লেখকঃ সাগর আহমেদ
সকাল দিকে টিউশনি শেষে মেসে ফিরছিলাম। আজকে টিউশনিটা সকালে ছিল। মনটা খুব খারাপ। কি আর বলবো। শুধু দুঃখের ইতিহাস। আমার মেসে থাকার মাসিক মোট খরচ সাড়ে তিন থেকে চার হাজার টাকা। অনেকের কাছে এটা সামান্য মনে হতে পারে। তবে আমাদের মত পরিবার বলে কথা! দুইটা টিউশনি থেকে বাইশ শত টাকা মাসে পেতাম। যদিও অনেক কম দিতো। তবুও অভাগাদের কাছে এটাই বিরাট কিছু!
বাড়ি থেকে টাকা আনাটা কি রকম কষ্টের, আশা করি ইতোমধ্যে বুঝতে পারছো। যদিও আমি যখন যা চেয়েছি যেভাবেই হোক পরিবার তা দেবার সব রকম চেষ্টা করেছে। বিশ্বাস করো, আমি পরিবার থেকে বাড়তি টাকা কখনো নেইনি! খুব প্রয়োজন ছাড়া।
মা-বাবা দুজনেই বয়স্ক আর এক ভাইয়ের উপর তার পরিবার ও ছেলে মেয়ে সহ আমরা সবাই নির্ভরশীল। হিসেব খুব সোজা। একজন আয় করে আর আমরা বাকিরা বসে বসে খাই!
শহরে এসে মাস দুয়েকের মধ্যে দুইটা টিউশনি পেয়ে অনেকটা পরিবারের বোঝা কমালাম। পাশাপাশি লেখাপড়াটাও চালিয়ে যাচ্ছিলাম। হঠাৎ দুই মাস যাবার পর একটা টিউশনি না করে দিল। যেখান থেকে বারো শ পেতাম। এমনিতেই অনেক কষ্ট করে দুইটা টিউশনি জোগাড় করেছিলাম, ভাবলাম, সামনে যদি আরেকটা ভালো টাকার মধ্যে পেয়ে যাই, অন্তত মাসে মাসে পরিবারকে চাপ দেয়া থেকে রেহাই দিতে পারবো। কি স্বপ্নই না মনে মনে দেখেছিলাম।
কিন্তু কপাল খারাপ থাকলে যা হয়! দুঃখ যদি কারো এমন আপন বন্ধু হয় তার তো সারাক্ষণ বন্ধুর সাথেই থাকতে হয়! তাই না? কোথা থেকে আরেকটা পাবো। উল্টো আরো ভাগের চলে গেল। মনকে আর বুঝাতে পারলাম না। তবে মাসের টাকা দিয়েই বিদায় করেছে।
হেটে হেটে মেসে ফিরছি। পাঁচ টাকা বাঁচানোর জন্য বহুদুর হাটার অভ্যাসটা এতদিনে ভাল মতই রপ্ত করা হয়ে গেছে। তাই গন্তব্য দুই-তিন কিলোমিটার হলে গাড়ির দিকে তাকানোর তো প্রশ্নই আসে না।
এমন পরিস্থিতিতে মনে হচ্ছে, একমণ বোজা যেন আমার ঘাড়ে চাপিয়ে দেয়া হয়েছে। আর আমি তা কাঁধে নিয়ে হেটে যাচ্ছি। এই সকাল বেলা কর্মক্ষম দেহটা অসাড় হয়ে গেলো!
রাস্তার ডান পাশ দিয়ে হাটছি। রাস্তার ওপাশে একজন বয়স্ক লোক, যিনি ভ্যান গাড়িতে করে বাসায় বাসায় নানা ধরনের তরি তরকারি বিক্রি করেন। লোকটাকে দেখেই মায়া পড়ে গেলো। তবে সবার যে মায়া লাগবে তা কিন্তু বলছি না! বলতে পারো যে, আমার মত এরকম লোকদের। শুকনো কাঠের দেহ। পুরণো লুঙ্গী আর ময়লাযুক্ত সাদা পাঞ্জাবী পরণে। কিছু ভদ্র লোক নিশ্চিত নাক ছিটকাবে এরকম আর কি। ওহ, কোথাও এরকম লোক দেখলেই আমার বুকের ভেতরটা এমন হু হু করে উঠে কেন? একটা অদৃশ্য টান অনুভব করি। যদি এদের সবার দুঃখগুলি নিজের মত করে ঘুচিয়ে দিতে পারতাম! কপালটা এতই প্রশস্ত যে, আমিও এদের দলেরই একজন প্রতিনিধি।
শহরের রাস্তার পাশের মহিলারা এদের প্রধান ক্রেতা। এই সকল মহিলারা আবার ব্যাপক হিসাবি। এক টাকাও তারা ছাড় দিতে রাজি নয়। যেমন ধরো, আমি যেই টিউশনি থেকে মাসে এক হাজার টাকা পাই, উনার স্বামী মাসে এক লক্ষ টাকা বেতন পান। আর উনি সরকারি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষিকা। মাস শেষে আমাকে মাত্র এক হাজার টাকা দিতে তাদের যে মতিগতি, মাঝে মাঝে মনে হত, ফ্রিতেই পড়াই! তবে সবাই কিন্তু এদের মত না। তবে যারা এদের মত না তাদের দেখা কবে যে পাবো! সে দিনের অপেক্ষায় আছি। মিতব্যয়ী হওয়া অবশ্যই ভালো। তবে অত্যধিক মিতব্যয়ীরা কৃপণ আর মনুষ্যত্বহীন!
আমি হেটে যেতে যেতে তাদের দর কষাকষির দৃশ্যটা ভালোই দেখতে পেলাম। মহিলাটা বলছে, “যদি দুই টাকা কেজিতে কম রাখেন তাহলে দুই কেজি নিবো। “যেহেতু হাতে আলু। বুঝতে পারলাম যে, আলুর দরদাম করছে। লোকটা বলল, “তাইলে তো আমার লোকসান হয়ে যাবে!”
“বাজারে তো বিশ টাকা। আপনে কেজিতে দুই টাকা বেশি নিচ্ছেন কেন?” মহিলার পাল্টা প্রশ্ন। লোকটা মলিন মুখে শুকনো একটা হাসি দিয়ে বলল, “দেখুন, এত কষ্ট করে বাড়ি বাড়ি ভ্যানগাড়ি নিয়ে ঘুরি, এজন্যই আপনাদের কাছে দুই টাকা বেশি চাই।
সম্ভ্রান্ত ভদ্র মহিলা তখন মুখটা বাঁকা করে বললো, “ধরেন, আপনার জিনিস, আমার আর লাগবে না!” বলেই দুহাতে ধরে রাখা আলু গুলো অনেকটা ছুড়ে মারার মত খাঁচায় রেখে দরজাটা আটকিয়ে দিলো। বেঁচারা বয়স্ক লোকটা মনে হয় এসবে অভ্যস্ত। তাই তার মুখে তেমন কোন অভিব্যক্তির প্রকাশ দেখলাম না।
ভাবতে লাগলাম। আহারে! দুই টাকার জন্য মানুষের কত কষ্ট। কারো দুই টাকা ব্যয় করতে কষ্ট। কারো দুই টাকা উপার্জন করতে কষ্ট।
আমার মনেও কষ্ট। এই টাকার কষ্ট। সে যাই হোক। ঘটনাটা আমাকে স্বান্ত্বনা দেবার জন্যই আমার সামনে ঘটেছে।
বেশির ভাগ বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনীতে আমি দেখেছি তাদের টাকার কষ্ট মারাত্মক রকম ছিল। সেই কষ্টের মধ্য থেকেই তাঁরা সাহস, শক্তি, পরিশ্রমের মাধ্যমেই আজ স্বরণীয়, বরণীয়।
কিন্তু আমি তো বিখ্যাত বা জ্ঞানীগুণী কেউ না। মনে হয় হতে পারবোও না। তাহলে এত এত কষ্ট আমাকে কেন জোড় করে বন্ধু বানাতে চায়? মনে হয় এইখানে একটা গোপন রহস্য আছে! স্রষ্টা ছাড়া আর কে জানে ভবিষ্যতের কথা! মনে হয় হয়েও যেতে পারি! আমি কিন্তু তা বলছি না। লক্ষণগুলো কিন্তু সে কথাই বলে!
প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব