Our Sherpur

টংক: নিম্নবর্গের অনন্য প্রতিরোধ সংগ্রাম

টংক: নিম্নবর্গের অনন্য প্রতিরোধ সংগ্রাম

টংক আন্দোলন হচ্ছে ব্রিটিশ ভারতের সর্বশেষ গণআন্দোলন। ময়মনসিংহ অঞ্চলের আধিবাসী হাজং গোষ্ঠী মূলত এই আন্দোলন সংগঠিত করে। আর তাদের নেতৃত্ব দেয় সুসং দুর্গাপুরের জমিদার সন্তান কমরেড মণি সিংহ। দীর্ঘ ১২ বছর চলে এই আন্দোলন। প্রাণ হারায় ৬০ জন মানুষ। ব্রিটিশরা অনেকের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেয়। নেতৃত্ব দেয়ার কারণে মনি সিংহ এর বাড়িঘর দখল করে নিয়ে তাতে হালচাষ শুরু করে ব্রিটিশরা।

  • সুসং দুর্গাপুর
  • নেত্রকোনা সুসং দুর্গাপুর

গারো পাহাড় কেন্দ্রিক জমিদারের বনজ আয় কমে যায় এবং বাধ্যতামূলক হাতিখেদা বন্ধ হয়ে যায় পাশাপাশি ইংরেজ কতৃক গারো হিল এক্ট ১৮৬৯ প্রণয়নের ফলে ভূস্বামীরা বেকায়দায় পড়ে যান। তখন বাড়তি অর্থ আদায়ের জন্য টংক ব্যাবস্থা আরোপ করা হয়। টংক স্থানীয় শব্দ অর্থ হলো ধান কড়ারি খাজনা। একর প্রতি ৬ থেকে মতান্তরে ১৫ মণ পর্যন্ত আদায় করা হত। এছাড়া এই প্রথার কৃষক কোন রকম উৎপাদন সহায়তা বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ফসল নষ্ট হলে জমিদার মহাজন দায়িত্ব নেবে না। মোটাদাগে কৃষকের দখলিস্বত্ব ছিলোনা জমির উপর।

জমিদার ও ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে এই আন্দোলনে প্রথম থেকে জড়িত ছিলেন হাজংমাতা রাশিমণি। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৪৬ সালের ৩১ জানুয়ারী ব্রিটিশ বাহিনীর বিরুদ্ধে সুসং এর বহেড়াতলী গ্রামে সরাসরি যুদ্ধে লিপ্ত হন হাজংমাতা রাশিমণি ও তার দল। যুদ্ধের এক পর্যায়ে ব্রিটিশ বাহিনীর গুলিতে তার সহযোদ্ধা সুরেং হাজত শহীদ হন। রাশমণি এর প্রতিশোধ নিতে নিজেই এগিয়ে যান এবং দায়ের আঘাতে দুজন ব্রিটিশ সৈন্যের শিরচ্ছেদ করেন। এক পর্যায়ে ব্রিটিশ সেনাদের হাতে তিনিও নিহত হন। রাশমণি এবং সুরেন্দ্র হাজং হলেন টংক আন্দোলনের প্রথম শহীদ।

নিম্নবর্গের চৈতন্যের অন্যতম বৈশিষ্ট্য সর্বজনীন হিংসার বহিঃপ্রকাশ এবং গণসংগ্রামের মাধ্যমে তার বৈধতা অর্জনে একটি প্রচেষ্টা, যাকে প্রখ্যাত তাত্বিক রণজিৎ গুহ নিম্নবর্গীয় আন্দোলনের ‘পদ্ধতি’ (modality) হিসেবে বর্ণনা করেছেন (Guha, 1999, pp.109-66)।

টংক আন্দোলন

টংক আন্দোলনে ১৯৪৬ সাল থেকে এই সর্বজনীন হিংসা বহিঃপ্রকাশ ঘটে কার্যত, কখনো পুলিশের ওপর গেরিলা আক্রমণ কিংবা জমিদারের কাচারি লুট, কখনোবা গৃহস্থ মহিলারা অতি সাধারণ দেশি অস্ত্র নিয়ে পুলিশকে আক্রমণ করেছেন। কমেরড মণি সিংহ এবং কমেরড প্রমথ গুপ্তর রচনায় এমন ঘটনার অনেক বয়ান লিপিবদ্ধ রয়েছে। যেমন পুলিশের গুলিতে আহত সুসং এর বহেড়াতলী গ্রামের রমণী কুমুদিনী হাজং এর আর্তনাদ শুনে রাশিমনির নেতৃত্বে মিহলা আত্মরক্ষা সমিতির সদস্যরা হাতে তুলে নেয় দা, চেওয়ার এবং রক্ত পতাকা। ৩১ জানুয়ারি ১৯৪৬। রাশিমণি তাঁর সঙ্গীদের উদ্দেশ্যে বেলন- ‘মই তিমাৎ, তিমাৎের ইজ্জত রক্ষা করিব, নাতে মরিব, তরা নীতি লইয়া বইয়া থাক।’ (গুপ্ত, ১৯৬৯, মুক্তিযুদ্ধে আদিবাসী পৃ.৮৩)

অর্থাৎ সংগঠেনর নিয়ম নীতি উপেক্ষা করে স্বতঃস্ফূর্ত আক্রমণের বহিঃপ্রকাশ এখানে ঘটেছে। ১৯৪৮’এর জঙ্গিবাদী আন্দোলেনর সময় সশস্ত্র সিপাহীদের সামেন নিশ্চিত মৃত্যুর কথা জেনেও আন্দোলনকারী লেঙ্গুরা হাটের অগেন্দ্রর চিৎকার, ‘মঙ্গল’দার রক্তের প্রতিশোধ লইেত অগ্রসর হও।’ (গুপ্ত, ১৯৬৯, পৃ.৯৭) আবার পুলিশের গুলিতে আহত হাজং বধূ শঙ্খমণি তার স্বামীর উেদ্দেশ বলেছন— ‘ম কে না চা, শত্রুকে মার, ওর রক্ত লা’। (আমার দিকে তাকিও না শত্রুকে মারো, তাঁর রক্ত আনো)। (গুপ্ত, ১৯৬৯, পৃ.৯৯) এই উন্মত্ত হিংসার প্রকাশ যা উচ্চবেগর্র কাছে অপরাধ হিসাবে গণ্য হয়, তাঁর মাধ্যমেই নিম্নবর্গের চৈতন্যে গণসংগ্রামে রূপ নেয় এবং তাদের দাবির পক্ষে বৈধতা আদায়ের চেষ্টা করে।

টংক বিরোধী এই হাজং জনজাতির বিদ্রোহের আলোচনায় তর্কাতীতভাবে স্পষ্ট হয়ে উঠে তা হল শাসক এবং শোষনের বিরুদ্ধে সুদীর্ঘ সংগ্রাম যা কখনও নিয়ন্ত্রিত, কখনও সশস্ত্র কখনও-বা জঙ্গি আকারে প্রকাশিত হেয়েছ। তবে বিভিন্ন সময়ে এবং পরিস্থিতিতে এই নিম্নবর্গীয় আন্দোলন তার চরিত্র বদল করেলও শেষ পযর্ন্ত ঘোড়ার লাগাম ছিল বহিরাগত বামপন্থী নেতৃত্বের হাতেই। একদিকে পুঁজিবাদী ঔপনিবেশিক শাসকের আধিপত্য বিস্তার, অপরিদেক তাদের সহেযাগী ক্ষয়িষ্ণু ভূস্বামীদের আধিপত্য রক্ষার সামন্ত কৌশল, আর এই দ্বৈত শাসন ও শোষণের মাঝে হাজং জনজাতির কৃষক অধিকার আদায় ও মুক্তি সংগ্রাম আরও জটিল এবং কণ্টকাকীর্ণ হয়ে উঠেছিল। ফলত নিম্নবর্গের প্রতিরোধ নানা কারণে ছিল আঞ্চলিকতায় সীমাবদ্ধ। তা কখনো জনজাতি অধ্যুষিত পর্বত অঞ্চল অতিক্রম করেনি।

রিয়াদ আল ফেরদৌস
লেখকঃ রিয়াদ আল ফেরদৌস

বিদ্রোহে হাজংদের অংশগ্রহণ সর্বাত্মক হলেও ডালু ও গারোদের যোগদান ছিল নগন্য। নিকটবর্তী মুসলমান কৃষকরা এই বিদ্রোহ সমর্থন করেলও তাঁরা সশস্ত্র সংগ্রামে অংশগ্রহণ করেনি, বরং শেষ দিকে সাম্প্রদায়িক সংঘাত এই সুদীর্ঘ সংগ্রামকে দুর্বল করে। বামপন্থী নেতৃত্বের নীতিগত অন্তর্দ্বন্দ্বের (সংস্কারবাদ বনাম স/শস্ত্র প্রতিরোধ) কারণে দিনশেষে শাসেকর স্বৈ/রতন্ত্রের মুখে এই নিম্নবর্গের আন্দোলন স্তিমিত হয়ে যায়।

Leave a Reply

Scroll to Top