রিয়াদ আল ফেরদৌস
নাকুগাঁও থেকে নন্নী, চেল্লাখালী থেকে যোগানিয়া, রাজনগর থেকে হালুয়াঘাট চারিদিকে থৈ থৈ পানি ঢল। কইত্থিকা আইলো এই বান? উজান ঢলে বেবাক ভাসায়া নিল আমন মরশুম, মইষ, মানুষ গেরামের! সামগ্রিক বিচার বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় নালিতাবাড়ীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার প্রকৃত কার্যকারণ তিনটি।
৪ অক্টোবর, ২০২৪। শেরপুরের নালিতাবাড়ী, শ্রীবরদী ও ঝিনাইগাতী উপজেলায় কমপক্ষে ১১৩টি গ্রাম তলিয়ে গেছে ফসলি জমি, ভেসে গেছে পুকুরের মাছ। পানিবন্দী হয়ে পড়েছে কয়েক হাজার পরিবারের মানুষ। টানা ভারী বর্ষণ ও পাহাড়ি ঢলে ভোগাই ও চেল্লাখালী নদীর বাঁধ ভেঙে ও পানি লোকালয়ে ঢুকে পড়েছে।
বিগত ৩ তারিখ, বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে নদী দুটির পানি বাড়তে শুরু করে। রাতে পানির তোড়ে পোড়াগাঁও, নয়াবিল, রামচন্দ্রকুড়া, বাঘবেড় ইউনিয়নসহ পৌরসভার গড়কান্দা, আড়াইআনী বাজার ও নিচপাড়া এলাকা প্লাবিত হয়। চেল্লাখালী নদীর পানিতে তলিয়ে গেছে নন্নী-আমবাগান সড়ক, উত্তর রাণীগাঁও, নালিতাবাড়ী- তিনানী শেরপুর সড়ক, নন্নী-মধুটিলা ইকোপার্ক।
১৯৮৮ এবং ১৯৯৮ সালের প্রলয়ঙ্কারী বন্যায় নালিতাবাড়ী আক্রান্ত হয়েছিলো। কিন্তু ২০২৪ এর অভিজ্ঞতা একেবারে আলাদা ও রীতিমতো ভয়াবহ। ভোগাই নদীর তীরবর্তী নয়াবিল গ্রামের গাতিপাগাড় বাঁধ অতীতেও ভেঙেছে অনেকবার। নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়েছে। এবারের বন্যায় ভোগাই নদী তীরবর্তী নয়াবিল বাজারের উত্তরে তিন থেকে চার স্থানে নদীর পাড় ভেঙে লোকালয়ে পানি প্রবেশ করেছে।
প্রথমবারের মত বাজার সহ মহাসড়কের এপার-ওপাড়ে জনবসতি প্লাবিত করে গোটা গ্রাম পানিবন্দি হয়ে পড়েছে। হাজার হাজার পরিবার একসাথে পানিবন্দি হওয়ার অভিজ্ঞতা স্মরণকালে এই প্রথম। গবাদি পশু, ফসলের খেত , ধানের গোলা ভেসে গেছে চোখের সামনে নিমিষেই। বন্যা মোকাবিলার অভিজ্ঞতা এই অঞ্চলের মানুষের নেই কোনকালেই।
নালিতাবাড়ীর প্রাণ প্রকৃতির সঞ্জিবনী পাহাড়ি নদী ভোগাই অতীতে ভোগবতী নামে পরিচিত ছিলো। বছরের আট মাস শুষ্ক এবং আষাঢ় থেকে আশ্বিন মাস পর্যন্ত প্রমত্তা, এই ছিলো ভোগাই নদীর গতিপ্রকৃতি। বানিজ্যতরী, বন্দর সবকিছু মিলিয়ে ভোগাই ছিলো স্বয়ংসম্পূর্ণ। বিগত শতকের আটের দশকের শেষভাগে ভোগাই নদীর উপর প্রথম কনক্রিট ব্রিজ নির্মাণ হয়। যাকিনা দুই পাড়ের মানুষের তো বটেই হালুয়াঘাট থেকে শেরপুর পর্যন্ত বাণিজ্যের নতুন দুয়ার প্রশস্ত করে দেয়। বিগত দুই দশকে নির্মিত হয়েছে নাকুগাঁও এবং জামিরাকান্দা রাবার ড্যাম কাম ব্রিজ। পাশাপাশি শক্তপোক্ত নদী শাসন। পানি সম্পদের পরে সর্বাধিক ব্যাবহৃত বৈশ্বিক খনিজ সম্পদ হচ্ছে বালু।
গারো পাহাড়ের ইকোসিস্টেমের গুরুত্বপূর্ণ উপাদান এই বালু যা পাহাড়ি নদী থেকে উত্তোলন করা হয়। বিশ্বজুড়ে এর প্রচুর প্রায়োগিক ও বাণিজ্যিক ব্যবহার রয়েছে। পতিত জমি ভরাট এবং দালান নির্মানের মৌলিক চাহিদা এই পাহাড়ি নদী থেকে উত্তোলিত বালু। নির্বিচারে বালু উত্তোলন প্রকৃতির ভারসাম্য ও জৈব পরিবেশ ধ্বংস করছে।
সাম্প্রতিক বছরে বিশ্বে ৫০ বিলিয়ন টন বালু উত্তোলন করা হচ্ছে যা কিনা প্রাকৃতিকভাবে একই সময়ে উৎপাদিত বালুর দ্বিগুণ। আমাদের নদীসমূহে এই উত্তোলনের পরিমাণ ভয়াবহ এবং অপরিমেয়। অতিরিক্ত ও বিধিবহির্ভূত বালু উত্তোলন একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া হয়ে দাড়িয়েছে এমনকি আদালতের নিষেধাজ্ঞাও এখানে তুচ্ছ।
নয়াবিল গ্রামের উত্তরে ডাক্তার গোপ এলাকায় আবাদি জমি ব্যবহার করে বালু উত্তোলনের ফলে নদীগর্ভে বিলীন হয়েছে অনেক ফসলি জমি, ফলত নদীর গভীরতা ও গতিপথ কয়েক বছরের মাঝেই পরিবর্তন হয়ে গেছে। নদী তীরবর্তী যেসব স্থানে (ফসলি জমি/বাড়ি/ বাঁশঝাড়) বালু প্রাপ্যতার সম্ভাবনা থাকে ক্রয় বা ইজারা নিয়ে শেষবিন্দু পর্যন্ত ড্রেজিং করে বালু উত্তোলন করা হয়।
বালু মহাল ও মাটি ব্যাবস্থাপনা আইন ২০১১ অনুযায়ী সংস্লিস্ট জেলা প্রশাসক বিধিমালা মোতাবেক নদীর কোন নির্দিষ্ট জায়গা বালু মহাল হিসেবে ঘোষণা দিতে পারেন তবে অবশ্যই ঐ স্থানে হাইড্রোগ্রাফিক জরিপ করে বালুর পরিমাণ নির্ধারণ করার বাধ্যবাধকতা আছে এবং যেকোন শর্তে বালু উত্তোলন বন্ধ করার এখতিয়ার থাকবে প্রশাসনের।
শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার জামিরাকান্দায় খরস্রোতা ভোগাই নদীর ওপর ১৯৯৬ সালে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে ১০০ মিটার দৈর্ঘ্যের রাবার ড্যাম কাম ব্রিজ নির্মাণ করা হয় কৃষি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে। শুষ্ক মৌসুমে এ বাঁধের মাধ্যমে নদীর ৮ কিলোমিটার উজান পর্যন্ত পানি মজুদ করা হয়। এ পানি দ্বারা ১১টি সংযোগ খালের মাধ্যমে পৌরসভাসহ উপজেলার সাত ইউনিয়নের প্রায় ১০ হাজার একর আবাদি জমি শুষ্ক মৌসুমে সেচ সুবিধা পায়। রাবার ড্যাম ও ব্রিজ সংলগ্ন একটি বৃহৎ এলাকা যদি শাসনের আওয়তায় নিয়ে আসা হয় সেসময়।
নদী যখন স্বাভাবিক তরঙ্গে বয়ে যায় তখন স্রোত, পরিবেশ ও সমপরিমাণ পলি বহন করে যা এর গতিপথকে সর্পিলাকার করে। ভাটিতে বাঁধ দিলে উজানে নদীর খাত ক্রমশ পরিবর্তিত হয়ে একাধিক উপখাত সৃষ্টি করে। ব্রিজ ও বাঁধ নির্মাণের সময় নদী শাসন এর শক্তিশালী কারণ। কেননা নদী এক জীনন্ত প্রাণবন্ত সত্তা। সে স্বমহিমায় প্রাণ সঞ্চার করে বয়ে যায়। শুষ্ক মৌসুমে ভোগাই নদীর স্থির পানি নদীর পলি প্রবাহে বিরাট এক বাঁধা। পাশাপাশি একই সময়ে সর্বত্র বালু উত্তোলন নদীকে এক অনিশ্চিত ও নির্মম পরিণতির দিকে এগিয়ে দিচ্ছে। যেকোন সময় ভূমিধসের মত ঘটনা হতে পারে এসব অঞ্চলে। নদী শাসনের অনিবার্য প্রতিশোধ বন্যার অন্যতম কারণ।
পৌর শহরের সার্জেন্ট আহাদ পার্ক (পুরাতন গরুহাটি) থেকে ভোগাই ব্রিজ পর্যন্ত শহর রক্ষা বাঁধ এবং বিপরীতপার্শ্বে ব্রিজের পূর্ব পাড়ে বঙ্গবন্ধু পার্ক হয়ে নিচপাড়া পর্যন্ত শহর রক্ষা বাঁধ (ব্লক) পর্যালোচনা করা যেতে পারে। নিজপাড়া, চিনামারা ও বঙ্গবন্ধু পার্ক পয়েন্টে দীর্ঘবছরের অপরিকল্পিত বালু উত্তোলন নদীর গতিপথ পরিবর্তন ও প্রশস্ততা বাড়িয়েছে। পক্ষান্তরে পৌর শহরে নদীর দুইপাড় শক্তভাবে শাসন করার ফলে প্রশস্ততা উজানের চেয়ে কম এবং অপরিবর্তিত রয়েছে।
প্রবল বর্ষণে ঢলের পানি শহরে প্রবেশ করার এটি একটি কারণ হতে পারে। পাশাপাশি শহরের আয়তন ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন, মূল শহরের ড্রেনেজ ব্যবস্থা আধুনিক ও বাস্তবসম্মত না হবার কারণে বাণিজ্যিক জায়গাগুলোতে অল্প বৃষ্টিপাতেই জলাবদ্ধতা দেখা দিচ্ছে। কেননা ঘনবসতিপূর্ণ মহল্লাগুলো থেকে কাছাকাছি নদী বা খাল/জলাশয়ে পানি সরে যাওয়ার রাস্তা নেই। বিগত দুই দশকে জ্যামিতিক হারে বেড়েছে জনসংখ্যা এবং যৌথ পরিবার ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে ছোট পরিবারের বিকাশ ঘটেছে।
সমাজ ও ভূমির উপর এর প্রতিক্রিয়া কি, তা আমাদের বুঝতে হবে। গৃহবাড়ি নির্মাণের জন্য সড়ক/মহাসড়ক সংলগ্ন ফসলি জমি ব্যাপকভাবে ব্যবহৃত হয়েছে বিগত বছরগুলোতে যা চলমান আছে এবং বৃদ্ধি পাচ্ছে। নতুন নতুন সড়ক ও মহাসড়ক উন্নয়নের ফলে প্রাকৃতিকভাবে বর্ষার পানি নিষ্কাশনের প্রবাহ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। পাশাপাশি সরকারি পুকুর, নিচু জলাশয়, অনাবাদি নামা জায়গা ভরাট হচ্ছে প্রতিনিয়ত। সরকারি বা ব্যাক্তিগত উদ্যোগে বিল বা নিচু জলাশয় কখনো সংস্কার / পরিষ্কার লক্ষণীয় হয়নি।
উত্তরাঞ্চল থেকে কিছু প্রাকৃতিক খাল নিন্মজলাভূমি/ ছড়া থেকে উৎপত্তি হয়ে দক্ষিণাঞ্চলের বিল বা নদীতে পতিত হয়েছে যেমন ভূইত্তা খাল তার মাঝে অন্যতম আছে ঐতিহ্যবাহী দর্শা খাল। কিন্তু আজকের বাস্তবতায় এসব খাল ক্রমশ ভরাট হচ্ছে এবং লোকালয়ে যাতায়াতের জন্য প্রতিটি খালের উপর প্রচুর কনক্রিট ব্রিজ নির্মাণ হয়েছে। এর ফলে খালের বর্ষা মৌসুমে পানি ধারণক্ষমতা এবং সমতলের পানি খালে প্রবেশমুখে সৃষ্টি হচ্ছে অসংখ্য প্রতিবন্ধকতা।
নালিতাবাড়ীর উত্তরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের পশ্চিম গারো পাহাড়ের ঢাল। পেটি বন্ধনির মতো সীমান্তরেখা ঘিরে রেখেছে এই গারো পাহাড়ের পাদদেশ। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে এর সর্বোচ্চ নকরেক গিরি শেখরের উচ্চতা ৪,৬৫২ ফুট (উইকি)।
পাহাড়ি নদী ভোগাই, মালিঝি, চেল্লাখালী, মহাঋষি ছাড়াও গারো পাহাড়ের অসংখ্য ছড়া, ঝর্ণা, করনদী মেলেং, নিতাই, বুড়ি ভোগাই এবং পর্বতগাত্র ধোয়া নিম্নগামী বৃষ্টির পানি স্বাভাবিক নিয়মে সমতলের ভূমিকে অবগাহন করে নেমে আসে। ফলত পাহাড়ি নদীর ঢলের সাথে অতিরিক্ত যুক্ত হয় পর্বত গাত্রের পানি। তীব্র বর্ষণে সুউচ্চ গিরিখাতে মাঝেমধ্যেই ঘটে পাহাড় ধস এবং প্রকাণ্ড বৃক্ষ উৎপাটিত হয়ে নদীতে ভেসে আরার ঘটনা। এর ফলে পলির সাথে অতিরিক্ত মাটি ও বনজ আবর্জনা নদীকে ভরাট করে ফেলা।
স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার প্রকৃত কার্যকারণ
সামগ্রিক বিচার বিশ্লেষণে প্রতীয়মান হয় নালিতাবাড়ীতে স্মরণকালের ভয়াবহ বন্যার প্রকৃত কার্যকারণ তিনটি। ভোগাই নদীতে রাবার ড্যাম ও শক্তিশালী নদীশাসনের জন্য কারণে নদীর গতিপথ পরিবর্তন, যত্রতত্র অবৈধ বালু উত্তোলনের ফলে নদীভাঙন বেগবান এবং গারো পাহাড়ের সমতলে নিম্ন জলাভূমি, খালবিল ভরাট করে জনবসতি গড়ে উঠা। আকষ্মিক বন্যার ক্ষয়ক্ষতির আলোচনা পর্যালোচনা ও পরবর্তী করণীয় নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা, প্রচেষ্টার কথা সর্বোত্র সারা দেশজুড়ে। কিন্তু আজকের আকষ্মিক এই বিপর্যয়ের কার্যকারণ কি? কিভাবে রচিত হয়েছে আজকের প্রেক্ষিত। আমরা কি বিগত দশকজুড়ে আঁচ করতেই পারিনি এমন একটি দিন আসলেও আসতে পারে?
আমাদের কণ্ঠস্বর, সংবাদমাধ্যম, সমাজ চিন্তক কি নদী ও পাহাড়ের কান্না, বিক্ষোভের ভাষা পাঠ করতে অক্ষম ছিলো নাকি জাগ্রত নিদ্রাচ্ছন্ন ছিলো! বড়ো একটি প্রশ্ন আজকের ও আগামীর জন্য। সচেতন জনগোষ্ঠী, প্রশাসন এবং রাষ্ট্রযন্ত্র ঐক্যবদ্ধ বাস্তবসম্মত পরিকল্পনা আগামীদিনের বিপর্যয় রোধ করতে পারে। পাশাপাশি সমজের চিন্তকদের মধ্যে প্রকৃতি পরিবেশ, প্রতিবেশ নিয়ে নতুন ঢেউয়ের ভাষা, ভাবনা ভাবতে হবে।
লেখকঃ সম্পাদক- বালুচর, প্রাবন্ধিক।
লেখাটি বাস্তব সম্মত পড়ে ভাল লাগছে❤️❤️❤️
লেখাটি পড়ে ভালো লেগেছে। লেখককে আন্তরিক ধন্যবাদ