গারো পাহাড়ের চিঠি : দুই
“উঁচু টিলার দু’পাশেই ঢালু। ছোট ছোট নুড়ি বিছানো ঢালুপথ। টানা হেঁটে গেলে হাটুতে টান পড়ে। হাঁপিয়ে উঠে সমান মতো অল্প পরিসরে দাঁড়িয়ে কিছুটা জিড়িয়ে নিতে গিয়ে দেখলাম টিলার এপাশ ওপাশ কেটে কেটে দু’পাশে ঢালু রাস্তা। এপাড় ওপাড়ের যোগাযোগের জন্য এই ঢালু পথ। টিলার কাটা শরীরে নানা লতা গুল্ম ঝুঁলে আছে বারান্দার টবে রাখা গাছের মত। দু’পাশের দেয়ালে শ্যাওলা। গাছের বিস্তারের কারণে আকাশ আরেকটু উপরে ওঠে গেছে। ডালের ফাঁক ফোকর দিয়ে অল্প অল্প ছায়া নুড়ি বিছানো পথে পড়েছে ছোপ ছোপ অন্ধকার।
ঢালু থেকে নামার পথে ততটুকু কষ্ট নেই–যতটুকু ওঠবার সময় পায়ের শক্তি আর দম লাগে। আগলাপটকা ভাবে শরীরের ভার একটু ঝুঁকে ছেড়ে দিলেই ঢালুপথ পথিককে এক্কেবারে সমতল রাস্তার মোড়ে নামিয়ে দেয়। তবে একটু সতর্কতা লাগে। নইলে গোল চৌকো নুড়িতে পা হড়কে যেতে পারে। পা পিছলে হাঁটু ছরে যেতে পারে। প্রথম যেবার আসি সবার হুড়মুড়িয়ে পড়ে গেছিলাম। হাঁটুতে চোট লেগেছিল বেশ।
নীচের পথ পায়ের পাতা জলেভেজা পথ। কোনো দূরে কোনো ঝোরা হতে চুঁয়ে চুঁয়ে জল গড়াতে গড়াতে এই বেলে মাটির পথ ভিজে ছুপছুপে হয়ে থাকে প্রায় সারা বছর। পথের কোনায় একটু আড়াল হয়ে টিটু টপাটপ কয়েকটি জলার পাখিকে সেলুলয়েডে গ্রেফতার করে ফেলল।
ঠিক তখনই বিচ্ছিরি কটু গন্ধ ছড়িয়ে ঘুৎ ঘুৎ করতে করতে একপাল শূকর ঢাল বেয়ে একটু বেশি গতিতে সড়সড় করে নেমে আসছে। বড় মাঝারি মেজো সেজো নোয়া ছোট সিকি আধূলির দঙ্গল– ঘরোয়া শূকরের দঙ্গল। অপ্রশস্ত পরিসর।চাপাচাপি ঠেলাঠেলির ভেতর দিয়ে সড়সড় করে নামছে কালো কালো ছোট্ট চোখের ঘুৎঘুৎদের দল।
দলের পেছনে খগেন কোচ–সতের আঠারো বছরের ছেলে। উদোম গায়। হাঁটু পর্যন্ত লুঙ্গি পরে নাভীর উপরে কুন্ডুলি পাকিয়ে রেখেছে বেশ বিচ্ছিরি ভাবে। ভেজা পথটুকু দ্রুত হেঁটে একটু উঁচু মতো জায়গায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখছিলাম শূকরের মিছিল। সারাদিন বনের এখানে ওখানে ঘুরে খগেন ঘুৎঘুৎদের নিয়ে ঘরে ফিরছে।
ঘুৎ ঘুৎ করতে করতে শূকর খাবার খুঁজে। দলবেঁধে খুঁজে। একটু নরম মাটি পেলেই শক্ত দাঁতের আঁচড়ে উলট পাটল করে ফেলে চরাচর। কেঁচো গাছের শিকড় গাছের মূল এমন কী সুযোগ পেলে জমি জিরাতের ফসল নিমিষে সাবাড় করে শূকরের পাল। আমাকে দেখে খগেন একটু হেসে হাতের পাজন দিয়ে ছোট শূকরগুলো তাড়াতে তাড়াতে আমাকে ছাড়িয়ে এগিয়ে গেলো। বাতাসে আরো আরো বিটকেলে গন্ধ ছড়িয়ে।
শূকর কোচদের ঘরোয়া প্রাণী। উঠানের পাশেই বাঁশের ঘের বানিয়ে সেখানে প্রতিপালিত হয়। কোচ যাপনের সাথে শূকর জড়িয়ে আছে নানা ভাবে। রয়েছে স্মৃতিতে শ্রুতিতে পুরাণে আর নানা ভোগ বিলাসের আচরণিক ধর্মাচারে। যার যা বিধান সে সেই বিধানই মানে; মেনে চলে গাঁওবুড়ার প্রযত্নে যৌথতার উৎসবে। একক ভাবে যে হয় না — তা নয়।নব জাতকের আগমনে অথবা নয়া ধানের বলক ওঠা ভাতের সাথে অথবা বিয়ে শাদীর আয়োজনে নানা উপাচারে জড়িয়ে রয়েছে শূকর।
জানি– শূকর নিয়ে তোমার একটু ঘিনঘিন ভাব আছে। কিংবা বলা ভালো ঘৃণা রয়েছে তোমার ভেতর জায়মান। খাদ্যাভ্যাসের কোন একরূপতা নাই। যত মত তত পথের মতো খাদ্যাভ্যাস নানা রঙে নানা বিভাবে নানা উপকরণে নানা প্রক্রিয়ায় বিস্তরণ ঘটেছে। হোক সে ব্যক্তিগত বা পারিবারিক বা কোন কৌমের ব্যবস্থাপনায়। একটি ধর্মমত যেমন আরেকটি ধর্মমত থেকে আলাদা– ঠিক তেমনি ধর্মামতের তাপ ও চাপে তার খাদ্যাভ্যাসের নিয়মকানুন আলাদা। অনেকটা স্থানাচার লোকাচার নির্ভর।
কেউ কারো মতো নয়। প্রত্যেকের স্বাতন্ত্র্যবোধ আছে। আমি মতের ভিন্নতা মানি। খাদ্যাভ্যাসের ভিন্নতা মানি। তবে কখনো কখনো খাদ্যাভ্যাসই মূখ্য হয়ে ওঠে ধর্মমতের চেয়ে। তখন গোল বাঁধে। অপরের সাথে যোগায়নই যে আত্মতার বিকাশের পথ সেটি ভুলে গিয়ে ভূরিভোজনই প্রধান হয়ে ওঠে। রান্নাঘরই হয়ে ওঠে মনুষ্যজাতির ত্রাতা।
একবার তোমার বাসায় বেড়াতে গেলে আমার পাতে তুলে দিয়ে ছিলে বাইন মাছের কষানো ঝোল। দেখতে দারুণ লাগছিল। অথচ দেখো তোমার পিড়াপিড়িতে আমি কোন ভাবেই মুখে দিতে পারলাম না। উটকি দিয়ে বমি-টমি আসছিল। আমি জানি বাইন মাছ তোমার ফেবারিট খাবার। রান্নাও করো বেশ মজিয়ে। তোমার হাতের যশ বাইন মাছের কষানো ঝোল রেঁধেই। অথচ দেখো বাইন মাছের কথা ভাবলেই আমার কিলবিল করে হেঁটে চলা সাপের কথাই মনে হাজির হয়। খেতে পারি না। গা রি রি করে। এটি আমার ব্যক্তিগত খাদ্যাভ্যাসের বাইরে। আর তোমার ম্যনুতে এক নম্বর।
সে যাই হোক–কোচ বাড়িতে লাগোয়া বাঁশের ঘেরে ঘরোয়া শূকরের যত্নশীলতার প্রকার দেখলে তুমি সত্যি অবাক হয়ে যাবে। খগেনের বাড়িতে গিয়ে দেখেছি শূকর আর কোচদের সম্পর্কের রসায়ন কত গভীরে প্রোথিত। অথচ তোমার আমার ঘিনঘিন ভাব।
পালিত ঘরোয়া শূকরের চেয়ে কোচদের জংলী শূকরের প্রতি যে উদ্দামতা দেখেছি তা সত্যি অবাক করার মতো। উঠানে বাঁধা ঘরোয়া শূকর পায়ে পায়ে কিলকিল করছে। ঘুৎঘুৎ করছে উঠান জুড়ে। তারপরও জংলী শূকরের পেছনে ধাওয়া করে ধরা যেন পৌরুষতা। ব্যক্তি কোচের নয় শুধু গোষ্ঠী কোচের পৌরষত্ত্ব। পৌরাণিক পৌরষবোধ। অহংকার আর জেগে ওঠার জয়ী হবার স্মৃতি ও শ্রুতি বীর্ষবান হবার আকাঙ্ক্ষা।
সেলিম আল দীনের বনপাংশুলের রাজেন্দ্র মান্দাইয়ের কথা মনে আছে তোমার? দুজনেই এক সাথে পড়েছিলাম ক্যাম্পাসে। শৈলী পত্রিকায় সে সময় প্রকাশিত হয়েছিল। দারুণ উৎদীপ্ত হয়েছিলাম তখন। এখনে সেলিম আল দীন দারুণ ভাবে এঁকেছে রাজেন্দ্র মান্দাইকে। দরা খেয়ে পরাজিত মান্দাই রাজেন্দ্র নাচতে নাচতে দেহের ভাঁজ ভাঙতে ভাঙতে গাইছে,
শূকর মারিব
কলিজা ফাঁড়িব রন্ধন করিব।
হো হো হো।
শিব কুচনী সন্ধ্যামনির থানে
আমাগোরে আইজকা মানত গ।
রাজেন্দ্র দরায় বুদ হয়ে থাকে। স্মৃতি ও পৌরাণিকতা নিয়ে ঘোরের ভেতর থাকে। ক্রমেই বেহাত হওয়া বন জেগে ওঠে সত্তা জুড়ে। নেশায় নেশায় জংলী শূকর মারার নেশা জেগে ওঠে। তখন রাজেন্দ্র “…. বনভরা যত অন্ধকার স্থল সাঁই কইরা বল্লম ছুঁড়ে মারবে আর বলবে এই মারলাম একটা। এই মারলাম…মারলাম দুইটা”
আমি যতবারই আসি কোচপাড়ায় কোন শক্ত সম্মত যুবক দেখলেই, জানো আমার রাজেন্দ্র মান্দাইয়ের কথা মনে পড়ে। একদা এ তল্লাটের রাজা ছিল কোচ। এখন আর রাজা নেই, বীর্য নেই, প্রতাপ নেই; বিচ্ছিন্ন কৌমের মানুষজন; সমূলে উৎপাটিত এক জনজাতির নাম। আজো রয়ে গেছে রাজধানীর ধ্বংসাবশেষ—স্মৃতির তলানিতে আর ইতিহাসের টিকা টিপ্পনীতে।
যেবার আমি প্রথম আসি এই তল্লাটে। গত শতকের নয়ের শুরুতে। এক শীতের বিকেল বেলায়। ঘুরতে ঘুরতে ঝুপ করেই দেখতে দেখতে রোদ সরে গিয়ে সবুজের সাথে অন্ধকার মিশে গেল। ঘন ঝোপের উঁচু টিলা তিন পাশ দিয়ে হৈ হৈ রৈ রৈ করতে করতে বল্লম ফলা বড় বড় লাঠি নিয়ে দৌড়াচ্ছে এক দঙ্গল লোক। কোমরে গামছা। মালকোঁচা দিয়ে উন্মত্তের মতো দৌড়াচ্ছে। আমি আর সুমন্ত বর্মন অন্ধকারের ভেতর দাঁড়িয়ে শুধু মাটিতে ধুপধাপ শব্দ আর চিৎকার চেচামেচির ভেতর শুনছি এ দিকে… এ দিকে…ডানে বাঁয়ে… আর অন্য পাশে নাইলনের মোটা দড়ির জাল ঘিরে রেখেছে টিলার এই পাশটায় ঢালুর দিকে। ঝোপগুলো কালো ছোপের মত অন্ধকার চারদিকে। দলবদ্ধ হয়ে দৌড়াচ্ছে।
আমি আর সুমন্ত অন্ধকার বেষ্টনির দাঁড়িয়ে আছি হতবিহ্বল হয়ে। কানে তালা লাগানো ঝিঁঝির কান্না আর দূরে নাম না জানা রাতচরা পাখির স্বরের ভেতর সোরগোল সপ্তমে কাঁপিয়ে ওঠে সমস্বরে থেমে গেলো ‘পাইছি পাইছি’র স্বস্তির ভেতর। ঝিঁঝিও তখন চুপ।
টর্চ আর বাঁশের আগায় পেচানো কেরোসিন ন্যাকড়ায় লাগানো উচ্চকিত আলোয় ভিড়ের মাঝে দেখলাম দশাসই এক জংলী শূকর জাল পেঁচিয়ে আছে কাৎ হয়ে। বুকের এপাশে ওপাশে গোটা তিনেক বল্লম এফোঁড়ওফোঁড় হয়ে গেধে আছে মাটিতে। বোঙ্গার আগুনে দেখলাম রক্ত পড়ছে জংলীর শরীর থেকে টুপটাপ করে মাটিতে বল্লমের গা বেয়ে। হাঁপাচ্ছে। হাঁপাচ্ছে। বুকের পাশটি উঠানামা করছে আর ক্রমেই মিয়িয়ে আসছে ছোট্ট কুচকুচে কালো চোখের পাপড়ি।
সেইবার-ই আমার প্রথম জংগী শূকর দেখা। দাঁতাল বরাহ দেখা। রক্তেমাখা কালো শরীর ভিজে জুবুথুবু। নাইলনের দড়িতে সামনের পেছনের পা বেঁধে আড়াআড়ি বাঁশ ঢুকিয়ে বীরের উল্লাস করতে করতে কাঁধে নিয়ে চলল অন্ধকার ফুঁড়ে। জোনাক জ্বলা অন্ধকার আরো অন্ধকার ফুঁড়ে বোঙ্গার আগুন পতপত করে বাঁশের আগায় জ্বলতে জ্বলতে পথ করে দিচ্ছে;পথ চিনিয়ে দিচ্ছে ।
সবাই বাঁশে ঝুলানো শূকর কাঁধে নিতে চাচ্ছে। তাই নিয়ে হট্টগোল। কর্তাগিরি জাহির করার হিড়িক। বিজয়ের উল্লাস। স্মৃতি ও পুরানের বীর্যের উল্লাস। বোঙ্গার আলোয় অন্ধকারে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে আমাদের।সামনে নিহত বরাহ। পিছনে পিছনে বিজয়ী সৈনিকের মিছিলে আমি আর সুমন্ত বর্মন। আমরা হাঁটছি কী– বলতে পারি দৌড়াচ্ছি কোচ পাড়ায় আমার মেজবানের নিকানো উঠানের দিকে।
সেকি উল্লাস! স্মৃতি ও শ্রুতির জেগে ওঠার উল্লাস। পুরাণ কথকতার দুয়ার খোলার উল্লাস। হাতের পেশি ঘাঢ়ের পেশি শক্ত বীর্যবান হবার উল্লাস। শব্দে শব্দে সেই উল্লাসের উত্তাপ গাঁথা যাবে না। সে উত্তাপ অন্ধকারে কোচদের সাথে আমাকে জারিত করেছিল।
তারপর দীর্ঘ প্রতীক্ষ। খোল মন্দিরার তালে তালে নেচে ছিল কোচপাড়া। আবছা আবছা আলো। আকাশে কালো কালো দাগ। একপোছ আলো আর একপোছ কালো রাতে গোল হয়ে সবার সাথে সবুজ কালপাতায় যখন ভুঁড়ি ভোজন যখন শেষ হয় চাঁদ তখন অনেকাংশে ঢলে পড়ছে আলো আর কালো বিলাতে বিলাতে।
চিঠির অক্ষরগুলো পড়তে পড়তে নিশ্চয়ই তুমি উগরে দেবে না ঘৃণা। খাদ্যাভ্যাসের ভিন্নতা মত ও পথের মতোই ভিন্নতা। আমাদেরই পড়শি কোচ গারো বর্মণ জনগোষ্ঠী। আমাদের ভালো মন্দ দিয়েই ওদের দাগিয়ে দিচ্ছি নানা অপবাদে। আলাদা আলাদ কৌমের আলাদা আলাদা খাদ্যাভ্যাস। রন্ধনপ্রণালী। আর তুমি তো জানই প্রতিটি রান্নার সাথে শুধু স্বাদ আর সাধ থাকে না– থাকে নানা গল্প নানা স্মৃতি নানা শ্রুতি; থাকে নানা আঞ্চলিক জন্মদাগ–শুধু চোখের দেখার ভেতর সবকিছু এঁকো না বরং দেখার চোখকে উন্মোচিত করো।
আজ আর না। ভালো থেকো।”
গারো পাহাড়ের চিঠি : এক
সূত্র: শুল্কপক্ষ।