Our Sherpur

নালিতাবাড়ির মাটি ও মানুষ

নালিতাবাড়ির মাটি

নালিতাবাড়ির মাটি ও মানুষ

লিখছেন অধ্যাপক আব্দুস সালাম (১৯৩৮-২০১১)। ‍প্রকাশকাল ২০০৬। শিক্ষকতা দিয়ে জীবন শুরু করলেও রাজনৈতিক কর্ম প্রক্রিয়ার পরিধির ভেতরই তিনি খুঁজে পেলেন সামাজিক দায়বদ্ধতার বাস্তবায়নের ঠিকানা। জন মানুষের সাথে দীর্ঘ সম্পর্কায়নের ফলশ্রুতিতে লিখলেন নালিতাবাড়ির মাটি ও মানুষের কথা।

দালিলিক প্রমান না থাকার কারণে এ  অঞ্চল হয়ে উঠেছিল ইতিহাস শূন্য। ময়মনসিংহের উত্তরে এই সীমান্তবর্তী এলাকায় রয়েছে ইতিহাসের অনেক ঘটনাবহুল ঘটনা। গ্রন্থায়নের অভাবে হারিয়ে গেছে কালের করাল স্রোতে। সে দিক বিবেচনায় অধ্যাপক সালামের বইটি নালিতাবাড়ি ইতিহাস চর্চায় একটি মাইল ফলক। বিশাল ক্যানভাসে তুলে আনলেন এ অঞ্চলের আর্থ-সামাজিক, সংস্কৃতিক, রাজনৈতিক কথকতার ইতিবৃত্ত।

Products list of Our Sherpur
শেরপুর জেলার যেসব পণ্য আওয়ার শেরপুর এ পাওয়া যায়।

যদিও তিনি তথ্য উপস্থাপনের প্রেক্ষিতে বিশ্লেষণের চেয়ে নাম চিহ্নের উল্লেখ্যকে প্রধান্য দিয়েছেন। উপাত্ত সমূহের অনুপুঙ্খ বিশ্লেষণ, পূর্বাপর তথ্যের যাচাই, তুলনা ও তার সামাজিক ভূমিকাকে এড়িয়ে গেছেন কিংবা বলা চলে উত্তর প্রজন্মের হাতে তুলে দিয়েছেন এ কর্মভার। তাছাড়া একক ব্যক্তির পক্ষে এ কাজ সময় ও শ্রম সাধ্যও বটে।

নালিতাবাড়ির মাটি ও মানুষ প্রবাহমান যাত্রাপথের সূচনা বিন্দু। এর মূল্যও কোন অংশে কম নয়। নালিতাবাড়ির ইতিহাসের দালিলিক প্রামান্য গ্রন্থ এটি। মত ও পথের ভিন্নতা থাকা সত্ত্বেও অধ্যাপক সালমকে তাঁর প্রাপ্য সম্মান আমাদরে দিতেই হবে। বইটি যথাযথ বাজারজাত করনের অভাবে সকল পাঠকের কাছে পৌঁছুতে পারেনি।

ইতিহাস একটি জীবন্ত প্রবাহমান ধারা। এই ধারা পরিক্রমায় উপাত্তের গ্রহন-বর্জন, সংশ্লেষণ-বিশ্লেষণ, তথ্য উপস্থাপনের ধরণ ধারণ নির্ভর করে ইতিহাস কথকের শ্রেণি চেতনা ও তাঁর আদর্শিক দৃষ্টিভঙির উপর। এই দৃষ্টিভঙিগত পার্থক্যের কারনে ইতিহাসের বহুমুখ উম্মেচিত হয়। এক্ষেত্রে নিঃসন্দেহে অধ্যাপকের নালিতাবাড়ির মাটি ও মানুষ বইটিতে আমাদরে বার বার ফিরে যেতে হবে। অধ্যাপক সালামের মানসভূমি এ কথায় বলে তিনি মুখবন্ধে জানিয়েছেন “মানুষ নতুনভাবে তাঁর অবরুদ্ধ সত্তাকে আবিষ্কার করে।”

এ প্রান্তিক অঞ্চলের সাহিত্য ও সংস্কৃতির চর্চার ব্যাপ্তিকাল খুব একটা বেশী নয়। গারো হাজং-হদি-ডালুদের লৌকিক পারলৌকিক বোধাশ্রিত প্রকৃতিবান্ধব সংস্কৃতি চর্চা ও চর্যা বরাবর ছিল এই জনজাতিদের মাঝে। লিখিত রুপের চেয়ে মৌখিক নির্ভরতার কারনে সেই লোকসাহিত্য যথাযথ ভাবে সূত্রায়ন হয়নি।

অন্যদিকে গত শতকের ৫০ ও ৬০ এর দশকে গণ দেশত্যাগের ফলশ্রুতিতে কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে গারোদের পালাগান সেরেন জিং। কোচ সম্প্রদায়ের বারিধারা ব্রত কিংবা হাজংদের কার্তিক ব্রত কথার মতো পাঁচালী। একটি জন গোষ্ঠীর জীবনাচার বিশ্বাস যাপনের নানা সূত্র থাকে এই সমস্ত পালাগান বা প্যাঁচালীর বয়ানের ভেতর।

নালিতাবাড়ির মাটি ও মানুষ
যোগানিয়া, নালিতাবাড়ি | ইয়াসীন | রূপসী শেরপুর

অধ্যাপক সালাম তাঁর মাটি ও মানুসের বইতে এই জনগোষ্ঠার যাপিত জীবনের তেমন একটা চিত্র আঁকতে পারেননি। যদিও নালিতাবাড়ির উর্বরভূমি গঠনে এই ভূমি পুত্ররাই ছিল প্রধান কারিগর। গত শতাব্দীতে সম্পন্ন হিন্দু পরিবারের অব্যাহত দেশ ত্যাগের ফলশ্রুতিতে শূন্য জায়গায় জীবন জীকিকার জন্য এসে আশ্রয় নিয়েছে বিক্রমপুর-টাংগাইল-ঢাকা-ফরিদপুররের হিন্দু মুসলিম সম্প্রদায়।

এই সম্প্রদায়ের প্রথম প্রজন্ম কেটেছে অস্তিত্বের জন্য লড়াই সংগ্রামে। এক্ষেত্রে একথা সত্যি মোস্তফা কামাল ইতিহাসের ছেঁড়াতাঁর সংযোগের প্রশ্নে ছিল নিবেদিত। একদিকে ভাগ্যাম্বেষী মানুষদের লড়াই অন্যদিকে আদীবাসী সম্প্রদায়ের যাপিত জীবনের তত্ত্বতালাশে তিনি ছিলেন ‍উন্মুখ। কিন্তু তাঁর অকাল পুয়ানে সেই গুলো আর সূত্রায়ন হলো না; নালিতাবাড়ি হারালো একজন ঐতিহ্য সন্ধানী ইতিহাস বিদকে।

তিনি একবার কথা প্রসঙ্গে বলেছিলেন “তল থেকে দেখা ঘটনা পরম্পরার ভেতরেই বয়ে গেছে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের মৌলিক সূত্র” মোস্তফা কামাল প্রসঙ্গে পরে আবার আসছি। তার আগেই যোগেন রায়ের কিছু সন্ধানের কথা আপনাদের বলি। পেশায় শিক্ষক যোগেন রায় বিভিন্ন নিবন্ধে এই সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের যে সন্ধানে তৎপর তা নিঃশন্দেহে একটি ইতিবাচক দিক। যদিও সাংস্কৃতিক সামাজিক পরিপ্রেক্ষিত ও কর্মতৎপরতার বিশ্লেষিত দিক সমূহ তুলে আনবার প্রবনতা তার লেখার ভেতর নেই বললেই চলে। শুধু তথ্যই পরিবেশন করেন। তার পরও উৎসমুখ সন্ধানে তিনি তৎপর।

তিনি নিজেও একজন সাস্কৃতিক কর্মী। আশির দশকে ময়মনসিংহ শহরের একজন শক্তিমান তরুন অভিনেতা হিসেবে সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন তিনি। বহুরূপী নাট্যগোষ্ঠার কর্মী হিসেবে কিংবা ছাত্র রাজনীতি ক্ষেত্রে একজন সংগঠক ও নেতা হিসেবে তার অবদান স্বীকার্য। এম.এন আলম তোতার পরিচালনায় “চোর” নাটকের অভিনয়ে তিনি সকলের প্রশংসা কুড়িয়ে ছিলেন। কাজে কাজেই নালিতাবাড়ির সাংস্কৃতিক পরিমন্ডলের সন্ধানে তার কাছে আমাদের প্রত্যাশা অধিক।

YouTube | Our Sherpur

ইতিহাসের মাটি খুঁড়ে যিনি সবচেয়ে বেশী এই দিকটি তুলে এনেছিলেন তিনি মোস্তফা কামাল (২০০২) তবে একথা স্বীকার্য যে, পাদপ্রদীপের নীচে অন্ধকার এ অঞ্চলে আগত হিন্দু মুসলিমদের প্রথম প্রজনোর কাল খন্ডটি ব্যয়িত হয়েছে নিজেদের জীবন ও জীবিকার তাগিদে। মোস্তফা কামাল লিখেছেন, “নিজেদের অস্তিত্ব প্রতিষ্ঠা করার পশ্চাতেই কেটে গেছে।” শিক্ষার আলোয় আলোকিত প্রজন্মের ধারকদের ভেতর একমাত্র নগেন্দ্র চন্দ্র পালই (১৯১৬-২০০৩) প্রথম ইতিহাস চর্চা ও সূত্রায়নের দিক উন্মোচন করেন। তার রচিত “নালিতাবাড়ি ইতিবৃত্ত” সেই ঘরনারই একটি কাজ। কিন্তু সেটি আলোর মুখ দেখেনি। তাঁর ইতিহাস রচনার দৃষ্টিভঙ্গি ও গভীরতা সম্পর্কে কিছুটা ওয়াকিবহাল হওয়া যায় ”অন্তরের ধ্রুব তারা অনন্তে হোক হারা”  নিবন্ধ পাঠে।

একটি স্কুল তথা আলোক রবি রশ্মি প্রতিষ্ঠার পেছনের সলতে পাকানো থেকে শুরু করে তৎকালীন সমাজ সংস্কৃতি রাজনীতি তথা সার্বিক প্রেক্ষাপট তিনি তুলে এনছেন। এ অঞ্চলের ইতিহাস চর্চার এই প্রবাদ প্রতীম আদী পুরুষের প্রতি মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা শ্রদ্ধার সাথে স্মরনীয়। মোস্তফা কামালই ছিলেন তাঁর একমাত্র যোগ্য উত্তরসূরী যে তাঁর আরদ্ধ অসমাপ্ত কাজে আত্ম নিয়োগ করেছিলেন।

নালিতাবাড়ির সামাজিক বিন্যাস কাঠামোর উৎস সন্ধানে বেড়িয়ে তুলে এনেছেন অনালোকিত তথ্যাবলি পাঠকের কাছে কিছু নিবন্ধ তুলেও ধরেছেন। কিন্তু হায়! তাঁর প্রাপ্ত তথ্যের উপস্থাপনের আগেই তিনি চলে গেছেন। মোস্তফা কামালের ইতিহাস পাঠ ও উপস্থাপনের যে অনন্যতা তা সম সাময়িক ইতিহাস সন্ধানের কাঠামোর সাথে সংগতিপূর্ণ। উপরিকাঠামো শুধু নয়; অবকাঠামোগত সন্ধান।

তাঁর নিজগ্রাম বড়ুয়াজানী কে কেন্দ্র করে প্রকাশিত স্মরনিকা “ঠিকানার (১৯৯৫) ভবিষ্যত কর্মপন্থার আদর্শ ও উদ্দেশ্যকে লক্ষ কের তিনি লিখেছেন, আমাদের প্রবল আকাঙ্খা রয়েছে, আমরা এলাকার আদিবাসীদের সংগ্রাম; বিশেষ করে বৃটিশ বিরোধী সংগ্রামে এ এলাকার অলিখিত ইতিহাস, ১৯৫০ ও ১৯৬৪ সালের ঘৃনিত সম্প্রাদায়িক দাঙ্গা এবং এ এলাকার জন জীবন ও অর্থনীতিতে তার প্রভাব এবং সর্বোপরি মহান মুক্তিযুদ্ধকালে এলাকার বিস্তারিত সঠিক তথ্য সংগ্রহের কাজ শুরু করেছি।”

মোস্তাফা কামাল এই ব্যপক পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করে যেতে পারেন নি। এমন দীর্ঘ মেয়াদী কষ্টসাধ্য পরিকল্পনা নিয়ে অন্য কেউ উদ্যোগী হয় নি। তাঁর মৃত্যু পরবর্তী সময়ে নালিতাবাড়ী সুদী সমাজ তাঁর কৃতকর্মের কোন মূল্যায়ন করার কোন উদ্যোগ গ্রহন করেন নি। তাঁর প্রকাশিত লেখা গুলোও রয়েগেছে অসংকলিত।

Leave a Reply

Scroll to Top