Our Sherpur

বারো দুয়ারী মসজিদের পুঁথিকাব্য

বারো দুয়ারী মসজিদের পুঁথিকাব্য | হারুনুর রশীদ

আল্লাহ স্মরণ করি (২) দরুদ পড়ি রাসুলুল্লাহর প্রতি।
পিতা-মাতা, গুরুজনে জানাই সালাম-ভক্তি॥

তারপর একে একে (২) কথা ছেঁকে করি নিবেদন —
শেরপুর জেলার গৌরবগাঁথার কিছু বিবরণ॥

‘কামরূপ’ নামে রাজ্য (২) তাহার বাজু নাম ‘দশকাহনিয়া’।
রাজধানী তার ‘গড়জরিপা’ দিলাম জানাইয়া॥

মহামতি আকবর (২) ক্ষমতাধর দিল্লির সিংহাসনে।
মানসিংহকে দায়িত্ব দেন বঙ্গ নিয়ন্ত্রণে॥

ব্রহ্মপুত্র নদী (২) নিরবধি খরস্রোতা বহে।
একূল ভাঙ্গে ওকূল গড়ে, কখনও থির নহে॥

জামালপুর ঘাট হতে (২) সূত্রমতে শেরিঘাট পর্যন্ত।
প্রস্থ ছিলো এত বিশাল, পানি অফুরন্ত॥

লোকে বলতো তারে (২) নদীটারে “লোহিত সাগর”।
পারাপারে নৌকা চলতো দুই কূল বরাবর॥

পারাপারের তরে (২) এক বছরে দিতে হয় দশকাহন।
“দশকা’নিয়া” নাম হলো তার এইটাই মূল কারণ॥

পরে ধীরে ধীরে (২) উত্তর ঘিরে পড়তে থাকে চর।
সুযোগ বুঝে মানুষেরা গড়ে বসত ঘর॥

   ----------    

হযরত শাহজালাল (২) শাহজামাল তিন শ’ ষাট আউলিয়া
ভারতবর্ষে চলে আসেন নিজের দেশ ফেলিয়া॥

তাদের একজন ওলি (২) শুনো বলি, জরিপ শাহ তার নাম।
তেরো শ’ তিন সালের কথা জানাইয়া দিলাম॥

সুফি জরিপ শাহ (২) রাহমাতুল্লাহ দায়িত্বভার জানা।
পছন্দসই জায়গা নিয়ে গড়েছেন আস্তানা॥

তিন শত ষাট একর (২) জমির ওপর খানকা অবস্থিত।
আশেপাশে অমুসলিমরা হলো রাগান্বিত॥

তার জিন মুরিদেরা (২) তিন পাশ ঘেরা খনন করে খাল।
খালের উপর তৈরি হলো সাত সাতটি জাঙ্গাল॥

মাত্র একটি রাতে (২) তৈরি, তাতে অবাক হয় সকলে!
ইসলামে যোগ দিতে মানুষ আসে দলে দলে॥

সেই খালটিই পরে (২) নামটি ধরে কালিদহ সাগর
এই খাল ধরে ব্যাবসা করে বহু সওদাগর॥

ইবাদতের জন্য (২) অগ্রগণ্য মসজিদ তৈরি করে।
কালে কালে এই মসজিদটি নতুন ভাবে গড়ে॥

কালের পরিক্রমায় (২) ভাঙ্গা-গড়ায় দরজা হয় বারো।
বারো দুয়ারী মসজিদ এটাই সন্দেহ নাই কারও॥

নিষ্ঠা, সততায় (২) উদারতায় ন্যায়বিচারে ধন্য।
অল্প দিনেই তিনি হলেন বাদশাহ বলে গণ্য॥

পূর্বে নেত্রকোণা (২) দক্ষিণ কোণা ব্রহ্মপুত্র ধরে।
পশ্চিম দিকে দেওয়ানগঞ্জ, আসাম হয় উত্তরে॥

এই এলাকা জুড়ে (২) বিরাজ করে জরিপ শাহের রাজ্য।
ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে বিচার পায় সব ন্যায্য॥

কালিদহের কাছে (২) আজও আছে জরিপ শাহের মাজার।
জিয়ারতে ভক্ত মানুষ আসে হাজার হাজার॥

   ----------    

জরিপ শাহের পরে (২) শাসন করে মুসলমান খলিফা।
চৌদ্দ শ’ পঞ্চাশে দখল করে কোচ “দলিপা”॥

কামরূপ রাজ্যের অধীন (২) রয় পরাধীন “দলিপ” হয় সামন্ত ।
“গড়দলিপা” নামে দুর্গ সাজায় আদি অন্ত॥

পাঠান সেনাপতি (২) দক্ষ অতি নামে “মজলিস খান”।
বঙ্গের রাজা “ফিরোজ শাহের” অনুমতি পান॥

আক্রমণের চোটে (২) পিছু হটে “দলিপ” হয় নিহত।
মজলিস খান রাজ্য চালান করে নিজের মত॥

জরিপ শাহের প্রতি (২) জানায় ভক্তি গড়জরিপা নামে।
কালে কালে সম্মানিত স্মৃতির ধরাধামে॥

জরিপ শাহের কবর (২) সন্ধান, খবর খুঁজে পাগলপারা।
হঠাৎ দেখে অর্ধেক দেহ মাটির উপর খাড়া॥

অর্ধেক মাটির নিচে (২) নয় তো মিছে, জিকির করছে। বাহ‌
বুঝতে পারে ইনিই হবেন সুফি জরিপ শাহ॥

তখন নতুন করে (২) মাজার গড়ে, সাজান পরিপাটি।
এক শ’ নব্বই, পঁয়ষট্টি ফিট দিঘে পাশে খাঁটি॥

রাজা মজলিস খান (২) দুর্গ সাজান করে মনের মত।
পাত্র-মিত্র, পাহারাদার সবাই বাধ্যগত॥

গড়জরিপা জুড়া (২) হাতি-ঘোড়া, হাজার হাজার সৈন্য।
শান বাঁধানো বহু পুকুর ছিলো সবার জন্য॥

চার পাশে চার দুয়ার (২) পুব পাশে তার নামটি কুমু দুয়ার।
উত্তর খিড়কি, পশ্চিম পানি, দক্ষিণ সমসকার॥

নৌকার আকার করে (২) বাগান গড়ে দক্ষিণ পাশের জলে।
দ্বীপের মতো বাগানটাকে লোকে ডিঙ্গি বলে॥

পুরান মসজিদটারে (২) আবার তারে নতুনভাবে গড়ে।
সামনে পুকুর, পিছে কূয়া সাজায় থরে থরে॥

সেই মসজিদের কাছে (২) আজও আছে মজলিস শাহের মাজার।
কাছেই স্কুল, মাদ্রাসা আর আছে ছোট বাজার॥

   ----------    

আঠারো শততে (২) সাতান্নতে ভূমিকম্প ঘটে।
গড়জরিপা দুর্গ চূর্ণ বিচূর্ণ হয় বটে॥

জাঙ্গাল দেবে যায় (২) ডিঙ্গি হারায়, প্রাসাদ ভেঙ্গে গেলো।
মসজিদ ডুবে মাটির নিচে, রাস্তা এলোমেলো॥

কালের পরিক্রমায় (২) ওই এলাকায় ঝোপ-জঙ্গলে ভরে।
সাধারণত যায় না মানুষ জীব-জন্তুদের ডরে॥

পরে দিনে দিনে (২) সবাই চিনে নামে মসজিদ আড়া।
ইতিকথা স্মৃতিকথা বলে প্রবীণ যারা॥

নবীনেরা শুনে (২) বলে মনে, এমন যদি হতো —
সেই মসজিদের হদিস পেলে গড়বে মনের মতো॥

ভারতের শর্ষিনা (২) সবার চিনা কামেল পীরের ঘাঁটি।
জামালপুরে আব্দুল আজিজ তাদের মুরিদ খাঁটি॥

পীরের তরিক ধরে (২) আমল করে পেলো এজাযত।
কঠোরভাবে মেনে চলে শরা-শরিয়ত॥

রাতে ঘুমায় যখন (২) দেখে স্বপন গড়জরিপায় যাও।
মাটির নিচে মসজিদ আছে, উদ্ধার করে নাও॥

আসে গড়জরিপায় (২) কথা জানায় এলাকার লোক ডাকে।
শুনে কথা সহায়তা সবাই করে তাকে॥

মস্ত বড় আড়া (২) সবাই খাড়া পীরের পিছু ধরে।
আব্দুল আজিজ এক ঢিল ছুঁড়ে চক্ষু বন্ধ করে॥

ঢিলটি পড়ে যেথায় (২) খুঁড়ে সেথায় সবাই ক্লান্তিহারা।
খুঁড়তে খুঁড়তে দশ ফুট নিচে সন্ধান পেলো তারা॥

পুরান মসজিদ থেকে (২) একে একে কিছু ইট নেয় খুলে।
ইটগুলোকে রাখে তারা যত্ন করে তুলে॥

গোলাপের আকৃতি (২) বর্গাকৃতি মুঘল যুগের মত।
অনুমানে বুঝা যায় না ইটের বয়স কত॥

প্রত্নতত্ত্ববিদ (২) চোখে নাই নিদ, বলে ধন্য ধন্য।
ইটগুলোকে নিয়ে গেলো গবেষণার জন্য॥

পীরের নির্দেশনায় (২) সর্বজনায় সিদ্ধান্ত নেয় বসে–
মাটির উপর গড়বে মসজিদ যেথায় গেছে ধসে॥

ভরাট করে মাটি (২) পরিপাটি নকশা অনুসারে
নতুন করে মসজিদ গড়ে ইমাম রাখে তারে॥

উনিশ শ’ তেষট্টি (২) কথা সত্যি নির্মাণ শুরু করে।
নিয়মিত চালু হলো বছর খানেক পরে॥

প্রস্থে চল্লিশ ফিট (২) একশত ফিট দৈর্ঘ্য পরিমাপে।
একতলা বিশিষ্ট মসজিদ বানায় খাপের খাপে॥

তিনটি গম্বুজ অলা (২) তিন জানালা ও বারোটি দুয়ার।
সামনে দিলো বিশাল পুকুর অজু, হাত-মুখ ধোয়ার॥

বারো দুয়ার বলে (২) তাই সকলে বারো দুয়ারী কয়।
অধর্ম সব ধ্বংস হবে, ধর্মের হবে জয়॥

দুর্গের অতি কাছে (২) আজও আছে “কাদির পীরের” দরগা।
দক্ষিণ-পূর্ব কোণাকুণি ঘোনাপাড়া জায়গা॥

ইয়েমেনে হতে (২) এই ভারতে বারো ওলি আসে।
আল্লাহর নামে ডানে-বামে ছড়ায় চারিপাশে॥

নোহাই বিলের ধারে (২) দরগা গাড়ে আব্দুল কাদির পীর।
মুসলমানদের নিয়ম কানুন শেখায় বন্দেগির॥

ছোট মসজিদ আছে (২) পশ্চিম পাশে আছে মাটির টিলা।
বড় একটি পাথর আছে, বুঝি না তার লীলা॥

রাজা মায়ের দিঘী (২) আলম দিঘী, সাহেব দিঘী আছে।
উত্তর পাশে কূয়া আছে মসজিদের খুব কাছে॥

পরম শ্রদ্ধা ভরে (২) স্মরণ করে জ্ঞানী-গুণী যারা।
আজগুবি সব কথায় মাতে বিদ্যা-বুদ্ধিহারা॥

প্রাচীন নিদর্শন (২) অমূল্য ধন গড়জরিপা জানি‌।
রূপে-গুণে, ধনে-মানে সে যে মহারানি॥

দাদা গরিবুল্লাহ (২) বলি খুইলা পিতা রজব আলী।
মায়ের নামটি হাজেরা আর নানা আস্কর আলী॥

আমি অধম হারুন (২) মুর্খ দারুণ, জানি কি আর অত?
যা জেনেছি তাই লেখেছি, করে নিজের মত॥

বলি সবার কাছে (২) বাকি আছে বহু তথ্য-কথা।
অনুসন্ধান করলে পাবেন কথার যথার্থতা॥

ত্রুটি থাকে যদি (২) শেষ অবধি ধরিয়ে দিন, তবে।
কথা দিলাম শ্রদ্ধা ভরে সংশোধিত হবে॥

আমার কথা যত (২) আপাতত হয়ে গেলো শেষ।
ইতিহাসে ঐতিহ্যময় সোনার বাংলাদেশ॥
আমার — সোনার বাংলাদেশ॥

তথ্যসূত্র:

  1. ময়মনসিংহের বিবরণ — শ্রী কেদারনাথ মজুমদার
  2. শেরপুর জেলার অতীত ও বর্তমান — পণ্ডিত ফছিহুর রহমান
  3. শেরপুরের ইতিকথা — অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন
  4. ইতিহাস ঐতিহ্য গড়জরিপা — প্রকৌশলী এম আহসান আলী ও মো. আকরাম আলী।
  5. শ্যামল বাংলা ২৬/০২/২০২২ আব্দুস সামাদ ফারুক।
  6. বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন।
  7. ভ্রমণ গাইড।
  8. উইকিপিডিয়া, শেরপুর জেলা।

টীকা:

  • কামরূপ: জাদুবিদ্যার পরাকাষ্ঠা হিসেবে পরিচিত কামরূপ কামাখ্যা রাজ্য।
  • বাজু: প্রশাসনিক এলাকা, প্রদেশ। মুঘল শাসন ও তার আগে দশকাহনিয়া বাজু কামরূপ রাজ্যের অধীনস্ত ছিলো। মজলিস শাহ, ঈশা খান, মুসা খানের আমলে কামরূপ রাজ্যের অধীনস্ত ছিলো না।
  • আস্তানা: দরবার, বৈঠকখানা, আখড়া। কথিত আছে জরিপ শাহের জিন মুরিদেরা মাত্র একটি রাতেই তিন শত ষাট একর জমি তিন পাশে খাল ও জাঙ্গাল তৈরি করে।
  • জাঙ্গাল: মাটির উঁচু টিলা। গড়জরিপার জাঙ্গালগুলো সবগুলো সমান ছিলো না। সর্বোচ্চ ২৫ হাত উঁচু ছিলো।
  • দলিপ: কোচ বংশীধারী সামন্ত রাজা। কামরূপ রাজার বশ্যতা মেনে দশকাহনিয়া বাজু দখল করেন। পরে মজলিস শাহের আক্রমণে পরাজিত ও নিহত হন।
  • মজলিস খান: শাহ মজলিস খান হুমায়ূন। বঙ্গের রাজা ফিরোজ শাহের সেনাপতি। ফিরোজ শাহের অনুমতিক্রমে দশকাহনিয়া বাজু দখল করেন। তার আক্রমণে দলিপ সামন্ত রাজাকে পরাজিত ও নিহত হন।
  • ডিঙ্গি: ডিঙ্গি অর্থ নৌকা। গড়জরিপাকে সবচেয়ে সুন্দর ও সুবিন্যস্ত করে সাজিয়েছেন শাহ মজলিস খান হুমায়ূন। দুর্গের ভিতরে সৈন্য সামন্ত, হাতি, ঘোড়া ছিলো। জলপান ও গোসলের জন্য অনেকগুলো পুকুর ছিলো। দুর্গের দক্ষিণ পাশের খালে চারিদিকে পানি বেষ্টিত দ্বীপের মতো নৌকা বা ডিঙ্গির মত লম্বালম্বি একটি শৌখিন ফুলবাগান ছিলো। কালের পরিক্রমায় এই ডিঙ্গি আকৃতির বাগানটি হারিয়ে যায়। কিন্তু স্মৃতিচিহ্ন থেকে যায়। ওই স্থানটি লোকমুখে ডিঙ্গি নামে পরিচিত হয়েছে।
  • আড়া: ঝোপঝাড়, জঙ্গলময় স্থান। ১৮৫৭ সালের প্রলয়ঙ্কারী ভূমিকম্পের ফলে গড়জরিপা দুর্গ বিরাণভূমিতে পরিণত হয়। ধীরে ধীরে তা দুর্গম আড়ায় পরিণত হয়।
  • লক্ষণ হাজো ও কোচবিহার: মজলিস শাহের মৃত্যুর পর দশকাহনিয়া বাজু আবার মুঘলদের দখলে আসে। কোচ বংশীধারী লক্ষী নারায়ন (লক্ষণ হাজো) দশকাহনিয়া বাজু দখল করে। পরে ঈশা খানের আক্রমণে ভীত হয়ে কোচদের নিয়ে পালিয়ে যায়। তারা যে এলাকায় বসবাস করতে থাকেন সেই এলাকাটির নামকরণ করা হয় কোচবিহার।
  • কাদির পীর: সুদূর ইয়েমেন থেকে ভারতে ধর্ম প্রচার করতে এক সাথে বারোজন আসেন। তাদের একজন ওলি আব্দুল কাদির (রহ.)। ঘোনাপাড়ায় তার মাজার আছে॥

Leave a Reply

Scroll to Top