আমার দেখা একজন সাদা মনের মানুষ
আমি উনাকে সাদা মনের মানুষ হিসেবেই ভেবে থাকি। আর আমার দেখা সেই সাদা মনের মানুষটার নাম রবিউল ইসলাম। জন্মস্থান এবং স্থায়ী বাড়ি কুষ্টিয়া জেলায়। চাকুরিতে যোগ দিয়ে তিনি নালিতাবাড়ি উপজেলার, নয়াবিলের অন্তর্গত দাওধারা গ্রামে আশির্বাদ হয়ে আসেন। দীর্ঘ প্রায় নয় বছর তিনি দাওধারা ইসলামিক মিশনে প্রোগ্রাম অফিসারের দায়িত্ব পালন করেন। চাকরির সুবাদে এই নয় বছর একই গ্রামে থাকার কারণে অন্যান্য সব চাকুরীজীবীদের মত স্থানীয় মানুষদের সাথে একটু সুসম্পর্ক আর উঠাবসা পর্যন্তই থাকতে পারতো! কিন্তু মানুষটি ব্যতিক্রম বলেই, গ্রামের মানুষদের জন্য ব্যতিক্রম কিছু করে গেছেন। জয় করতে পেরেছিলেন আশপাশের হাজার হাজার মানুষের মন!
গ্রামের বয়স্ক মানুষদের পাশাপাশি তিনি স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি পড়ুয়া সকল ছেলেমেয়েদের সাথে ধীরে ধীরে নিজ থেকে গড়ে তুলেন বন্ধু, ভাই, আত্মীয়র মত মধুর সম্পর্ক। প্রথম দিকে তিনি অফিস সময় বাদে সকাল, বিকাল এবং রাতে স্থানীয় ছাত্র-ছাত্রীদের বিনা খরচে ইংরেজি আর গণিত পড়াতেন। এভাবে বেশ কয়েক বছর বিনা পরিশ্রমে ছাত্রদের পড়াতে থাকায় এবং ছাত্র-ছাত্রীরা ভালো ফলাফল করার কারণে আশেপাশের দশ-বারো গ্রামে উনার নাম-খ্যাতি ছড়িয়ে পড়তে লাগলো। বিভিন্ন গ্রাম থেকে ছাত্র-ছাত্রীরা পড়ার জন্য এসে উনার কাছে ভিড় জমাতো। ভাবতেই অবাক লাগে, সঠিক সময়, যথারীতি অফিস করেও তিনি প্রতিদিন সকালে দুই-তিন ব্যাচ, বিকাল, সন্ধ্যা এবং রাতে মিলে তিন-চার ব্যাচের ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতেন।
তিনি যে সুনাম অর্জন করেছিলেন চাইলেই সে নামের প্রভাব খাটিয়ে লক্ষ লক্ষ টাকা উপার্জন করতে পারতেন। কিন্তু সাদা মনের মানুষ বলেই তিনি সম্পূর্ণ বিনা খরচে প্রায় শ খানেক ছাত্র-ছাত্রীদের পড়াতেন। অবশেষে তিনি উনার সেবার পরিধি বাড়াতে আর সচেতনতার লক্ষ্যে গড়ে তুলেন সকল ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে “দাওধারা ছাত্র কল্যাণ সমিতি” নামের সংগঠন। এই সমিতিতে তিনি নিজেই অর্থ যোগান দিতেন এবং বেছে বেছে স্বচ্ছল পরিবারের ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে পড়ার বিনিময়ে মাসিক সামান্য কিছু টাকা তুলতেন। আর গবীর ছাত্র-ছাত্রীদের কাছ থেকে কোন প্রকার চাঁদা নিতেন না।
এই সংঘটন বা সমিতির কার্যাবলী আর কর্মকান্ডই যেমন উনাকে সাদা মনের মানুষে পরিণত করেছে তেমনি দাওধারা গ্রামকে বানিয়েছিলো শিক্ষার আলোয় আলোকিত একটি শিক্ষিত গ্রাম।
সকাল, বিকাল, সন্ধ্যা কিংবা রাত, স্কুল সময় বাদে সকল সময়েই ছাত্র-ছাত্রীদের একটাই বিষয় ছিল, শুধু পড়াশোনা। পাঠ্য বই কিংবা পাঠ্য বইয়ের বাহিরে।
কিছু উল্লেখ যোগ্য কর্মকান্ডগুলো হলোঃ
১। প্রতি মাসে সমিতিতে যে টাকা উঠতো এবং তিনি নিজেও তাতে যে টাকা দিতেন, তার থেকে প্রতিদিন দুইটা দৈনিক পত্রিকা রাখার ব্যবস্থা ছিলো।
২। গরীব ছাত্র-ছাত্রীদেরকে প্রতি মাসে বৃত্তি প্রদান করা এবং প্রয়োজন অনুযায়ী বই, খাতা, কলম কিনে দেয়া হত।
৩। খেলাধুলার জন্য নিয়মিত বল, ব্যাট, ফুটবল সহ যাবতীয় খরচ পাতি সমিতি থেকে বহন করা হত।
৪। পাবলিক ভার্সিটিতে চান্স পাওয়া সকল ছাত্র-ছাত্রীদেরকে মাসিক অনুদান প্রদান করা হত।
৫। বাল্যবিবাহ রোধ এবং মেয়েদেরকে শিক্ষিত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করা হত। এবং তিনি নিজে গিয়ে অভিভাবকদেরকে বুঝাতেন এবং নিজ উদ্দ্যোগে সব রকম সহায়তা দিতেন। যাতে অভিভাবকগণ তাদের মেয়েদের লেখাপড়া করাতে উৎসাহিত হন।
৬। সমিতির পক্ষ্য থেকে বিভিন্ন সময়ে সফলতার সাথে ক্রিকেট এবং ফুটবল খেলার টুর্নামেন্টের আয়োজন করা হত।
৭। ছাত্র-ছাত্রীদের বিনোদনের জন্য প্রতিবছর সমিতির পক্ষ্য থেকে পিকনিকের আয়োজন করা হত।
৮। ছাত্র-ছাত্রীদেরকে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে তিনি বিভিন্ন সময়ে সাধারন জ্ঞানের প্রতিযোগিতার আয়োজন করতেন। সবাইকে লেখাপড়ার পাশাপাশি পত্রিকা পড়তে, সাধারণ জ্ঞানে দক্ষ হতে সব সময় উৎসাহিত করতেন।
এছাড়াও তিনি ব্যক্তিগত ভাবে বুদ্ধি পরামর্শ দিয়ে, আর্থিক ভাবে সকল মানুষকে সহযোগিতা করতেন। এমনকি এখনো নিরবে করে যাচ্ছেন। যদিও বর্তমানে তিনি চাকরির সুবাদে রাঙ্গামাটিতে আছেন।
যখন গ্রামের মানুষ জানতে পারলো যে, এই সাদা মনের মানুষটার বদলির আদেশ এসে গেছে, মুহূর্তের মধ্যে এই খবর আশেপাশের সকল গ্রামে ছড়িয়ে পড়লো। প্রায় অর্ধ শত মানুষ ছুটে গিয়েছিল উপজেলার নেতাকর্মীদের কাছে, যাতে উনাকে বদলি না করা হয়! এদিকে সকল মানুষ ছুটে এলো তাকে বিদায় জানাতে। সেদিন যে শ খানেক মানুষ তাকে বিদায় জানাতে এসেছিল, কারো চোখ বাকি ছিলো না চোখের পানিতে ভিজতে। আজ অনেক বছর পার হয়ে গেছে। এখনো গ্রামের মানুষ তাঁকে মনে রেখেছে একজন আদর্শ আর মহামানব হিসেবে। আর আমি উনাকে সাদা মনের মানুষ হিসেবেই দেখে থাকি। তাঁর আদর্শ আর দেখানো পথকে অনুসরণ করার চেষ্টা করে চলছি। এমন নিঃস্বার্থ আর পরোপকারী মানুষগুলো যেখানেই থাকুক ভালো থাকুক এটাই কাম্য।
লেখকঃ সাগর আহমেদ
শেরপুর সরকারি (বিশ্ববিদ্যালয়) কলেজ।
(ইংরেজি বিভাগ)