লেখকঃ সাগর আহমেদ
দিন-রাতকে কখনো বেঁধে রাখা যায় না। তাদের মধ্যেও যাওয়ার এবং আবার নতুন করে ফিরে আসার প্রতিযোগিতা চলে! আজ আমার “বিশেষ মানুষটা” প্রায় কয়েক মাস পর আমার সাথে দেখা করার জন্য কলেজে আসতেছে। রাতেই করে বলে রেখেছিলো। যতই ব্যস্ততা থাকুক, তাঁকে যথেষ্ট সময় দিতে হবে! কতদিন ধরে দেখে না, তাই তাঁর মনটা নাকি কেমন কেমন করতেছে। তাছাড়া হোটেলে গিয়ে দুজনে এক সাথে হালকা কিছু খাওয়া দাওয়া তো আছেই।
সবার বেলা পকেটের টাকা খরচ করতে মহব্বত লাগে! কিন্তু সব ছেলেদেরই তাদের প্রেমিকার জন্য এতশত টাকা খরচ করতেও কাগজের পাতার মত মনে হয়! নির্দয়ের মতও খরচ করতে পারে ভিখারীরাও। অর্থাৎ আমাদের মত মানুষেরা। কিন্তু কি করবো বলো, টাকা থাকলে তো খরচ করবো! গ্রামের স্কুলে যখন পড়তাম, পকেটে বিশ টাকা থাকলে এক সপ্তাহ পর পকেটে হাত দিলে বিশ টাকাই পেতাম! আর পঞ্চাশ টাকা হলে তো পুরো মাসটাই চলে যেত রাজার হালে! অন্যদিকে শহরে চলতে গেলে উঠতে বইতে শুধু টাকার দরকার।
কৃপনতার অভ্যাসটা আজো ধারণ করে চলেছি স্বগৌরবে। বিশ্বাস করো, যখন হাতে যথেষ্ট টাকা থাকে তখন খরচ করা বা দান করা বলো, আমাকেই খুঁজে পাবে সবার আগে। মানে, পরিস্থিতি বুঝে পদক্ষেপ! এত কিছু বলার পেছনের কারণ হলো, আমার হাতে টাকা নাই। চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার মনে হয় যতটা সম্ভব, এই চিন্তাটা দুঃখের কোন নিকট আত্মীয় হবে! দুঃখ যেখানে চিন্তাও সেখানে। এই চিন্তাকে দেশ থেকে বিতারিত করার জন্য যদি যুদ্ধেও যাওয়া লাগতো, তবে যে করেই হোক সেই দলের আমি সেনাপতি হতাম! সৃষ্টির শুরু থেকে এটা মানুষের শুধু ক্ষতিই করে আসছে।
বেলা এগারোটাই তাঁর সাথে আমার কলেজে দেখা হলো। তাঁকে অবশ্য কলেজে প্রায় এক ঘন্টা দাড় করিয়ে রেখেছিলাম। কল করে বলেছি, কষ্ট করে একটু অপেক্ষা করো, জরুরী এক কাজে স্যারের সাথে বের হয়েছি। আসলে পুরোটাই সাজানো ঘটনা! আমি মেসেই ছিলাম। প্রেমে পড়লে আর প্রেম করলে বাধ্য হয়ে যে কখনো কখনো মিথ্যে বলতে হয়, সকল ভুক্ত ভোগীরাই ভালো করে তা জানে। “সে” আসলে ফোনে কথা বলার সময় আমাকে মাঝে মাঝে ধমক পর্যন্ত দেয়। শাসনও করে বটে! তবে আমার সামনে এলে সম্পূর্ণ তার বিপরীত দিক দেখা যায়! এমন শান্ত আর অবুঝ হয়, যেন কিছুই বুঝে না! কলেজে এরকম পরিচিত জায়গা আর বন্ধু-বান্ধবের সামনে কথা বলার কি আর পরিবেশ আছে? তাই তাঁকে সাথে নিয়ে কাছেই এক জমিদার বাড়িতে চললাম। “সে” অন্যান্য মেয়েদের তুলনায় অনেক ভদ্র আর মার্জিত। অতি বিশেষ কারণ ছাড়া আমার সামনেও হিজাবে ঢাকা মুখটা বের করতে চায় না। আমিই অবশ্য প্রথম দিকে তাঁকে ধর্মের নীতিবাক্য গুলো শুনিয়েছিলাম। এখন সে প্রায় প্রতিদিন পবিত্র ধর্মগ্রন্থ পড়ে আর স্রষ্টার প্রার্থনাও করে। এ কারণে আজকাল আমাকেও মাঝে মাঝে তাজমহল দর্শন থেকে বঞ্চিত হতে হয়! প্রেমিকার মুখটা দেখাও কিন্তু তাজমহল দর্শন থেকেও কম নয়! বেলা অনেকটা এরই মধ্যে পাড় হয়ে গেছে। পেটে ক্ষুধার জ্বালা টের পাচ্ছিলাম। জানি, তাঁরও একই অবস্থা। তাঁর বাসে করে বাড়ি ফিরতে দেড় ঘন্টা অন্তত লাগে। আমি খাই আর না খাই, মানবতা আর ভালোবাসার খাঁতিরে তাঁকে তো খাওয়ায়ে দিতেই হবে! বললাম, “চলো হোটেলে গিয়ে খাবে। তারপর বাসে উঠিয়ে দিবো চলে যেও। “সে” নরম গলায় আস্তে করে বললো, “না থাক। তার কি দরকার।” আমি বললাম, “হুম, দরকার আছে না নাই, সেটা মানুষের মুখ দেখলেই বুঝা যায়!” “সে” একটা মুচকি হাসি দিলো। আমার মনে হলো, আমার মত অভাবীর পকেটে থাকা পাঁচশো টাকার চকচকে নোটের সমান মূল্যবান তাঁর সেই হাসিটা।
হোটেলে গিয়ে নিয়ন্ত্রিত আর আলাদা বসার জায়গায় দুজনে বসলাম। আমি এতটা খারাপ ছেলে নই আর ছিলামও না! সে কারণে, আমি টেবিলের এপাশে বসলাম, আর তাঁকে বললাম ওপাশে বসতে। সে অবশ্য বলছিলো, তাঁকে একবার যেন খাইয়ে দেই! আমি তাঁর চোখের দিকে তাকিয়ে বললাম, “থাক না এখন, বিয়ের পর শতবার খাইয়ে দিবো। সে সময়ের জন্য কিছু তুলে রাখো না!! বিয়ের কথা শুনে “সে” লজ্জার সাগরে ডুবে গেলো। এটা আসলে সব মেয়েদেরই সাধারণ বৈশিষ্ট্য।
আমি আমার গ্রামের মানুষদের কাছে খুব ভদ্র ছেলে বলেই পরিচিত। এবং এই কথাটা “তাঁকেও” বুঝাতে যথেষ্ট সক্ষম হয়েছি। তাই আমি যখন যা বলি সে বিশ্বাস করে, শুধু একটা বিষয় ছাড়া! সেটা সন্দেহ। আমি জানি আমার পকেটে মাত্র বিশ টাকা আছে! হোটেলে দুজনের খাওয়ার বিল কম করে হলেও একশোর উপরে হবে। তাছাড়া ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও আমি অল্প করে খেয়েছি। যাতে বিল বেশি না হয়ে যায়! আর “ওকে” বলেছি “তুমি খাও। আজ আমার খাওয়াতে একেবারেই রুচি লাগতেছে না।” সমস্যা রুচিতে না কোথায়, আশা করি আমার সবাই ভালো ভাবেই বুঝতে সক্ষম হয়েছো।
এ পকেট ও পকেট বার বার হাত ঢুকাতে লাগলাম। কিছু একটা নিশ্চিত হারিয়েছি এমন ভাব করে মুখে আঁতঙ্কের ছাপ ফুটিয়ে তুললাম। “সে” ততক্ষণে প্রস্তুত হয়ে তাঁর সাইড ব্যাগ হাতে নিয়ে উঠে দাড়ালো। আমার এমন অবস্থা দেখে বললো, “কি হলো তোমার? বার বার পকেটে হাত দিচ্ছ কেনো?” আমি এইবার শান্ত হলাম এবং তাঁর দিকে তাকালাম। বলা যেতে পারে একেবারে অসহায় দৃষ্টিতে! তারপর বললাম, “স্যার সকালে কল দিয়েছিল, তাই তাড়াহুড়ো করে বের হওয়ার সময় টাকা নিতে মনে ছিলো না। এখন কি হবে বলতো? সর্বনাশ হয়ে গেলো যে!” আসল কথায় আসার আগে পাঠকদের আগেই বলে রাখি, কেউ আবার সম্পূর্ণটা না জেনে আমাকে গালি দিও না! সবাই ইতোমধ্যে জেনে গেছো যে, আমি কষ্টের মধ্যে জীবন পার করলেও কিছুটা বুদ্ধিমান আগে থেকেই ছিলাম! আমি নিশ্চিত জানি যে, তাঁর কাছে ভাড়ার টাকা ছাড়াও আরো বাড়তি পাঁচশো টাকা আছে। সকালে আসার সময় কল করে বলেছিলো, তাঁর কি একটা বই কিনতে হবে। বইটা পরে অবশ্য কোন লাইব্রেরীতেই পায়নি! এখন কি ঘটবে, আশা করি কারো বুঝতে কষ্ট হচ্ছে না। দেখলাম, “সে” ব্যাগ থেকে পাঁচশো টাকার একটা নোট বের করলো। আমার দিকে তাকিয়ে গর্বের একটা ভাব নিয়ে বলল, “চিন্তার কোন কারণ নাই। টাকা আমার কাছে আছে। বই কিনতে চাইছিলাম, ভাগ্য ভালো যে, তখন বইটা পাইনি। বিল পরিশোধ করে আসো যা লাগে।” আমি বললাম, “তুমি দিবা? বিষয়টা কেমন দেখা যায় না!” “সে” একটু ধমকের সুরেই বললো, “কেনো? আমি কি তোমার কিছু হইনা? আমি কি তোমার বিপদে একটু পাশে দাড়াতে পারি না?”
আমি টাকাটা নিয়ে মুচকি একটা নিরব হাসি দিয়ে বললাম, “পারো। তুমি সব কিছুই পারো!” টাকা পরিশোধ করে হোটেল থেকে বের হয়ে এলাম। একটা কথা কি জানো? আমার পরিবারের লোকেরা, বিশেষ করে আমার ভাইয়েরা প্রায়ই বলতো যে, আমার দ্বারা নাকি কোন কাজই হবে না! আমি নাকি বোকা আর হাবাগোবা ছেলে! লেখাপড়া শিখছি না ছাই! এখন যদি আমি তাদের আমার এই বুদ্ধিমান কাজগুলো দেখাতে পারতাম! নিশ্চয় তাদের ভুল ভাঙতো। আমার সম্পর্কে তাদের সকল অতীত ধারণার পরিবর্তন হতো! কিন্তু দুঃখের বিষয়, এইসব কথাগুলো কি আর ভাইদের বলা যায়!
পূর্বের পর্ব গুলো-
প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব
পঞ্চম পর্ব