পর্যটনে শেরপুর সদর (পুঁথিকাব্য)
হারুনুর রশীদ
আল্লাহ স্মরণ করি (২) দরুদ পড়ি রাসুলুল্লাহর প্রতি।
পিতা-মাতা, গুরুজনে জানাই সালাম-ভক্তি॥
তারপর একে একে (২) কথা ছেঁকে করি নিবেদন।
শেরপুর জেলার গৌরবগাঁথার কিছু বিবরণ॥
রূপে-গুণে রানি (২) সবাই জানি আমাদের এই জেলা।
মন ভরে যায়, চক্ষু জুড়ায় পুরাকীর্তি মেলা।
সবুজ ছায়া ঘেরা (২) মায়া ভরা আমাদের শেরপুর।
পর্যটনে প্রাণে মনে আনন্দ ভরপুর॥
আছে গারোপাহাড় (২) রূপের বাহার ঝর্ণাধারা থেকে।
আড়াআড়ি নদী বয়ে চলে এঁকেবেঁকে॥
বনে বন্যপ্রাণী (২) আছে জানি নানা জাতের গাছ।
সমতলে ফসল ফলে, নদী-নালায় মাছ॥
একটি উপজেলা (২) খোলামেলা শেরপুর সদর নামে।
যতই দেখি ততই ভালো লাগে ডানে-বামে॥
“ইচলি” বিলের কাছে (২) জায়গা আছে “কোদালঝাড়া” নামে।
“দমদমাতে” সৈনিকেরা প্রশিক্ষণে ঘামে॥
আঠারো শ’ সাতে (২) বর্ণনাতে লেখা আছে জানি।
বৃটিশেরা তৈরি করে এই দমদমাখানি॥
বিপ্লবী নিয়োগী (২) ভূক্তভোগী, হার না মানা নেতা।
বাগান ঘেরা বাড়ি আছে শেরপুর টাউন যেথা’॥
বহু মুক্তিযোদ্ধা (২) জানাই শ্রদ্ধা মোস্তফা, বুলবুল।
স্মৃতি মাখা মৃগী নদীর উপর শেরীপুল॥
সাতই ডিসেম্বরে (২) অর্জন করে শেরপুরের বিজয়।
দারগ আলী পার্কে বিশাল লোক সমাগম হয়॥
বিজয় নিশান ওড়ে (২) হৃদয় জুড়ে স্বাধীনতার সুখ।
ভাই হারানোর বেদনাতে ভারাক্রান্ত বুক॥
মৃগী নদীর ধারে (২) ‘কসবা’ গাড়ে শাহাজাদা সুজায়।
‘কসবা’ মানে প্রশাসনিক ছোট কেন্দ্র বুঝায়॥
একুশ বছর ধরে (২) বসত করে রাজ্য শাসন চালান।
শাহাজাদা সুজার পিতা সম্রাট শাহজাহান॥
আজও মুঘল বাড়ি (২) নাপিত বাড়ি, থানাঘাট, কাঠগড়।
কাচারিঘাট, ধোপাঘাট নাম স্মৃতিতে ভাস্বর॥
বাজার ছিলো সস্তা (২) তার অবস্থা এক টাকা মণ ধান।
অন্য সকল পণ্যমূল্য হারাহারি মান॥
শৌখিন মানুষ যারা (২) পূর্বপাড়া চরশেরপুরে যাবে।
বিখ্যাত জামদানি শাড়ি মনের মতো পাবে॥
পাবে তাঁতের শাড়ি (২) রংবাহারি হস্তশিল্প মেলা।
নৌকা বাইচ, ঘোড়ার দৌড়, দেশি বহু খেলা॥
আজাহারের বাগান (২) শোন বাখ্যান, চিনি “অর্কিড” নামে।
“শ্যামলী পার্ক” অবস্থিত ঢাকলহাটি ধামে॥
আছে “গাজীর মাজার” (২) গাজীর খামার গিদ্দাপাড়া গ্রামে।
এই অঞ্চলের নামকরণ শের আলী গাজীর নামে॥
সুফি আব্দুল বাকী (২) বলে রাখি, বিবি মাইসাহেবা।
আত্মত্যাগী ভূক্তভোগী করে ধর্মের সেবা॥
জি কে পাইলট স্কুল (২) বলিনি ভুল, সবার নজর কাড়ে।
পৌনে তিন জমিদার বাড়ি ঘেরা ঝোপে ঝাড়ে॥
ডি সি লেকের ধারে (২) নজর কাড়ে বাগান, ঝর্ণাধারা।
মন ভরে না প্যাডেল বোটে ঘোরাঘুরি ছাড়া॥
শাহ কামালের মাজার (২) তেরা বাজার, কসবা মুঘলপাড়ায়।
মসজিদ দেখে ঐতিহ্যময় স্মৃতিতে মন হারায়॥
শনি, গোপীনাথ (২) রঘুনাথ, অন্নপূর্ণা মন্দির।
ভিন্ন ধর্মের ভিন্ন রীতি সাম্প্রদায়িক সন্ধির॥
সনাতনী যারা (২) আজও তারা পূজা-পার্বণ করে।
অষ্টমী স্নান, বারুণী স্নান করে শ্রদ্ধা ভরে॥
গল্প , ছড়া লেখক (২) ও গবেষক, আছে কাব্যপ্রেমী।
সাইফুল্লাহ পান সম্মাননা বাংলা একাডেমি॥
কবি জিতেন সেন (২) জিতিয়াছেন কোলকাতার গোল্ড মেডেল।
চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কার বিদ্যাবুদ্ধি অঢেল॥
গিরিশ চন্দ্র সেন (২) প্রকাশ করেন বঙ্গানুবাদ কোরান।
হরচন্দ্রের চারু প্রেসে পয়লা মূদ্রণ করান॥
“বিষাদ সিন্ধু” গ্রন্থ (২) কয়েক খণ্ড ছাপে চারু প্রেসে।
“চারু ভবন” দেখতে পাবেন এই শেরপুরে এসে॥
পুঁথি, কেচ্ছা, গাঁথা (২) নকশি কাঁথা, মণ্ডা, মিঠাই, মিষ্টি।
ধানের চাতাল, বাঁশের শিল্প অনবদ্য সৃষ্টি॥
প্রিয় শেরপুরবাসী (২) ভোগবিলাসী তুলশিমালার গন্ধে।
মহিষের দই, ছানার পায়েস, পিঠা খাই আনন্দে॥
সবাই সবার প্রতি (২) শ্রদ্ধা-ভক্তি দৃঢ় মনোবলে।
প্রয়োজনে মিলিত হই এক পতাকাতলে॥
দাদা গরিবুল্লাহ (২) বলি খুইলা পিতা রজব আলী।
মায়ের নামটি হাজেরা আর নানা আস্কর আলী॥
আমি অধম হারুন (২) মুর্খ দারুণ, জানি কি আর অত?
যা জেনেছি তাই লেখেছি, করে নিজের মত॥
বলি সবার কাছে (২) বাকি আছে বহু তথ্য-কথা।
অনুসন্ধান করলে পাবেন কথার যথার্থতা॥
ত্রুটি থাকে যদি (২) শেষ অবধি ধরিয়ে দিন, তবে।
কথা দিলাম শ্রদ্ধা ভরে সংশোধিত হবে॥
আমার কথা যত (২) আপাতত হয়ে গেলো শেষ।
ইতিহাসে ঐতিহ্যময় সোনার বাংলাদেশ॥
আমার — সোনার বাংলাদেশ॥
টীকা:
জামদানি পল্লী: শেরপুর সদর উপজেলার চরশেরপুর গ্রামে কামরুল ইসলাম এবং ভাটিলঙ্গরপাড়া গ্রামের এনামুল হক জামদানি পল্লী গঠন করেছেন। দেশে বিদেশে শেরপুরের জামদানি শাড়ির ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
সুফি আব্দুল বাকী ও মাইসাহেবা: সুফি দরবেশ মীর আব্দুল বাকী। তার সততায় মুগ্ধ হয়ে দশকাহনিয়া বাজুর অন্তর্গত সুসাং এর মহারাজা ২৭ ( সাতাস ) একর জমি দান করেন। কিন্তু, তার মৃত্যুর পর স্ত্রী ছালেমুন নেছা (মাইসাহেবা)-র সময় তৎকালীন জমিদার রাধা বল্লভ চৌধুরী মাত্র ৮ (আট) শতাংশ ছাড়া সব জমি জবর দখল করে নেয়। যে আট শতাংশ জমি দখলমুক্ত ছিলো, সেই জমিতেই স্থাপিত হয় শেরপুর শহরের প্রথম মসজিদ। সেটিই বিখ্যাত মাইসাহেবা জামে মসজিদ। পরবর্তীতে মসজিদের জমি পরিবর্ধন করা হয়েছে।
নিয়োগী: বিপ্লবী রবি নিয়োগী। পিতা রমেশ চন্দ্র নিয়োগী। মাতা সুরবালা নিয়োগী। জন্ম ৩০/০৪/১৯০৯ এবং মৃত্যু ১০/০৫/২০০২ খ্রিস্টাব্দ। বৃটিশ বিরোধী অবিসংবাদিত বিপ্লবী নেতা। টঙ্ক আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ সহ জীবদ্দশায় জনহিতকর প্রায় সব আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। জীবনে ৩৪ বছর কারা ভোগ করেছেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের একজন অবিসংবাদিত আন্দামান ফেরত বিপ্লবী নেতা।
হরচন্দ্র : জমিদার হরচন্দ্র রায় চৌধুরী। শেরপুরের প্রথম প্রেস চারু প্রেস প্রতিষ্ঠা করেন। এই চারু প্রেস থেকেই সাপ্তাহিক চারু বার্তা প্রকাশিত হয় ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে। হরচন্দ্র রায় চৌধুরী বাংলা, সংস্কৃত, আরবি, ফারশি, ও ইংরেজি ভাষায় বিদ্বান ছিলেন। তার রচিত গ্রন্থাবলী — উপাসনোল্লাসিনী, শ্রীবৎস উপাখ্যান, শেরপুর বিবরণী (১৮৭২), বংশানুচরিত (১৮৮৬), শেরপুরের বংশাবলী, মানুষের মহত্ত্ব, ভারতবর্ষীয় আর্য জাতির কর্মকাণ্ড।
মোস্তফা ও মৃগী নদী: শহিদ গোলাম মোস্তফা। পিতা আছির উদ্দিন তালুকদার। মাতা মাহমুদা খাতুন। পাকিস্তানে সৈন্যরা তাকে ধরে নিয়ে যায় এবং পরে মৃগী নদীর শেরি পুলের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে ২৩শে আগস্ট দিবাগত রাত বারোটার পর। স্মৃতি বিজড়িত শেরী পুলের ধারে শহিদ গোলাম মোস্তফা স্কয়ার এবং রাষ্ট্রীয় সম্মাননা দাবি করছি।
চন্দ্রকান্ত: মহাপণ্ডিত চন্দ্রকান্ত তর্কালঙ্কার। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক। অবিভক্ত ভারতে কোলকাতা সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ ছিলেন। এছাড়াও পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটির “গভর্নমেন্ট সংস্কৃত উপাধি” পরীক্ষার পরীক্ষক এবং “এশিয়াটিক সোসাইটি অব বেঙ্গল”-এর সদস্য ছিলেন। সতী পরিণয়, শিশুশিক্ষা ও প্রাথমিক পাঠশালা সহ ৩১টি গ্রন্থ রচনা করেছেন। এছাড়াও মঞ্চনাটকে অদ্বিতীয় প্রতীভার অধিকারী ছিলেন।
সাইফুল্লাহ: বিশিষ্ট কবি ও গবেষক। সাহিত্যে শেরপুর জেলার প্রথম বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন ২০২৪ খ্রিস্টাব্দে।
জিতেন সেন: বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক। অবিভক্ত ভারতে কোলকাতার গোল্ড মেডেল লাভ করেন।