দিন চলে যায়। মেসে বসে বসে ভাবতেছি। আবদুল আলীম তালুকদার স্যার কিছুক্ষণ আগে কল দিয়ে বলল, আগামীকাল প্রেস ক্লাবে যেতে হবে। “কবি সংঘ বাংলাদেশ” এর আয়োজনে আলোচনা সভা আছে। বিষয় “রোহিঙ্গাদের অধিকার”। এর ফাঁকে আমার লেখা একক প্রকাশিত বইয়ের মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানটা সেরে ফেলা হবে।
বলে রাখা ভালো। আমি অভাগা ইতোমধ্যে “সিন্ধুর পদ্য” নামে একটি কাব্যগ্রন্থ প্রকাশ করেছি। আত্মগোপনে থাকা মানুষ তো তাই কোন রকম প্রচারে নামতে পারি নাই। তাই কাছের কিছু মানুষ ছাড়া কোথাও তেমন পরিচিতি নাই। যদিও বই প্রকাশ করেছি এক বছর হতে চললো।
সে আরেক ইতিহাস। বই প্রকাশ করতে গিয়ে দশহাজার টাকা ঋণ করতে হয়েছিল! সে কথা এখন থাক। শুনলাম, অনুষ্ঠানে শহরের বড় বড় কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিক, বিভিন্ন কলেজের অধ্যক্ষ, প্রভাষক, আইনজীবী, রাজনৈতিক ব্যক্তিগণ উপস্থিত থাকবেন। সুতরাং সেখানে গিয়ে একটা চেয়ার দখল করা, সবার সামনে কিছু বলতে পারাটা কম সম্মানের নয়। মনে মনে অনুধাবন করলাম! মাঝখানে একটা কথা বলে রাখতে চাই। বলতেও খুব ইচ্ছে করছিলো। প্রথম দিকে আমি নিজের সৃজনশীল দক্ষতাগুলো গোপন রাখতে পছন্দ করতাম। আমি জানি, আমার মত এরকম অনেক লোকই আছেন। যারা নিজের ভিতরে সুপ্ত প্রতিভা মনের গুপ্ত স্থানে রাখতে ভালোবাসেন। এটা মোটেও ঠিক না। আমি শহরে এসে বিভিন্ন পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হতে, আর আমার থেকেও কম দক্ষতাসম্পন্ন ব্যক্তিদেরকে আমার থেকে বেশি পরিচিতি দেখে সেটা ভালো ভাবেই উপলদ্ধি করেছি। তাই আমি মনে করি, এটা এক ধরনের মানসিক রোগ অথবা দোষ! তাই প্রতিদিন এর মধ্য থেকে বের হতে চেষ্টা করছি। আর কারো মাঝে এরকম কিছু দেখলে তাদেরকে এর ক্ষতিকর দিকগুলো বুঝিয়ে বলার চেষ্টা করি। বসে বসে ভাবনার বিষয়টা এখন তবে খুলেই বলি। এরকম একটা অনুষ্ঠানে যাব, কিন্তু আমার যে কোন ভালো পোশাক নেই। টিশার্ট পড়েই এত বয়স পর্যন্ত পার করে দিলাম। এগুলো তো আর কোন অনুষ্ঠানে পরে যাওয়া যায় না। ভালো আর দামি পাঞ্জাবী আর শার্ট শুধু অন্যের গায়েই দেখে এলাম। নিজের পড়ার ভাগ্য এখন পর্যন্তও হলো না। কবে যে হবে স্রষ্টায় জানেন। আজ পর্যন্ত ভালো একটা প্যান্ট কপালে জুটলো না। দুইদিন যেতে না যেতেই দেখবে রং উঠে ফ্যাকাশে হয়ে গেছে! নয়ত কোমড় একদম টাইট আর নয়তো একদম ঢিলা! আর জুতা থেকে শুরু করে সকল পোশাকের ইতিহাস আরো মারাত্মক। এ জীবনে এমন কোন কাপড় নেই যেটা পড়েছি, যেখানে সুই-সুতা লাগাইনি! সুই-সুতার অনুশীলন প্রতিনিয়ত করতে করতে এখন আমি যে কোন মহিলার থেকে আরো ভালো সেলাই করতে জানি। তবে এই নিয়ে আমি মনে মনেই শুধু গর্ববোধ করি। বিষয়টা প্রকাশ পেলে কতই না লজ্জাকর! একটা পাঞ্জাবী অবশ্য ছিলো। তবে সেটাও আট বছর আগের কেনা! খুব কষ্ট করে হিসাব করে বছর বের করেছি। একটু বছরের এদিক সেদিক হতে পারে! কিন্তু সেটাও বাড়িতে ফেলে এসেছি। একটা বুদ্ধি অবশ্য পেলাম। তবে সেটা বলার আগে সবার কাছে ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি। কারণ, আমার বিবেকটা অনেক উন্নত! কাজে না হোক, তবে আমি চিন্তা করে হিসেব করে দেখেছি। অভাব আছে বলেই অনিচ্ছা সত্ত্বেও আজ আমাদের স্বভাবে এত পরিবর্তন। আমি একটা ছোট খাটো অন্যায় করলেও অনেক অনুশোচনায় ভোগী। এটা হয়ত ক্ষমা পাওয়ার অনেকগুলো লক্ষণের মধ্যে একটা। মেসে আমরা তিনজন এক রুমে থাকি। বাকি দুজন আমার বড় ভাই। আমার জন্য আশার কথা এই যে, তারা দুজনই বাড়িতে চলে গেছে। রশিতে ঝুলানো সব কাপড়ের সাথে এক বড় ভাইয়ের পাঞ্জাবীটা দেখতে পেলাম। দামি বটে তাছাড়া দেখতেও সেই! ভাবছি, এটা পড়েই অনুষ্ঠানে যাব আর এসে ধুয়ে শুকিয়ে আগের জায়গায় রেখে দিবো! এছাড়া আমি আর কোন ভালো উপায় দেখছি না। বিশ্বাস করো, মন থেকে বলছি। আমার যদি আজ অন্তত একটা ভালো শার্টও থাকতো, আমি ভুলেও ভাইয়ের পাঞ্জাবীটার দিকে হাত বাড়াতাম না। আমি তো আগেই বলেছি। মনুষ্যত্ব আমারও আছে। কিন্তু এখানে নিরুপায় হয়ে বিসর্জন দিলাম! পরে অবশ্য বড় ভাইয়ের পাঞ্জাবী পড়েই প্রেস ক্লাবে গিয়েছিলাম। সে এক স্বরণীয় মুহুর্ত। “কবি সংঘ বাংলাদেশ” এর সভাপতি তালাত মাহমুদ অনুষ্ঠানের মাঝে, উপস্থিত অতিথিদের সামনে খুব করে আমার প্রশংসা করলেন। এর পেছনে অবশ্য কিছু কারণ আছে। কারণটা তবে তালাত মাহমুদ স্যারের কাছেই শুনো..! “
দেখুন, অল্প বয়সী এক ছেলে। যার নাম সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। যে সময়ে আমরা কেউ হয়ত লেখালেখিই শুরু করিনা। অথচ সে কবিতার বই প্রকাশ করে ফেলেছে। কবিতার নিয়ম, ভাষার ব্যবহারকে অতিক্রম করে একজন অজোপাড়া গাঁয়ের ছেলে হয়েও সে সব বাঁধা অতিক্রম করে আমাদের শহরের মানুষগুলোর মধ্যে অনুপ্রেরণার দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। তার জন্য আমাদের “কবি সংঘ বাংলাদেশের” পক্ষ থেকে রইল অনেক অনেক অভিনন্দন।”
ওহ! আমি আসলেই দুঃখিত! তোমাদের সাথে কত আলাপ আলোচনা হলো। অথচ আমার নামটাই এখনো বলা হলো না! আমার নাম সালাহউদ্দীন। পুরো নাম সালাহউদ্দীন আইয়ুবী। আর ডাক নাম সালাদিন! সে যাই ঘটুক। প্রথম প্রথম এরকম প্রশংসা শুনে লজ্জা লাগছিলো খুব। অনুষ্ঠান শেষে যথারীতি আমার বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হলো। মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানের কিছু ছবি তুলে, আমার বই এবং আমার সম্পর্কে একটা প্রতিবেদন তৈরি করে রফিকুল ইসলাম আধার স্যার সেটা পত্রিকায় প্রকাশ করলেন। আর এভাবেই অনেকটা পরিচিত পেয়ে গেলাম!
লেখকঃ সাগর আহমেদ
প্রথম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
তৃতীয় পর্ব
চতুর্থ পর্ব