ্যাসের দোষে নিয়মের বিচারে তেমন তেমন যাপনকলায় মুখরিত হলে জীবন আটকে যায় নদীর চড়ায়। মুখ থুবড়ে জীবন। পুরাতনের অনুকরণ করে জীবনের ঢেউয়ে নেচে উঠা যায় না। জীবন ও তার কথকতা তখন জলাবদ্ধ পুকুর। উচ্ছলতা নেই– কেবলই ভাববাহী থিতু জীবন।
কোন যাপনই জীবনের বাইরে নয়। বৃহৎ জীবনের উৎস থেকে জারিত জীবনের প্রয়োজনে। আবার জীবনের প্রয়োজনে তাকে সৃষ্টিশীল সঞ্জীবনী রূপান্তর করার নামই কথা-বলা-জীবের কর্তাগিরি। নতুন কালের নতুন কর্তার নতুন কর্তাগিরি করে নতুন যাপনকলা যুক্ত করা। এখানেই এসে সে নতুন মানুষ। কালের দিশারী।
পেছনে পড়ে থাকে বিগতার হাড়গোড়ের কঙ্কাল শরীর। তাকে কাঁধে বয়ে নেয়া জীবনের ধর্ম নয়। কাজে কাজেই প্রাক্তনের হাড়হোড়ে রক্তমাংস যুক্ত করে প্রাণ সঞ্চার করতে না জানলে কোন দিনই জানা যাবে না কী ছিল সেই দিনের এই যাপনকলার অর্থবাচকতা। কেমন ছিল ব্যঞ্জনা আর অর্থদ্যোতকতা? তেমন সন্ধানের জন্য প্রয়োজন সেই সেই যাপনকলার সাথে যুক্ত মানুষের কেমন ছিল প্রাক্তন সময়ের কর্মমুখরতা। তার সন্ধান নিতে না পারলে কোন যাপনকলারই অর্থ খোঁজে পাওয়া যায় না।
বাড়ির কর্ত্রী ফি বছর ব্রতের আয়োজন করেন। পঞ্চফলে পঞ্চফুলে সজ্জিত হয়ে মণ্ডল। চাল-কলা-কাঁচা দুধে নৈবেদ্যের রেকাব পর্বে পর্বে পর্বত হয়ে ওঠে। পর্বত চূড়ায় তিন পাতা মুখী বেল পাতা প্রদীপের আলোয় চিক চিক করে ওঠে। জাঁদরেল গিন্নীর নিয়ম নিষ্ঠা আর কর্ম কৌশলতার পরিপ্রেক্ষিত দাঁড়িয়ে দাড়িঁয়ে নতুন বৌ নতমুখে সলজ্জ চোখে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে আর দেখে– আর দেখে উঠানের নটে গাছের গোড়ায় খাঁচায় শাশুড়ি মাতা আটকে রেখেছে পাশের বাড়ির বিড়াল।
সলজ্জ নতুন বৌ মুখর শাশুড়িকে হাতে হাতে একাজে ও কাজে সহায়তা করলেও প্রশ্ন করার আর সাহস হয় না। কী জানি কী আবার মুখ ঝামটা দিয়ে মুখিয়ে ওঠে আনন্দ মাটি করে দেয়– থাক বরং থাক প্রশ্ন–কেন কেন নানা উপাচারের সাথে উঠানে বন্দি পাশের বাড়ির বিড়াল? তার চেয়ে বরং কর্ত্রীর ইচ্ছায় কীর্তন হোক। যাজক ওম নমঃ বিষ্ণু স্বাহা টাহা করে যাক। প্রশ্ন আর করা হয়ে ওঠে না। বৌ বরং মুখভরে বাতাস নিয়ে শঙ্খে ফুঁ দেয়। কাঁসর বাজায়। দুই ঠোঁট গোল করে জিবের সরু ডগা বের করে আয়োতিদের সাথে যোগাড় দেয়।
যাজক গামছা বেঁধে ভুজ্জি আর দক্ষিণা নিয়ে চলে গেলো। প্রসাদ ভুড়ি ভোজনান্তে বিতরণ হলো ভক্তদের মাঝে। প্রশ্ন প্রশ্নই রয়ে গেলো। মুখরা শাশুড়ির মুখোমুখি হবার তাগদ আর পেলো না বালিকা বধুটি। দেখে দেখে শেখাই সার।প্রশ্ন আর করা হলো না। কিছুদিন পর শাশুড়ি মাতা চোখ বুজলেন চিরতরে।
বালিকা বধুর শেখার আগেই নতুন বছর ঘুরে এসেছে। আবার সেই ব্রত। অগ্রায়ন মাস। পঞ্চমী তিথী সমাগত।দশবাড়ি মাগুন তুলে তুলে এই ব্রত আয়োজন করতে হয়। কেন যে দশ বাড়ির কাড়া আকাড়া চালের মাগুন তোলে এই প্রযোজনা তা বালিকা বধুকে জানিয় যান নি শাশুড়ি মাতা। তিনি দেখছেন তার শাশুড়ির কাছে এমন এমন আচার বিচার।
কোন তাগিদে এই আয়োজনের প্রযোজনা কোন কর্মমুখরতায় উৎপত্তি তার গুপ্ত কথাটি ব্যক্ত হলেও সময়ের প্রয়োজনে ত্যাক্ত হয়ে পরিত্যাক্ত হয়েছিল। গাঠনিক অবয়ব কৌম ভেঙে গেলেও সেই সেই খন্ডিত পরিবারগুলোতে রয়ে গেছে স্মৃতি হিসেবে শ্রুতি হিসেবে ব্রত কথা হিসেবে–প্রাণহীন সংস্কার হিসেবে।
সেই ব্রত আজকের বধুটি আয়োজন করেছে। পুরুত ঠাকুর দুয়ারে। সময় বয়ে যাচ্ছে– ব্রত করা যাচ্ছে না। কেননা উঠানে বিড়াল খাঁচায় বন্দি করা যাচ্ছে না। টই টই করে খোঁজেও পাশের বাড়ি তো পাশের বাড়ি; পাড়ার কোথাও সাদা রঙের হুলো বিড়াল পাওয়া যাচ্ছে না বলে কেবলেই দেরি হয়ে যাচ্ছে। সময়ে বয়ে যাচ্ছে।তিথী পার হয়ে গেলে ঝাড়ে বংশে মঙ্গল। কোথায় পায় এই বিড়াল?
এই যাপনকলায় কেন বিড়াল খাঁচায় বন্দি করে রেখেছে শাশুড়ি মাতা খোলসা করে বলেনি —বালিকা বধুও জানবার ইচ্ছা জাগলেও বুকে দম নিয়ে সাহস হয়নি। যেমন করে শাশুড়ির শাশুড়ির কাছে সে জেনে নেয় নি দশ বাড়ির মাগুন তোলার কারণ কী? এই টুকু চাল তো তার ঘরেই ছিল।
আবার তাঁর শাশুড়িও জানতে পারেন নি যৌথ পরিবারের বুড়ো ঠাকরুন কর্ত্রী কিসের বন্ধনে থানে লাগানো পাকুড় বটের সাথে সাদা রেলসুতা দিয়ে সকলকে একই সাথে জড়িয়ে রেখে শুনাচ্ছেন ব্রত কথা। যে কথা কৌমের কথা যে কথা সোনালী কোন অতীতের সুখের রসে বশে থাকা। হা হয়ে শুনছেন আয়োতিরা হাতে দুর্বা আর নয়াধান নিয়ে।
যে বিধি ব্যবস্থায় কৌমের জন্ম যে কর্মমুখরতায় কৌমের শারীরিক ভাবে সবশ থাকা মানসিক ভাবে সরস থাকা তার স্মৃতি কৌম ভেঙে গেলেও রয়ে গেছে ক্রম পরম্পরায়।
বিড়াল বন্দি ব্রতকথার মাহাত্ত্য এই যে, বিড়াল দুধ খেয়ে ফেলে পুরো অনুষ্ঠানই বরবাদ করে ফেলে। তাই শাশুড়ি অনুষ্ঠান সুন্দর করে পালন করার জন্য তাকে বন্দি করে রাখে কিছু সময়ের জন্য। এটি ব্রতের কোন উপাচার নয়। আচার নয়।
প্রশ্ন বিহীন যাপনের জন্যেই তার গোপন কথাটি গোপনেই থেকে গিয়ে আচারেই বিচারের মতো শুরু হয়ে গেলো বিড়াল বন্দি ব্রত কথা। বিড়াল বন্দির কার্য কারণ অজানার জন্য একটি বড় আয়োজনে গিট্টু থেকে গেলে বংশ পরম্পরায়। যেন বিড়াল বন্দি করা ছাড়া এই অনুষ্ঠান হতে পারে না।
তেমনটি হয়েছে আমাদের নানা যাপনকলার ক্ষেত্রে। যাপনকলার কার্যকারণ ও তার কর্মমুখরতার সৃষ্টিশীল দিকটি পরখ করার আগেই নতুন বিধি ব্যবস্থার পাটাতেন দাড়িয়ে মননে ঔপনিবেশিকতার প্রস্তাবনায় নানা যাপন কলাকে রাঙিয়েছি লোক সংস্কৃতি বলে। আর লোকশিল্প মানেই প্রান্তিকের প্রান্তিকে যে প্রাকৃত ইতরজনেরা থাকে তাদের কলাবৃত্তির নামই লোকসংস্কৃতি বলে দাগিয়ে দিয়েছি।
এই সংস্কৃতি আদীম। অনাধুনিক। কুসংস্কার। কুফরি বলে বলে মুখে ফেনা তুলে ফেলল আধুনিকতাবাদীরা। অপরকে ঠেলে প্রান্তে না পাঠালে তার কেন্দ্র আর কেন্দ্র হয়ে উঠে না। নিজেও কেন্দ্রে থাকতে পারছে না। প্রান্তিকের আড়াআড়ি জীবনের বিপরীতে তার বাস খাড়াখাড়ি উতুঙ্গ শৈলচূড়ায়।
রৈখিক গতির পরিমাপ করে করে পেছনকে অনাধুনিক সামনেকে আধুনিক চিহ্নিত করে করে তার চলার গতি। প্রান্ত না থাকলে কেন্দ্র পানিশূন্যতায় ভোগে। শরীর দুর্বল হয়ে পড়ে। তাই তার প্রয়োজন লোকশিল্প লোকগান লোককবি ও কবিতা। লোক মেলা লোক সঙ্গিত।
জীবনকে খাড়াখাড়ি ভাগে বিভক্ত করে ফেলেছে উপনিবেশিক মন। দেহের শৃঙ্খল দূর হয়েছে বটে মননে এখনও নিজের মতো করে নিজের ক্ষমতা দিয়ে ভাববার তাগদ আমাদের গড়ে উঠে নি। এটি আশার কথা চারিদিকে নতুন নতুন জানালা খুলছে।
নিজের উপর অবিশ্বাসী করে তুলেছে আমাদের এই আধুনিক উপনিবেশিক মন। যেন নিজের কোন অর্জন নেই। নিজের কোন উর্বর ভূমি নেই। সবই অনাধুনিক। আদিম। কুসংস্কারের প্রস্তাবনা। আধুনিক মানুষ প্রান্তকে হীন উদ্ভিদসুলভ করে রাখার নানা কায়কারবার করে।
নিজের মাটি নিজে খোঁজে পায় না বলে আধুনিক মন নিজের কেন্দ্রে স্থাপন করে লোক গবেষনা কেন্দ্র লোক জাদুঘর। আয়োজন করে লোক উৎসব। খুজঁতে চায় ছিন্ন শেকড়। বিচ্ছেদ তাকে উন্নাসিক করে তোলে। একাকী করে তোলে।
অথচ আধুনিকতা যে যাপনের গাল ভরা নাম দিয়েছে লোকশিল্প তা যেন কাঁচামাল– সারাজীবন একই অবস্থায় একই ব্যবস্থায় পড়ে থাকা স্থীর কোন মাংসপিন্ড। তাকে নিয়ে গবেষণা করা যায় কিন্ত কেন্দ্রে স্থাপনে অনাগ্রহী। তাকে জাদুঘরে রাখতে উদ্যোত কিন্তু সচল করতে নয়। বৈশ্বিক নবরূপায়ণ নয়।
যাপনকলাকে প্রাণ সঞ্চার করতে ভয় হয়। যে কার্যকারণ থেকে যাপনকলার উৎপত্তি বিকাশ তার সন্ধান নিতে গেলে নিজেরই মাপে নিজেই খারিজ হয়ে যায়। যতটুকু বাজার দর আছে ততটুকুই ফেরি করে ফেরে নাগরিক ব্যবসায়ী। সব কিছুকে টাকায় রূপান্তরিত করার এক অদ্ভুত তাগদ আছে বাজার সংস্কৃতির।
কিন্তু এই যাপনকলার পরতে পরতে যে রাজনৈতিকতা জারি আছে তার সন্ধানে ব্রতী উত্তর উপনিবেশিক ভাবুক সম্প্রদায়। কথা-বলা-জীব নিজের ক্ষমতা চায়। নিজের বিকাশ চায়। নিজের শাসন চায়–দেহে ও মনে।
কর্মমুখরতার ভেতরই সৃষ্টিশীল যাপনকলা অবিনির্মানে মানুষ নিজেরই আনন্দে নিজেই শিব হয়ে উঠে। শিব অতীতমুখী নয়—তাঁর নীতি শিবতা নীতি– সহজতা স্বাভাবিকতা। অভেদাত্মক।
দ্বৈব বোধে নয়। অদ্বয় বোধ জারিত হওয়াই শিবতা। সে যেমন নতুন সৃষ্টির ক্ষেত্রে তেমন পুরাতনের ভেতর যদি কোন আগামী থাকে তাকে করে তোলে বৈশ্বিক। ভুতের পুনরাগমন তার কাজ নয়। সে করে সৃষ্টশীল রূপান্তর। যে বিচ্ছেদ ঘটে গেছে প্রাণ ও প্রকৃতির সাথে, কর্মমুখরতার সাথে তার সাথে সৃজনী সম্পর্কায়নের বীজ এখন রয়ে গেছে। প্রয়োজন শুধু উন্মুক্ত সৃজনী মন। যে মন নিজেকে দেখে নিজের মতো করে– সকলের সাথে মিলবার ও মেলাবার বহুবাদের আন্ত তাগিদে। বৃহৎ জীবনের শিব নৃত্যে। আর নৃত্য মানেই অবিরাম লীলাময়তা। বৃত্তীয় গতিময়তা।”
Table of Contents
প্রথম প্রকাশ: ইরাবতী। ১১/১১/১৯ সন