“১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১,
শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস”
আর কিছু কথা…
ইতিহাস থেকে যতটা জানতে পারি, দুটি দেশের মধ্যে, দুটি বৃহত্তর জাতির মধ্যে, যুদ্ধ সংগঠিত হলে, শত্রুকে পরাজিত করার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ কৌশল দুটো দলেই করে থাকেন। এখানে শুধু বিজয় অর্জন করাটাই মূখ্য বিষয় হলেও তার মধ্যে থাকে কিছু নিয়মনীতি। পরিবেশ পরিস্থিতির স্বীকার হলে সভ্য জাতি বা দেশও তাদের অস্থিত্ব বাঁচাতে যুদ্ধে নামতে বাধ্য হয়। সুতরাং যুদ্ধকে এড়িয়ে যাওয়া বা যুদ্ধকে অস্বীকার করার কোন কারণ নেই! কারণ, শত্রুর আক্রমণ প্রতিহত করতে গেলেও যুদ্ধে নামতে হয়।
আগেই বলেছি, যুদ্ধেরও কিছু নিয়মনীতি আছে।
যেমনঃ যেকোনো যুদ্ধেই শিশু ও নারীরা অসহায়, তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা বা ধর্ষণ করা, নিরপরাধ ব্যক্তিদের বিনা কারণে গণহত্যা করা যুদ্ধনীতির বহির্ভূত এক মানবতার চরম লঙ্ঘনীয় কাজ। কিন্তু আমরা অনেক যুদ্ধেই এগুলোর বাস্তবায়ন দেখিনা! ঠিক তেমনি, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীরা যখন জানতে পারলো তাদের পরাজয় নিশ্চিত। তখনই তারা আত্মসমর্পনের দুইদিন আগে নির্বিচারে বুদ্ধিজীবী হত্যায় মেতে উঠলো। সুতরাং একে কখনো যুদ্ধ বলা চলে না। যুদ্ধের নিয়মকে এদের কর্মকান্ডগুলো অতিক্রম করে গেছে। এটা যুদ্ধ থেকেও শতগুন নিম্নস্তরের কাজ! এটা হলো কাপুরুষতা, গণহত্যা, হিংস্রতা, মানবতার চরম পরাজয়! তাছাড়া এমনিতেই তারা দীর্ঘ সময় ধরে এদেশে ধর্ষণ, গণহত্যা, লুটপাট করে ঘৃণ্য ইতিহাস তৈরি করেছিলো।
এক ইতিহাস বইয়ে পড়েছিলাম, “ভারত উপমহাদেশে ব্রিটিশদের প্রায় দুশো বছরের প্রতারণা, লুটপাট, জোর জবরদস্থীর রাজত্ব শেষ হয়ে এলে, এদেশের রাজ্যগুলো, এদেশের নেতাদের কাছে বুঝিয়ে দেয়ার সময়, তাঁরা কিছু ঘৃণ্য কৌশল অবলম্বন করে। তার মধ্যে একটা হলো, বিতর্কিত সীমানা নির্ধারণ! তাঁরা এমন ভাবে ভারত-পাকিস্তানের সীমানা রেখা নির্ধারণ করে যাতে এই দুই দেশ স্বাধীন হওয়ার পরেও তাদের নিজেদের মধ্যে সমস্যাগুলো আজীবন থেকে যায়। যেমনঃ কাশ্মীর সীমানা নিয়ে ভারত, পাকিস্তানের সব সময়কার দ্বন্ধ। এমনকি, এই সমস্যা নিয়ে দুই দেশ এখনো প্রায়ই যুদ্ধের মূখোমূখী! যেন, ব্রিটিশ শাসনামলের প্রতারণা, লুটপাটের ইতিহাস নিয়ে গবেষণার চেয়ে নিজেদের সমস্যা নিয়েই যাতে দুই দেশ সব সময় ব্যস্ত থাকে!”
ঠিক তেমনি এই বর্বর পাকিস্তানিরা তাদের পরাজয় নিশ্চিত জেনেই ১৪ ডিসেম্বর এক নীল নকশা আঁকে! দেশে নামকরা বুদ্ধিজীবীদের ধরে ধরে বিনা কারণে, বিনা বিচারে, নির্বিচারে হত্যা করে।
যাতে বাংলাদেশ কয়েক দশক ধরে মেধাশূণ্য হয়ে পড়ে! বিশ্ব দরবারে মাথা সোজা হয়ে না দাড়াতে পারে।
এর পেছনের কারণগুলো হলো,
তারা যে অন্যায়, অবিচার আর গণহত্যা এখানে ঘটিয়েছে তা যেন বিশ্ব গণমাধ্যম, মিডিয়ায় যথাযথ ভাবে তুলে ধরার ব্যক্তিরা এদেশে জীবিত না থাকেন! সঠিক ভাবে বিশ্বের কাছে প্রমাণ তুলে ধরে তাদের বিরুদ্ধে সঠিক বিচার চাইতে না পারেন। যাতে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য-পরিসংখ্যান যোগ্য ব্যক্তিদের অনুপস্থিতে মুছে যায়। পরাজয় সুনিশ্চিত জেনে এভাবে খুঁজে খুঁজে দেশে বুদ্ধিজীবীদের নির্মমভাবে হত্যা করা পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল।
আমরা হয়ত অনেকেই বুদ্ধিজীবী হত্যার ফলাফলটা কিভাবে আমাদের দেশের উন্নতির পথে বাধা সৃষ্টি করেছে তা চিন্তা করে দেখিনা। একজন সত্যিকারের বুদ্ধিজীবী একটা দেশ, এমনকি পৃথিবীর অনেক দেশের ইতিহাস বদলে দিতে পারেন! যেমনঃ কার্ল মার্কস, রুশো আরো অনেকেই আছেন যাদের লেখনিকে প্রেরণা করে এগিয়েছে তাঁর দেশ, জাতি এই পৃথিবী। আমি মনে করি, সেই অভাবটা আমাদের দেশে এখনো পুরোপুরি পূরণ হয়নি। যুগের থেকে আমাদেরকে পিছিয়ে ফেলা হয়েছে। যদি সেই বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক, শিক্ষক- প্রভাষক, নাট্যকার রা বেঁচে থাকতেন, তাহলে তাঁদের স্বচোক্ষে দেখা মুক্তিযুদ্ধের সঠিক তথ্য, ঘটনা, ইতিহাস আমরা তাঁদের লেখনিতে পেতাম। যেমনঃ জাহানারা ইমাম এর “মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলি” আমাদের জন্য এক জীবন্ত সত্য ইতিহাস। আজ দুঃখের সাথে বলতে হয়, কিছু বছর আগের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসও বিকৃত হয়ে যাচ্ছে। আমাদের কাছে ভুল তথ্য তুলে ধরা হচ্ছে! যদি ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সালের বুদ্ধিজীবীরা বেঁচে থাকতেন, তাঁদের কাছে অবশ্যই আমরা অনেক প্রতিষ্ঠিত তথ্য পেতাম। কিন্তু আফসোস!
তাই ১৪ ডিসেম্বর ১৯৭১ সাল, আমাদের বাঙালি জাতির জন্য, বাংলাদেশের উন্নতির জন্য এক মহা বিপর্যয়ের দিন।
লেখকঃ সাগর আহমেদ
শেরপুর সরকারি (বিশ্ববিদ্যালয়) কলেজ।
ইংরেজি বিভাগ