বালুচর শিল্প, সাহিত্য এবং মনন চিন্তার কাগজ
বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের বিশেষ বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত অঞ্চল ময়মনসিংহ। সীমান্ত লাগোয়া উত্তরের গারো পাহাড়ের পাদস্পর্শী অরণ্যঘেরা এসব জনপদ এককথায় নয়নাভিরাম। ভোগাই, নিতাই, দর্শা, মেলেং, মহাঋষি, সোমেশ্বরী, গনেশ্বরী উত্তর ময়মনসিংহের পাহাড়ি নদী। গারো পাহাড় থেকে উৎপত্তি হয়ে বাংলাদেশের মাঝে প্রবেশ করে ভাটিতে বয়ে গেছে এসব নদী। পাহাড়ি সর্পিলাকার এসব নদীর অন্যতম বৈশিষ্ট্য এর গর্ভজাত কাঁচবালি। লাল বর্ণের এই কাচবালি আমাদের অন্যান্য এক খনিজ সম্পদ এবং ভৌগোলিক নির্দেশক পণ্যও বটে। এক জমানায় বর্ষা মৌসুম থেকে আশ্বিন মাস অবধি এই নদীগুলো প্রমত্তা ও বিপুলা রূপ দেখা যেত, আট মাস শুষ্ক এবং উজিয়ে দেয়া বালুচরে নদীর ক্ষীণ স্রোত জানান দিত।
এ কাগজে ছড়িয়ে আছে পাহাড়ি জনপদের মানুষের স্মৃতির নুড়িপাথর, শ্রুতি আর কল্পনার জগৎ। আমাদের কথা, ব্যাথা, স্মৃতি, ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সাংস্কৃতিক যাপনকে প্রজন্মান্তরে ছড়িয়ে দেবার প্রয়াস ছোটকাগজ বালুচর। এটি এক টুকরো অনাবাদি সাহিত্য ভূমি। শিল্প সাহিত্য চর্চার আতুরঘর ছোটকাগজ। ইতিহাস ঐতিহ্য এবং স্থানিক বরেণ্য কীর্তীমানদের কথা দালিলিক পাটাতনে তুলে আনা এই সাহিত্য কাগজের বৈশিষ্ট্য।
এই সাহিত্য পত্রিকা ইতোমধ্যে কাজ করেছে কৃষক আন্দোলনের দিনগুলোতে এই অঞ্চলের রাজনৈতিক গতিপ্রকৃতি নিয়ে। সেখানে বাংলাদেশ ও ভারতে অবস্থিত প্রত্যক্ষদর্শীদের স্মৃতিকথা যুক্ত করা হয়েছে। বিস্মৃত অনেক বিষয় মাঠ পর্যবেক্ষণ করে তুলে আনা হয়েছে এই পত্রিকায়।
‘বালুচর’ এর তৃতীয় বর্ষ, চতুর্থ সংখ্যয় ১৯৪৩ সালে নালিতাবাড়িতে অনুষ্ঠিত “ষষ্ঠ প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলন” এর নানা কথকতা ও ইতিহাসের দলিল আর প্রামাণ্য সাক্ষ্যে সাজানো।
নোটস: ১৯৩৬ সালে বঙ্কিম মুখার্জির নেতৃত্বে গঠিত হয় বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সভা। কলকাতার আলবার্ট হলে, আয়োজিত হয় নানা জেলার কৃষক সংগঠনের সন্মেলনে। জমির উপর জমিদারি মালিকানা উচ্ছেদ করে সেই জমি কৃষকের হাতে তুলে দেওয়া। লাঙল যার জমি তার, কৃষককে ঋণমুক্ত করা সহ নানা দাবী নিয়েই মূলত এই কৃষক সভা গঠিত হয়। কৃষক সভার লক্ষ্য ছিল, পূর্ণ স্বাধীনতা-আদর্শ ছিল কৃষক-শ্রমিকের রাজত্ব কায়েম।
কৃষক সভার জীবনে আন্দোলন ও সংগঠন সম্বন্ধে নালিতাবাড়ি সম্মেলন এক নতুন পরিস্থিতির সূচনা করে, নতুন নতুন কাজের ইঙ্গিত দেয়, কর্মী ও ভলন্টিয়ারদের মধ্যে নতুন উৎসাহ সৃষ্টি করে। পরবর্তী কালের আন্দোলন ও সংগঠনে তার সুস্পষ্ট ছাপ থেকে যায়, লিখেছেন সারা ভারত কৃষক আন্দোলনের বরেণ্য নেতা আবদুল্লাহ রসুল।
সে পর্যন্ত যতগুলো সম্মেলন হয়েছিল তার মাঝে নালিতাবাড়ী সম্মেলন ছিলো সবচেয়ে উৎসাহব্যঞ্জক, সফল এবং জনসম্পৃক্ত। তিনি ঐ সম্মেলনে সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়ে ছিলেন। সভাপতি হয়েছিলেন মোজাফফর আহমদ।
বালুচর পত্রিকার উঠে এসেছে স্থানীয় একাধিক বিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালের সামাজিক সাক্ষ্য এবং ইতিহাস তেমনি স্থানীয় শিক্ষকদের কথা। এই অঞ্চলের প্রাগ্রজ শিক্ষাগুরু শ্রী নিশিকান্ত ভাদুড়ী স্যারের প্রয়াণের পর তার অমর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে ছাত্রদের স্মৃতিকথা সম্বলিত “নিশিকান্ত ভাদুড়ী স্মৃতিতর্পণ” প্রকাশ করেছে এই সাহিত্য কাগজ।
একটি সাহিত্য ও সমাজ সচেতন মননশীল জনগোষ্ঠী ও পাঠকসমাজ সৃষ্টি করতে কাজ করে যাচ্ছে। গারো পাহাড়ের প্রকৃতি, পরিবেশ, প্রতিবেশকে সবুজ এবং প্রাণী বৈচিত্র্যময় একটি অরণ্য দেখতে চাই আমরা।
বালুচর সম্পাদনা করছেন রিয়াদ আল ফেরদৌস এবং সম্পাদনা পর্ষদ সদস্য জ্যোতি পোদ্দার, সজল কর্মকার।