Our Sherpur

গারো পাহাড়ে হাতির ঠিকানা কোথায়?

গারো পাহাড়ে হাতির ঠিকানা কোথায়
রিয়াদ আল ফেরদৌস
রিয়াদ আল ফেরদৌস

গারো পাহাড়ে হাতি এবং উপ পর্বতীয় অঞ্চলের কৃষি অর্থনীতির সম্পর্ক সুপ্রাচীন। গারো পাহাড়ের ধূসর হাতি আমাদের নিকট পড়শী। ওদের হিংস্র বা তাণ্ডবকারী বলা একদম সমীচীন নয়। ওরা ও আমরা সবাই প্রকৃতির সন্তান, সীমান্ত প্রভাবিত হাতির জীবন আজ ঠিকানার খোঁজে ফেরারি, ক্ষুধা ও তৃষ্ণায় উদ্বিগ্ন ধুঁকছে ওরা। হাতির রাষ্ট্রিক পরিচয় ও স্থানিকতা আজ পাহাড়ি জনপদের এক বিরাট প্রশ্ন। উনিশশো সাতচল্লিশ সালে বিভক্ত সীমান্ত ও ভূরাজনৈতিক বাস্তবতা সীমান্তের জনগোষ্ঠীকে দিয়েছে নতুন সজ্ঞায়ন এবং নবগঠিত জীবনধারা। কিন্তু বনভূমি বাটোয়ারা হলেও বুনো প্রাণীর যাপন বিবেচনা থেকে গেছে চিন্তার বাইরে। ফলত স্থানিক বাস্তুবতায় অভিন্ন ভূমির হাতি পেয়েছে বিচ্ছিন্নতাবাদীর পরিচয়।

সীমান্ত এমন এক বাস্তবতা যার সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাব তৎসংলগ্ন স্থানীকতার অবিচ্ছেদ্য অংশ। বাংলাদেশের উত্তর পূর্বাঞ্চলের গুরুত্বপূর্ণ সীমান্তবর্তী উপজেলা শ্রীবর্দী, ঝিনাইগাতি, নালিতাবাড়ী, হালুয়াঘাট। সীমান্ত রেখার ওপার থেকে মালিঝি, থলং, ভোগাই, নিতাই, দর্শা, মেলেং, সোমেশ্বরী , কংস, গণেশ্বরী সহ অসংখ্য পাহাড়ি ছড়া গারো এবং খাসিয়া হিলস থেকে দুরন্ত বেগে পাহাড়ের উপত্যকা ভেদ করে সমতলে চলে আসেছে।

বিশ্ব হাতি দিবস
গারো পাহাড়ে হাতির ঠিকানা কোথায়? | ছবি: মুগনিউর রহমান মনি

ব্রহ্মপুত্র নদের উত্তরে পাণ্ডব বর্জিত ৭০ মাইল দীর্ঘ পাহাড়ি অরণ্যঘেরা আদিবাসী জনপদে গারো হাজং, ডালু, কোচ, বানাই, হদি, রাজবংশী জনগোষ্ঠীর প্রাণ ও প্রকৃতিকে ধারণ করে চীর শান্তিময় সহাবস্থান ছিলো। পাহাড়ি জঙ্গলাকীর্ণ ভূমি চাষ ও বাসযোগ্য করে তুলার কৃতিত্ব এই গারো হাজং জনগোষ্ঠীর। চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত পরবর্তী কৃষি অর্থনীতি ও বহুস্তুরীয় মধ্যস্বত্বভোগী ভূমি সামন্ত ব্যবস্থা আদিবাসী কৃষক সমাজকে প্রভাবিত করে আসছিল। পলশী পতনের পর পাগলপন্থী সন্ন্যাসী বিদ্রোহ এবং ঠিক পরবর্তী সময়ে পাহাড়ি জনপদে হাতিখেদা আন্দোলন দানা বেঁধে উঠেছিল।

গারো পাহাড় থেকে জমিদার ও ভূমিসামন্তদের সম্পদ আহরণের অন্যতম মাধ্যম ছিলো হাতি। মুঘল জমানায় সুসং দুর্গাপুরের জমিদার কর মওকুফ পাওয়ার জন্য পাহাড়ের হাতি সরবরাহ করতেন। এছাড়াও বাণিজ্যিকভাবে মুর্শিদাবাদ, দিল্লি, পাটনায় হাতি বিপনন ছিলো জমিদার ও পাহাড়ি ভূমিসামন্তদের লাভজনক ব্যাবসা। অতিকায় হাতিকে পোষ মানিয়ে বিপনন উপযোগী করা এক কল্পনাতীত কঠিন কাজ।

গারো পাহাড়ের হাতির আকুতি
গারো পাহাড়ে হাতির ঠিকানা কোথায়? | ছবি: মুগনিউর রহমান মনি

হাজং কৃষকদের আসাম থেকে ধরে এনে এই কাজে বাধ্যতামূলক নিযুক্ত করা ছিলো এক ভয়ঙ্কর সামন্তবাদী প্রথা। দীর্ঘ পাহাড়ি অরণ্যসংকুল অঞ্চলে শতাধিক হাতি খেদা (হাতি ধরার ফাঁদ) তৈরি করা ছিলো। বিশাল শাল কাঠ দিয়ে বেষ্টনী তৈরি করে তার মাঝে কলাগাছ ও ধান চাষ করা হত এবং পোষা কুকনি হাতি বেঁধে রাখা হত। বন্য হাতি খেদার ভেতর আসলেই প্রবেশদ্বার বন্ধ করে দিয়ে কুকনি হাতির সাহায্যে বন্য হাতিকে শেকল পড়িয়ে আটকে ফেলা হত। এরপর বুনো হাতি পোষ মানিয়ে বিক্রির জন্য তৈরি করা এক দীর্ঘ প্রক্রিয়ার বহু হাজং যুবকের প্রাণহানি ঘটতে থাকে। হাজংরা এর বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হয়ে ওঠে মনা সর্দারের নেতৃত্বে। (সূত্র: প্রমথ গুপ্ত , মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী ) ফলশ্রুতিতে হাতিখেদা আন্দোলন হয়, সে ইতিহাস সুদীর্ঘ।

হাতিখেদা বিলুপ্ত হয়েছে আন্দোলনের ফলশ্রুতিতে কিন্তু প্রশ্ন জাগে কেন একবিংশ শতকেও হাতি সীমান্তের বুভুক্ষু, উদ্বাস্তু এবং পরিচয়হীনতা নিয়ে অস্বাভাবিক আচরণে লিপ্ত? গারো পাহাড়ে হাতির দাপুটে অস্তিত্ব যে বিগত কয়েক শতাব্দীতে সরব সন্দেহাতীতভাবে তা প্রতীয়মান। হাতি সাধারণত শারিরীক গঠনের কারণে দ্রুত পর্বতের চূড়ায় আরোহন বা অবরোহন করেনা। এরা উঁচু নিচু টিলায় যুথবদ্ধ চড়ে বেড়ায়, পাহাড় থেকে নেমে আসা নদীতে ও ঝরনায় পানি পান করে, খেলা করে।

হাতি
গারো পাহাড়ে হাতির ঠিকানা কোথায়? | ছবি: মুগনিউর রহমান মনি

এককালে গারো পাহাড় খাদ্যভাণ্ডারে সমৃদ্ধ ছিল। বেল, কাঁঠাল, কলা,পেপে আর অফুরন্ত ভোজ্য তৃণ গুল্মলতায় সমৃদ্ধ এই গারো পাহাড় কালক্রমে নি:শ্ব হয়ে পড়েছে সম্পদ ও প্রাচুর্যে। পাহাড়ি দুর্দান্ত নদীগুলোর উজিয়ে দেয়া চর, দখলে, দূষনে ও খনিজ সম্পদ লুন্ঠনের প্রতিযোগিতায় মৃত্যুর প্রহর গুনে চলে নিয়ত। সীমান্তরেখা হাতির জীবনকে প্রভাবিত করে নানাভাবে। ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠীর জীবন ও জীবীকার সম্পদ আহরণে গারো পাহাড় আজকের দিনেও অন্যতম প্রাকৃতিক উৎস।

এক জমানার সংখ্যাগরিষ্ঠ হাতি এখন হাতে গণনা করা যায়। ক্ষুধা ও তৃষ্ণার তাড়নায় একটু ছায়ার খোঁজে তাঁরা আদিপুরুষের পদচিহ্ন অনুসরণ করে ফিরে আসে চরাচরে। কিন্তু শতাব্দীর ভ্রমণে রাষ্ট্রহীনতার অভিধান তাঁর বোধগম্য হয়না কোন ক্রমেই। সীমান্তের ছিদ্রতা হাতির চলাচলের পথকে জুড়ে দেয় দুই দেশের প্রান্তিকতার সাথে। তপ্ত রোদে ক্লান্ত ক্লিষ্ট বুভুক্ষু ধুসর হাতি উদ্বাস্তু ঘুরে বেড়ায় গারো পাহাড়ের টিলায়, উপত্যকায়, সমতলে।

গারো পাহাড়ের বাস্তুতন্ত্র সময়ের পালাচক্রে প্রভাবিত ও পরিবর্তিত হয়েছে। আদিবাসীদের একচেটিয়া প্রাধান্যের বলদে সকল জনগোষ্ঠীর মিশ্র বসতি স্থাপিত হয়েছে গারো পাহাড়ের সমতলে। বুর্জোয়া শ্রেণির খনিজ ও বনজ সম্পদের বানিজ্যিক যোগান দিয়ে চলেছে গারো পাহাড়। একসময়ের দুর্গম ও নদী ভাঙনের কবলে ভগ্ন যোগাযোগ ব্যবস্থা এখন এককথায় আন্তর্জাতিক মহাসড়ক। রাষ্ট্রের কেন্দ্রকে সংযুক্ত করে জাতীয় অর্থনীতিকে বেগবানের লক্ষে পর্যটন শিল্পের বিকাশ গারো পাহাড়কে ঘিরে যেন সময়ের দাবি। চলছে ভূমি চিিহ্নতকরণ ও অধিগ্রহণ। একাধারে বুনো চিন্তা ত্যাগ করে পশুপাখিদের হাত থেকে পাহাড়কে সৃজনের দায়িত্ব হাতে তুলে নিয়েছে সভ্য সমাজ। আধিপত্যবাদী মানবায়িত নতুন ধারণা গারো পাহাড়ের চালচিত্র বদলে দিয়েছে একরকম ইচ্ছেপূরণের গল্পের মতো।

বুনো হাতি
গারো পাহাড়ে হাতির ঠিকানা কোথায়? | ছবি: মুগনিউর রহমান মনি

লোভ, দখলদারিত্বের নতুন মানচিত্রায়নে হাতির প্রজন্মের ভবিষ্যৎ যে নির্বিঘ্নে ছায়া-জলে যাপিত হবে তার সম্ভাবনা ক্ষীণ। তবে হাতির জন্য একটি প্রাকৃতিক বেষ্টনী, কিছু খাদ্যের প্রাকৃতিক ভাণ্ডার একটি নির্দিষ্ট অভয়ারণ্যে জলা জংলা স্থান রাষ্ট্র সামান্য সদিচ্ছায়ই করে দিতে পারে। মূলত বিধি-বাম হয় তখনই যখন আমরা খুঁজে পাইনা- গারো পাহাড়ে হাতির ঠিকানা কোথায়?

লেখক: রিয়াদ আল ফেরদৌস, প্রাবন্ধিক ও সম্পাদক

Leave a Reply

Scroll to Top