Our Sherpur

মাইসাহেবা মসজিদ, একটি ইতিহাস | হারুনুর রশীদ

মাইসাহেবা মসজিদ
মাইসাহেবা মসজিদ শেরপুর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের অংশ। তবে এই মসজিদের ইতিহাস নিয়ে যে ধোঁয়াশা ছিল তা দূর করেছেন অনুসন্ধানী লেখক কবি হারুনুর রশীদ।

একজন নির্লোভ

সাধক হজরত জরিপ শাহ (রহ)-র “গড়জরিপা”। বঙ্গরাজ্যের অন্যতম অঙ্গরাজ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে। সম্রাট আকবরের আমলে মুঘল সম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। তখন নামকরণ করা হয় “দশকাহনিয়া” বাজুহা। দশকাহনিয়া বাজুহার প্রায় শত বছর ধরে জায়গিরদার ছিলো গাজী বংশ। এই গাজী বংশের শেষ জায়গিরদার “শের আলী গাজী“। তিনি একুশ বছর মতান্তরে চব্বিশ বছর সফল জায়গিরদার ছিলেন। তিনি এক সময় “দশকাহনিয়া” নাম পরিবর্তন করে নতুন নামকরণ করেন “শেরপুর” এবং স্বাধীনতা ঘোষণা করেন।

ফলস্বরূপ বিশাল মুঘল সাম্রাজ্যের কাছে কার্যত নতি স্বীকার করতে হয়। শের আলী গাজীকে ক্ষমতাচ্যুত করে বাংলার সুবাদার “মুর্শিদকুলি খান” সুকৌশলে প্রশাসনিক নাম “বাজুহা” পরিবর্তন করে “পরগণা” করেন ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে। সেই সাথে “জায়গীরদার” পদবি পরিবর্তন করে “জমিদার” পদবি দেন। তবে “শেরপুর” নামটি বহাল রেখে নামকরণ করেন “শেরপুর পরগণা”। রাজধানী বহাল থাকে সেই “গড়জরিপা”। প্রথম জমিদার হলেন, “রামনাথ নন্দী”।

পরবর্তীতে শেরপুরের জমিদারী আনা/আনী হিসেবে বিভক্ত ছিলো। যার ফলে একই সময়ে একাধিক জমিদার ক্ষমতাসীন ছিলেন। পাশাপাশি ২৭ একর জমির মালিকানা ছিলো পার্শ্ববর্তী “সুসঙ্গ” পরগনাভূক্ত। এই ২৭ একর জমিটি রাজাবাড়ি হিসেবে পরিচিত।

এই রাজাবাড়ির ইতিহাস হচ্ছে, সুসঙ্গ পরগনার ভূতপূর্ব রাজা “রামসিংহ” ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে “আব্দুল রহিম” নাম ধারণ করেন এবং মুসলিম নারীকে বিবাহ করেন। এই অভিমানে তার “আব্দুল রহিম” পূর্ববর্তী স্ত্রী পুত্র “রণসিংহ”কে নিয়ে শেরপুর পরগনায় চলে আসেন। ঐতিহ্য অনুযায়ী রাজপরিবার অপরের জায়গায় থাকবেন না, অপরের খাবেন না। বিধায় শেরপুর পরগনায় ২৭ একর জমি কিনে বাড়ি নির্মাণ করেন। সেই বাড়িতে রাজপুত্র রণসিংহ ও তার মা বেশ কিছুদিন অবস্থান করেন। সেজন্যই এটি রাজাবাড়ি হিসেবে পরিচিত।

রামসিংহ ওরফে আব্দুল রহিমের পর আগের দিকের পুত্র এই “রণসিংহ” সুসঙ্গ পরগনার রাজা হন। সুসঙ্গ পরগনার এক সনদের মাধ্যমে এই জমি সিলেট থেকে আগত সুফি “শাহ চিনতি মাসুক” বা “শাহ চিনকি মহম্মদ”-এর নামে লাখেরাজ করে দেওয়া হয়। কিন্তু ইংরেজ সরকার এই “রাজাবাড়ি” খাস ঘোষণা করতে পদক্ষেপ নেয়। তখন রাজা “রণসিংহ”-র নাতি অধস্তন রাজা “রাজসিংহ” শেরপুর সফরে আসেন। তাদের রাজাবাড়িতে অবস্থান করেন।

উল্লেখ্য, রাজা “রাজসিংহ” অত্যন্ত চৌকশ, প্রজাবৎসল ও সাহিত্যিক ছিলেন। তিনি “ভারতীমঙ্গল কাব্য”, “রামায়ণ”, “মনসা পাঁচালী”, “ঢাকা বর্ণনা” ইত্যাদি কাব্যগ্রন্থ রচনা করেছেন। এই “রাজাবাড়ি” সংলগ্ন ছিলো জমিদার “রাধা বল্লভ রায় চৌধুরী”-র বাসভবন।

“শেরপুর পরগণা” সফর শেষে এই সাতাশ একর জমি ও স্থাপনা একজন নির্লোভ, নির্মোহ, সৎ মানুষকে দান করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন রাজা “রাজসিংহ”। বহু সাধু-সন্ন্যাসী এই জমির জন্য আবেদন করলেন। রাজার মনের মতো হয়নি। শেষে খবর পাওয়া যায়, এই সাতাশ একর জমিতেই ঝোপঝাড়ের মধ্যে এক তমাল গাছের নিচে একজন মুসলমান সুফি ধ্যান ও ইবাদতে মশগুল আছেন। কারও কাছে কিছু চান না। রাজার মনে ধরেছে। দূত পাঠালেন, রাজার কাছে গিয়ে দান গ্রহণ করতে। জবাবে ওই সুফি বলেন, এই তমালতলাই তার জন্য যথেষ্ট। দানের জমির দরকার নেই। এমনকি রাজার সাথে দেখা করার আগ্রহও নেই।

এই খবর শুনে রাজা রাজসিংহ অত্যন্ত আশ্চর্যান্বিত হলেন। সাব্যস্ত করলেন, ইনিই সত্যিকার নির্লোভ, নির্মোহ, সৎ মানুষ। নির্লোভ মানুষটির পরিচয় সংগ্রহ করলেন। তৎকালীন নিয়ম অনুযায়ী তামার পাত্রে দানপত্র দলিল লিখেন। রাজা রাজসিংহ নিজে সেই তমালতলায় গিয়ে দানপত্র দলিল হস্তান্তর করেন। এই নির্লোভ, নির্মোহ, সৎ মানুষটিই সুফি মীর আব্দুল বাকী (রহ.)।

মুঘল সম্রাট দ্বিতীয় আকবর শাহ-র (১৮০৬–১৮৩৭ খ্রিস্টাব্দ) নিয়োগপ্রাপ্ত শেরপুর পরগণার সুবাদার বা নায়েব সুবাদার অর্থাৎ উচ্চ পদস্থ রাজকীয় প্রতিনিধি “মীর আব্দুল বাকী” । স্ত্রী “সালেমন নেছা”কে নিয়ে রাজধানী “গড়জরিপায়” বসবাস করেন। দুজনেই অত্যন্ত ধার্মিক। ঘরে ১টি মতান্তরে ২টি সন্তান শৈশবে মৃত্যুবরণ করে।

আরও উল্লেখ্য যে, সিলেট থেকে আগত সুফি “শাহ চিনতি মাসুক” বা “শাহ চিনকি মহম্মদ”। তার নামে গড়জরিপায় ও গড়জরিপার বাইরে বহু লাখেরাজ সম্পত্তি ছিলো। মীর আব্দুল বাকীর আমলে সরকার বাহাদুর বনাম মীর আব্দুল বাকী গং মামলা দায়ের করা হয়। এই মোকদ্দমায় মীর আব্দুল বাকী গংকে পরাজিত করে সমূদয় সম্পত্তি খাস ঘোষণা করা হয় ৩১শে অক্টোবর ১৮৩৫ খ্রিস্টাব্দে।

একদিকে সন্তান হারানোর ব্যথা, অপরদিকে মোকদ্দমায় সুফি ভাইয়ের সম্পত্তি খাস হয়ে যাওয়া। দুইয়ে মিলে উদাসীন করে তোলে। সুবাদার মীর আব্দুল বাকী রাজকীয় কাজে ইস্তফা দেন। সুফি সাধনায় গৃহত্যাগী হলেন। সন্তানহারা স্ত্রী “সালেমন নেছা” অত্যন্ত ধার্মিক। আপন ভাগ্নে ” সৈয়দ আব্দুল আলী”কে নিয়ে রাজধানী গড়জরিপায় বসবাস করেন।

মীর আব্দুল বাকী (রহ.) মহারাজার রেখে যাওয়া বিশাল স্থাপনায় উঠলেন না। নিজের আস্তানাতেই কুঁড়ে ঘর তৈরি করেন। স্বামীর সন্ধান ও ঠিকানা পেয়ে তাপসী বিবি সালেমন নেছা রাজধানী গড়জরিপা ছেড়ে স্বামীর আস্তানা কুঁড়ে ঘরে চলে আসেন।

মাইসাহেবা ও মসজিদ

হজরত ইমাম হাসান (রা.)-র বংশধর সৈয়দ আজিম উদ্দিন। শেরপুর শেরী পাড়ায় বসবাস। সৈয়দ আজিম উদ্দিনের পুত্র সৈয়দ আব্দুল আলী। এই সৈয়দ আব্দুল আলী-র খালা সালেমন নেছা। তার জন্ম পাবনা জেলার ইমামবাড়ি। সৈয়দ বংশের পুরুষদের সম্মান করে “মিয়া সাহেব” ও “মিয়া জি” এবং মহিলাদের “মিয়া সাহেবান” ও “মা সাহেবান” ডাকা হয়। এই “মা সাহেবান” শব্দটি লোকমুখে “মাইসাহেবান” > “মাইসাহেবা” হয়েছে।

সুফি মীর আব্দুল বাকী (রহ.)-র জীবদ্দশায় বেশ কয়েকবার এই জমি জবরদখল করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছে জমিদার “রাধা বল্লভ চৌধুরী”। সুফি “মীর আব্দুল বাকী (রহ.)”-র ইন্তেকালের পর সেই আস্তানা /কুঁড়ে ঘরের পাশেই সমাহিত করা হয়। সালেমন নেছার দেখাশোনা ও সেবাযত্নে নিয়োজিত থাকেন সেই ভাগ্নে সৈয়দ আব্দুল আলী।

সময় সুযোগ বুঝে জমিদার রাধা বল্লভ চৌধুরী তার হস্তিবাহিনী, অশ্ববাহিনী ও লাঠিয়াল বাহিনী নিয়ে আক্রমণ করে প্রায় সমূদয় জমি জবরদখল করে নেয়। কিংবদন্তী আছে, বিবি সালেমন নেছা তখন আস্তানার কুটিরে বসে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতে মগ্ন ছিলেন। প্রায় সমূদয় দখল করে সেই আস্তানার পাশে গিয়ে বিশাল হাতি ঘোড়াগুলো মাটিতে নুয়ে পড়ে, সেলাম করে। কোনো ভাবেই আস্তানা ও কবরটি ভাঙ্গা সম্ভব হয়নি। সেই আস্তানা ও কবর মিলে মোট আট শতাংশ জমি জবরদখল থেকে মুক্ত থাকে। তখন লোকমুখে এই আস্তানাটি প্রসিদ্ধ হয়ে ওঠে “বিবি সাইবানির দরগাহ” বা “মাইসাহেবার দরগাহ” নামে।

জমিদার রাধা বল্লভ চৌধুরী নানাভাবে অন্যায়, অত্যাচার করতে থাকে। চরম অত্যাচারে অতিষ্ঠ বিবি সালেমন নেছা টিকতে পারেন না। ভাগ্নে সৈয়দ আব্দুল আলীকে নিয়ে শেরীপাড়ায় বসবাস করতে থাকেন। এসময় তিনি এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। স্থানীয় মুসলমানদের সহযোগিতায় আস্তানার ওই ৮ শতাংশ জমিতেই একটি মসজিদ নির্মাণ করেন ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে। মসজিদ নির্মাণের মধ্যমণি “মা সাহেবান” > “মাইসাহেবা” ‌।

লোকমুখে ছড়িয়ে পড়ে, “মাইসাহেবা মসজিদ” এবং “বাকী মিয়ার মসজিদ” এই দু’টি নাম। কালক্রমে “বাকী মিয়ার মসজিদ” নামটি কার্যত হারিয়ে যায়। প্রতিষ্ঠিত হয় “মাইসাহেবা মসজিদ” নামটি। মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক থাকেন “মা সাহেবান” নিজেই। অবশ্য সার্বিক সহযোগিতায় ভাগ্নে সৈয়দ আব্দুল আলী। মা সাহেবানের ইন্তেকালের পর স্বামীর কবরের পাশেই সমাহিত করা হয়। মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক থাকেন ভাগ্নে সৈয়দ আব্দুল আলী। সৈয়দ আব্দুল আলী ইন্তেকালের পর তাকেও সমাহিত করা হয় সুফি মীর আব্দুল বাকী (রহ.) ও মা সাহেবানের কবরের পাশে।

সেই সূত্রে বংশানুক্রমে এই সৈয়দ পরিবার এবং তাদের ঘনিষ্ট আত্মীয়তার সূত্রে সৈয়দ সিরাজুল হক ওরফে জান মিয়ার পরিবার মসজিদের তত্ত্বাবধায়ক নিয়োজিত থাকেন। উল্লেখ্য, সিলেট থেকে আগত শেরপুরে বসবাসকারী সুফি শাহ চিনতি মাসুক (রহ.)-র বংশধর এই সিরাজুল হক ওরফে জান মিয়া। এই জান মিয়ার বোনকে বিবাহ করেন সৈয়দ আব্দুল আলীর পুত্র “সৈয়দ জহির উদ্দিন” ওরফে “জহির পাগলা”।

মাই সাহেবা মসজিদ

মসজিদ সংস্কার ও আন্দোলন

মুসল্লি বৃদ্ধিসহ নানা কারণে মাইসাহেবা মসজিদ সংস্কার করা দরকার। ১৩১০ বঙ্গাব্দে (১৯০৩ খ্রিস্টাব্দ) ওই আট শতাংশ জমিতেই মসজিদটি বড় করার উদ্যোগ নেয়া হয়। নেতৃত্বে থাকেন অবিসংবাদিত মুসলিম নেতা “আফছর আলী খান” এবং “জননেতা সৈয়দ সিরাজুল হক খান” ওরফে “জান মিয়া”। ক্ষমতাসীন জমিদার “রাধা বল্লভ চৌধুরী” মসজিদ সম্প্রসারণে বাধা দেয় এবং মসজিদ উচ্ছেদ করতে পদক্ষেপ গ্রহণ করে।

জননেতা সিরাজুল হক ওরফে জান মিয়া ও আফছর আলী খান মিলে তৎকালীন ঢাকার নবাব “সলিমুল্লাহ” সাহেবের শরণাপন্ন হন। বিবরণ শুনে নবাব “সলিমুল্লাহ” নিজ সেঁরেস্তার ম্যানেজার জনৈক ইংরেজ সাহেবকে তদন্তে পাঠান। ইংরেজ ম্যানেজার সাহেব সরেজমিন তদন্ত করে নবাব সলিমুল্লাহর নিকট রিপোর্ট জমা দেন। তদন্ত রিপোর্ট পেয়ে নবাব সলিমুল্লাহ শেরপুরের জমিদারকে পত্র পাঠান। নবাবের পত্র পেয়ে মসজিদ সম্প্রসারণে আর বাধা দিতে সাহস পায়নি জমিদার “রাধা বল্লভ চৌধুরী”। সেই বছরেই (১৯০৩) প্রথম বার মসজিদ সম্প্রসারণ করা হয়।

এদিকে জমিদার রাধা বল্লভ চৌধুরীর ষড়যন্ত্র থেমে নেই। ইতোমধ্যে ১৮৯১ খ্রিস্টাব্দ থেকে তিনি সরকারের অনারারি মেজিস্ট্রেট ( সম্মানিভূক্ত বিচারক )-এর দায়িত্ব পান। একে তো জমিদার, তার উপর কোর্টের বিচারক। আইনের ফাঁকফোকর, পথঘাট সব জানা। গোপনে ময়মনসিংহ কালেক্টরেট অফিসের কর্মকর্তার মাধ্যমে ভলিয়ম বই থেকে এই সাতাশ একর জমির দলিলের পাতাগুলো সরিয়ে পুড়িয়ে ফেলে। ১৩০৬ বঙ্গাব্দে (১৯০৮-০৯ খ্রিস্টাব্দ) সমূদয় জমি (২৭ একর ) নিজের নামে সি. এস. রেকর্ডভূক্ত করে নেয়।

স্থানীয় মুসলমানদের পরামর্শ ও সহযোগিতায় সৈয়দ আব্দুল আলীর এক নাতি “সৈয়দ আফরোজ উদ্দিন” জমিদারের সি. এস. রেকর্ড বাতিলের মামলা দায়ের করেন। এই সময় মহারাজার দেওয়া তামার পাত্র দলিলটি ছিলো সৈয়দ আফরোজ উদ্দিনের মামা সৈয়দ সিরাজুল হক ওরফে জান মিয়ার চাচাতো ভাই “সৈয়দ সাহাব উদ্দিন”-এর জিম্মায়।

উল্লেখ্য, এখানে বিশেষভাবে বিবেচনার বিষয় হলো, দলিল সূত্রে সাতাশ (২৭) একর জমির মালিক মীর আব্দুল বাকী (রহ.)। উত্তরাধিকার সূত্রে বিবি সালেমন নেছা মাইসাহেবা। তাদের জীবিত কোনো সন্তান ছিলো না। মাইসাহেবার ভাগ্নে সৈয়দ আব্দুল আলীর নাতি “সৈয়দ আফরোজ উদ্দিন” সেই সম্পত্তির ভাগ খুব সামান্যই পেতে পারেন বটে। কিন্তু সৈয়দ আফরোজ উদ্দিনের মামার চাচাতো ভাই “সৈয়দ সাহাব উদ্দিন” সেই সম্পত্তির ভাগ পাবার কোনো সম্ভাবনাই নেই। তার উপর ক্ষমতাসীন অত্যাচারী জমিদারের কোপানলে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা। এছাড়াও নানাবিধ কারণে “সৈয়দ আফরোজ উদ্দিন” সেই তামার পাত্র দলিলটি আদালতে উপস্থাপন করেননি।

একদিকে সরকারি মূল ভলিয়মে দলিলের পাতা নেই। অন্যদিকে “তামার পাত্র দলিল’ আদালতে উপস্থাপন করা সম্ভব হয়নি। পাশাপাশি ক্ষমতাসীন জমিদার ও অনারারি মেজিস্ট্রেট রাধা বল্লভ চৌধুরীর তদবির তো আছেই। ফলে মামলাটি খারিজ হয়ে যায়।

অত্যাচারী জমিদার রাধা বল্লভ চৌধুরী পূণরায় মসজিদ উচ্ছেদ করতে চায়। স্থানীয় মুসলমানদের তীব্র প্রতিরোধের মুখে মসজিদ সংশ্লিষ্ট আট শতাংশ জমি দখল করতে পারেনি। কিন্তু মসজিদের উত্তর পাশে স্থাপন করা হয় ঘোড়ার আস্তাবল ও ঘোড়ার গাড়ির গ্যারেজ। যাতে করে অনেকগুলো ঘোড়ার মলমূত্র ছিটকে মসজিদ ও কবরস্থানের পবিত্রতা নষ্ট হয়। পাশাপাশি ঘোড়ার ডাক চিৎকার, সহিসদের আড্ডায় দূষিত পরিবেশ সৃষ্টি করে। দক্ষিণ পাশে তৈরি করা হয় পূজার আখড়া। পূজার আখড়া তো নয়, ঢাক ঢোলের বাদ্য বাজিয়ে অত্যাচার করাই মূল লক্ষ্য।

জমিদারদের প্রজা নিপীড়ণের এটি একটিমাত্র উদাহরণ। হিন্দু, মুসলিম, গারো , হাজং, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে দমন, পীড়ণ, শোষণ আর অবর্ণনীয় অত্যাচার চলতে থাকে। প্রতিবাদে টঙ্ক আন্দোলন, নানকার আন্দোলন, কৃষক আন্দোলন, ক্ষত্রিয় আন্দোলন, প্রজা আন্দোলন , বকসারি আন্দোলন, আদিস্তান আন্দোলনসহ বিভিন্ন আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। ১৯৫০ খ্রিস্টাব্দে প্রজাস্বত্ব আইন পাসের মাধ্যমে জমিদারী প্রথা বিলুপ্ত হয়।

জমিদার রাধা বল্লভ চৌধুরীরা সম্ভাব্য পরিস্থিতি বুঝতে পারে। জনরোষের ভয়ে প্রজাস্বত্ব আইন পাস হবার আগেই সদলবলে ভারতে পালিয়ে যায়। যাবার আগে “তিন আনি জমিদারী” স্বত্বাধিকার আমমোক্তার (পাওয়ার অব এটর্নি) দিয়ে যায় জোলগাঁও (বর্তমান ঝিনাইগাতী উপজেলাধীন) নিবাসী জনাব ফরিদ উদ্দিনকে। এই ফরিদ উদ্দিন সাহেব আমমোক্তার ক্ষমতার বলে পঁয়ষট্টি (৬৫) শতাংশ জমি মসজিদ কর্তৃপক্ষের কাছে বিক্রি করেন। মাইসাহেবা মসজিদের জমি সাকুল্যে হয় তিয়াত্তর (৮ + ৬৫ = ৭৩) শতাংশ।

মাইসাহেবা জামে মসজিদ মিনার

মাইসাহেবা মসজিদ সম্প্রসারণ

যথাসম্ভব মীর আব্দুল বাকী (রহ.) ও বিবি মাইসাহেবার আস্তানা বা কুঁড়ে ঘরটিই ঐতিহ্যবাহী মাইসাহেবা মসজিদরূপে তৈরি করা হয়। দুটি কাতারে ১৮ জন করে ৩৬ জন মুসল্লি একত্রে নামাজ আদায় করতে পারতেন।

১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে ঐতিহাসিক সংস্কার ও সম্প্রসারণ করে আরও তিনটি কাতার বাড়ানো হয়। তখন মসজিদ কাঠামোতে ইট, সুরকি ও চুনের মিশ্রনে ৪০ ইঞ্চি পুরু দেয়ালের গাঁথুনি দেওয়া হয়। পাঁচটি দরজা বিশিষ্ট মসজিদ দৈর্ঘ্যে ৩০ ফিট ও প্রস্থে ২০ ফিট। ছাদে পাশাপাশি তিনটি গম্বুজ রাখা হয়।

বর্তমান কাঠামো রূপ (২০২৫ খ্রিস্টাব্দ ) : বর্তমান মসজিদ ভবনসহ স্থাপনাটির নকশা তৈরী করেন শেরপুরের সৃজনশীল স্থপতি আব্দুল্লাহ ইবনে সাদিক (শাহীন)। ২০০১ খ্রিস্টাব্দ থেকে বেশ কয়েক বছর ধরে নতুন মসজিদ ভবন তৈরি করা হয়। সাদা রঙের প্রলেপণে তিন তলা বিশিষ্ট মাইসাহেবা মসজিদের উপরিভাগ দুইটি উঁচু মিনার ও আটটি গম্বুজ দ্বারা অলঙ্কৃত। বর্তমানে মাইসাহেবা মসজিদে একসঙ্গে প্রায় ৫-৬ হাজার মুসল্লি নামাজ আদায় করতে পারেন। মাইসাহেবা মসজিদ ভবনে পূর্ব পাশে পাশাপাশি ৬টি দরজা বিশিষ্ট প্রধান প্রবেশ পথ রয়েছে। দক্ষিণ পূর্বের সিড়ি এবং উত্তর পূর্বের সিড়ির ঠিক পূর্ব পাশে প্রথম তলা ছাদের উপর দুটি গম্বুজ আছে।

এই গম্বুজদুটির নিচ বরাবর আরও দুটি প্রবেশ পথ (দরজা) আছে। পূর্বপাশে প্রধান প্রবেশ পথের উপর উত্তর ও দক্ষিণ পাশে যথাক্রমে ৯৫ ফিট ও ৮৫ ফিট উঁচু মিনার দুইটি অবস্থিত। নিচতলায় পূর্বদিক বরাবর নয়নাভিরাম ফোয়ারা সম্বলিত অজুখানা এবং উত্তর পাশে শৌচাগারের অবস্থান। পশ্চিম বরাবর সম্পূর্ণ অংশ মূল মসজিদের সঙ্গে সমন্বয় করা হয়েছে।

এছাড়া বর্ধিত অংশের পূর্ব পাশের প্রথম ও দ্বিতীয় তলায় আছে একটি ইসলামিক সেমিনার কক্ষ ও একটি আধুনিক পাঠাগার। যার ফলে এই মসজিদ ভবনটি একটি ইসলামিক কমপ্লেক্সে পরিণত হয়েছে। মাইসাহেবা মসজিদের সামনের অংশটি ঈদগাহ তৈরি করা হয়েছে। মসজিদে বয়স্কদের বিনামূল্যে কোরআন শেখানো হয়। প্রতিদিন ফজর নামাজের পর শুদ্ধভাবে পবিত্র কোরআন তেলাওয়াতসহ নানা বিষয়ে তালিম দেওয়া হয়।

একজন করে খতিব, ইমাম, মুয়াজ্জিন ও তিনজন খাদেম মসজিদের সেবায় নিয়োজিত। মসজিদটিতে দু’জন পাহারাদার আছেন। একজন মসজিদ কর্তৃপক্ষের অন্যজন পৌর কর্তৃপক্ষের। সংলগ্ন এলাকাসহ মসজিদটি ক্লোজ সার্কিট ক্যামেরা দিয়ে নজরদারির ব্যবস্থা করা হয়েছে। মাইসাহেবা মসজিদে নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ দান করে তৃপ্তিবোধ করেন। এমনকি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীরাও এখানে দান করেন।

সম্প্রসারণের ফলে একটি কবরস্থান মূল মসজিদ ভবনের ভিতরে পড়েছে । এই কবরস্থানে মসজিদের প্রতিষ্ঠাতা সালেমুন নেছা, তার স্বামী মীর আব্দুল বাকী ( রহ.), ভাগনে সৈয়দ আব্দুল আলী, মসজিদের সাবেক খতিব ও সাধারণ সম্পাদক কাজী মোঃ মোহছেন, তার স্ত্রী উম্মে রেজা মরিয়ম, সাবেক মোয়াজ্জিন আব্দুল জব্বারসহ আরও কয়েকজনের কবর আছে। কবরগুলো চারদিকে ঘেরাও করে সবুজ গালিচায় ঢেকে রাখা হয়েছে।

তথ্যসূত্র:

  • ময়মনসিংহের বিবরণ, শ্রী কেদারনাথ মজুমদার।
  • সেরপুর বিবরণ, শ্রীহরচন্দ্র চৌধুরি।
  • ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার (প্রথম খণ্ড), শ্রীশৌরীন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী।
  • শেরপুর জেলার অতীত ও বর্তমান, পণ্ডিত ফছিহুর রহমান। 
  • শেরপুরের ইতিকথা, অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন। 
  • ইতিহাস ঐতিহ্যে গড়জরিপা, প্রকৌশলী এম আহসান আলী ও মো. আকরাম আলী।
  • ভারতের কৃষক সমস্যা, মুজাফফার আহমদ।
  • যে সংগ্রামের শেষ নেই, প্রমথ গুপ্ত।
  • মোমেনশাহী উপাখ্যান, অমর মিত্র।
  • মুক্তিযুদ্ধে শেরপুর, আবদুর রহমান তালুকদার।
  • সুফির বিশ্ব, নায়লা পাইলট।
  • বাংলাদেশে সূফী সাধক, ডক্টর গোলাম সাকলায়েন।
  • ভারতীয় উপমহাদেশের ইতিহাস, হাসান আলী চৌধুরী।
  • আসাম ও কামরূপে মুসলমানদের হাজার বছর, সরদার আবদুর রহমান।
  • বাংলা ও বাঙালীর বিবর্তন, ড. অতুল সুর।
  • বাংলা একাডেমি বাংলাদেশের লোকজ সংস্কৃতি গ্রন্থমালা শেরপুর, প্রধান সম্পাদক শামসুজ্জামান খান।  
  • শ্যামল বাংলা ২৬/০২/২০২২ আব্দুস সামাদ ফারুক।
  • বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন।
  • বাংলাপিডিয়া।
  • উইকিপিডিয়া, শেরপুর জেলা।

2 thoughts on “মাইসাহেবা মসজিদ, একটি ইতিহাস | হারুনুর রশীদ”

  1. Md. Abdus Salam

    মাইসাহেবা মসজিদের ইতিহাস, স্থাপত্য, এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্য এত সুন্দরভাবে এবং বিশদভাবে তুলে ধরার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ!

  2. Md Daloare Hossain

    প্রিয় লেখক, মাইসাহেবা মসজিদের ইতিহাস, স্থাপত্য, এবং সাংস্কৃতিক তাৎপর্য এত সুন্দরভাবে এবং বিশদভাবে তুলে ধরার জন্য আপনাকে আন্তরিক ধন্যবাদ! আপনার লেখার মাধ্যমে আমাদের স্থানীয় ঐতিহ্যের এই গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা সম্পর্কে গভীর ধারণা পেয়েছি। আপনার গবেষণা, উপস্থাপনা, এবং লেখার শৈলী সত্যিই প্রশংসনীয়। এমন তথ্যবহুল ও আকর্ষণীয় লেখা আমাদের সকলকে আমাদের ঐতিহাসিক স্থানগুলোর প্রতি আরও আগ্রহী করে তুলবে। এই অসাধারণ কাজের জন্য আবারও ধন্যবাদ ও শুভকামনা!

Leave a Reply

Scroll to Top