মেঘালয়ে ফিরে দেখা ৭১
শেরপুরের বীর মুুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডারর্স ফোরাম শেরপুর জেলা শাখার সাধারণ সম্পাদক এডভোকেট আখতারুজ্জামান একদিন আমাকে বলেন, রফিক তুমি তো প্রায়ই নাকুগাঁও হয়ে ভারতের তুরা যাও। আমাকে একদিন নিয়ে যাও। কবে মৃত্যু হয় ঠিক নেই, তাই শেষ বারের মতো ভারতের মেঘালয় রাজ্যের তুরায় মুক্তিযোদ্ধাদের ট্রেনিং সেন্টার, পুরাকাশিয়ার ক্যাম্পসহ একাত্তরের স্মৃতিময় স্থানগুলো দেখতে মন চাইছে। আমার পাসপোর্ট-ভিসা রেডি আছে।
আমি মুক্তিযুদ্ধ দেখিনি, তবে মুক্তিযুদ্ধের গল্প শুনেছি অনেক। প্রায় ৫০ বছর পর কেমন ছিল সেই দিনগুলো, কীভাবে যুদ্ধ করে জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তানরা জীবন বাজি রেখে এ দেশকে উপহার দিয়েছে, সেই ভয়াবহ দিনগুলোর সাক্ষি না হতে পারলেও সেই স্থানগুলো এক নজর দেখে আসার জন্য আখতার ভাইয়ের লোভনীয় প্রস্তাবে সাথে সাথেই রাজি হয়ে যাই।
কথা মতো আমি এবং আখতার ভাইয়ের দুই সহকর্মী আইনজীবী মো. সুরুজ্জামান এবং মুন্সি মোহসীন ভাইকে সাথে নিয়ে পাসপোর্ট নিয়ে বেরিয়ে পড়ি ১৩ সেপ্টেম্বর সকালে। নিজ জেলার নালিতাবাড়ি উপজেলার নাকুগাঁও-ভারতের ডালু ইমিগ্রেশন চেকপোস্ট দিয়ে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের বারাঙ্গাপাড়া বাজারে প্রবেশ করি।
সকালে বের হওয়ার উদ্দেশ্য ছিল বারাঙ্গাপাড়াস্থ একাত্তরের শরণার্থী শিবির, পুরাকাশিয়া ও মহেন্দ্রগঞ্জ মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্প এবং মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় বেশ কিছু স্থান পরিদর্শনের। কিন্তু সে পরিকল্পনায় বাগড়া বসায় বৃষ্টি। বৃষ্টির কারণে বারাঙ্গাপাড়াতেই দুপুর গড়িয়ে যায়। সীমান্ত ও পাহাড়ি এলাকা হওয়ায় বারাঙ্গাপাড়া থেকে তুরা শহরে বাস চলাচল বেলা আড়াইটার মধ্যেই শেষ হয়ে যায়।
বারাঙ্গাপাড়াতে থাকার কোন হোটেল বা বিকল্প ব্যবস্থা না থাকায় সিদ্ধান্ত নিতে হলো আড়াইটার বাস ধরে আপাতত তুরা শহরে গিয়ে রাত্রি যাপন করা। মাত্র ৪৫ কিলোমিটার দুরত্ব হলেও তুরা থেকে ডালু বা বারাঙ্গাপাড়া বাজার পর্যন্ত হাইওয়ে রোডের কাজ শুরু হওয়ায় এক ঘণ্টার পথ সময় লাগে প্রায় আড়াই ঘণ্টা। তাই ওই দিনের মতো মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিময় স্থানগুলো দেখার পরিকল্পনা স্থগিত করে তুরার বাসের টিকিট করি।
বাস ছাড়ার আরো আধ ঘণ্টা সময় থাকায় বারাঙ্গাপাড়া বাজারের সাথেই তৎকালের একটি ডাকবাংলোর খুঁজে বের হই। যেখানে একাত্তরে বাংলাদেশ থেকে আগত গণ্যমান্য ব্যাক্তিরা এসে থাকতেন। আখতার ভাইয়ের ধারণা মতো সহজেই খুঁজে পাই সেই বাংলোটি। বাংলোটি এখন সেই পুরোনো আদলে রায়েছে।
বর্তমানে এটি ভারতের পিডব্লিউডি এর বারাঙ্গাপাড়াস্থ অফিসকাম ডাকবাংলো হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে। ঘুরতে ঘুরতে এক কেয়ারটেকারকে পেয়ে যাই। তার সাথে কথা বলে বাংলোর সামনে আসতেই আখতার ভাই বলে উঠলেন, এই সেই বাংলো, এখানে একদিন এসেছিলাম আমাদের ময়মনসিংহের তৎকালের এমএনএ সৈয়দ আব্দুস সুলতান এর সাথে দেখা করতে। ঠিক আগের মতোই রয়েছে বাংলোটি। বাংলোর সামনে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে এবং আখতার ভাইয়ের স্মৃতিচারণ করতেই বাস ছাড়ার সময় হয়ে যায়। তাই দেরি না করে বাসে উঠে পড়ি।
বেলা আড়াইটায় ছেড়ে বাসটি তুরা শহরে পৌঁছায় বিকেল সাড়ে ৪ টায়। পাহাড়ি শহর বিধায় এখানে রাত ৮ টার মধ্যে দোকানপাটসহ সকল প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে যায়। তাই দ্রুত হোটেলে রুম নিয়ে এক ঝলক রাতের শহর দেখে আবার হোটেলে ফিরে রাতের খাবার শেষ করি।
এমনিতেই বৃষ্টির কারণে একটি দিন মিস, তাই পরের দিন সকালে পরিকল্পনা করি তুরা শহর থেকে প্রায় ১০ কিলোমিটার দুরে ৭ মাইল নামক স্থানে ট্রেনিং ক্যাম্পে যাওয়া এবং যুদ্ধের সময় আখতার ভাইসহ যেসব মুক্তিযোদ্ধা অসুস্থ ও আহত হয়ে স্থানীয় সিভিল হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়েছে সে হাসপাতালে ঢু মারার জন্য। এরপর আবারও বারাঙ্গাপাড়ায় ফিরে গিয়ে পোরাকাশিয়া ক্যাম্প পরিদর্শন করবো।
কথামত সবাই রাত ১০ টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়ি। কিন্তু সকালে উঠেই সবার মন খারাপ হয়ে যায়। আবার সেই বৃষ্টির বাগড়া। অঝোরে পড়ছে বৃষ্টি। আমাদের সফরসঙ্গী একজন আখতার ভাইয়ের উদ্দেশ্যে বলে উঠলেন, ভাই এবার আমাদের অভিযান ব্যর্থ, এই বৃষ্টির মধ্যে কোথাও যাওয়া যাবে না। বৃষ্টি কমলেই চলেন বাংলাদেশে ফিরে যাই।
আখতার ভাইয়ের মুখখানি তখন মলিন হয়ে যায়, এতো আশা করে দীর্ঘ প্রায় ৫০ বছর পর পুরোনো স্মৃতি রোমন্থনে এসে খালি খালি ফিরে যাবে, মনটা সায় দিচ্ছিল না। তাই তিন ভগ্ন হৃদয়ে বললেন, দেখি আরো কিছুক্ষণ, বৃষ্টি না কমলে তো আর করার কিছু নেই।
সকাল ৭ টা থেকে ৮ টা পর্যন্ত মুশলধারে বৃষ্টি হলেও ৮ টার পর কিছুটা কমে আসে। সেই সাথে আমাদের মনের জোরটা বেড়ে যায়। আমি বেরিয়ে পড়ি একটি অটো রিজার্ভ করতে। তুরা-ঢালু সড়কের ‘সাত মাইল’ নামক স্থানে আসা-যাওয়া ৪শ টাকায় ভাড়া নিয়ে গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বেরিয়ে পড়ি আমরা। আধ ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাই ‘সাত মাইল’ নামক স্থানে। ওখানে বর্তমানে ভারতীয় সরকারের একটি রাবার প্লান্ট প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। ওই রাবার প্লান্টের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে একটি পাহাড়ি নদী। জঙ্গলের ভিতর দিয়ে বয়ে যাওয়া নদীর কাছে যাওয়ার জন্য স্থানীয় রাবার বাগানের শ্রমিকদের সাথে কথা হলে তারা পথ দেখিয়ে দেয়।
তাদের কথা মতো জঙ্গলের পায়ে হাটা সরু পথ দিয়ে হাটা শুরু করলাম। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির কারণে পথটি বেশ পিচ্ছিল ছিল। সেইসাথে বৃষ্টির কারণে ওই রাস্তায় জোঁকের কামড় খাওয়ার ভয়ও ছিল। সেদিনের সেই রাইফেল কাঁধে ট্রেনিং নেয়া মুক্তিযোদ্ধার মতোই আখতার ভাই এগিয়ে যাচ্ছে সামনের দিকে। আর আমরা পায়ে পায়ে তার পিছু পিছু যাচ্ছিলাম। ঘন জঙ্গল ভেদ করে যখন এগিয়ে যাচ্ছিলাম তখন নিজেকেও একাত্তরের মুক্তিযোদ্ধা মতো অনুভব করতে লাগলাম। গহীন জঙ্গল মাড়িয়ে কিছুদূর যাওয়ার পর পৌছলাম বড় বড় পাথর বিছানো সেই নদীর কাছে।
আখতার ভাই নদীটি দেখেই আবেগে আপ্লুত হয়ে বললেন, “এই সেই পাথরের নদী ! এপথ দিয়ে আমরা সামনের ট্রেনিং ক্যাম্পে গিয়েছি এবং এখানে এক মাস ১০ দিন ট্রেনিং চলাকালে গোছল করেছি, মাছ ধরেছি।” তৎকালে ১১ নং সেক্টরের অনেক মুক্তিযোদ্ধা এ ট্রেনিং সেন্টারে ট্রেনিং নিয়ে হানাহার পাক সেনাদের উপর ঝাপিয়ে পড়েছে বাংলাকে মুক্ত করতে।
ট্রেনিং ক্যাম্পের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ওই পাথরের নদীর চারপাশ এখনও ঘন জঙ্গলে ভরে আছে। যেখানে তাবু গেড়ে ক্যাম্প করা হয়েছিল অর্থাৎ সমতল মাঠটি এখন সুপারী বাগান। তবে স্মৃতির মণিকোঠায় বার বার মনে হচ্ছিল এতো সেদিন এখানে এই মাঠে শত শত মুক্তিকামী মানুষ দেশ রক্ষায় ছুটে এসেছিল টেনিং এর জন্য। আজ সেই মাঠ সেভাবে নেই তবে এখানকার আলো-বাতাস সাক্ষি হয়ে আছে সেইসব বীর সেনাদের নানা কষ্টের কথা।
এদিকে ঘন জঙ্গল আর পাথরের নদীর পাথর মাড়িয়ে বয়ে যাওয়া কলকল পানির শব্দ এক অন্যরকম অনুভূতি জাগিয়ে তুলে মনে। সেই সাথে ভাবতে লাগলাম, আজ প্রায় ৫০ বছর পর এই এলাকাটি এখনও জনমানবশুন্য। ভয়ে শিহরিত হয়ে উঠছে শরীর। কিন্তু ৫০ বছর আগে এ স্থানের অবস্থা আরো কত ভায়াবহ ছিল সেটা ভাবছি আর চিন্তা করছি জাতীর শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধারা কতটা কষ্ট ও ত্যাগের বিনিময়ে যুদ্ধ তো দুরের কথা, এই মৃত্যু কুপের মতো জোঁক-সাপ-বিচ্ছু আর গহীন জঙ্গলের নানা হিংস্র প্রাণীর কবলে পড়ার কোন তোয়াক্কা না করে এখানে এসে ট্রেনিং করেছে।
এসব নানা কথা ভাবতে ভাবতেই সময়ের দিকে খেয়াল করে সেখান থেকে ফিরে আসি শহরের সেই তৎকালীন সিভল হাসপাতালে। যেখানে আহত ও অসুস্থ মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসা দেওয়া হতো। যদিও বর্তমানে সেখানে সেই সিভিল হাসপাতালের ভবনটি ভেঙ্গে নতুন করে তৈরী করা হয়েছে মাতৃ ও শিশুসদন এবং সিভিল হাসপাতালটি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। তবুও আখতার ভাই এখানে অস্ত্রের আঘাতে আহত হয়ে ভর্তি হয়ে বেশ কয়েকদিন চিকিৎসা নিয়েছিলেন। সেজন্য আখতার ভাইয়ের সাথে নতুন ভবনের ভিতরে কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে দেখে এবং স্মৃতিচারণ করে ফিরে যাই হোটেলে।
বৃষ্টি কিছুটা কমে যাওয়ায় সিদ্ধান্ত নিলাম তুরা থেকে দ্রুত ঢালু-বারাঙ্গাপাড়া গিয়ে পুরাকাশিয়ায় তৎকালীন মুক্তিযোদ্ধা ক্যাম্পসহ অন্যান্য স্মৃতিময় স্থান পরিদর্শন করবো। তাই হোটেলে গিয়ে দেরি না করে সকালের নাস্তা সেরেইে চেক আউট করে তুরা দোবাসিপাড়া বাসস্ট্যান্ডে যাই। বেলা ১১ টার বাসের টিকেট কেটে বেলা দেড়টার দিকে বারাঙ্গাপাড়া বাজারে পৌঁছাই আমরা।
ইমিগ্রেশনে বিকেল ৫ টার মধ্যে পৌঁছার আগে হাতে সময় ছিল মাত্র ৩ ঘণ্টা। সে হিসেবেই একটি অটো ভাড়া করে বেরিয়ে পড়ি বারাঙ্গাপাড়া বাজার থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে পুরাকাশিয়া বিএসএফ ক্যাম্পের সন্নিকটের উদ্দেশ্যে। ৩০ মিনিটের মধ্যে পৌঁছে যাই পুরাকাশিয়া পুরাতন বাজার এলাকায়। সেখান থেকে বিএসএফ এর ক্যাম্প প্রায় ৫ শত গজ দূরে একটি বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে আখতার ভাই স্মৃতিচারণ করেন এবং সেই স্থানটি চিহ্নিত করেন যেখানে আমাদের শেরপুরের গর্ব শহীদ বুলবুলের লাশ রাখা হয়েছিল।
শহীদ বুলবুল এবং তার সঙ্গীরা একাত্তরে শেরপুরের সেরী ব্রিজ উড়িয়ে দিতে এসে সুযোগ না পেয়ে ফিরে যাওয়ার সময় শ্রীবরদী উপজেলার কুড়িকাহনীয়া ব্রিজের কাছে আসতেই ব্রিজ পহারার দায়িত্বে থাকা আলবাদর বাহিনীর সদস্যরা মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে গুলি চালালে মুক্তিযোদ্ধা বুলবুল গুলিবিদ্ধ হয়। এসময় মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল খালেক সিকদারসহ অন্যান্য মুক্তিযোদ্ধারা তাকে তুরার হাসপাতালের উদ্দেশ্যে নিয়ে আসেন ওই স্থানে। রাতব্যাপী রক্তক্ষরণের কারণে প্রাথমিকভাবে তাকে বারাঙ্গাপাড়া চিকিৎসা কেন্দ্রে নিতেই তার মৃত্যু হয়।
বুলবুলের স্মৃতিচারণ শেষে ফিরে যাই পুরাকাশিয়া বন্ধকুঁচি গ্রামের উদ্দেশ্যে যেখানে ট্রেনিংপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প ছিল। এ ক্যাম্প থেকেই পরবর্তীতে যুদ্ধ পরিচালনা ও অভিযান চালিয়ে হানাদারমুক্ত করতে বিভিন্ন অপারেশনের পরিকল্পনা করা হতো। আমাদের অটো চালক এ গ্রামটি আগে থেকেই চিনতো তাই সহজেই ওই গ্রামে ঢুকে স্মৃতি হাতরাতে থাকেন আখতার ভাই। খুঁজতে লাগলেন সেই পাহাড়, যেখানে তাবু করে ক্যাম্প করা হয়েছিল। কিন্তু প্রায় ৫০ বছর পর সেই পাহাড়ে এখন সুপারি বাগান হওয়ায় চিনতে কষ্ট হচ্ছিল আখতার ভাইয়ের।
এসময় বার্নাড এম সাংমা নামে স্থানীয় এক গারো কৃষক আমাদের কাছে এসে বলেন, “কি খুঁজতাছ তোমরা?” তখন আক্তার ভাই তাকে মুক্তিযুদ্ধের বিস্তারিত বলতেই বলেন, “হ্যা হ্যা এখানে মুক্তি ক্যাম্প আছিল। আমি দ্যাখছি, আমার বয়স তখন ৮ বছর আছিল।” তখন তিনি আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেন এই সুপারি গাছ লাগানো পাহাড়েই ছিল ‘মুক্তি ক্যাম্প’। তখন সুপারি গাছ ছিল না, স্বাধিনতার পর এখানে সুপারি গাছ লাগানো হয়েছে।
এ ক্যাম্পের সামনে বড় বড় দুইটি কাঁঠাল গাছ ছিল। বার্নাডের এ স্মৃতিচারণ করতেই আখতার ভাই নানা স্মৃতিমূলক কথা শোনালেন আমাদের। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, নিয়মিত ক্যাম্প পাহারা দেওয়ার ধারাবাহিকতায় একদিন এ ক্যাম্প পাহারায় ছিলেন আখতার ভাই এবং মুক্তিযোদ্ধা তালপতুফ হোসেন মঞ্জু ভাই। ওই দিন সকালে মিত্র বাহিনীর এক ব্রিগ্রেডিয়ার জিপ নিয়ে ক্যাম্পে আসেন। এসময় মঞ্জু ভাই রাইফেল তাক করে ‘হোল্ড’ বলে জিপটি থামিয়ে দেয় এবং জিপ থেকে ওই ব্রিগ্রেডিয়ার হাত উঁচু করে নেমে এসে তাদেরকে পিট চাপরিয়ে বলেন, ‘আচ্ছা মুক্তি ফৌজ হ্যায়’।
এভাবে নানা স্মৃতিচারণ করতে করতে আমাদের ইমিগ্রেশনে প্রবেশের সময় হলে ওখান থেকে দ্রুত বারাঙ্গাপাড়া চলে এলাম। অটো দিয়ে আসার পথে অটোতে বসেই একাত্তরে শরণার্থী শিবির কোথায় কোথায় ছিল তা স্মৃতিচারণ করতে করতেই বারাঙ্গাপাড়া বাজারে এসে যাই। বিকেল সাড়ে ৪ টা বাজায় ওখানে আর দেরি না করে চলে যাই ভারতীয় ইমিগ্রেশনে। ওখানের কাজ শেষ করে পর্যাক্রমে কাস্টমস ও বিএসএফ এবং বাংলাদেশের বিজিবি, কাস্টমস ও ইমিগ্রেশন শেষ করে নাকুগাঁও থেকেই একটি সিএনজি নিয়ে শেরপুরের উদ্দেশ্যে রওনা হই।
সন্ধ্যা ৬ টার মধ্যে শেরপুর শহরে পৌঁছায় আমরা। ফিরে আসার সময় বারাবার মনে হচ্ছিল একাত্তর দেখিনি। একাত্তরের ভয়বহতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের জীবন বাজি রেখে যুদ্ধ, ট্রেনিং, দিনযাপন কোন কিছুই না দেখলেও এই প্রায় ৫০ বছর পর সেই দিনের ট্রেনিংক্যাম্প, কষ্টের ট্রেনিং এর কষ্ট কথা, রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে মাইলের পর মাইল রাইফেল কাঁধে নিয়ে দুর্গম পাহাড়-নদী, জঙ্গল পাড়ি দিয়ে কেবল মাত্র পায়ে হেঁটে রাত-বিরাতে ছুটে চলার কথা কল্পনা করতে করতে শরীর শিউরে উঠা অভিজ্ঞতা নিয়ে বাড়ি ফিরলাম। সেই সাথে আমি একদিনের জন্য ফিরে গিয়েছিলাম সেই একাত্তরে !
Table of Contents
তথ্য সূত্র : মুক্তিযোদ্ধা আখতারুজ্জামান, সাধারণ সম্পাদক, সেক্টর কমান্ডার্স ফেরাম, শেরপুর।