Our Sherpur

শ্রীবরদী নামকরণ | হারুনুর রশীদ

শ্রীবরদী নামকরণ

শ্রীবরদী নামকরণ, হারুনুর রশীদঃ “শ্রীবরদী” তথা “বৃহত্তর শেরপুরের” প্রসঙ্গ আসলেই প্রথম নামটি আসে “গড়জরিপা“। যতদূর জানা যায়, হজরত শাহজালাল (রহ.)-র নেতৃত্বে শ্রীহট্ট (সিলেট) রাজ্য জয় করা হয় ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে। হজরত শাহজালাল (রহ.)-র সফরসঙ্গী ছিলেন ৩৬০ জন আউলিয়া। শ্রীহট্ট রাজ্য জয়ের পর এই সফরসঙ্গীরা ইসলামী সমাজ ব্যবস্থা কায়েম করার জন্য সারা ভারতবর্ষে ছড়িয়ে পড়েন। অনেকেই বিভিন্ন জায়গায় স্থায়ী দরগাহ বা আস্তানা গেড়েছেন। অনেকেই স্থায়ী আস্তানায় থিতু হননি। এক স্থান থেকে অন্য স্থানে সফর করেছেন। অনেকেই আবার স্থায়ী আস্তানাকে কেন্দ্র করে রাজত্ব কায়েম করেছেন। এই রাজত্ব কায়েম করা সফরসঙ্গীদের একজন হজরত জরিপ শাহ (রহ.)।

হজরত জরিপ শাহ (রহ.) সিলেট থেকে পশ্চিমে নদী-নালা ও জঙ্গল বেষ্টিত অখ্যাত এক জনপদে তার আস্তানা গাড়েন। জনপদের বসবাসকারী লোকজন তো ইসলাম ধর্মের অনুসারী নয়। স্বভাবতই বিরোধিতা ও আক্রমণের আশঙ্কা থেকেই যায়। কথিত আছে, হযরত জরিপ শাহ (রহ.)-র জিন মুরিদেরা মাত্র এক রাতে তার আস্তানার তিন পাশে পরিখা বা খাল এবং খালের দুপাশে সাতটি উঁচু জাঙ্গাল তৈরি করে আস্তানা সুরক্ষার জন্য। উল্লেখ্য, আল্লাহ তায়ালার যে সব প্রিয় বান্দা জায়নামাজে চড়ে সুরমা নদী পার হতে পারেন, তাদের দ্বারা মাত্র এক রাতে খাল ও জাঙ্গাল তৈরি করা মামুলি ব্যাপার। হযরত জরিপ শাহ (রহ.)-র এই কেরামতি দেখে মানুষ দলে দলে মুসলমান হতে লাগলো।

অনেকেই মুসলমান না হলেও তার ন্যায়বিচার ও উদারতার জন্য অনুগত হলো। হজরত জরিপ শাহ (রহ.)-র আস্তানাটি পরবর্তীতে “গড়জরিপা” নামে পরিচিতি লাভ করে।

বিশেষত হযরত জরিপ শাহ (রহ.)-র আগমণের পর আরব ও ইয়েমেন থেকে ধর্মপ্রচারকগণ এই এলাকায় বেশি বেশি আসেন। শ্রীবরদীর ঘোনাপাড়ায় পীর আব্দুল কাদির (রহ.), শেরপুরে মীর আব্দুল বাকী (রহ.) দরগাহ স্থাপন করেন। শেরপুরে শাহ কামাল (রহ.)-র মাজার, মছল্লম গাজির দরগাহ, শ্রীবরদীতে খাজা বশির উদ্দিন (রহ.), ফতে মাহমুদ (রহ.), আব্দুল কাশেম চিশতি (রহ.) মাওলানা লুৎফর রহমান-এর পূর্ব পুরুষগণ উল্লেখযোগ্য। এছাড়াও বয়ড়ায় ছাওয়াল পীরের দরগাহ, রূপনারায়ণকুড়ায় বুড়া পীরের দরগাহ, ভাটপাড়ায় ইমামের দরগাহ, নছমনপুর, পাকুড়িয়া ফকির পাড়া, কুচনিপাড়াসহ বিভিন্ন স্থানে বেশ কিছু দরগাহ ও মাজার ইত্যাদি। এসবের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য আরেকজন সুফি দরবেশ হজরত সোহরাওয়ার্দী (রহ.)।

নামকরণ : “শ্রীবরদী” নামকরণ নিয়ে দুটি তথ্য প্রচলিত। প্রথমটি হলো, সুফি সাধক হজরত সোহরাওয়ার্দী (রহ.)-র নামানুসারে এই এলাকার নাম হয়েছে সোহরাওয়ার্দী > সরোয়ার্দী > সরোবর্দী > স্রবর্দী > শ্রীবর্দী > শ্রীবরদী।

দ্বিতীয় তথ্যটি হলো, জমিদারকন্যা “বরদা” দিদি থেকে “শ্রীবরদী” নামকরণ হয়েছে।

এই তথ্যটি বিশ্লেষণ করে দেখা যায় যে, এককালে বর্তমান নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, কলমাকান্দা, সুসং দুর্গাপুর গড়জরিপা রাজ্য ও পরবর্তীতে দশকাহনিয়া বাজু তথা শেরপুরের অন্তর্গত ছিলো বটে। কিন্তু প্রথমে ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে রাজা “টোডরমল্ল” বঙ্গরাজ্য বন্দোবস্ত করেন। তখন “দশকাহনিয়া” বাজু থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে “সুসঙ্গ” রাজ্য/বাজু প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী কালে ১৬৫৮ খ্রিস্টাব্দে “শাহজাদা সুজা” এবং ১৭২২ খ্রিস্টাব্দে “মুর্শিদকুলি খান” “বাংলা/ বঙ্গ” বন্দোবস্ত করেন। এসব বন্দোবস্তে সীমানার হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে। তবে সুসঙ্গ ও দশকাহনিয়া/শেরপুর আলাদাই থেকে যায়।

এই “সুসঙ্গ” রাজ্যের একাংশের অধিকারী ছিলেন “গোপীনাথ সিংহ”। তবে জমিদার ছিলেন গোপীনাথের বড় ভাই “বিশ্বনাথ সিংহ”। “গোপীনাথ সিংহের” স্ত্রী “রাণী হরসুন্দরী” এবং “প্রমদা” ও “বরদা” নাম্নী দুই কন্যা ছিলো। ১৮৪৩ খ্রিস্টাব্দে গোপীনাথের মৃত্যুর পর “প্রমদা ও বরদা” রাজধানী “দুর্গাপুর” ছেড়ে “শঙ্করপুর” গ্রামে বসবাস করেন। যা নেত্রকোনার অন্তর্গত। ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে “রাণী হরসুন্দরী” মৃত্যু বরণ করেন। তখন তারা (প্রমদা ও বরদা) মাত্র ১৩ ক্রান্তি অংশ জমিদারীস্বত্ব লাভ করেন বটে। কিন্তু জমিদারী পাননি। দেখা যাচ্ছে, জমিদার কন্যা “বরদা”-র সাথে এই এলাকার সংশ্লিষ্টতা পাওয়া যায় না। তার উপর বরদা-র আমল মাত্র ১৬০–১৮০ বছর আগে। অথচ “শ্রীবরদী” নামকরণ হয়েছে অন্তত ৫০০–৭০০ বছর আগে। তাহলে “বরদা” থেকে “শ্রীবরদী” নামকরণ হওয়া নিতান্তই হাস্যকর।

এছাড়াও ইংরেজ আমলে কোনো এক জমিদারের অধীনস্ত “শম্ভুনাথ” নামে একজন খাজনা আদায়কারী ছিলেন। তিনি নিজের নামানুসারে এলাকার নাম রাখেন “শম্ভুগঞ্জ”। কিন্তু, শম্ভুনাথের পরবর্তী কালে “শম্ভুগঞ্জ” নামটি কার্যত হারিয়ে যায়। যার ফলে “শ্রীবরদী” নামটিই পূণর্বহাল হয়॥

তথ্যসূত্র:

  • ময়মনসিংহের বিবরণ — শ্রী কেদারনাথ মজুমদার
  • ময়মনসিংহের বারেন্দ্র ব্রাহ্মণ জমিদার ( প্রথম খণ্ড) — শ্রীশৌরীন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী
  • শেরপুর জেলার অতীত ও বর্তমান — পণ্ডিত ফছিহুর রহমান
  • শেরপুরের ইতিকথা — অধ্যাপক দেলোয়ার হোসেন
  • ইতিহাস ঐতিহ্য গড়জরিপা — প্রকৌশলী এম আহসান আলী ও মো. আকরাম আলী।
  • শ্যামল বাংলা ২৬/০২/২০২২ আব্দুস সামাদ ফারুক।
  • বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন।
  • ভ্রমণ গাইড।
  • উইকিপিডিয়া, শেরপুর জেলা।

Leave a Reply

Scroll to Top