মৃত্যুর প্রহর গণনায় নওজোয়ান মাঠের সাক্ষী শতবর্ষী বটবৃক্ষ
রিয়াদ আল ফেরদৌস
টাউন শেরপুরের জমিদারের একসময় গুরুত্বপূর্ণ মহাল ছিল নালিতাবাড়ীর আড়াইআনী অধুনা নালিতাবাড়ী বাজার। শেরপুরের ইতিহাস ঐতিহ্যের সুলুকসন্ধানে অবশ্যম্ভাবীভাবে উঠে আসবে আড়াইআনী বাজারের নওজোয়ান মাঠের কথা, মাঠের অতীত গৌরবের কথকতা। তখন ভোগাই প্রমত্তা নদী। ওপারে তারাগঞ্জ বাজারে হান্টার্স ইলাভেন এবং আড়াইআনী বাজারের নওজোয়ান ক্লাবের ফুটবল খেলা মানেই তুলকালাম কাণ্ড উত্তেজনা আর মর্যাদার লড়াইয়ের দামামা।
এরই মাঝে ১৯৪৩ সালের ১০,১১,১২ মে মাসে এই নওজোয়ান মাঠে ঘটে যায় বিগত শতকের শ্রেষ্ঠ স্থানিক এক ঐতিহাসিক ঘটনা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরে তখন ভারতবর্ষের স্বাধীনতার সংগ্রাম দাবানলের মত ছড়াচ্ছে দ্রুতলয়ে। মেহনতী কৃষক, নিপিড়ীত আদিবাসী, হিন্দু মুসলিম সকল জনতা পাহাড়ি জনপদে দীর্ঘ দুশো বছরের উপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খল মুক্তি করতে বহুতলীয় আন্দোলনে যুক্ত।
ফকির বিদ্রোহ থেকে শুরু করে টঙ্ক আন্দোলনের উত্তপ্ত ভূমি এই নালিতাবাড়ী সহ গারো পাহাড়ের সমতলে ৭০ মাইল দীর্ঘ ব্রহ্মপুত্র পর্যন্ত প্রশস্ত পাহাড়ি জনপদ। বঙ্গীয় প্রাদেশিক কৃষক সম্মেলনের ষষ্ঠ সম্মেলন নালিতাবাড়ীর নওজোয়ান মাঠে আয়োজন করা হয়। উপস্থিত হয়েছিলেন সর্বভারতীয় কিংবদন্তি কৃষক আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ।
সম্মেলন উদ্বোধন করেছিলেন সাহিত্যতাত্ত্বিক গোপাল হালদার, সভাপতিত্ব করেছিলেন কমরেড মোজাফফর আহমদ এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন সারাভারত কৃষক আন্দোলনের কিংবদন্তি নেতা কমরেড আবদুল্লাহ রসুল। এছাড়াও মণি সিংহ এবং কমরেড রবি নিয়োগী সম্মেলন আয়োজনে মূখ্য ভূমিকা রাখেন। নালিতাবাড়ীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সন্তান জেলফেরত বিপ্লবী জলধর পালের নেতৃত্বে আয়োজক কমিটি গড়ে উঠেছিল।
নালিতাবাড়ী সম্মেলন আয়োজন সম্পর্কে আবদুল্লাহ রসুল লিখেছেন: ” সে পর্যন্ত যতগুলি প্রাদেশিক সম্মেলন হয়েছিল তার মধ্যে নালিতাবাড়ী সম্মেলন ছিল সবচেয়ে সংগঠিত ও বিভিন্ন দিক থেকে কর্মীদের জন্য সবচেয়ে উৎসাহজনক। জায়গাটা ছিল বাইরের জগৎ থেকে বেশ দূরে, শেরপুর টাউন থেকে হাটা পথে ১৩ মাইল। কাছাকাছি পাহাড় এলাকা ও আদিবাসী কৃষকদের বসতি। তখন ওদিকে বেশ বর্ষা। কৃষক সভার জীবনে আন্দোলন ও সংগঠন সম্বন্ধে নালিতাবাড়ী সম্মেলন এক নতুন পরিস্থিতির সূচনা করে, নতুন নতুন কাজের ইঙ্গিত দেয়, কর্মী ও ভলান্টিয়ারদের মধ্যে নতুন উৎসাহ সৃষ্টি করে। পরবর্তী কালের আন্দোলন ও সংগঠনে তার সুস্পষ্ট ছাপ থেকে যায়।”
সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য বিষয়- টঙ্ক প্রথার উচ্ছেদ, খাদ্য সমস্যা ও সংগঠন সম্পর্কিত আলোচনা, উৎপাদন বৃদ্ধি ও তেভাগা আন্দোলন প্রসঙ্গে। নওজোয়ান মাঠের সেই কালোচিত পরিণতির সম্মেলন যে বটবৃক্ষ তলে প্রকম্পিত করেছিলো কৃষক মজদুরের বিপ্লবী কন্ঠ “টঙ্ক নাই-টঙ্ক নাই, রাজা জমিদারের ধান্য নাই, লাঙল যার জমি তার, জল যার জাল তার” সে শতবর্ষী বটবৃক্ষ আজো ঠায় দাঁড়িয়ে সাক্ষ্য দিচ্ছে। মাঠের অস্তিত্ব আজ আড়াইআনী বাজারে নেই কিন্তু বাজারের মাঝে বটগাছটি বার্ধক্যে জীর্ণশীর্ণ হয়ে মৃত্যুর প্রহর গুনছে আর মহাকালের সাথে আজকের প্রাসঙ্গিকতার জানান দিচ্ছে।
এক জমানার নদীতীরবর্তী ঘাসের চত্ত্বরের বাতাবরণে গড়ে বেড়ে ওঠা বটের চারদিকে আজ কংক্রিটের পোক্ত ঢালাই বহুবছর ধরেই। বাজারের পরিবেশ ও প্রতিবেশকে শতাব্দী ধরে ছায়া ও অক্সিজেন যুগিয়েছে সে। কিন্তু আজ তার কণ্ঠে মৃত্যুবেড় হয়ে কংক্রিটের ঘেরাও ক্রমেই শ্বসন এবং জল শোষন প্রক্রিয়া অসম্ভব করে তুলছে নিয়ত। চারপাশে শুধু দালান, ঘরবাড়ি, বানিজ্যিক হাট বাজার। শুনা যায় হাটবাজার পুন:নির্মাণ হবে। শঙ্কা বটগাছটা কি…!!
সাম্প্রতিক সময়ে নালিতাবাড়ীর স্থানীয় সাহিত্য পত্রিকা ‘বালুচর‘ একটি বিশেষ সংখ্যা আয়োজন করেছে ১৯৪৩ সালের নওজোয়ান মাঠের সম্মেলন আয়োজন, পরিপ্রেক্ষিত, বিশ্লেষণ, ঐতিহাসিক দলিল এবং গুরুত্বপূর্ণ সাক্ষীদের স্মৃতি কথা নিয়ে। তল থেকে দেখা নালিতাবাড়ীর ইতিহাস চর্চায় গুরুত্বপূর্ণ একটি উপাদান বালুচরের চতুর্থ সংখ্যা।
স্থানীয় বিশিষ্ট জনরা মনে করেন ঐতিহাসিক এই সম্মেলনের স্মৃতি সংরক্ষণ করা একটি জরুরী সামাজিক ও সাংস্কৃতিক দায়িত্ব। স্থানীয় সরকার ও পৌর প্রশাসন এই বিষয়ে গুরুত্ব সহ বিবেচনা করবেন বলে সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা মনে করছেন। শতবর্ষী এই বটবৃক্ষ নালিতাবাড়ীর ইতিহাস, ঐতিহ্যের অমূল্য এক স্মারক। বৃক্ষটিকে যথাযথ পরিচর্যা এবং তলদেশের কনক্রিট আস্তরণ সরিয়ে দিলে কিছুদিন হলেও বেশি টিকে থাকবে কালের সাক্ষী হয়ে। স্থানীয় ইতিহাস সংরক্ষণে গুরুত্বপূর্ণ একটি পদক্ষেপ হতে পারে শতবর্ষী বটবৃক্ষকে রক্ষা করা।
লেখকঃ সম্পাদক- বালুচর, প্রাবন্ধিক।