৩৫ বছর পর আবার শেরপুরে স্থায়ী হচ্ছি। তাই সকাল বেলা হাঁটার সময় ঘুরে ঘুরে দেখি আর ফিরে যাই ৩৫ বছর আগের জীবনে। কী ছিল তখন, এখন কত পরিবর্তন হয়েছে। তখন শেরপুর ছিল গ্রামের মত। ২/১ টি বিল্ডিং ছাড়া আর সবই ছিল টিনের কাঁচা বাড়ি। মূল শহরের একটু বাইরে ছনের ঘরও ছিল প্রচুর। এখন কত সুরম্য অট্টালিকা হয়েছে, বড় বড় মার্কেট হয়েছে। দেখতেও ভাল লাগে। মনটা ভরে যায়।
মূল সড়ক ধরে হেঁটে পোস্ট অফিস পার হতেই চোখে পড়লো শিল্পকলা একাডেমী। নিশ্চয় সেখানে গান বাজনা, নাটক, আবৃতি হয়। আগেও শেরপুরে গান বাজনা হতো। বৃহত্তর ময়মনসিংহের নামকরা শিল্পী ছিল শেরপুরে। এ মুহূর্তে তৃপ্তি করের নাম মনে পড়ছে।
তবে নাটকে অনেক পিছিয়ে ছিল। এ প্রসংগে একটা ঘটনা খুব মনে পড়ছে। বলার লোভ সামলাতে পরছিনা।
সালটা ১৯৭৭। ৭৫ পরবর্তী সময়ে সারা দেশের মানুষ চাপা কষ্টে কাটাচ্ছিল। শেরপুরেও তার ব্যতিক্রম ছিল না। জিয়াউর রহমানের মার্শাল ল জারির পর মানুষজন ভয়ে আর মুখ খুলছে না। ৭৭ সালে হঠাৎ সামরিক শাসক ঘরোয়া রাজনীতি করার অনুমতি দেয়। অর্থাৎ ঘরের ভিতর সাউন্ড বক্স বাজিয়ে মিটিংকরা যাবে। জনমনে কিছুটা সস্তি ফিরে আসলো।
আমি তখন ডিগ্রী ক্লাসের ছাত্র। আমরা ক’ জন বন্ধু মিলে সিদ্ধান্ত নেই একটা নাটক করলে কেমন হয়? যেই কথা সেই কাজ। সাথে সাথে নাটকের নামও ঠিক করা হলো। আসকার ইবনে শাঈখের ” ক্রস রোডে ক্রস ফায়ার।” তখন সৈয়দ হান্নান স্যার প্রিন্সিপ্যাল। শেরপুর কলেজের অর্থনৈতিক অবস্থা খুব খারাপ। ছাত্রছাত্রীর সংখ্যাও খুব কমে গেছে। তারপর অনুমতি ও আর্থিক ব্যাপারটার জন্য স্যাররের কাছে গেলে তিনি অনুমতি দিলেন। নাটকে সহায়তা করার জন্য ইতিহাস বিভাগের সদ্য যোগদানকৃত শিক্ষক লতিফ স্যার ও অংকের মনিন্দ্র স্যারকে দিলেন। ঐ সময় ২৫০০ টাকা ছিল সাংস্কৃতিক ফান্ডে, সেটাও দিবেন বলে স্বীকার করলেন। নাটকের মহড়া শুরু হলো।
নাটকের মানুষ ‘মোহন’ ভাইকেও পেলাম। তিনি গিয়ে আমাদের নির্দেশনা দিচ্ছেন। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল নারী চরিত্র নিয়ে। ৩/৪ জন মেয়ের প্রয়োজন। কী করা যায়? ঐ বছর ১ম বর্ষে পড়তো নিজাম সাহেবের দুই মেয়ে, সুরেন বাবুর মেয়ে আর একজন মেয়েকে রাজি করালাম। তারা অভিনয় করবে, কিন্তু শর্ত হলো তাদের গার্ডিয়ানের অনুমতি নিতে হবে।
সবাই আমাকে ভার দিল। নিজাম সাহেবের সাথে আমার সম্পর্ক ভাল ছিল। ৭০ এর নির্বাচনে আমি তাঁর সাথে কাজ করেছি। নিজাম সাহেব রাজি হলে তার দুই মেয়ে, সুরেন বাবুকেও রাজি করানো যাবে, না হয় পরিমল দা কে রাজি করালেও হবে। তার সাথেও আমার সম্পর্ক আছে। সাথে সাথে আমি ও আর এক বন্ধু নিজাম ভাইএর বাসায় গেলাম। তিনি তখন নয়আনি বাজারের এক তলা বাসায় থাকতেন।
বাসায় গেলে গদিতে বসে প্রথমে রাজনৈতিক কথা বার্তা হলো। ঘরোয়া রাজনীতি চালুর প্রসংগে আলাপ করতেই তিনি বললেন জহুরা তাজ উদ্দিনকে শেরপুর আনার ব্যবস্থা হচ্ছে। যাক, সবশেষে নাটকের কথা বলতেই তিনি ভাবলেন চাঁদা চাইবো বোধহয়। তারপরও আমাদের চালিয়ে যেতে বললেন। আমি যখন মেয়েদের কথা বললাম তখন তিনি মুচকি হেসে বললেন ” দেখো, আমার মেয়েরা নাটক করবে এমন পরিস্থিতি এখনও শেরপুরে হয় নাই।” তিনি রাজি হলেন না। আমরা অনেক চেষ্টা করেও আর নাটকটা মঞ্চস্থ করতে পারি নাই। সে কষ্ট আজও মনের মধ্যে রয়ে গেছে।
শেরপুরের অনেক উন্নতি হয়েছে। অনেক মানুষ বড় বড় ব্যবসায়ী হয়েছে। অনেক চাকুরীজীবী হয়েছে। “বি সি এস”এ অনেকেই চাকুরী পাচ্ছে। আমারও দুই ছেলে ও ছেলের বৌরা ডাক্তার। সেনাবাহিনীতেও অনেকে চাকুরী করছে। ভাবতেও ভাল লাগে। শেরপুরের মানুষ আরও এগিয়ে যাবে, জ্ঞান বিজ্ঞানে, সাংস্কৃতিক কর্মকান্ডে আরও এগিয়ে যাবে, আরও অসাম্প্রদায়িক হবে, মুক্ত চিন্তার মানুষ তৈরি হবে, এ প্রত্যাশা থাকলো। আমিও যদি ওসব কাজে বাকি জীবন নিয়োজিত থাকতে পারি তবে, নিজেকে ধন্য মনে করবো। আজ রাখলাম। আরএকদিন অন্য প্রসংগ নিয়ে লেখা যাবে।ধন্যবাদ
লেখকঃ মোঃ রফিকুল ইসলাম অবঃ ক্যাপ্টেন, সেনা শিক্ষা কোর।