১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর আনুষ্ঠানিক ভাবে স্বাধীনতার ঘোষণার সাথে সাথেই হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে বাঙালী জাতি একযোগে ঝাঁপিয়ে পরে। পাক হানাদার বাহিনী “অপারেশন সার্চ লাইট” এর মাধ্যমে বাঙালী জাতিকে নিঃশেষ করে দেয়ার জন্য পৈশাচিক গণহত্যা শুরু করে। এর ধারাবাহিকতায় ২৬ এপ্রিল গুলি করতে করতে হানাদার বাহিনী শেরপুরে প্রবেশ করে। সেদিন নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করে অনেক নিরিহ মানুষকে হত্যা করে। হানাদার বাহিনীর হত্যা ও নারী নির্যাতন দিনের পর দিন চলতেই থাকে।
শেরপুর জেলার নালিতাবাড়ী উপজেলার কাকরকান্দি ইউনিয়নের সোহাগপুর গ্রাম। সীমান্ত ঘেঁষা শান্ত এ গ্রামের মানুষ পরিবার পরিজন নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করে আসছে। কিন্ত হানাদার বাহিনীর পৈশাচিকতার খবর তারা পাচ্ছে। তাদের মাঝে উৎকন্ঠাও বাড়ছে। ভয়ে ভয়ে দিন কাটাচ্ছে ঐ গ্রামের মানুষজন।
১৯৭১ সালের ২৫ জুলাই নেমে এল এক বিভীষিকা। পাক হানাদার বাহিনী চারদিক থেকে গ্রামটি ঘিরে ফেললো। তারপর চালালো নির্মম হত্যার মহোৎসব। প্রায় আট ঘন্টা চলে তাদের পৈশাচিকতা। একে একে হত্যা করে ১৮৭ জন নিরীহ গ্রামবাসী। গ্রামের ৬২ জন নারী বিধবা হন। মুহূর্তেই ভেঙে যায় তাদের সাজানো গোছানো সোনার সংসার। ১৩ জন নারী তাদের বর্বর নির্যাতনের শিকার হন।
প্রায় নয় মাস বক্তক্ষয়ি যুদ্ধে ৩০ লক্ষ লোকের রক্তের বিনিময়ে ও ০২ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে ১৬ ডিসেম্বর তারিখে দেশ স্বাধীন হয়। কিন্তু ঐ গ্রামের অসহায় বিধবাদের জীবন সংগ্রাম চলতে থাকে। তখন গ্রামটির নাম ” বিধবা পল্লী” নামে পরিচিত হয়। আজও সে নামেই আমরা গ্রামটিকে জানি। বঙ্গবন্ধু সরকার তাদের জন্য কিছু করা শুরু করেন। কিন্তু ৭৫ পরবর্তী সরকারগুলো তাদের তেমন কোন খোঁজ খবর রাখে নাই। আবার বঙ্গবন্ধু কন্যা তথা আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর তাদের সাহায্যে সহযোগীতা করতে থাকে। এক পর্যায়ে নির্যাতিত ১৩ জনকে সরকার মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। তার ধারাবাহিকতায় জাতীয় মুক্তিযোদ্ধা কাউন্সিল (জামুকা) এর ৫৪ তম সভায় প্রথমে ০৮ জন ও পরে ০৪ জন মোট ১২ জনকে মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে স্বীকৃতি দেয়। তারা হলেনঃ
(১)সালমা বেওয়া
(২)হাফিজা বেওয়া
(৩)জাবেদা বেওয়া
(৪)আছিরন বেওয়া
(৫)জবেদা-২ বেওয়া
(৬)হাসেন বানু
(৭)মহিরন বেওয়া
(৮) আছিরন নেছা
(৯) জরিতন বেওয়া
(১০)হাসনে আরা
(১১) হাজেরা বেগম-১
(১২) হাজেরা বেগম-২।
কৃতজ্ঞ জাতি মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের পুনর্বাসনে বদ্ধপরিকর। বর্তমান সরকার মুক্তিযোদ্ধা ও বীরাঙ্গনাদের সুযোগ সুবিধা অনেক গুণে বাড়িয়েছে। সোহাগপুরের সে বিধবা পল্লীকে “বীর কন্যা” পল্লী নামকরণ করে প্রতিটা সাড়ে নয় লক্ষ টাকা করে মোট ৩০টি
আধাপাকা ঘর তৈরি করে দিয়েছে। সরকারি বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা থেকে সোহাগপুরের নিগৃহীত পরিবারগুলো সাহায্য সহযোগিতা পাচ্ছে।
শেরপুরের সোহাগ পল্লীর মত অসংখ্য পল্লী এদেশে আছে যেখানে পাক হানাদার বাহিনীর বর্বরতা’র ক্ষত এখনো বয়ে বেড়াচ্ছে। সে সমস্ত অকুতোভয় বীর শহীদ ও বীরাঙ্গনাদের পরিবারকে সহায়তা করলে জাতি হিসেবে আমাদের সম্মান বাড়াবে। আসুন সরকারের পাশাপাশি আমরাও সেই বীরদের ও তাদের পরিবারের প্রতি সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে ধন্য হই।
লেখকঃ ক্যাপ্টেন (অবঃ) মোঃ রফিকুল ইসলাম, সেনা শিক্ষা কোর।