Our Sherpur

গোপন নায়ক উপন্যাস পর্ব (৮) সাগর আহমেদ

লেখকঃ সাগর আহমেদ


বাসের পেছন থেকে স্পষ্টই বুঝতে পরছিলাম, ছেলেগুলো একে অপরের সাথে কিছু একটা ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করছে। বার বার তাঁর দিকে তাকাচ্ছে আর হাসছে। যেহেতু এরই মধ্যে বাস ছেড়ে দিয়েছে, মনে হয় এইবার তাদের বিরক্ত করার সুযোগ হয়েছে।

আমি আর দেরী করলাম না। পেছন থেকে উঠে দাড়ালাম। দেখতে পেলাম, তাঁর পেছনে একজন বয়স্ক লোক বসেছে। সুতরাং এক সিট খালি। ধীরে উঠে দ্রুততার সাথে এগিয়ে গিয়ে ঐখানে বয়স্ক লোকটার সাথে বসলাম। আগের সিটে “সে” বসেছে, আর পরের সিটেই আমি! আর আমাদের বিপরীত পাশের সিটে ছেলেগুলো। তাদের মুখগুলো দেখেই বুঝতে পারলাম, আমাকে দেখে তারা বেশ বিরক্ত হয়েছে। কিন্তু তারপরেও তাদের মাঝে আগ্রহ আর স্বভাবের কোন পরিবর্তন দেখতে পেলাম না।
এমন সময় হঠাৎ তাদের মধ্য থেকে এক ছেলে প্রশ্ন করে বসলো, “এই যে আপু, কেমন আছেন?” দেখলাম, “সে” একটু ইতস্তত হয়ে সামান্য মাথা ঘুরালো। আবার দ্রুতই সোজা হলো। কিন্তু কোন প্রকার উত্তর দিলো না।

“ও আপু, আপনার নাম কি?”
আরেক জন আবার আরেকটা প্রশ্ন করলো। এবারও “সে” পূর্বের মত কোন সাড়া দিলো না। উত্তর না পেয়ে ক্রমেই ছেলেগুলো কৌতুহলী আর ক্ষীপ্ত হতে লাগলো।
“কি আপু, কথা বললে সমস্যা হয় নাকি আপনার? একটু পরিচিত হতে পারি না নাকি!”
তৃতীয় জনের এমন প্রশ্নেও কোন জবাব এলো না। আরেক ছেলে তো একটু বাড়িয়েই বললো, “আপু মনে হয় বোবা! কথা বলতে পারে না। সমস্যা নেই আপু। আপনার মোবাইল নাম্বারটা দেন, মেসেজেই কথা বলি।” এটুকুই বলেই সবাই এক সাথে হাসাহাসিতে মেতে উঠলো।

তোমরা তো বুঝতেই পারছো। ঘটনাটা কিন্তু আমার সামনেই ঘটতেছে। আর আমি শুধু চেয়েই দেখতেছি! শুধু আমি বললে ভুল হবে। আরো আমার মত নিষ্ক্রিয় দর্শকও আছেন! বাসে প্রায় আরো দশ বারো জনের মত যাত্রী। একজন যুবক বয়সী বাস হেলপারও আছে। কিন্তু কারো মুখেই প্রতিবাদের কোন ভাষা শুনতে পেলাম না। এমনকি কোন বিরক্তিকর মুখের অভিব্যক্তিও না! বিষয়টা আশ্চার্য জনক বটে। এমনটা হওয়ারই কথা। কারণ, সবাই জেগে জেগে ঘুমাইতেছে! বিবেক আর সৎ সাহসের ব্যবহার নিয়মিত না করার কারণে মারাত্মক মরিচা ধরেছে। তাই এটা আর কাজ করে না!
তবে এবার আমার অবস্থাটা বলি। আমি কিন্তু মোটেও স্বাভাবিক অবস্থাতে নেই। আমার মনে হয় না, আমি এর আগে এতটুকু ধৈর্য ধারণ করেছি!

তবুও আমাকে ধৈর্য ধারণ করতে হবে। আমি এর শেষ পর্যন্ত দেখতে চাই। আর পরিস্থিতি যদি নাগালের বাইরে চলে যায়, অবশ্যই তখন কোন ব্যবস্থা তো নেবই। অযথা ছোট কাজের জন্য বড় ঝামেলা ডেকে আনতে চাইছিনা। আমরা এটা জানি যে, খারাপকে ভালো করা যায়। কিন্তু যারা ছোট বেলা থেকেই খারাপ কাজ আর খারাপ দিকগুলোকে মনের সাথে, চিন্তার সাথে, কাজে কর্মে বাস্তবায়ন করে এসেছে, তাদের রক্তের ফুটায় ফুটায় তা মিশে যায়। তখন তাদেরকে মেরে ফেলা ছাড়া আর ভালো পথে আনা যায় না। সম্ভবও হয় না।

এইবার তো সব ছেলেরা মিলে আজে বাজে সব গান শুরু করে দিলো। কি যে বেসুরের সে গান! গলাগুলো একটু ভালো হলেও না এক কথা ছিলো!
আমি তাঁর দিকে তাকালাম। দেখলাম, পাথরের মত সোজা হয়ে বসে আছে। এরই মধ্যে ছেলেরা গান থামালো। আবার শুরু হলো তাদের মধ্যকার আলোচনা। একজন বললো, “এই চল, আপুর পিছু পিছু যাই। কোথায় থাকে তা খুঁজে বের করবো!” তার কথা শেষ না হতেই আরেকজন বললো, “আরে থাম, আপুর যদি আবার বয় ফ্রেন্ড থাকে তাহলে আমাদের খবর আছে!” তার কথাতে অন্যরা একমত হয়ে বললো, “হা তাইতো।” আর তখনি শুরু হলো চরম হাসাহাসি।

আহ, কথাটা আমার অন্তরের মধ্যে এসে লাগলো। আমি তো বরং এখানেই। কিন্তু কিছুই করতেছি না। তবে মনটা বলতেছে, এখনি জুতা দিয়ে পিটিয়ে বাস থেকে বের করে দেই। যাই হোক। মনকে অনেক বলে কয়ে কষ্ট করে বুঝালাম! জানি, একজন প্রতিবাদ করলেই বাকিরাও মুখ খুলবে। কিন্তু এই একজন আর কেউ হয় না। তাই এরা কখনো শাস্তিও পায় না। সে জন্যেই, আজ এদের উপস্থিতি দেশের সব খানেই!

ততক্ষণে বাস এসে স্ট্যাশনে থামলো। দেখলাম, সে তড়িঘড়ি করে বাস থেকে নেমেই রিক্সায় উঠলো। আমাকে আর দেখতে পেলো না। বাসের দিকে, ঐ বখাটে ছেলেগুলোর দিকে একবারের জন্যও তাকালো না। কিন্তু আমি ছেলেগুলোর দিকে আবারো তাকালাম। কি স্মার্ট, পরণে দামি পোশাক। তবে মনের দিক থেকে কতটা নিচু! এতক্ষণে রিক্সা অনেকটা চলে গেছে। তাঁর দিকে চেয়ে মনে মনে বললাম, কিছু মনে করো না। আমি তো সত্যি সত্যিই তোমার সাথে ছিলাম। কিন্তু তোমার হয়ে একটা কথাও বলিনি!

দুঃখের কাহিনী না বললে কেউ বুঝতে পারে না। আমিও আসলে গোপন কথাগুলো কাউকে বলতে চাই না। অনেক কথা আছে, যা আমার মত অনেকের সাথেই অহরহ ঘটেছে। ঘটে চলতেছে। এমন এমন কষ্টের কথা যেন কাউকে বলাও যায় না। বললে নিজে ছোট হওয়া ছাড়া আর কিছু না। তবুও সামান্য কিছু তার বলতে চাই।

রাত আটটার মত বাজতেছে। এক কোচিংয়ে ফ্রিতে তিন-চারটা ক্লাস নিয়ে শহরের অলিগলির পথ ধরে মেসে ফিরতেছি। এসময় অলিগলির রাস্তাগুলো অনেকটা মানুষ শুণ্যই থাকে। একা থাকলে আর একা পথ চললে কত ভাবনা যে মনে আসে সে আর কি বলবো। প্রত্যেকটা ভাবনায় দুঃখ সৃষ্টির হাতিয়ার!
বেশ কিছুদিন ধরে বিভিন্ন কিন্ডার গার্ডেন স্কুল এবং কোচিংয়ে কমপক্ষে দশ কি বারোটার মত CV জমা দিয়েছি! এই পর্যন্ত স্থায়ী চাকরি কোনটাতেই হলো না। সবাই শুধু কল করে বলে, আগে ফ্রিতে ক্লাস নিন, যদি আপনার ক্লাস ছাত্র-ছাত্রীদের ভালো লাগে, তাহলে অবশ্যই আপনাকে আমরা নিবো। কত চেষ্টা করে ছাত্র-ছাত্রীদের মন জয় করে ক্লাস নিলাম, কিন্তু কোথা থেকেও আর ডাক আসে না। পরবর্তিতে গোপন সুত্রের ভিত্তিতে জানতে পারলাম, এগুলো আসলে অনেক ক্ষেত্রেই ধোকাবাজি। যখন কোন স্কুল বা কোচিংয়ের কোন শিক্ষক অসুস্থতা বা অন্য কোন কারণে ছুটি নেয়, তখন ঐ শিক্ষকের অভাব পূরণ করার জন্য আমাদের মত অপেক্ষমাণ শিক্ষকদের দিয়ে ফ্রিতে ক্লাস করিয়ে নেয়! আর মিথ্যে আশ্বাস দেয় যে, নতুন শিক্ষক নেয়া হবে। সত্যটা জেনেও কিছু করার নেই। কারণ, লেখাপড়ার পাশাপাশি এরকম চাকরি যে আমাদের মত পরিবারের ছেলেদের খুবই দরকার! এভাবে আশ্বাস দিতে দিতে যদিই একটা চাকরি পেয়ে যাই! এই আশাতে জেনে শুনেও ফ্রিতে ক্লাস নিতে মোটেও আর কষ্ট হয় না!
কত দুঃখের জীবন কাহিনী পড়লাম। অবশেষে সবাই একদিন সফলতা পায়। কিন্তু আমার সফলতা কোথায়! আর কতদুর যেতে হবে সুখের সাক্ষাত পেতে। হতভাগাদের দলে থেকেও হতাশ হতে চাই না। স্রষ্টা নিশ্চয় একদিন আমার দিকেও ফিরে তাকাবেন!
নিজের জন্য, নিজের মা-বাবার জন্য, অন্তত কিছু একটা করতে চাই। যদি, প্রত্যেক মাসে মা কে পাঁচশত আর বাবাকে কিছু টাকা দিতে পারতাম! তখন তাঁদের মুখের অভিব্যক্তিটা কেমন হতো, সেটা দেখার জন্য আজ কত মাস ধরে চেষ্টা করে যাচ্ছি। তাঁদের সে স্বর্গের হাসিটা কি আমি দেখতে পারবো! তার সদুত্তর আকাশের স্রষ্টায় দিতে পারবেন!

প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পঞ্চম পর্ব
ষষ্ঠ পর্ব
সপ্তম পর্ব

Leave a Reply

Scroll to Top