অঃ ক্যাপ্টন (অবঃ) মোঃ রফিকুল ইসলাম, সেনা শিক্ষা কোর।
১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে পূর্ব বাংলার জনগণ ভাষার অধিকার ফিরে পেলেও তখনও গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরে পাই নাই। ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট জয়লাভ করেও মাত্র দুই বছর ক্ষমতায় ছিল। তারপর নানা বাহানায় ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ুব খান সমারিক শাসন জারি করলে বাঙালীদের মনে ক্ষোভ আরও বেড়ে যায়। ১৯৬২ সালে শিক্ষা আন্দোলনের পর বঙ্গবন্ধু ১৯৬৬ সালে ০৬ দফা দাবী পেশ করেন। ০৬ দফা ছিল পূর্ব বাংলার জনগণের মুক্তির সনদ। জেনারেল আইয়ুব খান ১৯৬৮ সালে বঙ্গবন্ধুকে ১ নং আসামি করে মোট ৩৫ জনের বিরুদ্ধে আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা দায়ের করে এবং বঙ্গবন্ধু সহ মোট ২৮ জনকে গ্রেফতার করে। বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা সেনানিবাসে বন্দি করে সমরিক আইনে ফাঁসির আদেশ দেয়া হয়। তখন পূর্ব বাংলার ছাত্র জনতা আইয়ুব শাহীর বিরুদ্ধে ফুঁসে উঠে। বঙ্গবন্ধু সহ সকল রাজবন্দিদের মুক্তি ও আইয়ুব খানের পদত্যাগের দাবীতে সারা বাংলার মানুষ একযোগে মাঠে নামে। ০৬ দফার সাথে ছাত্রদের ১১ দফার দাবী নিয়ে সকল ছাত্র সংগঠন এক হয়ে মিছিল, হরতাল ও সমাবেশ শুরু করলে সর্বস্তরের জনগণ এতে সমর্থন দেয়। সকলের শ্লোগান ছিল,” তোমার আমার ঠিকানা, পদ্মা মেঘনা যমুনা, পিন্ডি না ঢাকা, জেলের তালা ভাঙবো শেখ মুজিবকে আনবো ইত্যাদি। এমাতাবস্থায় আইয়ুব সরকার নির্মমভাবে আন্দোলন দমনের চেষ্টা করলে পুলিশের গুলিতে নাখাল পাড়ায় বাচ্চাকে দুধ খাওয়ানে অবস্থায় আনোয়ারা বেগম, সেনানিবাসে বন্দী অবস্থায় সার্জেন্ট জহুরুল হক, রাজশাহী বিশ্ব বিদ্যালয়ের ডঃ শামসুজোহা, নবকুমার উচ্চ বিদ্যালয়ের নবম শ্রেণির ছাত্র মতিউর রহমান ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আসাদ গুলিবিদ্ধ হয়ে নিহত হলে আন্দোলন চারদিকে ছড়িয়ে পরে এবং গণ অভ্যুত্থান শুরু হয়। আইয়ুবশাহী তখন বঙ্গবন্ধুকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয় এবং ২৫ মার্চ পাকিস্তানের লৌহ মানব আইয়ুব খান পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়। তখন জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারি করে ৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন ঘোষণা করে।
আমি তখন হাই স্কুলের নিচের শ্রেণীর ছাত্র। এমতাবস্থায় সকল কাজ ফেলে প্রতিদিন সকলের সাথে মিছিলে যোগদান করি। তখন শেরপুরে প্রতিদিন বিশাল মিছিল হতো। একদিনতো শেরপুর মিছিলের শহরে পরিণত হলো। আমি ছোট মানুষ, সবার আগে। তখন একজন বলিষ্ট লোক আমাকে কাধে নিয়ে মিছিলের অগ্রভাগে। আমি সেই অবস্থায় শ্লোগান দিতে থাকি। প্রায় সকলেই মিছিলে আসার সময় লাঠি, বল্লাম, রামদা নিয়ে আসতো। কেউ কেউ লাঙল, জেয়াল মই নিয়ে আসতো। সেদিন পৌরপার্ক লোকে লোকারণ্য হয়ে গিয়েছিল। সেদিন শেরপুরের সর্বদলীয় কমিরটির নেতৃবৃন্দ ভাষণ দেয়।
এর আগে ০৬ দফার ভিত্তিতে পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন কায়েমের জন্য এবং আইয়ুব শাহী পতনের জন্য সকল মেম্বার চেয়ারম্যানদের পদত্যাগ করানোর জন্য কেন্দ্র থেকে নির্দেশ আসলে আমরা ০৫ মার্চ বলাইর চর ইউনিয়ন পরিষদের তদানিন্তন চেয়ারম্যান জ্বনাব জসিমউদ্দিন পেরির বাড়িতে গেলে তিনি ০৮ মার্চ শনিবার যেতে বলেন। আমরা ০৮ মার্চ সকালবেলা তার বাড়িতে জড় হলে হঠাৎ শুনতে পাই চেয়ারম্যান সাহেব পিছনের রাস্তা দিয়ে পালিয়েছেন। তখন শত শত মানুষ তার বৈঠকখানায় হামলা করলে চেয়ারম্যান সাহেবের কলেজ পড়ুয়া ছেলে দুতলা থেকে গুলি বর্ষণ করলে ০৫ জন গুরুতর আহত হয়। তাদের মধ্যে জঙ্গলদীর আহত দারোগ আলী ভাই শেরপর নেয়ার পথে মারা যান। এখবর মুহূর্তের মধ্যে চারদিকে ছড়িয়ে পরলে শেরপুর ও জামালপুর থেকে হাজার হাজার ছাত্র জনতা পেরি বাড়ি আক্রমণ করে এবং সন্ধ্যার দিকে পেরিদের সকল ঘর জ্বালিয়ে দেয়। বৃহত্তর ময়মনসিংহে ছাত্র নেতা মিন্টুর পরেই দারোগ আলী ভাই শহীদ হন। কৃতজ্ঞ জাতি স্বাধীনতার পর শেরপুর পৌরপার্ক ও জঙ্লদীতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় শহীদ দারোগ আলীর নামে নাম করন করে।
জেনারেল ইয়াহিয়া খান সামরিক শাসন জারি করার পর ৭০ সালের ডিসেম্বরে সাধারণ নির্বাচন দেয়। সে নির্বাচনে আওয়ামীলীগ নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্টতা লাভ করলেও বর্বর ইয়াহিয়া ক্ষমতা হস্তান্তর না করলে বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। দীর্ঘ ০৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ শেষে ৩০ লক্ষ লোকের রক্তের বিনিময়ে, ০৩ লক্ষ মা বোনের ইজ্জতের বিনিময়ে আমরা সে বছর ১৬ই ডিসেম্বর বিজয় অর্জন করি। এক কথায় বলা যায় ১৯৬৯ এর গণ অভ্যুত্থানের হাত ধরেই আমরা মহান স্বাধীনতা পেয়েছি। পেয়েছি আমাদের হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ সম্পদ লাল সবুজের পতাকা। এখন দেশ গড়ার সময়, আসুন সকলে মিলে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তুলি। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু