গোপন নায়ক পর্ব-১০
মেয়েটা জানালো যে, “এই তো সামনেই আমাদের বাসা। এই যে সামনে মোড় দেখছেন, তার ডান দিকে কয়েক বাসার পরেই আমাদের বাসা। আসলে, আমরা এখানে ভাড়া থাকি। আব্বুর কর্মস্থল এই সদরেই। আর আমি ফুপ্পির বাসায় বেড়াতে গিয়েছিলাম। আসার সময় গাড়ির সমস্যা হওয়াতে ফিরতে কিছুটা দেরি হয়ে গেলো।” “তাহলে নিশ্চয় তোমার আম্মু- আব্বু খুব চিন্তায় আছেন?” মুখটা মলিন করে আমাকে জানালো যে, “তা কি আর বলতে হয়! দুঃখের বিষয় আমার মোবাইলেও চার্জ নেই। তাই চিন্তাটা আরো বেশি!”
আমি বীরের মত অভয় দিলাম, “সমস্যা নেই! এসেই তো পড়েছো। তাছাড়া আমি তো এখন সাথে আছি। তোমাকে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসবো। যদিও ঐ মোড় থেকে বামের রাস্তাটা আমার গন্তব্য।” দেখলাম, আমার কথা শুনে মেয়েটা যারপরনাই খুশি হলো! আমিও খুশি হলাম! যাক, একটা বিপদে পড়া মেয়েকে একটু হলেও সাহায্য করতে পারছি। অন্যান্য টুকটাক কথা বলতে বলতে দুই রাস্তার মোড়ে এসে পড়লাম।
জানা কথা যে, আমার গন্তব্য বাম দিকে আর মেয়েটার ডান দিকে। কি আর করার। চার-পাঁচ মিনিট দেরি করে মেয়েটাকে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে আসলে আমার আর তেমন কিছু আসে যাবে না। জীবনে কত সময় অকাজে কত ভাবে ব্যয় করলাম। আর এটাতো উপকারের জন্যই করছি! এতক্ষণ পর্যন্ত ভালোই ছিলাম। কিন্তু মোড়ে এসে দেখি, আমার মত বয়সি আধুনিক চাইপের চুল স্টাইলিশ পাঁচজন ছেলে।
আমাদের দেখেই তারা রাস্তার দুপাশে দুজন-তিনজন করে একটা পজিশন নিয়ে দাড়ালো। বিষয়টা কিছুটা আঁচ করতে পারলাম। তবে যেন আমার আন্দাজটা মিথ্যে হয়। এটাই আপাদত চাওয়া। নইলে আমি ফেঁসে যেতে পারি। ক্রমেই কাছে আসছি আর ছেলেগুলো ক্রমেই অধিক থেকে অধিকতর বিকৃত ভাবে আমার দিকে এক পলকে তাকিয়ে আছে। বিষয়টা রহস্যজনক! তবে একটা ছেলেকে বেশিই রাগান্বিত মনে হচ্ছে! মেয়েটার দিকে আড় চোখে তাকালাম। দেখলাম, ঘৃণিত ভাবে শুধু ঐ বেশি রাগান্বিত ছেলেটার দিকে বার বার আড় চোখে সেও তাকাচ্ছে! একটা প্রতিশোধ নেয়ার মত অভিব্যক্তির প্রকাশ আন্দাজ করতে পেলাম।
আমি বার বার বলে থাকি। আমি ততটা বোকা ছেলে নই! তার মানে হলো, আমি এখানে চমৎকার মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার হচ্ছি! উত্তম কথা, বলির পাঠা! ছেলেগুলোর একেবারে কাছে আসতেই মেয়েটা আমাকে উদ্দেশ্য করে বলে উঠলো, “ভাইয়া, আপনি সত্যিই অনেক ভালো! আপনি আমার খুব বড় একটা উপকার করলেন! ভাইয়া, আপনি না থাকলে আজকে আমার কি যে হত। অবশেষে আমার দিনটা ভালোই ভালোই পার করলাম। তাইনা ভাইয়া?”
এমন কথা শুনে আমি তো একেবারে থ খেয়ে গেলাম! মেয়েটার বুদ্ধির তারিফ করতে হয়। নিজেকে বাঁচানোর যত সব কৌশল। নইলে ছেলেগুলোকে শুনিয়ে শুনিয়ে এভাবে জোরে জোরে বার বার ভাইয়া ভাইয়া বলার কারণ কি? আমার তো লজ্জা করছিলো তখন! অনেকটা বিব্রতকর পরিস্থিতি! আর কিছু বুঝার বাকি রইলো না। এত বুদ্ধিমান হওয়ার পরও মাঝে মাঝে কিছু মানুষ এভাবেই আমাকে ব্যবহার করে গেলো। তারপরও কষ্ট করে মুখে হাসিটা ধরে রাখলাম। মুচকি হাসিতে বললাম, “সঠিক বলেছো।” তারপর মোড় থেকে ডান দিকের পথ ধরে তার বাসার গেইটের সামনে চলে এলাম।
মেয়েটা আমাকে ইচ্ছেমত ধন্যবাদ জানালো! অর্থাৎ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করার জন্য মুখে যা যা বলার দরকার সব বললো! কিন্তু বাসার সামনে আসার পরও একবারও বাসার ভিতরে যেতে বললো না! আর আমি তেমন ছেলেও ছিলাম না যে, অপরিচিত কারো বাসায় প্রথম বারেই যাবো! মেসে ফিরতে হবে। মনটা ভালো যাচ্ছে না। দেখলাম, মোড়ে ছেলেগুলোকে দেখা যাচ্ছে না। সাহস পেলাম। নইলে হয়ত বা জবাবদিহি করতে হতে পারে। শহরের ছেলেদের একদম বিশ্বাস নেই। বাপের টাকা থাকলে আর রাজনৈতিক প্রভাব থাকলে এইসব ছেলেরা অসম্ভবকেও সম্ভব করতে পারে!
ওহ্! একটা ভুল হয়ে গেছে। অপরিচিতার নামটা তো জানা হলো না! না কোন মোবাইল নাম্বার! যাক গে। বিপদে পড়েছে বলে সুযোগ নিতে নেই। উপকার করেছি সেটাই বড় কথা! মোড় পাড় হয়ে বামের গলির পথ ধরেছি। তার মানে ছেলেগুলো চলে গেছে। যেমনটা ভেবেছি তেমনটা হয়নি। তাহলে আমার অনুমান নির্ভর অভিজ্ঞতায় ভুল আছে! ভাবতে না ভাবতেই হঠাৎ সামনে গেটের ওপাশে অনেকগুলো পায়ের আওয়াজ শুনতে পেলাম। আর মুহুর্তেই ছেলেগুলো গেইট পেরিয়ে আমাকে ঘিরে ধরলো! কিছুই বুঝে উঠতে পারলাম না।
সামনে থেকে একজন বলে উঠলো, “কি ভাইজান, ভালো আছেন? কিছু মনে নিয়েন না। একটু দাড়ান। আপনার সাথে দুই মিনিট কথা আছে!” এদিকে আমার বুকটা ধপধপ শুরু করে দিলো! আসন্ন বিপদের আভাসটা ঠিকই বুঝতে পারলা। তবুও স্বাভাবিক ভাবে নরম গলায় বললাম, সমস্যা থাকবে কেন! বলুন না! আরেকজন বলে উঠলো “মেয়েটা আপনার কি হয়? তার সাথে কতদিন ধরে এসব চলছে?” আমি নিরীহের মত এক গাল হেসে দিয়ে বললাম, “এসব কি বলছেন? এই তো! এই গলি দিয়ে আসার সময় আমাদের প্রথম দেখা! সত্যি করে বলছি। এর আগে ঐ মেয়ের সাথে আমার কখনো দেখা বা কথাও হয়নি!”
পেছন থেকে চড়া গলায় আরেকজন ধমক দিয়ে বললো, “ফাজলামি করেন মিয়া? আমাদের সাথে মিথ্যে কথা। মেয়েটাই তো বললো যে, তার দিনটা আজকে ভালো কেটেছে! তা কি একা একা ভালো দিন কাটে? নিশ্চয় আপনিও সাথে ছিলেন!” আমি আকাশ থেকে পড়লাম! আমি তাহলে ভালো ভাবেই ফাঁদে আটকে গেছি! তবুও আগের বারের মতই শান্ত ভাবে বললাম, “না ভাই, বিশ্বাস করেন, মেয়েটা তার আত্মীয়র বাসায় গিয়েছিলো। সে কথায় আমাকে বলছিলো!” মনে হয় আমার কথাটা তাদের কারোরই মনঃপূত হলো না! দেখলাম, রাগে একেকটা জ্বলতেছে। তাদের মধ্যে থেকে একজন বলে উঠলো, “এভাবে কাজ হবে না। কেউ এসে গেলে কাজের কাজ কিছুই হবে না। অ্যাকশনে যেতে হবে!” সবাই দেখলাম তাতে শায় জানালো।
মুহুর্তেই একজন এসে আমার শার্টের কলার ধরে ফেললো! বলে উঠলো, “সত্যি করে বল্, মেয়েটার সাথে তোর কতদিন ধরে প্রেম চলছে? নইলে তোর হাড়গুড় সব গুড়া করে দিবো এখনি!” এমন ব্যবহারে আমি জীবনের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি অপমানিত হলাম। এই প্রথম জীবনে কেউ আমার শার্টের কলার ধরলো! শক্তি আমারও ছিলো। আমিও এই পাঁচজন হালকা পাতলা ছেলেদের থেকেও কম নই। মনটা চাইছিলো যে, এখনি ধরে মাথায় তুলে ইচ্ছেমত আছাড় দিতে থাকি! তারপরও ঝামেলাই যাওয়াটা ভালো মনে করলাম না।
শান্ত ভাবেই বললাম, “সত্যি বলছি ভাই। আমি মেয়েটাকে চিনিই না! এমনকি তার নামটা পর্যন্ত জানি না!” আরেক ছেলে লাফ দিয়ে এগিয়ে এসে বললো, “তুই তো আমাদের ভালোই বোকা পাইছিস!” বলেই আমার বাম গালে সজোড়ে একটা চড় বসিয়ে দিলো! ঠাস করে একটা শব্দ হলো! কিন্তু তার থেকেও ব্যথাটাই বেশি পেলাম! ছোট বেলা পড়া না পাওয়ার কারণে ভাইদের হাতে বাম-ডান দু’গালে অগণিত চড় খেয়েছিলাম। আজ এত বছর ধরে নিরাপদে আগলে রাখা গালটায় আবার চড় খেলাম। কিছুক্ষণের জন্য দম বন্ধ হয়ে আসছিলো। এদিকে শরীরের রক্ত টগবগ করে উঠলো। মাথায় মারামারি করার চরম নেশা জেগে উঠলো!
ধারাবাহিক পর্ব: এক, দুই, তিন, চার, পাঁচ, ছয়, সাত, আট, নয়, দশ..