৭১ এর গল্প বলা
প্রকৃতির যথা নিয়মে বছর ঘুরে ডিসেম্বর আসলেই স্বাধিকার আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে কিছু বলতে ইচ্ছে করে। ৭১এর দুঃসহ স্মৃতিগুলো মাথায় কিলবিল করে। তাছাড়া সেইসব সোনালী দিনগুলোর কথা আজকের প্রজন্মকে জানানো আমাদের নৈতিক দায়িত্বও বটে।
আজকের গল্পের শুরুতেই শ্রদ্ধা জানাই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, মহান স্বাধীনতার স্থপতি, জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে, সেইসাথে শ্রদ্ধা জানাই ৩০ লক্ষ শহীদদের আত্মার প্রতি যাঁরা দেশের জন্য সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করে গেছেন। আরও শ্রদ্ধা জানাই সেই দু’লক্ষ মা-বোনকে যাঁরা নারীত্বের শ্রেষ্ঠ সম্পদ দেশের জন্য বিলিয়ে দিয়েছেন। শ্রদ্ধা জানাই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের যারা জীবন বাজি রেখে পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছেন। সর্বোপরি শ্রদ্ধা জানাই শেরপুরের কৃতি সন্তানদের যাঁরা মুক্তি যুদ্ধের সংগঠক ছিলেন কিংবা সরাসরি পাক হানাদারদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ সম্পদ ’স্বাধীনতা’ এনেছেন। সকলকে সশ্রদ্ধ সালাম, তাঁদের জানাই মনের মণিকোঠা ও হৃদয়ের গহীন কন্দর থেকে নিঃসরিত ভালবাসা।
আমরা যাঁরা মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছি, মুক্তিযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছি কিংবা মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বতোভাবে সহায়তা করেছি তাঁদের নৈতিক দায়িত্ব হলো পরবর্তী প্রজন্মকে সঠিক ইতিহাস জানানো। কী দুঃসহ ঘটনা ঘটেছিল ৭১।
৬৯এর গণ অভ্যুত্থানের প্রত্যক্ষ ফসল হলো ৭০ সালের সাধারণ নির্বাচন। এই নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর আওয়ামী লীগ তথা বঙালী জাতীয়তাবাদের পক্ষে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করলে আমাদের মনে ছয় দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের ক্ষীণ আশা জাগায়। সমগ্র পূর্ব বাংলার মানুষ প্রত্যাশা করে ২৪ বছরের জুলুম নির্যাতনের পর এবার পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠী বঙ্গবন্ধুকে প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব দিতে বাধ্য হবে। নির্বাচনের পর বঙ্গবন্ধু সারা বিশ্বের নির্যাতিত মানুষের অবিসংবাদিত নেতা হিসেবে আবির্ভূত হন। তবে বঙ্গবন্ধু জানতেন তারা সহজে বাঙালীদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করবে না। তাই তিনি রাজ পথের আন্দোলনও অব্যাহত রাখেন।
অনেক টালবাহানার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া ০৩ মার্চ ১৯৭১ তারিখে অধিবেশনে আহ্বান করলে আমাদের আর কোন সন্দেহ থাকে না। কিন্তু পাকিস্তান পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলি ভুট্টো ৮৮ আসন পেয়ে ক্ষমতার মসনদে আসীন হওয়ার জন্য মরিয়া হয়ে উঠেন। আর তখনই বিপত্তি ঘটে। তিনি ইয়াহিয়া খানকে কুপরামর্শ দেন। ইয়াহিয়াও কুচক্রী ভুট্টোর ফাঁদে পা দেন। তিনি হঠাৎ করে ০৩ মার্চের অধিবেশন স্থগিত করলে সমগ্র পূর্ব বাংলা বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। আর তখনই আমাদের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন স্বাধীনতার আন্দোলনে রূপ নেয়।
ছাত্র, কৃষক, শ্রমিক জনতা রাজনৈতিক নেতাদের উপর স্বাধীনতা ঘোষণার জন্য প্রবলভাবে চাপ সৃষ্টি করেন। সমগ্র পূর্ব বাংলা বিক্ষোভ ও মিছিলের জনপদে পরিণত হয়। ছাত্র জনতা বঙ্গবন্ধুকে প্রকাশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা করার অনুরোধ করতে থাকে। ইতোমধ্যে ০২ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করেন।
বঙ্গবন্ধু দূরদর্শী নেতা। তিনি বাঙালীদের আরও প্রস্তুত করতে চান। তাই তিনি তাড়াহুড়ো না করে ০৭ মার্চ ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) জনসভায় ভাষণ দেয়ার ঘোষণা দেন। তখন আমরা ধরেই নিয়েছিলাম সেদিনই তিনি প্রকাশ্যে স্বাধীনতা ঘোষণা করবেন। কিন্তু তিনি সেদিন সরাসরি স্বাধীনতা ঘোষণা না দিলেও বজ্র কন্ঠে বললেন, ‘এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ তিনি যাঁর যা আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলেন।
০৭ মার্চের ভাষণ সরাসরি ঢাকা বেতার থেকে প্রচারের কথা থাকলেও সেদিন পাক সরকার তা প্রচার করতে দেয় নাই। সেদিন সন্ধ্যায় বিবিসি ও আকাশবাণী থেকে বঙ্গবন্ধু আংশিক ভাষণ আমরা শুনেছি। পরদিন ০৮ মার্চ ঢাকা কেন্দ্র থেকে সম্পূর্ণ ভাষণটি শুনেছি। ভাষণ শুনে সারা বাংলার মানুষ স্বাধীনতার জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে এক হয়ে যায়।
সমগ্র পূর্ব বাংলা বঙ্গবন্ধুর নিয়ন্ত্রণে চলে আসে। সারা দেশের সাথে আমরাও প্রতিদিন শেরপুরে মিছিল করতে থাকি। সকলের হাতে থাকতো বল্লম, বর্শা, রামদা, টেটাসহ নানা দেশীয় অস্ত্র। শেরপুর তখন মিছিলের শহরে পরিণত হয়।
২৩ মার্চ শহীদ দারোগ আলী পার্কে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত স্থানীয়ভাবে তৈরি ’জয়বাংলা’ লেখা সাদা পতাকা উত্তোলন করেন ছাত্র জনতা। সেদিন যাঁরা পতাকা উত্তোলন করেন তাঁদের কয়েকজনের নাম মনে পড়ে। তাঁরা ছিলেন আমজাদ ভাই, মোজাম্মেল হক, অদু ভাই, আক্তার ভাই, মোহন ভাই প্রমুখ ছাত্র নেতা। এর পর শেরপুরের জনসাধারণ আরও প্রতিবাদী হয়ে উঠে। ইয়াহিয়া আলোচনার নামে সময় ক্ষেপণ করতে থাকলে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে সারা দেশে সংগ্রাম কমিটি গঠন করে। শেরপুরেও আনিসুর রহমান, নিজাম উদ্দিন আহমেদ, এডভোকেট আব্দুস ছামাদ, রবি নিয়োগী, খন্দকার মজিবুর রহমান, আব্দুর রশিদ, মোহসীন মাস্টার, এমদাদুল হক হীরার নেতৃত্বে সর্বদলীয় সংগ্রাম কমিটি গঠিত হয়।
দলমত সবাই আড়াই আনী জমিদার বাড়িতে (মহিলা কলেজ) বাঁশের লাঠি ও অনন্য দেশীয় অস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত নিতে থাকে। আমরাও গ্রাম থেকে প্রায় প্রতিদিনই শেরপুরে এসে মিছিলে যোগ দিতে থাকি। বঙ্গবন্ধু তখন ইয়াহিয়ার সাথে ০৬ দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসনের জন্য আলোচনা চালিয়ে যান। অন্যদিকে নেতাদের প্রস্তুতি নিতে নির্দেশ দেন। মার্চের ১৭ তারিখে জেনারেল টিক্কা খান বাঙালীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে জেনারেল খাদিম হোসেন রাজা ও জেনারেল রাও ফরমান আলীকে নির্দেশ দেন।
সেমতে তারা আমাদের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নিতে প্রস্তুতি গ্রহণ করতে থাকলে তখন বঙ্গবন্ধু বুঝতে পারেন যে আলোচনার মাধ্যমে এর সমাধান সম্ভব নয়। এভাবে ২৫ মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন জানতে পারেন পাক বাহিনী সেদিনই বাঙালীদের নিধন শুরু করবেন। তখনই তিনি নেতা কর্মীদের নিরাপদ আশ্রয়ে যেতে বলে রাত ১২টার পর স্বাধীনতার ঘোষণা দেন। এই ঘোষণা দেশি বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে ২৬ মার্চে প্রচারিত হয়। আমরা সে খবর ২৬ মার্চ আকাশবাণী ও বিবিসি এর মাধ্যমে শুনে সার্বিক প্রস্তুতি নিলাম।
২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে হানাদার পাক বাহিনী ’অপারেশন সার্চ লাইট’ এর নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ ঢাকার রাস্তা ঘাটে হাজার হাজার নিরীহ বাঙালীদের হত্যা করে। ২৬ তারিখ সকালে ঢাকা বেতারকেন্দ্র বন্ধ দেখে আমরা আকাশবাণী কলকাতা কেন্দ্র থেকে দেব দুলাল বন্দোপাধ্যায়ের কন্ঠে প্রথম এ নিষ্ঠুরতম হত্যাকান্ডের খবর পেয়ে স্তম্ভিত হয়ে যাই।
আমরা তখন কী করবো বুঝে উঠতে না পেরে নেতাদের নির্দেশের জন্য অপেক্ষায় থাকি। সেদিন সকালেই নিউ মার্কেট মোড়ে সমবেত হয়ে হানাদারদের মোকাবেলা করার দৃঢ় প্রতিরোধ গড়ার অঙ্গিকার করে নেতৃবৃন্দ বক্তব্য দিলে আমরা উজ্জীবিত হই। তখন ’জয়বাংলা’ শ্লোগানে পুরো শেরপুর প্রকম্পিত হয়। ’বীর বাঙালি অস্ত্র ধর বাংলাদেশ স্বাধীন কর’ ’তোমার নেতা আমার নেতা শেখ মুজিব, শেখ মুজিব’ ইত্যাদি শ্লোগান দিতে থাকি। সন্ধ্যায় বিবিসি থেকে বিস্তারিত শুনে আরও লোমহর্ষক ঘটনা জানতে পারি।
এ সময় রাংটিয়া ইপিআর ক্যাম্পের সুবেদার আব্দুর হাকিম আনসার, মুজাহিদ স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে রাংটিয়ার প্রশিক্ষণ শিবির স্থাপন করলে প্রথম ব্যাচে শেরপুরের ১২ জন ছাত্রনেতা প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন।
এদিকে ঢাকা থেকে হানাদার বাহিনী টাঙ্গাইল হয়ে মধুপুরের দিকে অগ্রসর হতে থাকলে এপ্রিলের প্রথম সপ্তাহে সুবেদার আব্দুর হাকিম অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে মধুপুরে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন। কয়েকদিনের মধ্যেই আমাদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়লে তারা জামালপুরের চরাঞ্চলে শিবির স্থাপন করে প্রশিক্ষণ চালিয়ে যান।
২০ এপ্রিল হানাদার বাহিনী হেলিকপ্টার থেকে প্রশিক্ষণ শিবিরের উপর মেশিনগানের গুলি ছুড়লে ১৩ জন অসামরিক নাগরিক শহীদ হন। এর পর শহরের মানুষজন ভয়ে দিক্বিদিক ছুটতে থাকে। তখন টাঙ্গাইল, মধুপুর, ধনবাড়ি ও জামালপুরের লোকজন শেরপুরে চলে আসে। শেরপুরের নেতৃবৃন্দ তখন কৃষি ইনস্টিটিউট ও বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তাদের আশ্রয় প্রদান করে। আমরা ছাত্ররা তাদেরকে সহায়তা করতে থাকি।
এদিকে শরনার্থীরা ভারতে যেতে চাইলে স্থানীয় রাজাকাররা বাঁধা প্রদান করে। এর সাথে চুনের চরের দুই ভাই হবিবর গুন্ডা ও শিরাজ গুন্ডা এসে শক্তভাবে বাঁধা প্রদান করে। তখন নেতৃবৃন্দ তাদের সাথে দেনদরবার করে শেষপর্যন্ত ভারত পাঠানোর সিদ্ধান্ত হয়। তারপর মাইকিং করে ২২ এপ্রিল সকাল থেকে ২৭টি বাস ট্রাক যোগো শরনার্থীদের ভারত পাঠানো শুরু করে।
২৫ এপ্রিল পর্যন্ত শরনার্থী সীমান্ত এলাকায় নেয়া চলতে থাকে। আমরাও যার যার মত তখন গ্রামে ফিরে যাই। এদিকে হানাদার বাহিনী ২৬ এপ্রিল বহ্মপুত্র নদ পার হয়ে গুলি করতে করতে শেরপুর শহরে প্রবেশ করেই শনি বিগ্রহ মন্দিরের পুরোহিত সুব্রত ভট্টাচার্য, রুটির দোকানী আহমদ আলী, বুলবুল সহ অনেককেই নির্বিচারে হত্যা করে।
সেদিনই স্থানীয় রাজাকারের সহায়তায় শহরের অদূরে ঝাউগড়া গ্রামের সর্বজন শ্রদ্ধেয় মহেন্দ্র দেবের বাড়িতে গিয়ে মহেন্দ্র দেব, শেরপুর থেকে আশ্রয় নেয়া ব্যবসায়ী চৌথমল কারুয়া, নিপু সাহা সহ মোট আটজনকে বেঁধে মৃগী নদীর ধারে নিয়ে লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে লাশগুলো নদীতে ফেলে চলে যায়। পরবর্তীতে মৃতদেহগুলো ভেসে আমাদের পাড়ার উত্তর দিকে মৃগী নদীর ঘাটে আটকে থাকে। তখন আমি সহ কয়েকজন মিলে লগি দিয়ে দেহগিলো ছাড়িয়ে দেই। পরে খুনুয়া বাজারের কাছে দেহগুলো দশানী নদের ঘাটে গিয়ে আটকে থাকে। তখন মৃতদেহগুলো আর সরানোর মতো অবস্থা ছিল না। সেখানেই শিয়াল কুকুরে দেহগুলো খেয়ে ফেলে। তারাই শেরপুরের প্রথম শহীদ।
১৯৭১ সালে হানাদার বাহিনীর বর্বরতায় প্রায় এক কোটি বাঙালি ভারতে আশ্রয় নেয়। এদের মাঝে হাজার হাজার যুবক বিভিন্ন ক্যাম্পে গেরিলা প্রশিক্ষণ নিয়ে জুন জুলাই মাসে বাংলাদেশে প্রবেশ করতে থাকে। তখন আমাদের মাঝে সাহসের সঞ্চার হয়। তখন হানাদার বাহিনী যাকে যেভাবে পাচ্ছে নির্মমভাবে হত্যা করছে। হাজার হাজার ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দিচ্ছে। লাখ লাখ মা বোনের ইজ্জত হরণ করছে।
মুক্তিবাহিনী তখন শেরপুরের সীমান্ত এলাকায় হানাদার বাহিনীকে মোকাবেলা করছে। বিশেষ করে নকশীর যুদ্ধ, কামাল পুরের যুদ্ধ উল্লেখযোগ্য। তাছাড়া সারাবছর ধরে শেরপুরের বিভিন্ন জায়গায় হানাদার বাহিনীর সাথে যুদ্ধ হয়। সে সময় শত শত মুক্তিযোদ্ধা আমাদের চর এলাকায় তথা মুক্ত এলাকায় আশ্রয় নেয়। তখন দেশে খুব অভাব ছিল। তারপরও আমরা শত শত মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয় দেই। নিজের থাকার ঘরটাও ছেড়ে দিয়েছি। অনেকসময় দুই তিনজন করে ভাগ করে দিয়েও তাঁদের খাবার ব্যবস্থা করেছি।
যতই সময় গড়িয়ে যাচ্ছে, হানাদার বাহিনী দূর্বল হয়ে পড়ছে আর মুক্তিযোদ্ধারা সাফল্য অর্জন করে চলছে। হানাদার বাহিনী বুঝতে পেরেছে তাদের বিদায় ঘন্টা বেজে গেছে। তখন তারা আরও বেপরোয়া হয়ে হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে।
অক্টোবরে শেষের দিকে তারা পাকা বাঙ্কার তৈরি করা শুরু করে। কোন বাঙালি পেলেই তাদের দিয়ে ইট বহন করাচ্ছে। তখন আমরা বুঝতে পারছি বড় কোন যুদ্ধ শুরু হবে। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এম আর আক্তার মুকুলের চরম পত্র শুনে মুক্তিযোদ্ধারা মানসিক শক্তি অর্জন করছে। বিভিন্ন সেক্টর থেকে হানাদার বাহিনীর পরাজয়ের খবর শুনে আমরা আরও উজ্জীবিত হচ্ছি। ভারতের তদানিন্তন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী সারা পৃথিবী ঘুরে বিশ্ব জনমত গঠন করে চলেছেন। অপরপক্ষে হানাদার পাক বাহিনী তাদের অত্যাচারের মাত্রা বাড়িয়ে দিচ্ছে। এলাকার লোক ধরে যাকে আহমদ নগর পাঠাতো সে আর ফিরে আসতো না।
এর মধ্যেই আমাদের এলাকায় লোমহর্ষক ঘটনা ঘটে যায়। সেদিন ২৪ নভেম্বর। আমরা কয়েকজন সকাল ০৮:০০ টার দিকে মৃগী নদীতে মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য জেলেদের কাছ থেকে মাছ সংগ্রহ করছি। এমন সময় হঠাৎ এলএমজির বার্স্ট ফায়ারের শব্দ। মুহুর্মুহুর শব্দে আকাশ বাতাস প্রকম্পিত।
আমরা মনে করেছি ভীমগঞ্জ ঠাকুর বাড়ি আক্রান্ত হয়েছে। একটু পরেই আগুনের লেলিহান শিখা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ছে। সেদিন আমাদের বাড়িতে ৩৪ জন মুক্তিযোদ্ধার একটি দল অবস্থান করছিল। তারা সহ আমরা কয়েকজন মৃগী নদী পার হয়ে একটু সমনে গিয়ে শুনি হানাদার বাহিনী সূর্যদ্দী বড় বাড়ি আক্রমণ করেছে। তখন আশেপাশের বিশেষকরে বেতমারী, চরখার চর, ফটিয়ামরী সহ চর এলাকায় অবস্থান রত সকল মুক্তিযোদ্ধারা ভীমগঞ্জ ও আশপাশে জড় হতে থাকে।
মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার বাহিনীকে প্রতি আক্রমণ করার কথা বললে অনেকে নিষেধ করেন। আক্রমণ চালালে হতাহতের সংখ্যা বেড়ে যাবে। সেদিন হানাদার বাহিনী ২/৩ ঘন্টা তান্ডব চালিয়ে প্রায় ২০০ বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। তারপর তারা গাড়িতে করে শেরপুর ফিরে যায়। তখন মানুষজন তাদের প্রিয়জনদের খুঁজাখুঁজি শুরু করে। বাড়ির জঙ্গলে, ধানক্ষেতে খুঁজে ৪৯টি লাশ পাওয়া যায়। একদিকে প্রিয়জনের মৃত্যু, বাড়িঘর ভস্মীভূত হওয়ার পর এক হৃদয়বিদারক দৃশ্যের সৃষ্টি হয়। স্বজনদের কান্নায় আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠে। স্বাধীনতার মাত্র ২২ দিন পূর্বে হানাদার বাহিনী তাদের জঘন্যতম নিষ্ঠুরতা দেখায় সূর্যদ্দী গামে। স্বচক্ষে না দেখলে লিখে সে পৈশাচিকতার বর্ণনা করা যায় না।
এর পরেই শুরু হয় আমাদের বিজয়। ডিসেম্বরের শুরু থেকেই একের পর এক রণাঙ্গনে হানাদার বাহিনী পরাজিত হতে থাকে। তখন ইয়াহিয়া ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে মুক্তিবাহিনী ও মিত্র বাহিনী যুগপৎ আক্রমণ চালায়। ০৪ ডিসেম্বর হানাদার বাহিনী ঝিনাইগাতি ও কামালপুর ছেড়ে শেরপুর চলে আসে। আমরা উল্লাসে আত্মহারা। শেরপুরের পতন তখন সময়ের ব্যাপার মাত্র।
আমরা সব সময় খবর নিচ্ছি আর অপেক্ষা করছি কখন শেরপুর মুক্ত হবে। অবশেষে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ এলো। ০৬ ডিসেম্বর দিবাগত রাতে হানাদার বাহিনী তল্পিতল্পা গুটিয়ে ব্রহ্মপুত্র পার হয়ে জামালপুর পিটিআই এলাকায় আশ্রয় নেয়। ০৭ ডিসেম্বর শেরপুর মুক্ত হয়।
আমাদের আনন্দ আর ধরে না। ভোরেই আমরা দলবেঁধে শেরপুরে রওনা দেই। কানাশাখোলা এসে দেখি মানুষের ঢল, বিরাট মিছিলের লম্বা লাইন। একরকম দৌড়েই শেরপুর পৌঁছে দেখি নিউমার্কেট ও তার আশপাশের এলাকায় মিত্র বাহিনীর সারি সারি গাড়ি আর মিত্র বাহিনীর লোকজন। আমরা ’জয়বাংলা’ শ্লোগান দিচ্ছি তারা বলছে ’জয় হিন্দ।’ আমরাও তাদের সাথে জয়বাংলা ও জয় হিন্দও বলছি। তাঁদের সাথে বাংলা, হিন্দি ও ইংরেজি মিশিয়ে কথা বলছি। তারাও আন্তরিক।
আমাদের আনন্দ আর ধরে না। সারা শেরপুর সবাই মিলে ঘুরছি আর ’জয়বাংলা’ শ্লোগানে শ্লোগানে মুখরিত করে তুলছি। এমন সময় খবর এলো মিত্র বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল জগজিত সিং অরোরা হেলিকপ্টারে শেরপুর আসছেন। শুনেই দৌড়ে দারোগ আলী পার্কে হাজির হলাম। মানুষের ভিড়ে মিত্র বাহিনী সামাল দিতে হিমসিম খাচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জেনারেলের হেলিকপ্টার এসে পৌঁছালো । বীর দর্পে নেমে এলেন জেনারেল।
তিনি পৃথিবীর বিখ্যাত সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে শেরপুরকে মুক্ত ঘোষণা করেন এবং সাংবাদিকদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেন। তিনি পরবর্তী ০৭ দিনের মধ্যে ঢাকা মুক্ত করার আশাবাদ ব্যক্ত করেন। আমিও সেদিনের ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলাম। সারাদিন উল্লাস করে সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে যাই। সেদিনের স্মৃতি আজও হৃদয়ে জ্বলজ্বল করছে। তারপর আমরা অপেক্ষা করি ঢাকা তথা বাংলাদেশকে হানাদার বাহিনী মুক্ত করে বিশ্বের বুকে স্বাধীন জাতির মর্যাদা লাভের জন্য। আর ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ তারিখে পাক হানাদার বাহিনী মিত্র ও মুক্তি বাহিনীর কাছে ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দানে আত্মসমর্পন করে।
আমরা স্বাধীন হলাম। বিনিময়ে ত্রিশ লক্ষ শহীদদের রক্ত আর দুই লক্ষ মা বোনের ইজ্জত দিতে হয়েছে। অতঃপর অপেক্ষার পালা কবে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন দেশে আসবেন। খুব বেশি সময় নেয়নি। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি লন্ডন ও ভারত হয়ে বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন সর্বকালে সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শুরু হয় দেশ গড়ার আর এক সংগ্রাম।
তারপর নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে আজ জাতি ইতিহাসের এক অনন্য উচ্চায় দাঁড়িয়ে। স্বাধীনতার মাত্র সাড়ে তিন বছরের মাথায় পরাজিত পাকিস্তানের প্রেতাত্মারা বঙ্গবন্ধুকে স্বরপরিসর হত্যা করই খান্ত হই নাই। ধ্বংস করেছে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা। যে ’জয়বাংলা’ শ্লোগান জাতিকে এক করেছিল সেই জাতীয় শ্লোগান নিষিদ্ধ করে পাকিস্তানি ধারায় ’জিন্দাবাদ’ নিয়ে আসা হয়। আমাদের দারোগ আলী পার্কের নামটাও উচ্চারণ করা নিষিদ্ধ ছিল। দীর্ঘ ২১ বছর জাতিকে সেই খেসারত দিতে হয়েছে। পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্ব আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এসে আমরা মুক্তি যুদ্ধের চেতনায় ফিরে আসছি।
আসুন, আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ঐক্যবদ্ধ থেকে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ি এবং স্বাধীনতার সুফল ঘরে ঘরে পৌঁছে দেই। দেশ থেকে সকল অনিয়ম, দুর্নীতি দূর করে দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফুটাই। সকলেই দুর্নীতি ও দুর্নীতিবাজদের ঘৃণা করি। বিজয়ের মাসে এই হওক আমাদের শপথ। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।
লেখক : ক্যাপ্টেন (অবঃ) মোঃ রফিকুল ইসলাম, সেনা শিক্ষা কোর।