সুজলা-সুফলা, শস্য-শ্যামলা, ছায়া ঢাকা, পাখি ডাকা নয়নাভিরাম সৌন্দর্যে পূর্ণ আমাদের এই বাংলাদেশ। দেশের উত্তর সীমান্তে ছোট একটি জেলা শেরপুর। এ জেলার অন্যতম একটি উপজেলার নাম ঝিনাইগাতী। পাহাড়ি এলাকার সাধারণ বৈশিষ্ট্য হলো, একদিকে টিলা-উঁচু ভূমি; অন্যদিকে গভীর-অগভীর ছোট বড় খাদ। তার ফাঁক-ফোকরে সমতল ভূমি। গারো পাহাড়ও ব্যতিক্রম নয়। এই এলাকায় ঘন ঘন অসংখ্য খাদ ও খানাখন্দে ভরা প্রচুর ঝিনুক পাওয়া যেতো। এখনও পাওয়া যায় বটে। ঝিনুককে আঞ্চলিক ভাষায় বলা হয় ঝিনই, ঝিনাই। আর খাদ বা খানাখন্দকে বলা হয় গাত, গাতা, গাতি, গাতী। এই ঝিনাই (ঝিনুক) ও গাতী (খাদ) মিলে এলাকার নামকরণ হয়েছে, “ঝিনাইগাতী”।
ঝিনাইগাতীর পর্যটনে প্রথমে আসে “গজনি অবকাশ” । অবকাশ ঘিরে বসত করে গারো, হাজং, কোচ, ডালু, চাকমা, চনচইঙ্গা, মান্দি, খাসি সহ বিভিন্ন সম্প্রদায়ের লোক। হাজার বছর ধরে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিদ্যমান। তাদের হাতে তৈরি তাঁতের শাড়ি সারা দেশের সমাদৃত। বন্যপ্রাণী, ঝর্ণাধারা, হ্রদ ও প্রাকৃতিক দৃশ্য উপভোগের জন্য সুউচ্চ ওয়াচ টাওয়ার নির্মাণ করা হয়েছে। যাতায়াতের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে রঙ্গিন ও প্রশস্ত রাস্তা। বাঘ, হাতি সহ নানা প্রাণীর ভাস্কর্য, দোলনা, লেক, পেডেল বোট, ঝুলন্ত সেতু বাড়তি প্রণোদনা যোগায়। শৌচাগার, বিশ্রামাগার ও তথ্যকেন্দ্র স্থাপন করা হয়েছে।
খুব বড় না হলেও চিড়িয়াখানা আছে, বেশ সমৃদ্ধ। সারি সারি শাল, সেগুন, গজারি, অশ্বত্থ, পাকুরসহ নানা জাতের গাছ, আনারসের বাগান। ইতোমধ্যে পরীক্ষামূলক চা বাগান করা হয়েছে। বন্যপ্রাণী, পাখপাখালি তো আছেই। সাথে আছে প্রচুর মৌচাক। উল্লেখযোগ্য একটি বট গাছে ৫০ (পঞ্চাশ) থেকে ৭৩ (তিয়াত্তরটি) পর্যন্ত মৌচাক দেখা যায়।
মেঘালয় ঘেঁষা সন্ধ্যাকুড়ায় আছে বিশাল রাবার বাগান। রাবার গাছের সৌন্দর্য ও রাবার তৈরি উপভোগ করতে বহু পর্যটক আসেন।
নিকটেই আছে, “চুকোলুপি চিলড্রেন পার্ক”। প্রাকৃতিক দৃশ্যের পাশাপাশি নানা ধরনের রাইড মনকে চাঙ্গা করে তোলে।
স্বল্প দূরত্বে গান্ধীগাঁওতে আছে, “বনরানি ফরেস্ট রিসোর্ট”। গাড়ি পার্কিং, শৌচাগার, বিশ্রামাগার থাকায় সারা বছর পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে।
অদূরে তাওয়াকুচা গ্রামে পাহাড়ের আড়ালে বিস্তীর্ণ মাঠ, ছোট বড় সবুজ টিলা, বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ এবং “মায়াবী লেক”। বন্যপ্রাণী সংরক্ষণের তাগিদে মায়াবী লেকের ধারে কোনো রিসোর্ট তৈরি করা হয়নি। যাওয়া-আসা বেশ কষ্টসাধ্য। তবুও এর সৌন্দর্যের টানে পর্যটকদের ভিড় লেগেই থাকে।
পিট কয়লা ও ছোট পাথরের খনি এই গজনি পাহাড়। পরিবেশের ভারসাম্য বজায় রেখে সীমিত আকারে কয়লা ও পাথর সংগ্রহের অনুমতি আছে বটে। কিন্তু, এই সুযোগে কিছু অসাধু লোক ব্যাপক হারে সংগ্রহ করছে বছরের পর বছর ধরে। যার ফলে পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা বিদ্যমান। সংশ্লিষ্টদের সুদৃষ্টি কামনা করছি।
নকশি ক্যাম্পের পতনের মাধ্যমে মহান মুক্তিযুদ্ধে ঝিনাইগাতীর বিজয় অর্জিত হয় ৪ঠা ডিসেম্বর ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দ। নকশি, জোলগাঁও, আহম্মদ নগর, জগৎপুর, বগাডুবিসহ বহু গণকবর এখনও অরক্ষিত অবস্থায় আছে। এগুলো সংরক্ষণ করে দর্শনীয় সৃতিস্তম্ভ নির্মাণ করলে পর্যটকদের দৃষ্টি আরও বাড়বে।
নালিতাবাড়ির গর্বিত সন্তান বীর মুক্তিযোদ্ধা নাজমুল আহসান। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সাথে সন্মূখযুদ্ধে কাটাখালি পুলের স্থানে নির্মমভাবে শাহাদাত বরণ করেন। তার স্মৃতিতে কাটাখালি পুরাতন পুলে “শহিদ নাজমুল স্কয়ার” নির্মাণ করা হয়েছে। এই “শহিদ নাজমুল স্কয়ার” পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে।
কাটাখালি পুলের কাছেই ঘাগড়া গ্রাম। ঘাগড়া গ্রামেই আছে মুঘল আমলে নির্মিত ঐতিহ্যবাহী “খানবাড়ি জামে মসজিদ”। এটি “লস্করবাড়ি জামে মসজিদ” নামেও পরিচিত। বহু পর্যটক ও প্রত্নতত্ত্ববিদ পরিদর্শন করতে আসেন।
হাডুডু, নৌকা বাইচ, ঘোড়দৌড়, মইদৌড়সহ নানা ধরনের দেশি খেলাধুলা, কিচ্ছা, জারি, মারফতি গান, ভরিয়ে দেয় সবার মনপ্রাণ।