Our Sherpur

ঝগড়ারচরের নামকরণ ও ইতিহাস

ঝগড়ারচরের নামকরণ ও ইতিহাস

ঝগড়ার চর বাজার। শেরপুর জেলার শ্রীবরদী উপজেলার ৭ং ভেলুয়া ইউনিয়নের অন্তর্গত একটি হাট- বাজার। বারারচর মৌজার অধিনস্থ এই বাজারটির চারপাশ সংলগ্ন গ্রামগুলো হলো- উত্তর পূর্ব দিকে- তিনানী পাড়া, পূর্ব দিকে- ডাকরা পাড়া, পশ্চিম দিকে- মোদক পাড়া, পশ্চিম দক্ষিণ দিকে- ঝগড়ার চর নয়া পাড়া, দক্ষিণ দিকে- বারার চর, উত্তর দিকে- কাউনের চর কান্দাপাড়া ও পশ্চিম উত্তর দিকে- বাউশমারী।

একই সাথে এই বাজারের চারপাশের উপজেলাগুলো হলো- পশ্চিমে বাজার সংলগ্ন সীমানা থেকে ইসলামপুর উপজেলা, চার কিলোমিটার উত্তরে বকশীগঞ্জ উপজেলা, তিন কিলোমিটার দক্ষিণে শেরপুর সদর উপজেলা, এবং বাজারটির অবস্থান শ্রীবরদী উপজেলার দক্ষিণ সীমান্তে। উপজেলা শহর শ্রীবরদী, বকশীগঞ্জ, ইসলামপুর এবং জেলা শহর শেরপুর ও জামালপুর এর সাথে বর্তমানে বাজারটির পাকা সড়কের যোগাযোগ ব্যাবস্থা বিদ্যমান।

বাজারটি ইসলামপুর উপজেলা, বকশীগঞ্জ উপজেলা, শেরপুর সদর উপজেলা এবং শ্রীবরদী উপজেলার প্রত্যন্ত গ্রামাঞ্চল ও শেরপুর, জামালপুর জেলাসহ উল্লেখিত উপজেলা শহরের মানুষের জন্য অত্যন্ত জনগুরুত্বপূর্ণ। জামালপুর জেলার বকশীগঞ্জ ও দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা এবং কুড়িগ্রাম জেলার রৌমারি ও রাজিবপুর উপজেলার মানুষজনের জামালপুর বা দেশের দক্ষিণাঞ্চলে যাতায়াতের একমাত্র সহজ রাস্তাটি এই বাজারের বুক বরাবর অবস্থিত।

ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট

১৭৯৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা থেকে প্রকাশিত শ্রী হরচন্দ্র চৌধুরীর ‘সেরপুর বিবরণ‘ গ্রন্থে বারার চর মৌজা, চকবন্দি মৌজা, চরহাবর মৌজা এবং পোড়াদহ বাজারের নাম উল্লেখ থাকলেও ঝগড়ার চর নামটি উল্লেখ নেই। সেই হিসেবে ১৮ শতকের পরে বাজারটি স্থাপিত হয়েছে বলে অনুমান করা হয়।

শ্রী হরচন্দ্র চৌধুরীর লিখিত পোড়াদহ বাজার সেই সময়ের ব্যাবসায়িক মূল কেন্দ্রবিন্দু ছিল। পোড়াদহ বাজার সংলগ্ন মৃগী নদীর বিস্তৃতি থাকায় বাজারটির কলকাতার সাথে নৌ যোগাযোগ ছিল। পোড়াদহ বাজারের আশপাশ ছিল হিন্দু অধ্যশিত অঞ্চল। কালের বিবর্তনে পোড়াদহ বাজার প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেলেও ঝগড়ার চর বাজার বর্তমানে এতদ অঞ্চলের সবচেয়ে বৃহৎ বাজার।

ঝগড়ার চরের নামে- ঝগড়ার চর ভূমি অফিস (স্থাপনের কাল অজ্ঞাত), ঝগড়ার চর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যােলয় স্থাপনের কাল ১৯৩৮ সাল। ঝগড়ার চর আদর্শ উচ্চবিদ্যালয় স্থাপনের কাল ১৯৪৮ সাল। এছাড়া হাল আমলে – ঝগড়ার চর হামিদাবাদ বালিকা প্রাথমিক বিদ্যালয়, ঝগড়ার চর জনতা ব্যাংক, নানারকম সামাজিক প্রতিষ্ঠান ইত্যাদি স্থাপিত হয়েছে।

১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এখানের প্রাথমিক ও উচ্চবিদ্যালয়ে পাকিস্তানি বাহিনী ক্যাম্প করেছিল। ১১নং সেক্টরের অধিনস্ত এই অঞ্চলের এই ঝগড়ার চর পাকিস্তানি ক্যাম্প উত্তরে ভারতীয় সীমান্তের কামালপুর ক্যাম্পের সাথে লিয়াজো করে মুক্তি বাহিনীকে পরাস্ত করার চেষ্টা করত।

দীর্ঘ নয় মাস যুদ্ধ চলাকালে মুক্তি বাহিনীর বীর সৈনিকদের একটি অংশ এই ক্যাম্প থেকে কামালপুর ক্যাম্পের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করার লক্ষ্যে ফুলকার চর বুলবুলি ব্রীজটি মাইনের মাধ্যমে গুঁড়িয়ে দেয়। ১৯৭১ সালের ৬ ডিসেম্বর মুক্তি বাহিনী ও মিত্র বাহিনী সমন্বয়ে পাকিস্তানি ক্যাম্প গুঁড়িয়ে দেওয়ার লক্ষ্যে ঝগড়ার চর বাজারে বিমান হামলা চালানো হয়। সেদিনই এই অঞ্চল স্বাধীন হয়। তাই ৬ ডিসেম্বর ঝগড়ার চর মুক্ত দিবস।

এছাড়াও কামালপুর হয়ে মুক্তি বাহিনী ও মিত্রবাহিনীর দল এই বাজার হয়ে এদেশের অভ্যন্তরে এসেছিলেন। তাই এই বাজারটি যেমন ঐতিহাসিক তেমনি একটি গুরুত্বপুর্ণ জায়গা।

ঝগড়ারচরের নামকরণ

ঝগড়ার চর! নামটা শুনলে যে কারুর মনে একটা ধাক্কা লাগে। বস্তুত ঝগড়াবিবাদ নয় বরং এই অঞ্চলের মানুষ অত্যন্ত শান্তি প্রিয়। তবে এমন নামকরণ কেন? এই বাজারের নামকরণ ও স্থাপনকাল বিষয় সম্পর্কে- শেরপুর জেলার ইতিহাস ঐতিহ্য সাহিত্য ও সংস্কৃতি নিয়ে লেখা ‘ইতিহাস ঐতিহ্যে শেরপুর’ গ্রন্থের লেখক কবি, কথাসাহিত্যিক ও প্রাবন্ধিক আশরাফ আলী চারু দীর্ঘদিন কাজ করেছেন।

তিনি জানিয়েছেন যে- বর্তমান ঝগড়ার চর বাজারটি একসময় এ জায়গায় ছিল না। কেননা যদি বাজারটি এই বর্তমান জায়গায় থাকত তবে ‘সেরপুর বিবরণ’ গ্রন্থে শ্রী হরচন্দ্র চৌধুরী তা উল্লেখ করতেন।

লোকমুখে জানা গেছে বাজারটির তৎকালীন অবস্থান ছিলো বর্তমান বাজারের পশ্চিম পাশে অবস্থিত বাউশমারী গ্রাম ও কড়ইতলা গ্রামের পূর্বাংশে। যে এলাকা দুটি বর্তমানে জামালপুর জেলার ইসলামপুর উপজেলার অন্তর্গত। তৎকালীন সময়ে যোগাযোগ ব্যাবস্থা খারাপ থাকার কারণে (বর্তমান শেরপুরের শ্রীবরদী উপজেলাধীন) অত্র অঞ্চলে স্থানান্তরের প্রয়োজন হয়। কিন্তু বাজার স্থানান্তরের আলোচনা উঠলে বাউশমারী ও কড়ইতলা তথা বাজার সংলগ্ন এলাকার লোকজন ও বর্তমান বাজার সংলগ্ন এলাকার তৎকালীন লোকজনের মধ্যে বাকবিতণ্ডা ও ঝগড়াঝাঁটি হয়। এরই ধারাবাহিকতায় এখানে বাজার বসে।

যেহেতু তৎকালীন একই জেলা তথা সবাই ময়মনসিংহ জেলার মানুষ – সেই হিসেবে তারা বিষয়টি মিমাংসা করে বাজারটি বর্তমান যেখানে আছে সেখানেই পরিচালনা করতে আরম্ভ করেন।

ঝগড়ারচরে সরিষার আবাদ

জানা যায় ঝগড়ার চর বাজারের পূর্ব নাম ছিল গোবিন্দগঞ্জ বাজার। ১৮৫০ সালের একটু আগে বা পরে স্থানান্তরের মাধ্যমে গোবিন্দগঞ্জ বাজারের নামকরণ হয় ঝগড়ার চর বাজার। বাজার স্থানান্তরের পরও গোবিন্দগঞ্জ নামটি প্রচলিত ছিল।

অনুমান করা হয় সরকারি দলিল দস্তাবেজে আস্তে আস্তে ঝগড়ার চর নামটি প্রচলিত হওয়ার মাধ্যমে গোবিন্দগঞ্জ নামটি কালের পরিক্রমায় হারিয়ে গেছে। আগেই বলা হয়েছে এই অঞ্চলের জন মানুষের- ইসলামপুর, বকশীগঞ্জ, শ্রীবরদী, শেরপুর ও জামালপুর যাতায়াতের কেন্দ্রবিন্দু হলো এই ঝগড়ার চর বাজার। তাই বাজারের পশ্চিম দিকের একটি রোডের নাম ইসলামপুর রোড। এর উত্তর দিকের রোডের নাম বকশীগঞ্জ রোড। উত্তর পূর্ব দিকের রোডের নাম শ্রীবরদী রোড। পূর্ব দিকের রোডের নাম শেরপুর রোড। এবং দক্ষিণ দিকের রোডের নাম জামালপুর রোড।

গুরুত্বপূর্ণ এই বাজারটিকে একটি ফাঁড়ি থানা করার জন্য একটি প্রস্তাব জাতীয় সংসদে উপস্থাপিত হলেও এখনো তা বাস্তবায়ন হয়নি। বাজারটি শেরপুর ও জামালপুর জেলার মধ্যে সবচেয়ে বড় বাজার।
এই বাজারের মিষ্টি বরই নিয়ে বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত একটি গানে স্মৃতিচারণ করা হয়েছে। একই সাথে এই বাজারের মহিষের টক দই ও শীতকালে (পিঠালি) গাবা তরকারি সারাদেশ ব্যাপি ব্যাপক প্রসিদ্ধি সুনাম এনেছে।

আশরাফ আলী চারু
লেখক: আশরাফ আলী চারু

Leave a Reply

Scroll to Top