ডালু নাকুগাঁও গণহত্যাঃ একটি বিস্মৃত রণাঙ্গন
১৭ ই এপ্রিল ১৯৭১। মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলায় (মুজিব নগর) অস্থায়ী বাংলাদেশ সরকারের শপথ গ্রহণের মধ্য দিয়ে বাঙালির স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রথম প্রাতিষ্ঠানিক অভ্যুদয় ঘটে। সেই মাহেন্দ্রক্ষণে উপস্থিত হাজার মুক্তিকামী জনতাকে স্বাধীনতা সংগ্রমের শপথবাক্য পাঠ করান মেজর খালেদ মোশাররফ (বীর উত্তম) এবং ঠিক পরক্ষণেই ” জয় বাংলা… “তোমার নেতা আমার নেতা – “শেখ মুজিব,শেখ মুজিব”.. সংগ্রাম, সংগ্রাম.. চলবেই, চলবেই.. এই বজ্রকণ্ঠের ধ্বনি আবির হয়ে সারা পূর্ব বাংলার (বাংলাদেশ) আকাশে বাতাসে আলোর গতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল, যেখানে মিশে ছিল হাজার বছরের লালিত মুক্তির আকাঙ্ক্ষা।
অখন্ড পাকিস্তানের কফিনে শেষ পেরেক ঠুকা হয়ে গেছে অনেক আগেই। মুক্তিকামী সর্বোস্তরের বাঙালি তখন সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্যে দিয়ে মাতৃভূমির সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে মরণপণ রণাঙ্গনে উপস্থিত। ৭ মার্চ ১৯৭১,বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মুক্তির যে বীজ মন্ত্র বাঙালিকে দিয়েছিলেন সংগ্রাম করে স্বদেশ মুক্ত করতে, ২৫ মার্চ পরবর্তী পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বর্বরোচিত গণহত্যা, পাকিস্তানের কারাগারে বন্দি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব এবং ইয়াহিয়া খানের গুপ্ত ষড়যন্ত্রের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ইতোমধ্যে সারা দেশে গণহত্যা, লুন্ঠন আর অগ্নিসংযোগ করে নিরস্ত্র বাঙালি নিধনের অভিযানে লিপ্ত হয়।
২৬, মার্চ ১৯৭১ হতে প্রথম সপ্তাহে সারা দেশ থেকে যেসব মুক্তিকামী মানুষের জনস্রোত প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যের তথা পশ্চিমবঙ্গ, বিহার, ত্রিপুরা, আসাম, মেঘালয় অভিমুখে যাত্রী হয় তা কল্পনাতীত হারে বাড়তে থাকে দিন দিন। প্রথম সপ্তাহে মাত্র কয়েক হাজার আওয়ামিলীগ নেতা-কর্মী ও বিদ্রোহী সশস্ত্র বাহিনীর সদস্য ভারতে প্রবেশ করে। পাকিস্তানী হানাদারদের নৃশংসতায় রাজধানী হতে সুদূর মফস্সল অবধি বিসৃত এই জনস্রোত এপ্রিলের তৃতীয় সপ্তাহে ১১ লক্ষের কাছে এবং মে মাসে আরো ৩১ লক্ষ বিপন্ন মানুষ ভারতে আশ্রয় নেয়। বাংলাদেশের-সাথে ভারতের ৪০৯৬ কি.মি. এর বিসৃত সীমান্ত। এই সীমান্তের ৪৪৩ কি.মি. মেঘালয়ের সাথে এবং এই লাগোয়া সীমান্ত মেঘালয় ও অন্যান্য অঙ্গরাজ্যের জনজীবনের সাথে মুক্তিযুদ্ধকে তৎকালীন বাস্তবতায় সংযুক্তিতে বাধ্য করে।
এপ্রিল ১৯৭১ থেকে ১ জুন পর্যন্ত আসাম ও মেঘালয়ে মোট ৪,১০,০০০ বাঙালি শরণার্থী প্রবেশ করে যাদের ৩,২৮,১৩৫ জনকে বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় দেয়া হয় বাকিরা আত্মীয় স্বজন এর বাড়িতে আশ্রয় গ্রহণ করেন। শুধু মেঘালয়ে প্রায় ২২৩০০০ জন বাঙালি আশ্রয় গ্রহণ করেন। সর্বশেষ ভারতীয় সরকারি হিসেবে ১৯৭১ সালের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশ থেকে বিভিন্ন ভারতীয় রাজ্যে সর্বমোট ৯৮ লক্ষ ৯৯ হাজার ৩০৫ জন শরণার্থী প্রবেশ করে। এর মাঝে ৬,৬৭,৯৮৬ জন উদ্বাস্তু শরণার্থী মেঘালয় রাজ্যের পাহাড় ও সমতলে আশ্রয় নেয়। এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে বাঙালি শরণার্থীদের ক্রমবর্ধমান চাপ ভারত সরকারের নীতিনির্ধারণী মহলে এক তীব্র উৎকণ্ঠার সৃষ্টি করে।
পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী ভারতের সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে অনিশ্চয়তা বোধ করলেও দ্রুতই বুঝতে পারে যে পূর্বাঞ্চলে ভারতীয় সেনাদের সম্যক প্রস্তুতি এবং স্বল্প সংখ্যার জন্য তারা পাল্টা প্রিতিরোধে হয়ত সমর্থ নাও হতে পারে। ব্যাপক শরণার্থী সংখ্যা বৃদ্ধি এই পাঁচ অঙ্গরাজ্যের সমতল ও পাহাড়ি, গারো, হাজং, কোচ আদিবাসী, অপেক্ষাকৃত দরিদ্র ও ঘনবসতিপূর্ণ অঞ্চলের জন্য আর্থসামাজিক চাপ, দ্রব্যমূল্য উর্ধগতি বাড়াতে থাকে। পাহাড় বেষ্টিত পশ্চিম গারো পাহাড়ের মেঘালয় অঞ্চলে মূলত তুরা শহর যা মুক্তিযুদ্ধের কর্মকান্ডের মূল একটি বড় ঘাঁটিতে পরিণত হয়।
ভারতে তৎকালীন রাষ্ট্র ক্ষমতাশীন দল কংগ্রেস তথা প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্ধিরা গান্ধীর উপর সামগ্রিক পরিস্থিতি উদ্বেগজনক হয়ে ওঠে মে, ১৯৭১ এ এবং সৃষ্টি করে এক অনিবার্য বাধ্যবাধকতা। বাংলাদেশ সংকটের উপযুক্ত সমাধান অনুসন্ধানে বাংলাদেশের অভ্যন্তরে যেন মুক্তিসংগ্রাম স্তিমিত না হয়ে যায় এ মর্মে ছাত্র যুবকদের প্রশিক্ষণ দানে ভারত সরকার নীতিগতভাবে সম্মত হয় ৩০, এপ্রিল ১৯৭১। মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করার জন্য ৯ই মে ভারতীয় সেনাবাহিনীকে দপ্তরাদেশ দেয়া হয়, তাদের হাতে ন্যস্ত হয় মুক্তিযুদ্ধে যোগদানেচ্ছু বাঙালিদের সশস্ত্র প্রশিক্ষণের দায়িত্ব।
এপ্রিল মাসে ভারতীয় সীমান্ত নিরাপত্তারক্ষী বাহিনী বি.এস.এফ বিক্ষিপ্তভাবে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ এবং অস্ত্র সরবরাহ ও সামগ্রিক অন্যান্য বিষয়ে যে স্বল্প সাহায্য শুরু করেছিল তার উন্নতি ঘটতে থাকে। ভারতীয় সেনাদের তত্বাবধানে শুরু হওয়া এই প্রশিক্ষণের মান ছিল নেহাতই সাধারণ, মূলত হালকা অস্ত্র ও বিস্ফোরকের ব্যবহার। মে, মাসের শেষ সপ্তাহে শুরু হয় দুই হাজার ছাত্র যুবকের প্রথম দলের প্রশিক্ষণ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ ও মেঘালয়ের মাঝে ১০৮ টি সীমান্ত ফাঁড়ি বিদ্যমান ছিল। এ সময় গোটা সীমান্তজুড়ে সীমান্তরক্ষীদের টহল বাড়ানো হয়।
ঢাকা থেকে প্রায় ১৯২ কিঃমিঃ উত্তরে, ময়মনসিংহ মহকুমা পার হয়ে শেরপুর অঞ্চলের নালিতাবাড়ীর সীমান্তবর্তী গ্রাম নাকুগাঁও। মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরুতে মুক্তিকামী নিরস্ত্র মানুষ নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে সীমান্ত পাড়ি দিয়ে মেঘালয় পৌঁছুবার অন্যতম মুক্তাঞ্চল এই নাকুগাঁও-ডালু সংযোগ সড়ক। মেঘালয় রাজ্যের কোলে পশ্চিম গারো পাহাড়, যার কিছু সমতল আর পাহাড়ের ভাজে সুপারি বাগান, ছাড়া, ঝিরিপথে জড়ানো; বিধাতা তাঁর অকৃপণ মহিমার তুলিতে যেন চিত্রিত করেছেন-ভোগাই নদী বিধৌত মেঘালয়ের তুরা হতে ডালু, নাকুগাঁও অঞ্চলের প্রকৃতি যা ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের এর গৌরবময় ক্যানভাসে পরিণত হয়।
নালিতাবাড়ীর উত্তর প্রান্তে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের শুন্যরেখা সংলগ্ন যে গ্রাম নাকুগাঁও সহ হাতিপাগার, তন্তর, কালাকুমা মুক্তাঞ্চল হয়ে প্রতিদিন হাজার হাজার মুক্তিকামী শরনার্থী ডালু-নাকুগাঁও সড়ক হয়ে মেঘালয়ে প্রবেশ করতে থাকে। বৃহত্তর ময়মনসিংহ মহকুমার সকল শ্রেণি পেশার হিন্দু, মুসলিম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান, আদিবাসী সহ সকলেই এই মুক্তিকামী মানুষের মিছিলে ছিলো,উল্লেখ্য মেঘালয়-বাংলাদেশ সীমান্ত তখনো মুক্তিযুদ্ধের প্রভাবে উত্তপ্ত হয়নি।
৮, মে ১৯৭১। বাংলাদেশ সংলগ্ন ৫ টি ভারতীয় অঙ্গরাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীরা একযোগে দাবি করেন যে- ‘সীমান্ত অতিক্রম করে যে মুক্তিকামী শরণার্থীরা ভারতে এসেছে, অনতিবিলম্বে যাতে তাঁরা ঘরে ফিরে যেতে পারে সে অবস্থা সৃষ্টি করতে হবে’। পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, ত্রিপুরা, মেঘালয় ও বিহারের মূখ্যমন্ত্রীগণ কলকাতার মহাকরণে এক বৈঠকে মিলিত হয়ে এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। আসামীয় মুখ্যমন্ত্রী মহেন্দ্রমোহন চৌধুরী’র ভাষায় : ‘বাংলাদেশের মানুষের উপর আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তান মূলত ভারতের উপর একটি বড়, যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে যা ভারতকে সকল শক্তি দিয়ে মোকাবিলা করতে হবে।’
১৯৭১ সালে,বি.এস.এফ অপেক্ষাকৃত একটি নতুন সংস্থা ছিলো। বি.এস.এফের প্রথম মহাপরিচালক ছিলেন মিঃ কে.এফ.রুস্তমজি। বি.এস.এফ-এর অন্যতম প্রধান দায়িত্ব ছিল মুক্তিবাহিনীকে প্রশিক্ষিত করা। বি.এস.এফ বাংলাদেশের (তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান) অভ্যন্তরে গেরিলা আক্রমণ চালাতে এবং সাংগঠনিক দক্ষতা বৃদ্ধিতে মুক্তিবাহিনীকে সার্বিক সহায়তা করে আসছিল। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে সূচনালগ্ন থেকেই বি.এস.এফ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী, মুক্তিবাহিনীর সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে যুদ্ধ করে। সেনাবাহিনীর অপারেশনাল নিয়ন্ত্রণের অধীনে ২৩ টি বি.এস.এফ ইউনিট মোতায়েন করা হয়েছিল এবং তারা শত্রু অবস্থানের বিরুদ্ধে স্বাধীনভাবে, সেইসাথে সেনাবাহিনীর সাথে মিলিতভাবে প্রতিরক্ষামূলক এবং আক্রমণাত্মক উভয় পদক্ষেপে তাদের কৃতিত্ব জারি রেখেছিল।
১৯৭১ সালের ২৫ মে। ডালু (পশ্চিম গারো পাহাড়), এক বৃষ্টিস্নাত সকাল, ভোরের আলো তখনও ফোটেনি। ভোগাই নদীর পূর্ব পার্শ্বে তন্তর, কালাকুমা গ্রাম আর পশ্চিম পার্শ্বে হাতিপাগার-নাকুগাঁও। নালিতাবাড়ী হতে শিমুলতলা, নয়াবিল, হাতিপাগার, নাকুগাঁও গ্রাম হয়ে ভারতের ডালু শুন্যরেখা পর্যন্ত ভোগাই নদীর তীর ঘেঁষে সড়ক দূরত্ব ১৩.৪ কিঃ মিঃ যা ১৯৭১ সালে খুবই দুর্গম, নদীভাঙনের ফলে বেহাল ভগ্নদশা এবং দীর্ঘ সময়সাপেক্ষ ছিলো এই পথ পাড়ি দেওয়া।
সীমান্ত পাড়ি দেবার উদ্দেশ্য দেশের বিভিন্ন প্রান্তের মানুষ ভোররাত থেকেই ডালু-নাকুগাঁও এবারো থেবড়ো-কর্দমাক্ত এবং অপ্রশস্ত সড়ক পার হয়ে মেঘালয়ে প্রবেশ করছিল। নদীতে পানি ছিল সহনীয় স্রোত যেন কোমর পানি অথবা বুক পর্যন্ত পানি ভেঙে পারাপার হওয়া যায়। মেঘাচ্ছন্ন আকাশ, সাথে বৃষ্টি। আচমকা ভোর ৪:৩০ মিনিটের দিকে ১২০ মি.মি. মাঝারি মেশিনগানের গোলাবর্ষণে প্রকম্পিত হয়ে ওঠে চারপাশ। কেউ কিছু বুঝে উঠার আগেই চারদিকে ছোটাছুটি আর আর্তচিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে ওঠে, বাতাসে ছড়িয়ে পড়ে বারুদের গন্ধ। শুরু হয় নির্বিচারে মুক্তিকামী মানুষকে গণহত্যার এক নির্মম দৃশ্যের অবতারণা।
এর পূর্বে পাকিস্তানি হানাদাররা ২৪ তারিখ রাতে পানিহাটা সংলগ্ন মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে আতর্কিত আক্রমণ চালায় এবং ঘটনাস্থলে দুইজন বীর মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হন। এটা ছিল মূল লক্ষ্য আক্রমণ হতে মনযোগ বিচ্যুতির একটা কৌশল। পাকিস্তানী সৈন্যদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ, এলাকায় টহল এবং ভারতে শরনার্থীদের আগমন পরীক্ষা করার জন্য ডালু নাকুগাঁও চেকপোস্ট স্থাপন করা হয়েছিল। একটি অংশে বি.এস.এফ জওয়ানদের একটি ছোট দল পশ্চিম সেক্টরে পূর্ব পাকিস্তান (বাংলাদেশ)-ভারত সীমান্তের কিল্লাপাড়ায় অগ্রবর্তী সীমান্ত পর্যবেক্ষণ পোস্ট পরিচালনা করছিল। এর বাম দিকে ভোগাই নদী এবং একটি বাঁশ এবং কাশবনের খাঁজ পাকিস্তানি হানাদারবাহিনীকে প্রাকৃতিক আচ্ছাদনের সুবিধা প্রদান করে। কিল্লাপাড়া বি.এস.এফ পোস্টটি একটি ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে ছিল। এটি আন্তর্জাতিক সীমান্ত থেকে মাত্র ২০০ গজ এবং বি.এস.এফে’র প্রধান ডালু সীমান্ত ফাঁড়ি থেকে প্রায় ১ কিঃ মিঃ দূরে ছিল।
পাকিস্তান হানাদারদের লক্ষ্য ছিল ভারতের অভ্যন্তরের দিকে যুদ্ধ শুরু করার জন্য কৌশলগত ডালু-নাকুগাঁও-তুরা সড়কের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা এবং নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করা। এই আক্রমণ একজন নির্ভিক কোম্পানি কমান্ডার এবং বি.এস.এফে’র তৎকালীন সহকারী কমান্ড্যান্ট, মিঃ বালজিৎ সিং ত্যাগী’র নেতৃত্বে সাহসী বি.এস.এফ সৈন্যদের একটি ছোট দল দ্বারা দৃঢ়তার সাথে মোকাবিলা হয়। সেখানে মাত্র একটি সৈন্যদল ছিল, ভোর সাড়ে ৪ টায় প্রধানত ডালু সীমান্ত ফাঁড়ি ও কিল্লাপাড়ায় প্রথম হামলা শুরু হয়। পানিহাটার পথ হয়ে আসা পাকিস্তানি সৈন্যরা গাছ, বাঁশের খাঁজ এবং অসম জমির আড়ালে ১২০ মি.মি. মাঝারি মেশিনগান থেকে নিরলসভাবে গুলি চালাচ্ছিল। তারা দুইবার কিল্লাপাড়া ফাঁড়ি দখল করার অপচেষ্টা করেছিল কিন্তু প্রতিবারই সাহসী বি.এস.এফ জওয়ানরা তা প্রতিহত করেছিল।
দুই কোম্পানির (১৫০ জনেরও বেশি সৈন্য) নিয়ে পোস্টে তৃতীয় বড় আক্রমণ চালানোর জন্য শত্রুর প্রস্তুতি সম্পর্কে বিশ্বাসযোগ্য তথ্য পেয়ে কোম্পানি কমান্ডার মিঃ বালজিৎ সিং ত্যাগী অতিরিক্ত শক্তি নিয়ে পোস্টে পৌঁছান। তাঁর ভাষ্যমতে “আমরা অতিরিক্ত ফায়ার পাওয়ার দিয়ে আমাদের অবস্থানকে শক্তিশালী করেছিলাম এবং শত্রুরা ডালু এবং কিল্লাপাড়া উভয়েই আক্রমণ করতে শুরু করলে আমরা গুলি চালাই, “ডালুতে শক্তিশালী ৩ ইঞ্চি মর্টার এবং কিল্লাপাড়ায় হালকা মেশিনগান অগ্রসরমান পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর বর্ষন করা হয়।
সকাল ০৬:১৫ মিনিটে যুদ্ধটি আরও খারাপের দিকে মোড় নেয় যখন শত্রুর গোলাবর্ষণের দরুণ সামনের সারির টেলিফোন লাইনগুলি ভেঙে যায়। লাইনগুলি পুনরুদ্ধার করার প্রচেষ্টা প্রবল প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছিল, মিঃ বালজিৎ সিং ত্যাগী বলছিলেন “আমি যে জীপটি ব্যবহার করছিলাম সেটির টায়ারে একটানা গুলি লেগেছিল এবং আমি পায়ে হেঁটে বের হয়েছিলাম যখন একটি শেল এসে পড়ে, গাড়িটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস হয়ে যায়, সামনে পড়ে থাকা একটি বাইসাইকেল নিয়ে আমি অগ্রসর হই”।
সকাল ০৬:৪০ মিনিট নাগাদ, কিল্লাপাড়ায় চূড়ান্ত আক্রমণ শুরু হয়, যখন পাকিস্তানি সৈন্যরা সীমান্তের হাতিপাগার দিক থেকে অগ্রসর হতে শুরু করে; আক্রমণের তীব্রতা ক্রমশ বাড়তে থাকে। এরই মধ্যে, প্রায় ২০০ শত্রু সৈন্য কিল্লাপাড়ার দিকে অগ্রসর হয়, যার ফলে গুলি ফুরিয়ে যাওয়ায় হাতে-কলমে যুদ্ধ হয়।
এই মুহূর্তে শূন্যরেখায় হানাদাররা মুক্তিকামী শরণার্থীদের উপর ঝাপিয়ে পড়ে এবং নির্বিচারে হত্যা করতে শুরু করে। বি.এস.এফ-এর দখলে থাকা ৩ ইঞ্চি মর্টার ব্যবহারের কমান্ড স্ট্রাকচার ছিল শত্রুর মোকাবিলায় কিন্তু একটি স্থায়ী আদেশের অধীনে, ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরের পূর্বানুমতি ছাড়া মর্টার শেল নিক্ষেপ করা নিষেধ ছিল। রাইফেল থেকে গুলি চালানোর জন্য একাধিক অনুরোধ করা হলেও তা প্রত্যাখ্যান করা হয়েছিল,কারণ ভারত কোন রাষ্ট্রের সাথে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে নি তখনো। শত্রু সৈন্যদের অগ্রসর হওয়ার মুখেই মিঃ বালজিৎ সিং ত্যাগী ব্যক্তিগত ঝুঁকিতে আক্রমণকারী দলের উপর ৩ ইঞ্চি মর্টার শেল ছোঁড়ার নির্দেশ দিয়েছিলেন। মর্টার ফায়ার কিল্লাপাড়ায় লুকিয়ে থাকা বি.এস.এফ জওয়ানদের ক্ষণিকের কভার দেয়।
এক সময় পাকিস্তানি সেনারা কিল্লাপাড়ার বি.এস.এফ পোস্ট দখল করতে সক্ষম হয়, কিন্তু ২-৩ ঘণ্টার মধ্যে বি.এস.এফ মর্টার শেল নিক্ষেপ করে পাকিস্তানি সেনাদের বিরুদ্ধে পাল্টা প্রতিরোধ শুরু করে। ৮৩ ব্যাটালিয়ন বি.এস.এফ এর সহকারী কমান্ড্যান্ট মিঃ বালজিৎ সিং ত্যাগী মাত্র দুই সেকশন সর্বমোট ২৫/২৬ জন সৈনিক নিয়ে পাকিস্তানিদের দ্বারা দুটি ভয়ঙ্কর আক্রমণের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, পশ্চিম গারো পাহাড়ের কিল্লাপাড়ায় নয়জন বি.এস.এফ সৈনিক বীরত্বের সাথে লড়াই করতে গিয়ে শহীদ হন, এবং দুই অথবা পাঁচ জনকে যুদ্ধববন্দি করা হয়।
একটি ভাঙা রাইফেল যার নম্বর 4169Y, শত্রু বাহিনীর অপ্রতিরোধ্য উপস্থিতি সত্ত্বেও নয় জন জওয়ান দ্বারা বীরত্বপূর্ণ নিরস্ত্র লড়াইয়ের ঐ দিনের সাক্ষ্য বহন করে। বীর মুক্তিযোদ্ধা আশফাক এর নেতৃত্বে কয়েকজন গেরিলা মুক্তিযোদ্ধা কাছাকাছি অবস্থান থেকে দ্রুত ডালু-নাকুগাঁও আক্রমণের সংবাদ পেয়ে সম্মুখ রণাঙ্গনে প্রবেশ করে এবং বি.এস.এফ জওয়ানদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সম্মুখ যুদ্ধ করে শহীদ হন। পাকিস্তানি সৈন্যরা কিল্লাপাড়া ফাঁড়ি দখল করতে পারলেও তাদের বিজয় ছিল খুব অল্প সময়ের জন্য।
অবশেষে, মিঃ বালজিৎ সিং ত্যাগীর বীরত্বপূর্ণ কমান্ডের অধীনে, বি.এস.এফ উক্ত ফাঁড়ির নিয়ন্ত্রণ পুনরুদ্ধার করতে পারে। মিঃ বালজিৎ সিং ত্যাগী আরও বলেছিলেন “এমনকি আমরা তাদের মৃতদের টেনে নিয়ে যেতে দেখেছি, যা কয়েক ডজন ছিল”। তাদের বীরত্ব শত্রুদের কৌশলগত ডালু-নাকুগাঁও তুরা সড়কের নিয়ন্ত্রণ অপচেষ্টা রুখে দিয়েছিল।
সীমান্তরক্ষী বাহিনী বি.এস.এফ এর যে নয়জন সৈনিক বীরত্বের সাথে লড়াই করে শহীদ হন তারা হলেন হেড কন্সট্রেবল মন বাহাদুর রাই, নায়েক কল্যাণ সিং নেগি, কন্সট্রেবল খুলধর সাইকিয়া, মন বাহাদুর ছেত্রী, প্রমোদ চন্দ্র কলিতা, মণিভদ্র সিং, দেবেন্দ্র দত্ত বহুগুনা, পুরণ বাহাদুর চন্দ এবং খেম বাহাদুর চন্দন, যারা তাদের মাতৃভূমির ভূখণ্ড এবং সেই সাথে ডালু বাজার-নাকুগাঁও এলাকা এবং আশেপাশের এলাকায় আশ্রয় নেওয়া হাজার হাজার বাঙালির জীবন রক্ষায়। তাদের সর্বশ্রেষ্ঠ আত্মত্যাগ আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে চির অম্লান হয়ে থাকবে। মিঃ বালজিৎ সিং ত্যাগী সহ তাদের সকলকে বীরত্বের পদক দেওয়া হয়েছিল। পাকিস্তানি হানাদারদের বিরুদ্ধে মেঘালয়, শিলচর (দক্ষিণ আসাম) এবং ত্রিপুরা সেক্টরে ৮৪, ৮৫, ৮৬, ৮৭, ৯২, ৯৩, এবং ১০৪ ব্যাটালিয়নের নিয়মিত বি.এস.এফ জওয়ানরা অনুরূপ সাহসিকতায় যুদ্ধ করেছিল।
প্রায় ২০০ জনের অধিক বীর বাঙালি ডালু-নাকুগাঁও গণহত্যায় শহীদ হন। তাঁদের গুটি কয়েকজনকে সনাক্ত করা গেলেও বাকি সবাই অজ্ঞাত বীর শহীদ নামেই মহাকালের পাতায় বিলিন হয়ে যান। বেশিরভাগ শহীদের দেহ ভোগাই নদীর স্রোত প্রবাহে ভেসে যায়। ধারণা করা হয় ৫০/৬০ জন শহীদকে নাকুগাঁও শূন্যখার দক্ষিণ পার্শ্ব লাগোয়া নদী তীরবর্তী সমতল ভূমিতে গণকবরে সমাহিত করা হয়।
ডালু-কিল্লাপাড়া, নাকুগাঁও যুদ্ধ ও গণহত্যার কোন রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি মেলেনি আজও। দৃশ্যমান নেই গণকবর সংরক্ষণের কোন চিহ্ন-নামফলক অথবা শহীদ স্মরণে বেদি। একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের গৌরব আর স্বজন হারানোর ব্যাথার মিশেলে বিস্মৃতির অতল তলে হারিয়ে যাওয়া রক্তেভেজা ডালু-নাকুগাঁও এর মাটি। নাকুগাঁও গণহত্যায় বীর মুক্তিযোদ্ধা আশফাক, মোতালেব নালিতাবাড়ী উপজেলার নিরেন দাস, নিপেন দে, আশরাফ আলী, ফণীন্দ্র দাস, শেরপুর এর হরিয়া, ক্যাপ্টেন মাহফুজ, হোসেন সহ নাম না জানা দুই শতাধিক নিরস্ত্র নারী-শিশু সহ মুক্তি পাগল বাঙালি আত্মত্যাগ স্বীকার করেন। যাদের বুকের তাজা রক্ত আমাদের অর্জন করে দিয়েছে একটি স্বাধীন-সার্বভৌম ভূখন্ড, নতুন আত্মপরিচয়। মহাকালের স্বাক্ষর নিয়ে ভারত-বাংলা বিধৌত ডালু-নাকুগাঁও এর বুক চিড়ে প্রবাহমান ভোগাই নদী আজো বয়ে চলেছে বীর শহীদদের রক্তের ঋনভার।
তথ্যসূত্র:
- মুক্তিযুদ্ধে ভারত, আসাম ও মেঘালয় : তথ্য ও দলিল (সাহিত্য প্রকাশ )
- মূলধারা’৭১ (মঈদুল হাসান, ইউ.পি.এল )
- বিধানসভার কার্যবিবরণী (আসাম,মেঘালয় )
- ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকার,মে-২০১৯: মিঃ বালজিৎ সিং ত্যাগী।
- এম. এ. হাকাম হীরা, ৭১-নালিতাবাড়ী , ৭ ডিসেম্বর, ২০০৯ নালিতাবাড়ী মুক্ত দিবস উপলক্ষে প্রকাশিত কাগজ।
- সরেজমিনে ঘটনাস্থল পরিদর্শন।