Our Sherpur

ব্রহ্মপুত্র পাড়ের ওসমান আলীরা, পর্ব-২

ওসমান ভাইয়ের অগোচরে প্রতিবেশীরা ওদিকে ঘরের বেড়া কেটে সরাচ্ছে। তা ছাড়া যে কোন উপায় নেই। শেষ রক্ষা হবেনা ভেবেই একাজ করা হচ্ছে। সকলের মনে এই ভয়ও  আছে ওসমান ভাই জানতে পারলে বাধা না দিয়ে ছাড়বেনা। তবু কাজ চলছে পুরো উদ্যমের সাথে। রাত্রির অন্ধকার কেটে আলোর আভা ফুটে উঠেছে। নদের ওপারে শহর হতে মাইকে ফজরের আজানের ধ্বনি ভেসে আসছে। আজান শুনে ওসমান ভাই অজু করলেন। নামাজ পড়তে যাবেন এসময় স্ব শব্দে হুহু করে কেঁদে উঠলেন।ওসমান ভাইয়ের এ কান্না অনেকেই বুঝে উঠতে পারলেন – অনেকেই বুঝলেননা। ওসমান ভাইদের বাড়ির উত্তর পশ্চিম পাশেই মসজিদ ছিলো। সেই ছোট হতেই ঐ মসজিদে নামাজ পড়তে যেতেন দাদার হাত ধরে। গ্রামটি পরিপুর্ণ ছিল বাড়ি ঘরে। লোকে লোকারন্য গ্রামের
মাঝখানে ছিল মসজিদটি। প্রতিটি কাতার পুর্ণ হত মুসুল্লিতে। শুক্রবারে মসজিদের বাইরেও কাতার করা হত। শবই মেরাজ, শবই বরাত, তারাবীহ এবং লাইলাতুল কদর এসব রাত্রিতে মুসুল্লিদের স্বতঃ স্ফুর্ত উপস্থিতি নামাজ পড়া আর মিষ্টি বিতরনের ধুম পড়ে যেত। কি যে আনন্দ ছিল সে সময়। আর আজ ফজরের নামাজ পড়ার জন্য অজু করে কাদছেন আর ভাবছেন কোথায় যাবেন নামাজ পড়তে। মসজিদটিও যে ভেংগে নিয়ে গেছে নদের করাল স্রোত। ওসমান ভাইয়ের কান্নার শেষ নেই। অনেকেই বুঝাতে চেষ্টা করছে কিন্তু ওসমান ভাই কান্না থামাতে পারছেনা। ওসমান ভাই আহাজারি করে বলছে – গ্রামটা চুরমার করে দিল নদে, কি অপরাধ ছিল আমাদের। কি পাপই বা করে ছিলাম আমরা? আজ নামাজ পড়ার মসজিদটাও নাই। এই বয়সে আর কিইবা দেখার বাকি থাকলো? ঘর হারা হতে দেখলাম- আশেক, খোকা , লেবু, আইবেলী সহ অনেককেই। নীঢ়ারা হলো কত পাখির ঝাঁক, হারিয়ে গেলো রোজিনার স্বামী আর কত – আর কত দেখাবে নদের বেটা নদ। শেষতক লালুটাকেও নিয়ে নিলি। দুহাতের তালুতে চোখ মুছে চাটাই বিছিয়ে নামাজে মত্ত হলেন ওসমান ভাই। নামাজে দাঁড়িয়ে সবাইকে বাড়িঘর ভাংগার সুযোগ করে দিলেন তিনি।  এই সুযোগে দ্রুত কাজ করে যাচ্ছে সবাই। ঘরের বাড়া কাটতে দেখে খুপরির কবুতর গুলো পাখ ঝাড়া দিয়ে বের হয়ে পড়ল। এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল কবুতর গুলো। বাড়ির চার পাশের গাছপালা গুলো নেই। চারদিকেই শুন্য। একপাশে নদের হুংকার, পাড় ধ্বসে পড়ার দ্রূশ্য। অনবরত ধ্বসে পড়ছে আর পড়ছেই এ যেন মহা প্রলয়ের এক ঘনঘটা। কবুতর গুলো শংকিত মনে পাখা নেড়ে উড়ে এল রশিদ চাচার বাড়ি। ওরাও এখন বুঝে গেছে  এ বাড়িটাই সকলের আশ্রয়স্থল। ক্লাশ এইটে পড়া ছেলেটি দৌড়ে এল কবুতর গুলোর সাথে। রশিদ চাচার উঠানে দাঁড়িয়ে আয় আয় করে ডাক দিল আর ওমনি কবুতর গুলো নেমে এলো তার পায়ের কাছে।

প্রতিদিন খাবার দেয় আজো খাবারের আশায় কবুতর গুলো নামলেও আজ এই মুহুর্তে খাবার না দিতে পেরে মনে মনে ক্ষমা চেয়ে নিল ছেলেটি। কবুতর গুলোও তার অক্ষমতা বুঝতে পেরে আবার উড়ে বসলো রশিদ চাচার চালে। গরুগুলো নিস্পলক চেয়ে আছে ওবাড়ির দিকে। চেয়ে চেয়ে দেখছে ওসমান ভাইয়ের নামাজ পড়ার দূশ্য। হয়তো ভাবছে তাদের শেষ গন্তব্যের কথা। রাতে ঘুম ছিলনা তাই সকলের ছোখেই ঘুমঘুম ভাব। ছলছল করছে সকলের চোখ। আর ছলছল চোখ গুলো খুঝে বেড়াচ্ছে শেষ আশ্রয় স্থল। শিশুগুলোও বুদ্ধিমান হয়ে উঠেছে – খাবারের জন্য কোন কৈফিয়ত নেই, নেই কোন কান্না। বুকের দুধ খাওয়ার আগ্রহ নেই। তাই মায়েরা যারযার ঘরের আসবাব সামানা সরানোর কাজে ব্যাস্ত। তাড়াতাড়ি সরাতে না পারলে এগুলোর শেষ রক্ষা হবেনা। আর তাই বাচ্চা ফেলে যারযার কাজ করে যাচ্চে মায়েরা। ওসমান ভাই নামাজ পড়া শেষ করেছেন। বাড়ির পোষা বিড়ালটা ওসমান ভাইয়ের কুল ঘেসে বসলো। বিড়াল্টাকে কুলে তুলে নিয়ে নদের ঢেউয়ের মতই বাধভাংগা কান্নায় পশ্চিম পাশের করাল গ্রাসী নদটাকে দেখিয়ে বললেন- ওবেটা তোর ঠিকানাটাও কেড়ে নিতে চায়। তুইতো অবলা তোরতো কোন পাপ নেই- তোর প্রতি ওর শত্রুতা কিসের? কষ্ট নিসনা ভাই আমরা যেখানে যাব তোকেও সেখানে নিয়ে যাব। তোকে ফেলে যাবনা। তুইযে আমাদের অতি আপন। কতদিন থেকে আমাদের সাথে আছিস- না না তোকে ফেলে যাব কেন ? ভয় নেই আমরা যা খাব তোকেও তাই খাওয়াবো। তুই কাদিস্না ভাই-বলেই ওসমান ভাই আবার কেদে উথে। ওসমান ভাইয়ের আকুতির শেষ নেই। নামাজের মোনাযাত করার আগে বাড়ির পাশের গোরস্থানের দিকে একবার তাকালেন। মন্থর পায়ে এগিয়ে গেলেন তারপর দোয়া দরুধ পড়ে মোনাযাত করলেন। মৃত রুহের মাগফেরাত কামনা করলেন। মনে মনে আওড়াতে লাগলেন – তুমি নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। সর্বনাশা নদ তোমাকে বিলিন না করে নিলে তোমার ভবিষ্যত প্রজন্মেরা তোমার নিশানা দেখে তোমার বুকে লুকিয়ে থাকা রুহের জন্য মোনাযাত করত। কিন্তু যেখানে তোমার অস্তিত্তই বিলিন হয়ে যাবে কে করবে তোমাতে লুকিয়ে থাকা রুহের মাগফেরাত কামনায়। তোমাকে লালন করতে হবে আমাদের অন্তরে। ওসমান ভাইয়ের বাড়িঘরের দিকে কোন খেয়াল নাই। ঘরগুলো যে যার মত ভেংগে সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ওসমান ভাই আর তাড়াও করছেনা বকাবকিও করছেনা। ঠায় দাঁড়িয়ে আছে গোরস্থানের কাছে। গামছায় চোখ মুচছে বারবার। আবারো পাড় ধবসার শব্দ হলো। ওসমান ভাইয়ের কলজে যেন কেপে উঠলো। ওসমান ভাই কাঁপা গলায় ডেকে বললেন – এই তোরা এদিকে আয়, সকলে মিলে গোরস্থানটাকে সরিয়ে নিয়ে যাই। তাড়াতাড়ি আয় তানাহলে গোরস্থানটা ভেসে যাবে। দাদার কবরটাও ভেসে যাবে আর বাপেরটাও- আয় আয় তাড়াতাড়ি আয়। কিন্তু কেউ আসেনা, ওসমান ভাইয়ের ডাকে
কেও সাড়া দেয়না। ওসমান ভাইয়ের কথায় সকলের চোখে পানি আসে। দাদার কবরের উপর লালগোলাপ গাছে দুটি লাল গোলাপ ফুটে উঠেছে। কি সুন্দর টকটক করছে ফুল দুটি। অল্পক্ষণ পরেই হয়তো নদের বক্ষে মিশে যাবে এরাও। হয়তো ভেসে যাবে দিকদিগন্তে কোন অজানায়। ভাটির মানুষেরা নাগালে পেলে কুড়িয়ে নিবে। নয়তো আপনা আপনি পচে যাবে নদের পানিতে। কতক্ষণ তাকিয়ে থেকে ফুল দুটিতে দাদা আর বাবাকে আবিষ্কার করে নিল ওসমান ভাই। ফুলদুটি তুলে এনে সবাইকে ডেকে বললো – নিয়ে যাক সব ভেংগে তছনছ করে নিয়ে যাক। চুরমার হয়ে যাক সব। তোরা দেখে যা- দাদা আর বাবাকে খুজে পেয়েছি। এই দেখ – এটা
আমার দাদা আর এটা আমার বাবা। এই দুটিই দাদা আর বাবার অস্তিত্ত। এখন যেখানেই যাই, যেখানেই থাকি, যেভাবেই থাকি দাদা আর বাবাকে দোয়া করতে বাদা রইলনা। এই দুটিকে আবার দাফন করে গোরস্থান বানাবো। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ
পড়ে দোয়া করবো। এবার এমন এক জায়গায় যেতে হবে যেখানে নদ বেটার আর কুনজর
যেন না পড়ে। যেখানে থাকবেনা বেটা নদের উম্মত্ততা। যেখানে পারবেনা হানা দিতে। কিন্তু পরক্ষণেই মনে আঁক কাটে কোথায় যাবে এরা, কি করবে? সবি তো শেষ করে দিলো, সবি তো শেষ, শেষ সম্বল টুকুও শেষ। যেখানে নিজের মাথা গুজার ঠাই নেই সেখানে আবার গোরস্থান। ওসমান ভাই সত্যিই যেন পাগল হয়ে গেছে। আল্লাহর এই দুনিয়ায় জায়গার অভাব আছে নাকি? যদিও বৈরিতা আর হেয় প্রতিপন্ন করা মানুষের স্বভাব – তবু আল্লাহ কাউকে না খাইয়ে মারেননা। ততক্ষনেও বিড়াল্টি ওসমান ভাইয়ের পিচু ছাড়েনি। লালু থাকলেও পিচু ছাড়তোনা। বিড়ালটির দিকে তাকিয়ে আনমনেই লালুকে ডেকে উঠলো ওসমান ভাই। লালু ডাকে সাড়া দিলনা কিন্তু শাবান ওসমান ভাইয়ের ডাকে সাড়া দিলো। ওসমান ভাই
শাবানের দিকে এগিয়ে এলেন। দেখলেন শাবানের চোখ দিয়ে নিধরে পানি ঝড়ছে। ওসমান ভাই তার চোখ মুছে দিলেন –বললেন তোর চিন্তা কিশের আমাদের সাথেই থাকবি। আমাদের সাথেই খাবি আমাদের সাথেই ঘুমাবি। অশান্ত মনে এই এক শান্তনার বাণী আরকি। ওদিকের ঘরগুলো সবাই সরিয়ে নিয়ে গেছেন। আর নদটাও যেন আরো বেশি করে ভেংগে নিয়ে যাচ্ছে। সারারাতের ঘুম কামাই আর পরিশ্রমে সবাই যখন ক্ষুধার্ত –তখন শিরিনা চাচী ওদেরকে কিছু মুখে দেবার জন্য ডাকলেন। কেও বেচে থাকার তাগিদে সামান্য মুখে দিল।  কেও আবার কিছুই মুখে দিলনা। আর ওসমান ভাইয়ের কথা হল লালু, শাবান, তুফান এদের অভুক্ত রেখে তার খাওয়া হবেনা। শাবান আর তুফান থাকলেও লালু যে নেই এ সহজ কথাটা ওসমান ভাইকে কে বোঝাবে। আরেকবার দেখা হল রোজিনার সাথে। ওসমান ভাই বললেন- রোজিনা তোরও পোড়াকপাল আর আমারও। তোর সংসারে উপার্জণকারী নেই আর আমার সব শেষ। এখন কি করব না পারব অন্যের জমিতে কামলা দিতে না পারব শহরে গিয়ে রিক্সা চালাতে। আমি
পুরুষ হয়েও যে তোর মত হয়ে গেলাম। তোরও যেমন অস্তিত্তের লড়াই আমারো তাই।
আমি পাগল হয়ে যাবরে আমি পাগল হয়ে যাব।
নদের ভাংগনে কবলিত হয়ে এপারের অনেক লোক ওপারের জেগে উঠা চরে বাড়ি বানিয়েছে। তাই ওপারের লোকেরা নৌকা, ট্রলার নিয়ে এসে ঘরের চাল, খুটি, বেড়া, প্রয়োজনীয় জিনিস পত্রাদি তুলে নিয়ে যাচ্ছে। এপারে যখিন থাকায় যাবেনা অপারে যাওয়া ছাড়া আর গতি কি? সকলেই ওপারে যাওয়ার প্রস্তুতি নিতে লাগলো কেবল ওসমান ভাই ছাড়া। সে ওপারে যেতে রাজি নয় তবু যেতে হবে। বাপ দাদার  কবরে হাটু গেড়ে বসে হাউমাউ করে কাদলো কতক্ষণ। তারপর সবাইকে ডেকে শেষ দোয়া করতে চাইলো। সবাই প্রস্তুতি নিয়ে মা, বাবা, পাড়া প্রতিবেশি, আত্মীয় স্বজন সকলের জন্য দোয়া করলেন। এপারের সকলের কাছে বলে গেলেন আমি আমার দাদা আর বাবাকে নিয়ে গেলাম। তাদের জন্য তোমরা দোয়া করিও। তারা আমার কাছেই থাকবে আজীবন। এই বলে তাজা গোলাপ দুটি সকলকে  দেখালেন। সকলেই
ওসমান ভাইকে প্রলাপ বকতে দেখে কাঁদলেন। অশ্রু ঝরে পড়লো সকলের চোখ হতে। ওসমান ভাই তবু যেতে রাজী নয়- যখন দেখলেন শাবান, তুফানকে নৌকায়  তুলা হয়েছে আর শাবান হুংকার দিয়ে ওসমান ভাইয়ের দূষ্টি আকর্ষন করছে  তখন তিনি মন্থর গতিতে নগ্ন পায়ে নৌকায়  উঠলেন। নৌকা ওপারের উদ্যেশে চলতে শুরু করলো আর ওসমান ভাই নিস্পলক তাকিয়ে থাকলেন বাপ দাদার ভিটে আর গোরস্থানের
দিকে।

প্রথম পর্ব

লেখকঃ আশরাফ আলী চারু

Leave a Reply

Scroll to Top