১৯৪৭ সালে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারত ভাগ হয়ে অদ্ভুত এক রাষ্ট্রের জন্ম নেয়। ১২০০ মাইল দূরে তার একটি অংশ ছিল, নাম ছিল পূর্ব পাকিস্তান এবং অপর অংশের নাম ছিল পশ্চিম পাকিস্তান। এ দুই অংশের মধ্যে সাংস্কৃতিক, ভৌগোলিক ও ভাষাগত দিক থেকে মৌলিক পার্থক্য ছিল। বাংলা ভাষাভাষী জনসংখ্যা ছিল সংখ্যাগরিষ্ট। কিন্তু বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার ব্যাপারে রাষ্ট্রের জন্মের ঊষালগ্ন থেকে পাকিস্তানি সরকার ষড়যন্ত্র করে আসছিল এবং মৌলিক অধিকারের ব্যাপারে বৈষম্য সৃষ্টি করে করেছিল। এমতাবস্থায় পাকিস্তান সরকার ১৯৪৮ সালে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্টভাষা ঘোষণা করে। ফলে পূর্ব বাংলার মানুষের মনে গভীর ক্ষোভের জন্ম নেয়। ফলে ভাষার দাবিতে দ্রোতই আন্দোলনের সূচনা হয়। এ আন্দোলন দমনের জন্য পাক সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে সভা সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে।
১৯৪৮ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি তারিখে পাকিস্তানের গণপরিষদে ইংরেজি ও উর্দুর পাশাপাশি সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহারের একটি প্রস্তাব তদানিন্তন গণ পরিষদের সদস্য ধীরন্দ্র নাথ দত্ত উত্থাপন করলে অনেকে এ প্রস্তাবকে স্বাগত জানায়। তবে খাজা নাজিমুদ্দিন এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেন। পাকিস্তানের প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খান এ প্রস্তাবকে “বিভেদ সৃষ্টির অপচেষ্টা” বলে উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন “পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা কেবল মাত্র উর্দু হতে পারে।” প্রধানমন্ত্রীর এ হটকারি বক্তব্য শুনে বাঙালীদের মাঝে ক্ষোভ বাড়তে থাকে এবং ঢাকা শহরের অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা ২৬ ফেব্রুয়ারি ক্লাস বর্জন করে শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে।
শহরে বিক্ষোভ প্রদর্শন করে। ভাষার দাবীতে ২৯ ফেব্রুয়ারি পূর্ববাংলায় ধর্মঘট ও প্রতিবাদ দিবস পালিত হয়। এমনই এক টানটান উত্তেজনার মধ্যে ১৯৪৮ সালের ১৯ মার্চ পাকিস্তানের স্থপতি মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ ঢাকায় আসেন। তিনি ২১ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে ঘোষণা করেন “উর্দুই হবে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা” এবং ২৪ মার্চ কার্জন হলে গিয়ে জিন্নাহ সাহেব সে কথার পুনরাবৃত্তি করলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল ছাত্র এর প্রতিবাদ করেন। সে সময় “রাষ্ট্রভাষা বাস্তবায়ন কমিটি” নামে একটি কমিটি করা হয় যার অন্যতম প্রধান ছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান।
খাজা নাজিমুদ্দিন পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হয়ে ৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি ঢাকায় এক ভাষণে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে পুনরায় উল্লেখ করেন। ফলে পূর্ব বাংলার মানুষ ক্ষোভে ফেটে পরে। এর প্রতিবাদে ২৯ জানুয়ারি প্রতিবাদ সভসভা এবং ৩০ জানুয়ারি ছাত্র ধর্মঘট পালিত হয়। পরবর্তীতে ২১ ফেব্রুয়ারি দেশব্যাপী সাধারণ ধর্মঘটের সিদ্ধান্ত হলে পাকিস্তান সরকার ২১শে ফেব্রুয়ারি থেকে পরবর্তী একমাস সভাসমাবেশ নিষিদ্ধ করে ১৪৪ ধারা জারি করে।
এঘোষণায় সমগ্র বাঙালী জাতি ক্ষোভে ফেটে পরে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভংগের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করে। ২১শে ফেব্রুয়ারি সকাল ৯টায় বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র/ ছাত্রী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে জড় হয়ে ১৪৪ ধারার বিপক্ষে শ্লোগান দিতে থাকে। বেলা একটার দিকে ছাত্ররা পুলিশের প্রতিবন্ধকতা ভেঙে রাস্তায় নামার চেষ্টা করলে পুলিশ কাঁদনে গ্যাস নিক্ষেপ করে এবং কয়েকজন ছাত্রদের গ্রেফতার করে। ফলে ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে নামলে পুলিশ গুলি বর্ষণ শুরু করলে আব্দুল জব্বার ও রফিকউদ্দিন ঘটনা স্থলেই নিহত হয়।আব্দুস সালাম ও আবুল বরকত সহ আরও অনেকে নিহত হয়। সেদিন অহিউল্লাহ নামের নয় বছরের একজন শিশুও নিহত হয়। এসময় ছাত্র হত্যার খবর ছড়িয়ে পরলে পূর্ব বাংলার মানুষ ক্ষোভে ফেটে পরে এবং সারা দেশে সর্বাত্মক হরতাল পালিত হয়। তখন গত্যন্তর না দেখে সরকার উর্দুর সাথে বাংলাকেও রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। এভাবেই বাংলার মানুষ রাজপথে রক্ত দিয়ে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করে।
শেরপুরে ভাষা আন্দলোনঃ ভাষা আন্দোলনের প্রথম দিকে যোগাযোগের অভাবে শেরপুরে তেমন কোন প্রভাব পড়ে নাই। শুধু দুই একদিন ছাত্ররা ক্লাস বর্জন করে। কিন্তু ১৯৫২ সালে ঢাকায় ছাত্র হত্যার প্রতিবাদে মিটিং মিছিল চলছিল। তদানিন্তন তরুণ ছাত্রনেতা হাবিবুর রহমান, নিজামউদ্দিন আহমেদ, আবুল কাশেম, আব্দুর রশিদ, সৈয়দ আব্দুস সোবহান, মোহসীন আলী প্রমূখ ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছেন। এদের পরামর্শ দিতেন আনিসুর রহমান, খন্দকার মজিবর রহমান, নূর মোহাম্মদ উকিল প্রমূখ ব্যক্তিবর্গ। এসময় শেরপুরের স্কুলের ছাত্ররা মিছিল মিটিং এ অংশ নেয়। উল্লেখ্য, সদ্য প্রয়াত ভাষা সৈনিক শেরপুরের কৃতি সন্তান সৈয়দ আব্দুল হান্নান সে সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসেবে সরাসরি ভাষা আন্দোলনে অংশ গ্রহণ করেন।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারির ছাত্র হত্যার খবর শহরের একমাত্র রায় চরণ বাবুর রেডিও থেকে সন্ধ্যায় খবর পাওয়া যায়।পরদিন লোকমুখে খবর পেয়ে শহরে মিছিল হয়। ২৩ ফেব্রুয়ারি নূর মোহাম্মদ উকিলকে আহ্বায়ক করে “সর্বদলীয় ভাষা আন্দোলন” কমিটি গঠন করা হয়। ২৪ ফেব্রুয়ারি নয়ানীবাড়ি মাঠে হাজার হাজার লোকের উপস্থিতিতে প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। ২৭ ফেব্রুয়ারি নয়ানীবাড়ি নট মন্দিরের সম্মুখে মুসলিম লীগের এক সভায় ভাষা আন্দোলনের পক্ষের ছাত্ররা মুসলিম লীগের নেতাদের পদত্যাগ দাবী উত্থাপন করলে কয়েকজন নেতা পদত্যাগের ঘোষণা দিলেও পরবর্তীতে তারা তাদের কথা রক্ষা করে নাই। এসময় ভাষার দাবীতে সংগ্রামরত সৈয়দ আব্দুস সোবহানকে গ্রেফতার করা হয়। তাছাড়াও খন্দকার মজিবর রহমান, নিজামউদ্দিন আহমেদ, আহসানউল্লাহ প্রমূখকে গোয়েন্দা বাহিনীর লোকজন জিজ্ঞাসাবাদ করে।
১৯৫২ সালের ভাষা শহীদের স্মরণে প্রগতিশীল ছাত্রবৃন্দ চক বাজারে শহীদ মিনারের ভিত্তি স্থাপন করে। ১৯৫৩ সালেট ২৮ নভেম্বর পৌর কার্যালয়ে শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য বৈঠকে সকল প্রতিষ্ঠানের ছাত্র নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। বৈঠকে ১৩ সদস্যের “শহীদ মিনার নির্মাণ” কমিটি গঠন করা হয়। নিজামউদ্দিন আহমেদ ও মনসুর আলী ইট দিয়ে নির্মাণ কাজে সাহায্য করেন। চক বাজারের দেবোত্তর সম্পত্তির উপর শহীদ মিনার নির্মাণের জন্য বাবু রবি নিয়োগীর নেতৃত্বে জায়গা বরাদ্দের জন্য আড়াই আনী জমিদারের নিকট হতে মৌখিক অনুমতি নিয়ে নির্মাণ কাজ শুরু করেন। রাজমিস্ত্রী বিশ্বনাথ চৌহান রাতের বেলায় আলো জ্বালিয়ে একটি পিলার নির্মাণ করে। ১৯৫৪ সালের জানুয়ারিতে নির্মাণ কাজ শেষ হয়। ১৯৭১ সালে পাক হানাদার বাহিনীর গোলার আঘাতে ধ্বংস হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত শররের সকল রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড সেখানেই পরিচালিত হতো।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে শেরপুর বাসীর অংশগ্রহণ ছিল অতুলনীয়। ঐ সময় পাক সরকারের রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সকলস্তরের জনসাধারণের ভাষা আন্দোলনে অংশগ্রহণ ছিল দেশ প্রেমের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। ভাষা আন্দোলনের প্রভাবে শেরপুরে সামপ্রদায়িক সম্প্রতি আরও বেড়ে যায়।
ভাষা আন্দোলনের হাত ধরেই ঘটেছে হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ ঘটনা মুক্তি যুদ্ধ, আর আমরা পেয়েছি কাঙ্ক্ষিত স্বাধীনতা।কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় আন্দোলনের অনেক বছর পরেও আমরা সর্বস্তরে মাতৃভাষাকে প্রতিষ্ঠিত করতে পার নাই। শুদ্ধভাবে বাংলাভাষা লিখতে, পড়তে ও বলতে পারছি না। আসুন আমরা বাংলাকে সর্বস্তরে প্রতিষ্ঠিত করার শপথ নেই। পৃথিবীতে সম্ভবত আমরাই একমাত্র জাতি যারা মাতৃভাষা প্রতিষ্ঠার জন্য রক্ত দিয়েছি। জাতিসংঘের অঙ্গ সংগঠন ‘ইউনেস্কো ‘ ১৯৯৯ সালে ২১শে ফেব্রুয়ারিকে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে যা আমাদের পরম পাওয়া। কৃতজ্ঞত জাতি হিসেবে ১৯৫২ সালের ভাষা শহীদ ও মুক্তিযুদ্ধের সকল শহীদ এবং সময় সময় গণতান্ত্রিক আন্দোলনে যাঁরা শহীদ হয়েছেন তাদের সকলকে শ্রদ্ধা নিবেদন করে দেশ গড়ার শপথ নিয়ে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ি।
লেখকঃ ক্যাপ্টেন মোঃ রফিকুল ইসলাম (অবঃ) সেনা শিক্ষা কোর।
তথ্য সূত্র- ইন্টারনেট